ডেস্ক রিপোর্ট
প্রকাশ: ০২ অক্টোবর ২০২৩, ০৫:২২ পিএম
আপডেট: ০২ অক্টোবর ২০২৩, ০৭:২৯ পিএম
প্রকাশ: ০২ অক্টোবর ২০২৩, ০৫:২২ পিএম
ডেস্ক রিপোর্ট
আপডেট: ০২ অক্টোবর ২০২৩, ০৭:২৯ পিএম
দফায় দফায় সহিংসতা ছড়িয়ে পড়া ভারতে নতুন কিছু না। কিন্তু দেশটির মণিপুর রাজ্যে সাম্প্রতিক সময়ে ঘটে যাওয়া ভয়াবহতা গোটা দেশকে নাড়িয়ে দিয়েছে এবং পার্লামেন্টকে পর্যন্ত স্তম্ভিত করে দিয়েছে। জমিজমা, উপজাতীয় মর্যাদা, মাদক ব্যবসা ও অভিবাসন নিয়ে মেইতেই ও কুকি সম্প্রদায়ের মধ্যে একটি ভয়ংকর দ্বন্দ্বের কারণে মিয়ানমারের সীমান্তবর্তী ছোট রাজ্য মণিপুর গত মে মাসের গোড়া থেকে কেঁপে কেঁপে উঠেছে। এখন পর্যন্ত এ সমস্যার দ্রুত কোনো সমাধানও দেখা যাচ্ছে না।
এই হানাহানি অপমান, আঘাত
ও মৃত্যুর একটি ভয়ংকর পথ উন্মুক্ত করে গেছে। সেখানে নারীদের প্রকাশ্যে বস্ত্র হরণ করা
হয়েছে, তাদের সম্ভ্রম কেড়ে নিয়েছে প্রতিদ্বন্দ্বী গোষ্ঠীর মানুষেরা; এমনকি তাদের ধর্ষণ
ও হত্যা পর্যন্ত করা হয়েছে। এখন পর্যন্ত কেন্দ্রীয় সরকার ও বিরোধী দলগুলো রাজ্যটিতে
শান্তি পুনরুদ্ধারের ক্ষেত্রে যে অগ্রগতি করতে পেরেছে, তা খুবই নগণ্য।
মণিপুরের এই সংঘাত কিন্তু
রাতারাতি শুরু হয়নি। বর্তমানে যে পরিস্থিতি সেখানে চলছে, তার পেছনে অনেকগুলো জটিল কারণ
আছে। এর মধ্যে জনসংখ্যাগত ভারসাম্যহীনতার বিষয়টি সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ।
মেইতেইদের বক্তব্য হলো,
গোটা রাজ্যে যত লোক আছে, তার ৫৩ শতাংশই তাদের সম্প্রদায়ের; অথচ তারা রাজ্যের মাত্র
১০ শতাংশ জমির মালিক। অন্যদিকে কুকিরা মোট জনসংখ্যার মাত্র ১৬ শতাংশ হলেও তারা নাগা
সম্প্রদায়ের লোকদের সঙ্গে এক হয়ে রাজ্যের ৯০ ভাগ জমি ভোগ করে থাকে। কুকিদের নিয়ন্ত্রণে
যে ৯০ ভাগ জমি আছে, সেই জমির ৯০ শতাংশই অনুর্বর, পাথুরে ও পাহাড়ি। অন্যদিকে মেইতেইদের
দখলে থাকা জমিগুলো উর্বর এবং সমৃদ্ধভাবে তা চাষাবাদ করা হয়।
কুকি আর নাগাদের বেশির ভাগই খ্রিষ্টান। তাঁরা ভারতের জটিল এনটাইটেলমেন্ট ব্যবস্থার আওতায় উপজাতির মর্যাদা ভোগ করে থাকেন; যার অর্থ হলো অ-উপজাতিরা তাঁদের জমি কিনতে পারে না, এমনকি সেখানে বসতিও গড়তে পারে না। অন্যদিকে মেইতেইরা প্রধানত হিন্দু (অবশ্য তাঁদের মধ্যে কেউ কেউ খ্রিষ্টানও আছেন) এবং তাঁরা সে ধরনের কোনো সুবিধা ভোগ করতে পারেন না।
গত মার্চে মণিপুর হাইকোর্টের
একটি রায় উত্তেজনাকে আরও উস্কে দিয়েছে। আদালত রাজ্য সরকারকে তফসিলি উপজাতির মর্যাদা
দেওয়ার বিষয়ে ১০ বছরের পুরোনো সুপারিশ অনুসরণের নির্দেশ দিয়েছেন এবং এর পাশাপাশি মেইতেইদের
জন্য এ–সংক্রান্ত রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক সুবিধা সংরক্ষণের আদেশ দেন। এতে কুকিরা প্রতিবাদ
জানালে এর পাল্টা জবাব হিসেবে মেইতেই জনগোষ্ঠী কিছু মানুষ সহিংস হামলা শুরু করে।
পরিস্থিতি দ্রুত নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যায় ও রাজ্যজুড়ে দাঙ্গা ছড়িয়ে পড়ে। জুলাইয়ের শুরুতে দাঙ্গায় আনুমানিক ১২০ জন নিহত হন এবং ৭০ হাজার লোক বাস্তুচ্যুত হয়ে আশ্রয় শিবিরে ঠাঁই নেন।
কুকি গ্রুপগুলো এই সহিংসতাকে
উসকানি দেওয়া ও স্থায়ী করার জন্য মেইতেইদের দুটি চরমপন্থী গ্রুপকে দোষারোপ করে। তাদের
একটি হলো মেইতেই লিপান, অপরটি হলো আরামাবাই তেঙ্গল। দুটি গ্রুপের বিরুদ্ধেই আরও হামলার
উসকানি হিসেবে কুকি এবং অন্যান্য উপজাতীয় সম্প্রদায় সম্পর্কে ঘৃণাত্মক বক্তব্য ও গুজব
ছড়ানোর অভিযোগ রয়েছে।
এর ফলে সমস্যার জট আরও পাকিয়ে যায়। এদিকে, মিয়ানমার থেকে যেসব অভিবাসীরা এসেছিল, তাদের অধিকাংশই বার্মিজ চিন সম্প্রদায়ভুক্ত। এদের সঙ্গে স্থানীয় কুকিদের আত্মীয়তার সম্পর্ক আছে। তারা স্থানীয় জমিজমা ও সম্পদে ভাগ বসানোয় তা অ-কুকি সম্প্রদায়কে নিরাপত্তাহীনতায় ফেলে দিয়েছে।
এদিকে, কুকিরা অভিযোগ করেছে, মেইতেই নেতৃত্বাধীন সরকার যে ‘মাদকের বিরুদ্ধে যুদ্ধ’ ঘোষণা করেছে, তার মাধ্যমে মূলত তাদেরকে টার্গেট করা হচ্ছে। তাদের দাবি, তাদের সম্প্রদায়কে ভিটেছাড়া করার অজুহাত হিসেবে রাজ্য সরকার এই মাদকবিরোধী অভিযান চালাচ্ছে। তবে সম্প্রতি একজন উচ্চপদস্থ মণিপুরি পুলিশ কর্মকর্তা পদত্যাগ করে বলেছেন, রাজ্যটির মেইতেই গোষ্ঠীভুক্ত বিজেপি দলীয় মুখ্যমন্ত্রী এন বীরেন সিং ও তাঁর সরকার মাদক সম্রাটদের আশ্রয়-প্রশ্রয় দিচ্ছেন এবং মাদক–সংক্রান্ত তদন্তে হস্তক্ষেপ করে মাদক কারবারিদের ছেড়ে দিচ্ছেন।
এই গোলযোগের গোলকধাঁধার
আরেক কারণ হলো মেইতেইদের আদি উপজাতীয় সানামাহি ধর্ম ও আদি আদিবাসী সংস্কৃতির পুনরুজ্জীবনবাদী
আন্দোলন। অষ্টাদশ শতকে তখনকার মণিপুরি রাজা পামহিবা ও তাঁর প্রজারা সানামাহি থেকে খ্রিষ্টধর্মে
দীক্ষিত হয়েছিলেন। এর বাইরে মিশনারিদের প্রভাবে তাঁদের কেউ কেউ সাম্প্রতিক যুগে খ্রিষ্টধর্মে
দীক্ষিত হয়েছিলেন।
সানামাহি আন্দোলন চায়
মেইতেই সম্প্রদায় এই উভয় ‘নতুন’ ধর্মকে পরিত্যাগ করুক। এর কিছু সদস্য হিন্দু ও খ্রিষ্টান
উভয় সম্প্রদায়ের সম্পত্তির ওপর হামলার সঙ্গে জড়িত। সানামাহিদের কেউ কেউ তাঁদের ধর্মকে
তাদের স্বতন্ত্রতা জাহির করার ও বাইরের আধিপত্যকে রোধ করার উপায় হিসেবে দেখে থাকেন।
এদিকে, কংগ্রেস নেতা
রাহুল গান্ধী মণিপুরে সফর করলেও তবে সেখানে তিনি সরকার ও বিরোধী দলের বাধার মুখে পড়েন।
আর ভারতের নরেন্দ্র মোদি এ প্রসঙ্গে কোনো মন্তব্যই করছেন না। প্রতিদিনই সেখান থেকে
সহিংসতা ও হত্যার নতুন খবর আসছে। এ অবস্থায় রাষ্ট্রীয়ভাবে কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণ করাই
দ্বন্দ্ব মেটানোর একমাত্র উপায়।_প্রজেক্ট সিন্ডিকেট
[প্রজেক্ট সিন্ডিকেটে প্রকাশিত শশী থারুর-এর লেখা প্রবন্ধের সংক্ষেপিত অনুবাদ। শশী থারুর ভারতের কংগ্রেস পার্টির এমপি ও দেশটির সাবেক পররাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী এবং জাতিসংঘের সাবেক সহকারী মহাসচিব]
সাম্প্রতিক দেশকাল ইউটিউব চ্যানেল সাবস্ক্রাইব করুন
বিষয় : মণিপুর ভারত সংঘাতময় রাষ্ট্র শশী থারুর
© 2024 Shampratik Deshkal All Rights Reserved. Design & Developed By Root Soft Bangladesh