কোন পথে রাজস্থান নির্বাচন

আগামী বছর ভারতে অনুষ্ঠিত হতে যাচ্ছে সাধারণ নির্বাচন। এর আগে পাঁচ রাজ্যের বিধানসভা নির্বাচন ভিন্নমাত্রা যোগ করেছে। মধ্যপ্রদেশ, ছত্তিশগড়, তেলেঙ্গানা বা মিজোরামে বিজেপির অবস্থা অনেকটাই বেগতিক। সেখানে তারা জিততে পারে, এটা বিজেপি নেতারাও হয়তো বিশ্বাস করেন না। মিজোরামের নির্বাচনে পার্শ্ববর্তী রাজ্য মণিপুরের প্রভাব পড়বে নিশ্চিতভাবেই। সেখানে দুয়েকটি আসন জেতাও তাদের জন্য মুশকিল হবে বলে মনে করছেন বিশেষজ্ঞরা। তেলেঙ্গানায় ৭-৮ তার বেশি আসনের স্বপ্নও দেখছে না বিজেপি। ছত্তিশগড় বা মধ্যপ্রদেশে কংগ্রেসের পাল্লাই ভারী। 

কিন্তু রাজস্থানে কংগ্রেস-বিজেপি লড়াই সমানে হওয়ার কথা। তবে এখানেও কংগ্রেস কিছুটা এগিয়ে থাকছে। গোটা রাজ্যে একসঙ্গে নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়। এতে নিযুক্ত ছিলেন এক লাখের বেশি নিরাপত্তাকর্মী। ৩ ডিসেম্বর ভোট গণনা ও ফল ঘোষণা হবে।

কংগ্রেসের রাজস্থানের মুখ্যমন্ত্রী অশোক গেহলট ঘরে ঘরে গিয়ে ভোট চাওয়ার নীতির জন্য পরিচিত। তিনি দ্বিতীয় মেয়াদে ক্ষমতায় থাকতে চাইছেন। অপরদিকে বিজেপি সংখ্যাগরিষ্ঠতা পাওয়ার জন্য প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির জনপ্রিয়তার ওপর নির্ভর করছে। এখানে কিছু তথ্য রাজস্থানের রাজনীতি ও এই নির্বাচনকে বোঝার জন্য গুরুত্বপূর্ণ। রাজস্থানের ২০০ আসনের মধ্যে ১৯৯টির জন্য ভোটগ্রহণ হয় গত ২৫ নভেম্বর। কংগ্রেস প্রার্থী ও বিধায়ক গুরমিত সিং কুনারের মৃত্যুর কারণে শ্রীগঙ্গানগরের করনপুর আসনের নির্বাচন স্থগিত করা হয়। ২০১৮ সালের নির্বাচনে কংগ্রেস ১০০টি ও বিজেপি ৭৩টি আসনে জয় পায়। ২০১৩ সালে বিজেপি ১৬৩ আসনে জিতে নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা পেয়েছিল।

এবারের নির্বাচনে এক হাজার ৮৬২ জন প্রার্থী প্রতিদ্বন্দ্বিতা করছেন এবং মোট ভোটার সংখ্যা ৫ কোটি ২৫ লাখ। এর মধ্যে ১ কোটি ৭১ লাখ ভোটার ১৮ থেকে ৩০ বছরের মধ্যে এবং ২২ লাখ ৬১ হাজার নতুন ভোটার ১৮-১৯ বছর বয়সী। এই তরুণ প্রজন্মই ভোটের নির্ধারক শক্তি বলে মনে করা হচ্ছে। 

কংগ্রেস আশা করছে যে ‘জাদুকর’ নামে পরিচিত গেহলটের জাদু, তার কল্যাণমূলক কার্যক্রম কংগ্রেসকে পুনরায় নির্বাচিত করবে। তবে রাজস্থানের ভোটাররা ১৯৯৩ সাল থেকে কোনো সরকারকে দ্বিতীয় মেয়াদে ক্ষমতায় থাকতে দেয়নি এবং এ রাজ্যে বিজেপির ফিরতে মোদির জনপ্রিয়তার পাশাপাশি এ বিষয়টিও নির্ভর করছে। কিন্তু রাজস্থানে দলের সবচেয়ে জনপ্রিয় নেত্রী এবং সাবেক মুখ্যমন্ত্রী বসুন্ধরা রাজে সিন্ধিয়াকে মুখ্যমন্ত্রী পদের দাবিদার হিসেবে বিজেপি ঘোষণা করেনি। এটি দলের ভেতরকার কোন্দলের বহিঃপ্রকাশ বলে মনে করা হচ্ছে।

নারী নির্যাতন বেড়ে যাওয়া, দুর্নীতি এবং আর্থিক কেলেঙ্কারির মতো ইস্যুতে কংগ্রেসকে আক্রমণ করছে বিজেপি। বিজেপি আশা করছে যে গেহলট এবং তার সাবেক সহযোগী শচীন পাইলটের মধ্যকার দ্বন্দ্ব তার পক্ষে কাজ করবে। ২০২০ সালে এ দ্বন্দ্ব প্রকাশ্যে আসে। এ বছরের শুরুতে তা বড় আকার ধারণ করে। তবে ভোটের কয়েক সপ্তাহ আগে মুখ্যমন্ত্রী ও পাইলট দুজনই এ দ্বন্দ্ব হ্রাস করেছেন। পাইলট কংগ্রেস প্রার্থীদের ভোট দেওয়ার জন্য একটি ভিডিও প্রকাশ করেন, যা গেহলট সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে শেয়ার করেন। এটি কংগ্রেসের মধ্যে ঐক্যের চিহ্ন নির্দেশ করে।

বিশ্লেষকদের মতে, বিজেপির তিনটি নির্বাচনী মডেল আছে- প্রথম মডেল অনায়াসে জিতে যাবে এমন রাজ্যগুলোর জন্য। দ্বিতীয় মডেল হাড্ডাহাড্ডি লড়াই হবে এমন রাজ্যের জন্য। তৃতীয় মডেল হলো যেসব রাজ্যে বিজেপির জেতা অসম্ভব, সেগুলোর জন্য। প্রথম মডেল খুব পরিষ্কার, দলের পুরনো মুখদের বাতিল করে দাও, মোদি-শাহের অনুগত দল তৈরি কর আর তীব্র সাম্প্রদায়িক বিষ ছড়াও। এসব রাজ্যে তারা কোনো মুসলমান প্রার্থীকে দাঁড় করান না। দ্বিতীয় মডেলের ফর্মুলা হলো- শাসক দল থেকে নেতা ভাঙাও, শাসক দলকে মুসলিম তোষণকারী আর হিন্দুবিরোধী স্ট্যাম্প দাও এবং ইডি, সিবিআই দিয়ে নাজেহাল করে দাও সরকারকে। তিন নম্বর ফর্মুলা হলো- নেতারা গিয়ে হিন্দু-মুসলিম মেরুকরণের জন্য বিষ ছড়াবেন; কিন্তু তার সঙ্গেই নির্বাচনের পরের হিসাব, কোন দলের সঙ্গে জোট করা যায়, কীভাবে গোটা পাঁচেক আসন নিয়েও সমর্থন দিয়ে একটা সরকার বানানো যায়, আঞ্চলিক দলের একজন মুখ্যমন্ত্রীকে সামনে রেখে এক সরকারের শরিক হওয়া যায়, যে মুখ্যমন্ত্রীকে পাঁচ বছরের জন্য ঢালাও অনিয়ম করার সুযোগ দেওয়া হবে, প্রতিটা ঘটনার ওপর নজর রাখা হবে এবং পাঁচ বছর শেষে সেই দলের নেতাদের ইডি, সিবিআইয়ের মতো দুর্নীতিবিরোধী সংস্থার ভয় দেখিয়ে নিজের ভেতর ঢুকতে বাধ্য করা, না হয় কারাগারে নিক্ষেপ করা হবে। এই পাঁচ বছরের মধ্যেই বেশ কিছুটা সংগঠন বাড়িয়ে নেওয়া যাবে। 

এই তিন মডেলের মিশ্রণই হলো বিজেপির নির্বাচন জেতার জাতীয় মডেল। রাজস্থান নিয়ে মোদি-শাহ এতটাই নিশ্চিত ছিলেন যে, এই রাজ্যে তাদের দলের একমাত্র সর্বগ্রাহ্য মুখ বসুন্ধরাকে জনসভায় না ডেকে, সাংবাদিকদের সামনে অপমান করে মনে করছিলেন বসুন্ধরা ফুরিয়ে যাওয়া শক্তি, তিনি আর কী করবেন। তবে দিন যত গেছে, তত বোঝা গেছে, রাজস্থানের লড়াই হাড্ডাহাড্ডি হতে চলেছে। শুরুর দিকে পোস্টারে সহাস্য মোদির ছবিই শুধু শোভা পেত। কিন্তু ভোটের সপ্তাহ দুয়েক আগে থেকে সেখানে চারজনের মুখ, এর মধ্যে বসুন্ধরাও একজন। 

এদিকে রাজস্থানে মাত্র ১০ শতাংশের মতো মুসলিম আছে, কিছু আসনে তারা নির্ণায়কও। দুটি ঘটনা রাজস্থানে ক্ষমতা ও মুসলিম বিদ্বেষের বাস্তবতা বুঝতে তাৎপর্যপূর্ণ। গত বছর দিল্লিতে বিজেপি নেত্রী নুপূর শর্মা হজরত মোহাম্মদ (স.)-কে নিয়ে বাজে মন্তব্য করেন। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ছড়ায় যে, কানহাইয়া লাল নামে উদয়পুরের এক দরজি নাকি সেই বক্তব্যকে সমর্থন করেছিলেন। এতে ক্ষুব্ধ হয়ে দুই মুসলিম যুবক তাকে ছুরিকাঘাতে হত্যা করে। এটি ২০২২ সালের ২৮ জুনের কথা। সেদিনই দুই যুবক গ্রেপ্তার হয়। এখনো তারা কারাবন্দি। রাজ্য সরকার কানহাইয়ালালের পরিবারকে ৫০ লাখ রুপি ক্ষতিপূরণ এবং দুই সন্তানকেই চাকরি দিয়েছে। কানহাইয়ালাল এবারের নির্বাচনে সর্বত্র বিজেপির হাতিয়ার। রাজস্থানে এর ওপর ভর করে চলছে মুসলিমবিদ্বেষী প্রচারণা। 

দ্বিতীয় ঘটনাটি দুই ভাই নাসির আর জুনায়েদের। তারা হরিয়ানা থেকে বাড়ি ফিরছিল, রাস্তায় গরু পাচারকারী বলে তাদের দুজনকে পিটিয়ে মারা হয়। অভিযুক্ত মানু মানেসর অনেক পরে ধরা পড়ে। একটা একটা করে মামলায় জামিন পাচ্ছে। নাসির-জুনায়েদ হত্যা মামলায়ও পেয়ে যাবে এই বজরং দলের নেতা। তবে কানহাইয়ালালের মতো নাসির-জুনায়েদের পরিবার কোনো ক্ষতিপূরণ পায়নি। এটাই রাজস্থানের বর্তমান রাজনীতি। মুসলিম বিদ্বেষের বিষ রাজ্যের বিভিন্ন অঙ্গে ছড়িয়ে পড়েছে। তবে নির্বাচনের রাজনীতিতে বিজেপি নিরঙ্কুশ থাকতে পারছে না। কারণ হিসাবটা খুব জটিল।

রাজস্থানে জাত-পাতের বিভক্তি নতুন নয়, রাজপুতদের সঙ্গে গুজ্জরদের, গুজ্জরদের সঙ্গে মিনাদের, বিভিন্ন গোষ্ঠীর লড়াই সর্বত্র। আর রয়েছে স্থানীয় পর্যায়ে গ্রামপ্রধানদের রাজত্ব। তারা গ্রামে এক সমান্তরাল শাসন-বিচারব্যবস্থা পরিচালনা করে। গুজ্জররা গতবার উজাড় করে ভোট দিয়েছিল কংগ্রেসকে। কারণ তারা মনে করেছিল, তাদের একজন জাঠ নেতা শচীন পাইলট মুখ্যমন্ত্রী হবেন। সাড়ে চার বছর লড়াই করে ভোটের আগে পাইলট, গেহেলট সমঝোতা হয়েছে বটে; কিন্তু গুজ্জররা কংগ্রেসকে নিরঙ্কুশ সমর্থন দেবে কিনা তা নিয়ে প্রশ্ন আছে। আবার পাইলটকে মুখ্যমন্ত্রী হিসেবে রেখে কংগ্রেস ভোটে নামলে রাজপুতরা মুখ ফিরিয়ে নিত। কারণ গেহেলট রাজপুত। তাই অবস্থা বুঝে বিজেপির বিভিন্ন নির্বাচনী মডেলের প্রয়োগ চলেছে রাজস্থানে। তবে শেষ পর্যন্ত জটিল সমীকরণে কংগ্রেস-বিজেপি উভয়ের জন্যই নিরঙ্কুশ জয় নিশ্চিত করাটা কষ্টকর। তবে কংগ্রেস হয়তো এবারও শতাধিক আসনে জয় পেতে পারে বলে মনে করছেন বিশ্লেষকরা।

সাম্প্রতিক দেশকাল ইউটিউব চ্যানেল সাবস্ক্রাইব করুন

মন্তব্য করুন

Epaper

সাপ্তাহিক সাম্প্রতিক দেশকাল ই-পেপার পড়তে ক্লিক করুন

Logo

ঠিকানা: ১০/২২ ইকবাল রোড, ব্লক এ, মোহাম্মদপুর, ঢাকা-১২০৭

© 2024 Shampratik Deshkal All Rights Reserved. Design & Developed By Root Soft Bangladesh

// //