ক্ষুধার রাজ্যে আরও পতন ভারতের

ভারতে ক্ষমতাসীন উগ্র হিন্দুত্ব জাতীয়তাবাদী নরেন্দ্র মোদি সরকার দেশটিকে বিশ্বগুরু বানানোর স্বপ্ন দেখাচ্ছে; কিন্তু বিভিন্ন সূচকে দেখা যাচ্ছে এর উল্টো চিত্র। ভারতের জনগণের জীবনমান ক্রমশ নিচের দিকে নামছে। সম্প্রতি বিশ্ব ক্ষুধা সূচকে শ্রীলঙ্কা, নেপাল, বাংলাদেশ, পাকিস্তানের চেয়েও নিচে অবস্থান ভারতের। দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোর মধ্যে একমাত্র তালেবান শাসিত আফগানিস্তান রয়েছে ভারতের নিচে। অথচ এ প্রতিবেদনকে কথিত ষড়যন্ত্রের নাম দিচ্ছে মুসলিমবিদ্বেষ আর উগ্র জাতীয়তাবাদের ভর করা সরকার।

বিশ্ব ক্ষুধা সূচকের প্রতিবেদন যৌথভাবে তৈরি করে ‘কনসার্ন ওয়ার্ল্ডওয়াইড’ ও ‘ওয়েল্ট হাঙ্গার হিল্ফে’। প্রথম সংস্থাটির প্রতিষ্ঠা হয়েছিল ১৯৬৮ সালে আয়ারল্যান্ডে এবং দ্বিতীয়টি ১৯৬২ সালে তৎকালীন পশ্চিম জার্মানিতে প্রতিষ্ঠিত হয়। বিশ্বের বিভিন্ন প্রান্তে কত মানুষ অনাহারে দিন কাটাচ্ছেন, কোন দেশের কত মানুষ গুরুতর অপুষ্টিতে ভুগছেন ইত্যাদি তথ্যের ওপর ভিত্তি করে প্রতিবছরই প্রকাশিত হয় এই ক্ষুধা সূচক। ক্ষুধা সূচক প্রস্তুতির জন্য মূলত চারটি উপাদানের ওপর নজর দেওয়া হয়-অপুষ্টি, চাইল্ড ওয়াস্টিং (পাঁচ বছরের কম বয়সী শিশুদের উচ্চতার জন্য কম ওজন), চাইল্ড স্টান্টিং (পাঁচ বছরের কম বয়সী শিশুদের বয়সের অনুপাতে কম উচ্চতা) এবং শিশুমৃত্যু (পাঁচ বছরের কম বয়সী শিশুদের মৃত্যুর হার)। এখানে শিশু বলতে পাঁচ বছরের কম বয়সীদের কথা বলা হয়েছে। এই চার উপাদানের মধ্যে সবচেয়ে বেশি গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে অপুষ্টি এবং শিশুমৃত্যুর ওপর। ক্ষুধা সূচক প্রস্তুতির জন্য প্রথমে আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি সম্পন্ন সংস্থাগুলো থেকে প্রতিটি দেশের এই উপরে উল্লিখিত চারটি উপাদান বিষয়ে তথ্য সংগ্রহ করা হয়। ০ থেকে ১০০-এর মাপকাঠিতে প্রতিটি দেশকে পয়েন্ট দেওয়া হয় এবং সেই পয়েন্টের বিচারেই তালিকায় যথাস্থানে ঠাঁই হয় সংশ্লিষ্ট দেশের। এটিকে পাঁচ শ্রেণিতে ভাগ করা হয়। ১০-এর নিচে স্কোর মানে ‘ভালো’, ১০-২০-র মধ্যে স্কোর ‘মোটামুটি’, ২০-৩৫ স্কোর ‘গুরুতর’, ৩৫-৫০ স্কোরের অর্থ ‘উদ্বেগজনক’ এবং ৫০-এর ওপরে স্কোরের অর্থ ‘অত্যন্ত উদ্বেগজনক’।

গত অক্টোবরে প্রকাশিত ক্ষুধা সূচকের প্রতিবেদন অনুযায়ী, ভারতের অবস্থান ১২৫টি দেশের মধ্যে ১১১তম। ভারতের প্রতিবেশী দেশগুলোর মধ্যে চীনের অবস্থান শীর্ষ ২০টি দেশের মধ্যে রয়েছে। শ্রীলঙ্কা রয়েছে ৬০ নম্বরে। নেপাল, বাংলাদেশ এবং পাকিস্তান রয়েছে যথাক্রমে ৬৯, ৮১ ও ১০২তম স্থানে। ভারতের পেছনে রয়েছে যুদ্ধবিধ্বস্ত আফগানিস্তান, হাইতি, সোমালিয়া এবং দক্ষিণ সুদানের মতো আফ্রিকার ১২টি দেশ। প্রতিবেদন অনুসারে, ভারতের স্কোর ২৮.৭। ২০০০ সাল থেকে ২০১৫ সালের মধ্যে ভারত ক্ষুধা সূচকে উল্লেখযোগ্য অগ্রগতি ঘটিয়েছিল। ২০০০ সালে ভারতের স্কোর ছিল ৩৮.৪, যা ২০০৮ সালে কমে আসে ৩৫.৫-এ, ২০১৫ সালে ৬.৩ কমে স্কোর হয় ২৯.২। পরবর্তী আট বছরে উন্নতি হয়েছে মাত্র ০.৫! 

২০১৩ সালে বিশ্ব ক্ষুধা সূচকে ভারতের স্থান ছিল ৬৩। ২০২২ সালে তা নেমে এসেছে ১০৭ নম্বরে। ২০২১ সালে বিশ্ব ক্ষুধা সূচকে ভারতের স্থান ছিল ১০১। ২০২০ সালে ছিল ৯৪। ২০১৪ সাল থেকে ক্ষমতায় রয়েছে বিজেপি নেতৃত্বাধীন সরকার। তবে ক্ষুধা সূচকে ভারতের এই ‘অধঃপতন’ কোনোভাবেই মেনে নেয়নি ভারত সরকার। কেন্দ্রীয় মহিলা ও শিশুকল্যাণ মন্ত্রণালয় এক বিবৃতিতে জানায়, ‘সূচকটিতে গুরুতর পদ্ধতিগত সমস্যা রয়েছে। স্পষ্টতই কিছু ভুল পরিমাপ হয়েছে।’ মোদি সরকারের দাবি, এই ধরনের সমীক্ষায় যে পদ্ধতি (মেথডোলজি) ব্যবহার করা হয় তা ভারতের মতো বিরাট বৈচিত্র্যপূর্ণ দেশের ক্ষুধা পরিমাপের ক্ষেত্রে অবৈজ্ঞানিক। সূচক গণনার জন্য ব্যবহৃত চারটি নির্দেশকের মধ্যে তিনটিই শিশু স্বাস্থ্যের সঙ্গে সম্পর্কিত। এটি দেশের সমগ্র জনসংখ্যার মাপকাঠি হতে পারে না। পাশাপাশি চতুর্থ এবং সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ নির্দেশক বয়স অনুযায়ী উচ্চতা এবং ওজনের মধ্যে ভারসাম্য না থাকা অপুষ্টিতে ভোগা শিশুর হার Proportion of Undernourished (PoU) population- এর হিসাব করা হয়েছে মাত্র তিন হাজার জনের নমুনার সমীক্ষার ওপর ভিত্তি করে। আরও বেশি শিশুর মধ্যে এই যৌথ সমীক্ষাটি চালানো উচিত ছিল বলে মনে করছে মোদি সরকার। প্রসঙ্গত বিশ্বের বিভিন্ন দেশে ক্ষুধা পরিমাপের জন্য জাতিসংঘের ‘ফুড অ্যান্ড এগ্রিকালচার অর্গানাইজেশন’ বা এফএওর পদ্ধতি ব্যবহার করা হয়; যে পদ্ধতিকে অবৈজ্ঞানিক বলে দাবি করেছে ভারত সরকার।

এ প্রতিবেদন নিঃসন্দেহে দেশটির মানুষের ক্ষুধা নিয়ে উদ্বেগের বিষয়। প্রতিবেদন অনুসারে, ভারতে প্রায় ২২ কোটি ৪৩ লাখ বা ১৬.৬ শতাংশ মানুষ অপুষ্টির শিকার। পৃথিবীতে এই সংখ্যা প্রায় ৮৩ কোটির কাছে। ১৫ থেকে ২৪ বছরের নারীদের মধ্যে রক্ত স্বল্পতার হার ৫৮.১। এ ছাড়াও প্রতিবেদনে উঠে এসেছে আরও এক উদ্বেগের বিষয়। বলা হচ্ছে, শিশুদের দৈর্ঘ্য ও ওজনের অনুপাতিক ভারসাম্যের বিচারেও ভারত পিছিয়ে। ভারতে ১৮.৭ শতাংশ শিশুর ক্ষেত্রে এমনটা দেখা গেছে। ভারত সরকার বলছে, দেশটির ‘পোশন ট্র্যাকার’ প্রতি মাসে জানান দিচ্ছে, শিশুদের দৈর্ঘ্যরে সঙ্গে ওজনের আনুপাতিক হারের ফারাকের যে সমস্যা, তা কমছে। গ্লোবাল হাঙ্গার ইনডেক্স বলছে, ১৮.৭ শতাংশ, আর ভারতের পোশান ট্র্যাকার দেখাচ্ছে ৭.২ শতাংশ। ভারত বলছে, প্রধানমন্ত্রী গরিব কল্যাণ অন্ন যোজনার হাত ধরে ১১১৮ লাখ টনের খাদ্য সামগ্রী বণ্টন করা হয়েছে। ২৮ মাসের এই স্কিমে অন্তত ৮০ কোটি মানুষ সুবিধা পাচ্ছে। এ ছাড়াও পোশন ২.০, মিশন সক্ষমের মতো স্কিমকেও সামনে আনছে দিল্লি।

বিশ্ব ক্ষুধা সূচক প্রকাশ্যে আসার পর সুর চড়িয়েছে বিরোধী শিবির। এ ব্যাপারে বিজেপিকে নিশানা করেছে তারা। মোদি সরকারের আমলে অবস্থা খারাপ থেকে খারাপতর হয়েছে। মানুষের জীবনধারায় যে ব্যাপক অবনতি হয়েছে, বিশ্ব ক্ষুধা সূচকের প্রতিবেদনে তা স্পষ্ট হলো বলে অভিযোগ তাদের। তারা প্রশ্ন তুলছেন, অনেকেই বিশ্বাস করেন ‘আচ্ছে দিন আয়েগা’। প্রশ্ন হলো সেই দিন কবে আসবে?

ভারতের প্রথম সারির প্রায় সব সংবাদমাধ্যম সযতেœ এড়িয়ে গেছে এই প্রতিবেদন সংক্রান্ত সব খবর। দুয়েকটা মিডিয়ায় তা স্থান পেলেও তা প্রকাশের ক্ষেত্রে গুরুত্ব দেওয়া হয়নি। পত্রিকায় খবর প্রকাশে যা নিউজপ্রিন্ট খরচ হয়েছে, তার চেয়ে বেশি নিউজপ্রিন্ট খরচ করা হয়েছে এই প্রতিবেদনকে মিথ্যা, বিদেশি চক্রান্ত প্রমাণে। প্রসঙ্গত প্রেস ফ্রিডম সূচকে ১৮০টি দেশের মধ্যে ১৬১তম স্থানে রয়েছে ভারত। বিশ্লেষকরা বলছেন, প্রতিদিন দেশের মানুষের সামনে আলগা হয়ে যাচ্ছে মিথ্যার মুখোশ। সাধারণ মানুষকে দেশপ্রেমের নামে উগ্রবাদের মাদকে আচ্ছন্ন রেখে দেশের সম্পত্তি কয়েকটি করপোরেট গোষ্ঠীর হাতে তুলে দেওয়ার চেষ্টা প্রতিদিন স্পষ্ট থেকে স্পষ্টতর হচ্ছে। ভারতের অর্থনীতি নিচের দিকে যাচ্ছে প্রতিনিয়ত। পর্দার আস্তরণে ঢেকে ফেলার চেষ্টা হলেও এক ধাক্কায় দেশের নাজুক স্বাস্থ্যব্যবস্থাকে চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিয়েছে কোভিড-১৯। জাঁকজমকপূর্ণ জি-২০ অধিবেশনের আয়োজন বা ২০৩৬ সালে অলিম্পিক গেমস আয়োজনের পরিকল্পনা, সব কিছুতেই বিপর্যস্ত অর্থনৈতিক অবস্থাকে আড়াল করার চেষ্টা। এ ক্ষুধা দমন করার ক্ষমতা আজকের ভারতের নেই। ক্ষুধার্ত ভারত যেন নির্মম বাস্তবতারই সাক্ষী।

সাম্প্রতিক দেশকাল ইউটিউব চ্যানেল সাবস্ক্রাইব করুন

মন্তব্য করুন

Epaper

সাপ্তাহিক সাম্প্রতিক দেশকাল ই-পেপার পড়তে ক্লিক করুন

Logo

ঠিকানা: ১০/২২ ইকবাল রোড, ব্লক এ, মোহাম্মদপুর, ঢাকা-১২০৭

© 2024 Shampratik Deshkal All Rights Reserved. Design & Developed By Root Soft Bangladesh

// //