পাকিস্তানের খাইবার পাখতুনখোয়া রাজ্যের ‘দারা আদম খেল’ গ্রামটি সে দেশের আর পাঁচটি সাধারণ গ্রামের মতো নয়-শুধু পাকিস্তান কেন, ব্যতিক্রমতার নিক্তিতে বিশ্বব্রহ্মাণ্ডেই এর তুলনা পাওয়া দুষ্কর। খাইবার পাখতুনখোয়া প্রদেশে আফ্রিদি ও পাখতুন সম্প্রদায়ের মানুষের বসবাস।
দারা আদম খেল গ্রামটি পাহাড়ি। অবৈধ অস্ত্র তৈরি ও বিক্রি এই গ্রামের বাসিন্দাদের মূল পেশা ও নেশা। অস্ত্রের ঝংকারে মুখরিত থাকলেও গ্রামটি বেশ শান্ত-যুদ্ধের ময়দান থেকে দূরে। গ্রামের মূল রাস্তার ধারে সারি সারি দাঁড়িয়ে আছে অস্ত্রের দোকান। সেখানে খুব অল্প দামেই মেলে অটোমেটিক পিস্তল, রিভলবার, শটগান এবং অত্যাধুনিক কালাশনিকভ রাইফেল। এ অস্ত্রগুলো ছাড়াও আধুনিক যে কোনো অস্ত্রের কপি তৈরি এখানকার কারিগরদের কাছে একেবারেই সহজ ব্যাপার। মাত্র ৩০ হাজার পাকিস্তানি রুপির বিনিময়ে মার্কিন সৈন্যদের হাতে সজ্জিত থাকা এম-১৬ রাইফেলের একটি কপি রাইফেল পাওয়া সম্ভব এ গ্রামে। সেমি-অটোমেটিক একে-৭৪ রাইফেলটি একে-৪৭ থেকে আরেকটু আধুনিক, এই গ্রামের অস্ত্রের বাজারে ক্রেতাদের পছন্দের শীর্ষে রয়েছে এটি। মাত্র ১০ হাজার পাকিস্তানি রুপির বিনিময়ে বিক্রি হয় রাইফেলটি। দারা আদম খেলের মতো অবৈধভাবে অস্ত্র তৈরি ও বিক্রির এত বড় বাজার পাকিস্তানে আর একটিও নেই। এখানকার কারিগররা অস্ত্র তৈরির লক্ষ্যে দেশের নানা প্রান্ত থেকে বিভিন্ন আকারের ধাতুর টুকরো সংগ্রহ করেন। এগুলো প্রক্রিয়াজাত করে বিভিন্ন কারখানায় আগ্নেয়াস্ত্র তৈরি করা হয়। হাতে চালিত নিতান্ত সাধারণ যন্ত্র দিয়েই অস্ত্র তৈরির পুরো প্রক্রিয়াটি সম্পন্ন করা হয়।
দারা আদম খেলের দুই-তৃতীয়াংশ মানুষ অস্ত্র তৈরির ব্যবসার সঙ্গে সরাসরি জড়িত। বংশ পরম্পরায় ব্যবসাটি পরিচালিত হয়ে আসছে। এক শতাব্দীরও বেশি সময় ধরে গ্রামটিতে অস্ত্র তৈরি হয়ে আসছে। বর্তমানে দুই হাজারেরও অধিক কারিগর রয়েছেন এখানে। তাদের তৈরি অস্ত্রের বড় চালানই পাকিস্তানের বাইরে চলে যায়। প্রতিবেশী দেশগুলোর সশস্ত্র সংগঠনগুলোই এ অস্ত্রের প্রধান ক্রেতা। দারা আদম খেলের কারিগররা অস্ত্র তৈরিতে এতটাই দক্ষ যে ‘বিমানবিধ্বংসী অস্ত্র’ থেকে শুরু করে লুকিয়ে রাখার উপযোগী ‘পেন গান’ও তারা তৈরি করে দিতে পারেন। দারা আদম খেলে তৈরি কপি অস্ত্রের সঙ্গে আসল অস্ত্রের পার্থক্য খুঁজে পাওয়া দুঃসাধ্য। আসল অস্ত্র থেকে কর্মক্ষমতায় কোনো অংশেই কম নয় দারা আদম খেলে তৈরি অস্ত্র।
দারা আদম খেলে ঠিক কবে থেকে অস্ত্র তৈরির সংস্কৃতি শুরু হয় তার সুনির্দিষ্ট তথ্য পাওয়া যায় না। কিংবদন্তি রয়েছে, ‘১৮৫৭ সালের কোনো এক সময় ব্রিটিশ সেনাবাহিনী থেকে দারা আদম খেল গ্রামে পালিয়ে আসা এক সৈনিকের হাত ধরেই অস্ত্র কারখানার সূত্রপাত। এই সেনাসদস্যের কাছ থেকে সেখানকার অধিবাসীরা অল্প দিনেই অস্ত্র বানানোর কলাকৌশল শিখে নেন। আর অল্প দিনেই দারা আদম খেল পরিণত হয় সে দেশের অবৈধ অস্ত্র নির্মাণ ও বিক্রির সবচেয়ে বড় বাজারে। ১৯৭৯ সালে তৎকালীন সোভিয়েত ইউনিয়ন কর্তৃক আফগানিস্তানে সেনা অভিযান শুরু হলে আফগানদের মধ্যে অস্ত্রের চাহিদা বেড়ে যায়। আর তখন এই গ্রাম হয়ে উঠল স্বল্পমূল্যে উন্নত আগ্নেয়াস্ত্র ক্রয়ের সবচেয়ে বড় উৎস। সেই থেকে দারা আদম খেলের অস্ত্রের চাহিদা বাজারে বেড়েছে বৈ কমেনি। আজও পাকিস্তান ও আফগানিস্তানের বিভিন্ন সশস্ত্র সংগঠনের অস্ত্রের জোগানের অন্যতম ভিত্তি এই গ্রামটি। বছরের পর বছর এই অস্ত্র ব্যবসা চলছে দারা আদম খেলে। রাষ্ট্র কর্তৃক কোনো বৈধতা নেই অস্ত্র উৎপাদনের। তবু নির্বিঘ্নে চলছে ভয়ঙ্কর সব মারণাস্ত্রের ব্যাপক উৎপাদন, ক্রয়ের ক্ষেত্রেও কোনো বাধা নেই। পাকিস্তানের প্রশাসন নির্বিকার, দেখেও না দেখার ভান করে চলছে।
সাম্প্রতিক দেশকাল ইউটিউব চ্যানেল সাবস্ক্রাইব করুন
© 2024 Shampratik Deshkal All Rights Reserved. Design & Developed By Root Soft Bangladesh