দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার ধনী নগররাষ্ট্র সিঙ্গাপুর। এক সময়ের ব্রিটিশ উপনিবেশের বাণিজ্যিক স্থান হিসেবে ব্যবহৃত দেশটি বর্তমানে বৈশ্বিক অর্থনৈতিক ‘হাব’-এ পরিণত হয়েছে। তবে সিঙ্গাপুরে ব্যক্তি পর্যায়ে অর্থনৈতিক অস্বস্তি বাড়ছে। সিঙ্গাপুরের সরকারি তথ্যানুসারে, বছরের প্রথম ছয় মাসে (জানুয়ারি-জুন) সেখানে ২ হাজার ৩৩৪ জন দেউলিয়াত্বের আবেদন করেছেন, যা ২০২৩ সালের একই সময়ের তুলনায় ২৫ শতাংশ বেশি। এ সময় সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ ৫৯৪ জনকে দেউলিয়া ঘোষণা করেছে, যা আগের বছরের তুলনায় ১১ শতাংশ বেশি।
ধনী এই দেশটির অর্থনীতি বিদেশি শ্রমিকদের ওপর অনেকটাই নির্ভরশীল। ২০৩০ সালের মধ্যে দেশটির বিদেশি বাসিন্দাদের সংখ্যা মূল জনগোষ্ঠীর অর্ধেক হবে, এমন ধারণা আগেই করেছিল সিঙ্গাপুর সরকার। জীবনযাত্রার খরচ ক্রমাগত বাড়ছে বলে সাধারণ মানুষকে যে কোনো কাজের জন্য নির্ভরশীল হতে হচ্ছে ঋণের ওপর। কার্যত সেখানে যে কোনো কাজের সঙ্গে ঋণ অপরিহার্য। আর তা শোধ করতে না পারলে দেউলিয়া ঘোষণা করা ছাড়া কোনো গতি থাকে না। এসব ক্ষেত্রে আবেদনকারীকে পেশাগত জীবনে ব্যর্থ বা অমিতব্যয়ী হিসেবে দেখা হয়। তারা চাকরি হারাতে পারেন বা গুরুত্বপূর্ণ কোনো কাজে নিয়োগ পান না। এ ক্ষেত্রে দেউলিয়াত্ব অর্থনৈতিকভাবে শেষ অবলম্বন হিসেবে বিবেচিত হয়, যা সামগ্রিকভাবে দেনাদারের মানসিক ও অর্থনৈতিক চাপ থেকে বাঁচাতে পারে।
সিঙ্গাপুরে ঋণগ্রহীতা নিজে বা পাওনাদার উচ্চ আদালতে যেতে পারেন। অন্তত ১৫ হাজার ডলার অপরিশোধিত ঋণের ক্ষেত্রে ঋণগ্রহীতা আইন মন্ত্রণালয়ে ডেবট রিপেমেন্ট স্কিম (ডিআরএস) সহযোগিতা পেতে পারেন। তবে সাহায্য পাবেন কিনা তা নির্ধারণ করেন আদালত। ডিআরএসের লক্ষ্য হলো ঋণগ্রহীতাকে দেউলিয়া হওয়া এড়াতে সাহায্য করা। অবশ্য ঋণগ্রহীতা সরাসরি এ স্কিমে যোগ দেওয়ার আবেদন করতে পারেন না, যদি না পাওনাদার তার বিরুদ্ধে দেউলিয়া ঘোষণার আবেদন করেন।
সব সময় চাইলেই যে ডিআরএসের অধীনে সাহায্য পাওয়া যাবে, এর নিশ্চয়তা নেই। এ সুবিধা পেতে কিছু শর্ত পূরণ করতে হয়। এর একটি হলো, মোট ঋণের আকার দেড় লাখ ডলারের বেশি হতে পারবে না। আরও গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলো ওই ব্যক্তিকে কোনো কাজে নিযুক্ত থাকতে হবে।
এ বিষয়ে ক্রেডিট কাউন্সেলিং সিঙ্গাপুরের (সিসিএস) জেনারেল ম্যানেজার ট্যান হুয়ে মিন জানান, ডিআরএসে মাসিক কিস্তিতে ঋণ পরিশোধ করতে হয়, তবে তা পাঁচ বছরের বেশি নয়। এর মাধ্যমে ঋণগ্রহীতারা যে পরিমাণ অর্থ পরিশোধ করেন তা সাধারণত প্রকৃত ঋণের চেয়ে কম। একবার কোনো ব্যক্তি ডিআরএসের অধীনে বাধ্যবাধকতা পূরণ করলে নতুনভাবে আর্থিক জীবন শুরু করতে পারেন। ঋণগ্রহীতাকে পুরো টাকা পরিশোধ করতে না হলেও তারা যে বড় ধরনের ছাড় পাবেন, এমন নিশ্চয়তা নেই বলে জানিয়েছে সিঙ্গাপুরের আইন মন্ত্রণালয়। তবে ৭০ শতাংশ পর্যন্ত ছাড় দেওয়ার নিয়ম রয়েছে। সুবিধা নিয়েও কোনো দেনাদার যদি ঋণ পরিশোধে ব্যর্থ হয়, তবেই পাওনাদাররা দেউলিয়া ঘোষণার আবেদনসহ ব্যক্তির বিরুদ্ধে আইনি ব্যবস্থা নিতে পারেন। আবার অনেক ক্ষেত্রে শুরুতেই ঋণগ্রহীতা ডিআরএসের অনুপযুক্ত বিবেচিত হন। সরকারি প্রতিবেদন অনুসারে, ব্যক্তি খাতে দেউলিয়াত্ব এড়াতে সরকার ঘোষিত ডিআরএস ঋণগ্রহীতাদের ততটা সাহায্য করতে পারে না।
আইনি সেবাদাতা সংস্থা ‘ইউয়েন ল’-এর সহযোগী পরিচালক ট্রিস জেভিয়ার জানান, এক সময় দেউলিয়াত্ব থেকে মুক্তির কোনো স্পষ্ট সময়সীমা ছিল না সিঙ্গাপুরে। কখনও কখনও ২০-৩০ বছরও লেগে যেত। তবে ২০১৬ সালে আইনি সংস্কারের ব্যক্তির অর্থনৈতিক পরিস্থিতির ওপর বিবেচনা করে সময়সীমা নির্ধারণ করা হয়। এখন প্রথমবার দেউলিয়াত্বের ক্ষেত্রে সময়সীমা নির্ধারণ করা হয়েছে তিন থেকে সাত বছর, পরের বার পাঁচ থেকে নয় বছর। প্রথমবার কেউ লক্ষ্য পূরণ করলে পাঁচ বছর পর এ সংক্রান্ত পাবলিক রেকর্ড থেকে নাম মুছে ফেলা হয়। কিন্তু যারা ব্যর্থ হন তাদের নাম স্থায়ীভাবে পাবলিক রেকর্ডে থেকে যায়।
সিঙ্গাপুরে দেউলিয়া ব্যক্তি সম্পদ গোপন করতে পারেন না বা প্রতি মাসে অল্প অর্থ পরিশোধ করে পার পেয়ে যাবেন এমন নয়। তার যদি গাড়ি বা সম্পত্তি থাকে, তাহলে সেগুলো বিক্রি করে হলেও ঋণ পরিশোধ করতে হবে। দেউলিয়া আইন বিদেশে থাকা সম্পদের ক্ষেত্রেও প্রযোজ্য, অর্থাৎ বিদেশের অ্যাকাউন্টে অর্থ লুকানো যাবে না। এমনকি পাওনাদারদের এড়াতে পরিবারের সদস্যদের কাছে সম্পদ হস্তান্তর বেআইনি।
দেউলিয়া ব্যক্তিরা অনুমতি না নিয়ে বিদেশ ভ্রমণ করতে পারেন না। ব্যবসা পরিচালনা করতে বা কোনো কোম্পানির পরিচালক হতে পারেন না।
সাম্প্রতিক দেশকাল ইউটিউব চ্যানেল সাবস্ক্রাইব করুন
© 2024 Shampratik Deshkal All Rights Reserved. Design & Developed By Root Soft Bangladesh