সাতচল্লিশ থেকে চব্বিশ

বাংলাদেশের গণঅভ্যুত্থানে পশ্চিমবঙ্গের প্রান্তিক স্বরের সংহতি

বাংলাদেশে ফ্যাসিবাদের অবসান ঘটিয়ে চব্বিশে ছাত্র-জনতার গণ-অভ্যুত্থানের পাশে মোটেও গোটা পশ্চিমবঙ্গ দাঁড়ায়নি। বরং বৃহত্তর কলকাতার প্রান্তিক কিছু স্বর এই অভ্যুত্থানকে নৈতিক সমর্থন জানিয়েছে। যদিও পরবর্তী সময়ে ভারতীয় গণমাধ্যম যেভাবে বাংলাদেশের পরাজিত, পলাতক ফ্যাসিস্ট অপশক্তির হয়ে ভুয়া প্রোপাগান্ডা ম্যানুফ্যাকচারিংয়ের কারখানা খুলে বসেছে, তাতে বাংলাদেশের গণ-অভ্যুত্থানের পক্ষে থাকা পশ্চিমবঙ্গের ছাত্রশক্তির বড় অংশই এখন বিভ্রান্ত। ভারতীয় রাষ্ট্রবাদ ও হিন্দুত্ববাদের চোখ দিয়েই তারা এই মুহূর্তে বাংলাদেশের চলমান রাজনৈতিক স্ট্রাগলকে পাঠ করছে। ফলে প্রান্তিক স্বর আরো প্রান্তিক হয়েছে পশ্চিমবঙ্গে। তথাপি আমরা যারা এখনো বাংলাদেশকে দিল্লির চশমা দিয়ে না পাঠ করে বাংলার নিম্নবর্গের, নিপীড়িত মানুষের ইতিহাস ও সমকালীনতার দৃষ্টিভঙ্গি দিয়ে পর্যবেক্ষণ করি, তারা, মানে সেই আমরা এখনো বাংলাদেশের গণ-অভ্যুত্থানের চলমানতা থেকে শিখছি। ইতিহাস ঝালিয়ে নিচ্ছি ভবিষ্যতে পশ্চিমবঙ্গের মাটি থেকে দিল্লির ফ্যাসিবাদী রাজনীতিকে খেদানোর স্বপ্ন নিয়ে।

বাংলাদেশের সঙ্গে পশ্চিমবঙ্গ-ত্রিপুরা-ঈশানবঙ্গসহ অবিচ্ছেদ্য অংশগুলোর সম্পর্ক পুনর্মূল্যায়ন আজ এই কান্তিকালে ইতিহাসের ভেতর থেকে সমকালীন কালপ্রবাহকে পর্যবেক্ষণ ও ব্যবচ্ছেদের মাধ্যমেই সম্ভব। সে প্রসঙ্গে আসব, আসব চব্বিশের জুলাই বঙ্গবিপ্লবে পশ্চিমবঙ্গে প্রান্তিক স্বরগুলোর অবদান প্রসঙ্গেও। কিন্তু পাশাপাশি প্রাসঙ্গিক হয়ে উঠেছে সাতচল্লিশকে ফিরে দেখা। কারণ ওই কালবিন্দুতেই বাংলা ভাগ হয়ে যায়। প্রথমে দেখা যাক জুলাই মাসে বাংলাদেশের প্রভাব পশ্চিমবঙ্গে কীভাবে পড়েছিল।

জুলাই ২০২৪, পশ্চিমবঙ্গ 

বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনকে দমন করতে ঢাকাসহ বাংলাদেশের বিভিন্ন প্রান্তে যেভাবে জুলুমশাহী ফ্যাসিস্ট হাসিনা সরকার ছাত্র-জনতার ওপর নামিয়ে এনেছিল রাষ্ট্রীয় নিপীড়ন, যেভাবে সংগঠিত হয়েছিল গণহত্যা, তার বিরুদ্ধে পশ্চিমবঙ্গে জ্ঞানগঞ্জ ও নয়াচিন্তা নামক দুটি সংগঠন যৌথভাবে প্রথম রাস্তায় নামে। লেখক, গবেষক বিশ্বেন্দু নন্দ, কবি ও সমাজকর্মী অত্রি ভট্টাচার্য এবং গবেষক নজরুল আহমেদকে সঙ্গে নিয়ে আমি যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের অদূরেই এইট-বি বাসস্ট্যান্ডে প্রতিবাদ সভা করি। এরপর নকশালবাড়ি ধারার ছাত্ররা রাস্তায় নামেন। বাংলাদেশ ডেপুটি হাইকমিশনের কার্যালয়ের সামনে বিক্ষোভ হয়। যে বিক্ষোভে পুলিশ লাঠিও চালায়। যদিও একুশে জুলাই তৃণমূল কংগ্রেসের জনসভায় পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় বাংলাদেশের 

ছাত্র-জনতার প্রতি মৃদু সংহতিও জানান। যদিও দিল্লিকে টপকে তিনি কিছু যে করতে পারেন না, তাও বুঝিয়ে দেন। কিন্তু সেই সময় বিজেপি ও সিপিএম প্রকাশ্যে আওয়ামী ফ্যাসিস্টদের পক্ষে সওয়াল করতে থাকে। মোদির বন্ধু হাসিনার পক্ষে যে বিজেপি কথা বলবে, এটা স্বাভাবিক, কারণ দুজনেই ফ্যাসিস্ট। কিন্তু লালপতাকাধারী সিপিএমও হাসিনার পক্ষে সওয়াল করতে থাকে। তাদের ভাষ্য ছিল, মার্কিন সাম্রাজ্যবাদের মদদে হাসিনার পতন ঘটিয়েছে ইসলামিক জাতিবাদীরা! 

আগস্ট, ২০২৪, পশ্চিমবঙ্গ 

৫ আগস্ট ফ্যাসিস্ট হাসিনা শাসনের অবসান ও দিল্লিতে পালানোর পর ভারতীয় মিডিয়ায় বাংলাদেশ নিয়ে কুৎসা শুরু হয়ে যায়। দুর্গাপূজার সময় বাংলাদেশের সংখ্যাগুরু ছাত্র-যুবা হিন্দুদের মন্দির ও মণ্ডপ পাহারা দিয়ে সুষ্ঠু ও শান্তিপূর্ণভাবে শারোদোৎসব সম্পন্ন করলেও পশ্চিমবঙ্গে তখন থেকেই তিলকে তাল করা শুরু হয় হিন্দু নিপীড়নের চিরাচরিত গালভরা কাহিনির প্রচার করে।

চিন্ময়কৃষ্ণ দাসের গ্রেপ্তার ও ইসকন থেকে বহিষ্কৃত ধর্মীয় নেতা চিন্ময়কৃষ্ণের গ্রেপ্তারের পর থেকেই পশ্চিমবঙ্গসহ গোটা ভারতে বাংলাদেশ সম্পর্কে ভুয়া প্রচার তুঙ্গে ওঠে। কবি ও দার্শনিক ফরহাদ মজহার চট্টগ্রামে গিয়ে চিন্ময়কৃষ্ণ ও সনাতনী হিন্দু জোটের আট দফা দাবির প্রতি সংহতি জ্ঞাপন করলেও বাংলাদেশের অন্তর্বর্তী সরকারের কোনো এক পক্ষের মদতে রাষ্ট্রদ্রোহের অভিযোগে চিন্ময়কে গ্রেপ্তারের ঘটনা যে ইতিবাচক নয় এবং বাংলাদেশবিরোধী প্রপাগান্ডা, তা বোঝা গেছে তরুণ এই সন্ন্যাসীর গ্রেপ্তারের পর। তখন থেকেই ভারতের মিডিয়ায় বাংলাদেশের ব্যাপারে লাগাতার ভুয়া নিউজ প্রচারিত হচ্ছে। অদ্ভুতভাবে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ও তার অবস্থান ১৮০ ডিগ্রি পরিবর্তন করেন এবং তার পর থেকে বিজেপির সুরে ভারতের সব কটি দলই হাসিনার পক্ষে সরাসরি অথবা প্রকারান্তরে কথা বলতে শুরু করে। এমনকি নকশালবাড়ি ধারার তথাকথিত বিপ্লবী ছাত্রসংগঠনগুলোও সিপিএমের মতো করেই গণ-অভ্যুত্থানকে মার্কিন সাম্রাজ্যবাদের কারসাজি ও হিন্দু নিপীড়নের তৎপরতা হিসেবেই দেখতে শুরু করে। ভারতীয় জাতীয়তাবাদ বা ঔপনিবেশিক ভারতীয় রাষ্ট্রবাদের ছাতার তলায় দাঁড়িয়ে যায় ডান-মধ্য-বামসহ প্রায় সব কটি দল। 

আসলে পশ্চিমবঙ্গের বাবু-সমাজের দৃষ্টিভঙ্গির ভিত্তিটাই ভারতীয় জাতীয়তাবাদের উন্মেষের সঙ্গে সম্পৃক্ত। যে ভারতীয় জাতীয়তাবাদ আসলেই আরএসএসের হিন্দি-হিন্দু-হিন্দুস্তানি জাতিবাদের লেবাস মাত্র। দিল্লি যেভাবে একাত্তরকে বাংলাদেশের জনযুদ্ধের বিজয় হিসেবে না দেখে পাকিস্তানের বিরুদ্ধে ভারতের বিজয় হিসেবে দেখেছে, যেভাবে আওয়ামী লীগ ও শেখ মুজিবুর রহমানকেই মুক্তিযুদ্ধের এক ও একমাত্র ধারক-বাহক হিসেবে দেখেছে এবং নিজের ঔপনিবেশিক ও  ফ্যাসিস্ট শাসন কায়েম রাখার স্বার্থে বাংলাদেশেও আওয়ামী ফ্যাসিবাদের উন্মেষ ঘটিয়ে জমিদারি ব্যবস্থা চালিয়েছে, ঠিক সেভাবেই বাংলাদেশকে পাঠ করতে শিখেছে পশ্চিমবঙ্গের বাবু সমাজ। বামেরাও তার বাইরে নয়। কারণ পশ্চিমবঙ্গসহ উপমহাদেশের বামেরা উচ্চবর্ণ ও উচ্চবিত্তের প্রতিনিধি। তাই সাতচল্লিশ, একাত্তর ও চব্বিশে বাংলাদেশের মজলুম-নিপীড়িত-অভদ্রবিত্ত ভূমিমানুষের স্ট্রাগল ও বিজয়কে বাংলাদেশের চোখ দিয়ে দেখতে তারা অক্ষম। এর পেছনে রয়েছে বর্ণবাদী ও ঔপনিবেশিক ইতিহাসের ধারা। একাত্তরকে পশ্চিমবঙ্গের বাবু সমাজ সেলিব্রেট করে মূলত আওয়ামী ন্যারেটিভকে সামনে রেখে। আর পাকিস্তানের পরাজয় হেতুই একাত্তর প্রসঙ্গে পশ্চিমবঙ্গের আবেগ আছে। কিন্তু একাত্তরের অসমাপ্ত বৈপ্লবিক কর্মসূচি চব্বিশের গণ-অভ্যুত্থানের মাধ‌্যমে পরিপূর্ণতা পাওয়ার সম্ভাবনা তৈরি হলে তারা এই ক্রান্তিকারী ঘটনাকে সন্দেহের ও নেতিবাচক দৃষ্টিকোণ থেকে দেখে, কারণ চব্বিশে দিল্লির বিশ্বস্ত হাসিনা রেজিমের পতন ঘটেছে। 

বঙ্গের  ইতিহাস ফিরে দেখা

অনার্য, বাদামি চামড়ার ভূমি, কৃষক, মৎস্যজীবী, কারিগরদের সহাবস্থানের ভূমি বাংলা বারবার হামলার শিকার হয়েছে। সেন শাসনের সুবাদে বর্ণবাদীদের আগমন ঘটেছিল বঙ্গে, সুলতান আমলে তা প্রতিহত হয়। চৈতন্য-নিত্যানন্দ মহাপ্রভুদের ভাবান্দোলন ও পীর-আউলিয়া মুর্শিদগণের সহজ ইসলামের প্রসারে বঙ্গে প্রতিহত শঙ্করাচার্যীয় মায়াবাদ, ব্রাহ্মণ্যবাদী আধিপত্য ও চতুর্বর্ণাশ্রমের মাৎস্যন্যায়। এমনকি দিল্লির মোগলদেরও প্রতিহত করা হয় বঙ্গের বারো ভুঁইয়াদের স্ট্রাগলে। পাল যুগে বঙ্গের যে উন্মেষ ও গৌরব, তা সুলতানি যুগে ব্যপ্ত হয়ে স্বাধীন নবাবের আমলে বিকশিত হয়। কিন্তু ঘাপটি মেরে থাকা বর্ণবাদীরা জগৎ শেঠ, কৃষ্ণচন্দ্র রায়, নবকৃষ্ণ দেবদের বদান্যতায় এবং ঔপনিবেশিক প্রভুদের পৃষ্ঠপোষকতায় স্বাধীনতার সূর্য অস্তমিত করে বাংলায় ঔপনিবেশিক শাসন কায়েম করে। 

ঔপনিবেশিককালে ফকির-সন্ন্যাসী বিদ্রোহ, কৈবর্ত্য বিদ্রোহ, তিতুমীরের প্রতিরোধ, মতুয়াদের সংঘর্ষ, আদিবাসীদের সংগ্রাম- এসবকে পাশ কাটিয়ে ব্রিটিশ পৃষ্ঠপোষকতাতেই তৈরি হয় বাবুদের ভারতীয় জাতীয়তাবাদের তত্ত্ব ও তদানুসারী রাজনীতি। আমরা যদি একটু এগিয়ে দেখি, তাহলে দেখব, ঔপনিবেশিক শাসক ও উত্তর-পশ্চিম ভারতের কালোবাজারি বনিয়াদের সঙ্গে গাঁটছড়া বেঁধে তেতাল্লিশে মন্বন্তর সংগঠিত হয়। বাংলায় এ নিয়ে বিশদে কাজ করেছেন আইরিশ-বাঙালি গবেষক জন্ম মুখোপাধ্যায়। তার গবেষণামূলক বই ‘ক্ষুধার্ত বাংলা’ ওই সময়ের ব্যবচ্ছেদ করেছে নিখুঁতভাবে। এরপরেই ছেচল্লিশের সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা ও সাতচল্লিশের বাংলা ভাগ। 

সাতচল্লিশের আগস্টের আগে ৪৬-৪৭ জুড়ে অখণ্ড বঙ্গের চার দিকপাল পেশ করলেন ভারত-পাকের সমান্তরালে অখণ্ড বাংলা রাষ্ট্রের প্রস্তাব। সেই প্রস্তাবকে কার্যত বুড়ো আঙুল দেখিয়ে ভারতের জাতীয় কংগ্রেসের রাইট উইং অংশ ও হিন্দু মহাসভার যৌথ কারসাজিতে ভাগ হয়ে গেল বাংলা। আবুল হাশিম, শরৎচন্দ্র বসু, হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী ও কিরণশঙ্কর রায়, অখণ্ড বঙ্গের এই চার জাতীয় নেতা প্রস্তাব দিয়েছিলেন ব্রিটিশ ভারত বিভক্তির ফলে যদি স্বাধীন ভারত ও স্বাধীন পাকিস্তান জন্ম নেয়, সে ক্ষেত্রে ভারতীয় উপমহাদেশ তিন খণ্ডে বিভক্ত হোক। ভারত, পাকিস্তান ও স্বাধীন সার্বভৌম, সমাজতান্ত্রিক বাংলা। এই প্রস্তাব মূলত চিত্তরঞ্জন দাশের রাজনৈতিক চিন্তা পরম্পরারই অংশ ছিল। যদিও তা বাংলার শ্যামাপ্রসাদ মুখোপাধ্যায় ও গুজরাটের সর্দার বল্লবভাই প্যাটেলদের কলকাঠিতে নাকচ হয়ে যায়। ব্রিটিশ আমলেই বাংলা থেকে ঈশানবঙ্গকে বিচ্ছিন্ন করে অসমের অংশ করা হয়েছিল। সাতচল্লিশে দুটি স্বাধীন রাষ্ট্রের জন্ম হওয়ায় ভাগ হয়ে গেল বঙ্গের বাকি অংশগুলো। পূর্ববঙ্গ হয়ে গেল পূর্ব পাকিস্তান, বঙ্গের পশ্চিম অংশ পশ্চিমবঙ্গ নামে ভারতের অঙ্গরাজ্য হলো। ত্রিপুরবঙ্গের কুমিল্লা ও ব্রাহ্মণবাড়িয়া বাদে বাকি অংশ ভারতের ত্রিপুরা রাজ্যের অংশ হলো। এমনকি সাতচল্লিশের পরেও পশ্চিমবঙ্গ ভেঙে মানভূমের একটা বড় অংশ বিহারে চলে যায়। এই ইতিহাসকে কেন্দ্র করেই নয়ারূপে বাংলার রাজনীতি দুটি রাষ্ট্রের মধ্যে বিভক্ত হয়ে যায়।

মনে রাখা দরকার বাংলা থেকেই ভারতীয় জাতীয়তাবাদের উন্মেষ ঘটেছিল, ব্রিটিশবিরোধী স্ট্রাগলের নামে আসলে ঔপনিবেশিক শক্তির সঙ্গে সমঝোতাপূর্ণ অবস্থানের ভেতর থেকে। এই ভারতীয় জাতীয়তাবাদই একটি ফেব্রিকেটেড বেঙ্গল রেনেসাঁর জন্ম দিয়েছিল। ভারতীয় জাতীয়তাবাদের উন্মেষ, বাংলার তথাকথিত নবজাগরণ- এসবই যে ঔপনিবেশিক শক্তির পৃষ্ঠপোষকতায় বাবু বাঙালির রাজনৈতিক ক্ষমতায়নের সঙ্গে জড়িয়ে, তা বলার অপেক্ষা রাখে না। এও বলার অপেক্ষা রাখে না যে ১৯০৫-এর প্রাদেশিক বিভাজনের নিরিখে বঙ্গভঙ্গ প্রস্তাবের বিরোধিতায় যে স্বদেশি আন্দোলন, তা মূলত সামন্তশ্রেণির বর্ণহিন্দু বাবু বাঙালির রাজনৈতিক আধিপত‌্য ধরে রাখার স্ট্রাগল। কলকাতার সমান্তরালে বাংলার সমান্তরাল কেন্দ্র যদি ঢাকা হয়, তাহলে বাবুদের একচ্ছত্র মৌরসিপাট্টা যে বন্ধ হয়ে যাবে, এটা বুঝতে পেরেই বাঙালি মুসলমান ও বাঙালি নমঃশূদ্রের রাজনৈতিক ক্ষমতায়ণের কেন্দ্র হিসেবে প্রাদেশিক বঙ্গভঙ্গ প্রস্তাবের বিরোধিতা করা হয়। রবীন্দ্রনাথ বুঝতে পেরেছিলেন এই খেলা। তাই ভাবের ঘরে চুরি না করে, নিজের উপন্যাসের মাধ্যমে রবীন্দ্রনাথ তার পূর্বেকার অবস্থানের আত্মসমালোচনাও করেন। ‘বাংলার মাটি বাংলার জল’ গানটি যে রাজনৈতিক অবস্থান থেকে রচনা করেছেন, সেই তিনিই রাজনীতির দফারফা করে ছেড়েছেন তার ‘ঘরে-বাইরে’ উপন্যাসে। এমনকি ১৯২৫ সালের একটি প্রবন্ধে স্বদেশি আন্দোলনকে ‘চরকা-সংস্কৃতি’ বলে বিদ্রুপ করেন। 

মনে রাখা দরকার, ১৯০৫-এর প্রস্তাবের বিরোধিতা করে যে রাজনৈতিক ধারা, সেই পরম্পরাই ১৯৪৭-এ বাংলা ভাগের পক্ষে দাঁড়াচ্ছে। উল্টোদিকে জমির প্রশ্নের মীমাংসা ও নিম্নবর্গের বাঙালির (বাঙালি মুসলিম ও নিম্নবর্ণের বাঙালি হিন্দু) ক্ষমতায়নের লক্ষ্যে পাকিস্তান আন্দোলনে শরিক হয়েও শেষমেশ ভারত ও পাকিস্তানের সমান্তরালে বাংলা অখণ্ড প্রস্তাব তুললেন সোহরাওয়ার্দী, আবুল হাশিমরা। সেই প্রস্তাবে সায় দিলেন শরৎচন্দ্র বসুরাও। কিন্তু বৈদিক বর্ণহিন্দুত্বের রাজনীতি যে ভারতীয় জাতীয়তাবাদ পয়দা করেছিল, সেই ধারায় বাংলা ভাগের পক্ষে সওয়াল করলেন বাংলার শ্যামাপ্রসাদ মুখোপাধ্যায়রা, যা বল্লবভাই প্যাটেল ও ব্রিটিশদের সৌজন্যে বাস্তবায়িত হয়ে যায়। নিম্নবর্গের হিন্দু হয়ে পাকিস্তানের মন্ত্রী হন যোগেন মণ্ডল। এমনকি উচ্চবর্ণের হিন্দু বাঙালি হয়েও পাকিস্তানের মন্ত্রী ধীরেন্দ্রনাথ দত্তও। এ প্রসঙ্গে বলি ভারতীয় জাতীয়তাবাদের অন্দরে বাংলার যে ভদ্রবিত্ত সুশীল হিন্দু জাতীয়তাবাদের চর্চা করেছেন, তারা সহজেই উত্তর ও পশ্চিম ভারতীয় হিন্দুদের সঙ্গে ঐক্য তৈরি করে প্যান ইন্ডিয়ান পলিটি তৈরি করেন পাকাপোক্তভাবে। অন্যদিকে পাকিস্তান আন্দোলনের সঙ্গে থেকেও উত্তর ও পশ্চিম ভারতের আশরাফ মুসলমানদের সঙ্গে একাত্ম হতে পারেননি বাংলার ‘আতরাফ’ জনতার প্রতিনিধিরা। ফলে প্রথমে তারা ভারত-পাকের সমান্তরালে বাংলা অখণ্ড রেখে তৃতীয় রাষ্ট্র কায়েমের পক্ষে সওয়াল করেন। পরে এই অংশই পূর্ব পাকিস্তানে করাচি হেজিমনির বিরুদ্ধে এবং অসাম্প্রদায়িক ও সৌভ্রাতৃত্বমূলক বাংলা স্বাধিকারের পক্ষে, বাংলা ভাষা ও সংস্কৃতির মর্যাদা রক্ষার পক্ষে সংগ্রাম চালান। যার অন্যতম মুখ হয়ে ওঠেন মওলানা ভাসানি। ১৯৫২-এর ভাষা সংগ্রাম, উনসত্তরের আন্দোলন ও একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধ আসলে সাতচল্লিশের নিম্নবর্গের বঙ্গবাসীর রাজনৈতিক উন্মেষের ধারাবাহিকতা। তার পরিপ্রেক্ষিতেই একের পর এক অর্জন। এই ইতিহাসে একাত্তর অবধি সোহরাওয়ার্দীর ক্যাডার হিসেবে সংযুক্ত হয়ে ক্রমে শেখ মুজিব হয়ে ওঠেন একমাত্র মুখ। কারণ তার মাথায় ছিল দিল্লির আশীর্বাদ। একাত্তর অবধি বঙ্গবন্ধুর ভূমিকা অস্বীকার না করেই বলা যায় যে তাকে মুক্তিযুদ্ধের একমাত্র আইকন করার পেছনে ছিল দিল্লির ভারতীয় জাতীয়তাবাদ নির্ভর ঔপনিবেশিক রাষ্ট্রতত্ত্বের দৃষ্টিকোণ নির্মাণের রাজনীতি। বাহাত্তরে বাকশাল কায়েম ও বাংলাদেশে দুর্ভিক্ষ, মুজিবের স্বৈরাচার হয়ে ওঠা, এসব তাই কখনোই চোখে পড়ে না কলকাতার বাবু সমাজের। আর মুজিব যে সীমা ছাড়ান নাই, সেই সীমা লঙ্ঘন করে বাংলাদেশের গণসার্বভৌমত্বকে সম্পূর্ণ বিনষ্ট করে সংঘ পরিবারের দাসানুদাস হয়ে যান শেখ হাসিনা। সীমানা ছাড়িয়ে গেছেন হাসিনা। 

এসব হয়তো পশ্চিমবঙ্গের তরুণ প্রজন্মের চোখেও পড়েছে। কিন্তু ভারতীয় জাতীয়তাবাদ, রাষ্ট্রনৈতিকতা ও বাবু সমাজের দৃষ্টিভঙ্গি থেকে তারাও বাংলাদেশের তথা মজলুম-নিপীড়িতের পুনরায় গণ-উন্মেষকে মেনে নিতে পারছেন না। যদিও আমাদের মতো গুটিকয়েক মানুষ আছে, যারা বাংলাদেশের রাজনৈতিক ইতিহাস ও সাম্প্রতিক রাজনৈতিক উন্মেষকে ভদ্রবিত্তের উঠানের বাইরে বেরিয়ে পর্যালোচনা করছে। কেননা আমরা বাংলাদেশকে ধারণ করি মর্মে, একাত্তরকে ধারণ করি চেতনায়। চব্বিশকে বহন করি অন্তরে। ভালোবাসি সোনার বাংলাদেশকে। 

লেখক : কবি ও সাংবাদিক, কলকাতা

সাম্প্রতিক দেশকাল ইউটিউব চ্যানেল সাবস্ক্রাইব করুন

মন্তব্য করুন

Epaper

সাপ্তাহিক সাম্প্রতিক দেশকাল ই-পেপার পড়তে ক্লিক করুন

Logo

ঠিকানা: ১০/২২ ইকবাল রোড, ব্লক এ, মোহাম্মদপুর, ঢাকা-১২০৭

© 2025 Shampratik Deshkal All Rights Reserved. Design & Developed By Root Soft Bangladesh