ভারত-পাকিস্তান দুই পারমাণবিক শক্তিধর দেশের চলমান সংকট বিপজ্জনক মোড় নিচ্ছে। অথচ বিশ্ব কেমন যেন এই ইস্যুতে নীরব। শান্তি প্রতিষ্ঠার আহ্বানও খুব একটা জোরালো মনে হচ্ছে না। তবে কী বড় বিপর্যয়ের সামনে পড়তে যাচ্ছে দক্ষিণ এশিয়া?
বিবিসির দক্ষিণ এশীয় আঞ্চলিক সম্পাদক আনবারাসান ইথিরাজান এক প্রতিবেদনে লিখেছেন, “প্রাথমিক ধারণা ছিল যে, ভারত যখন আকাশপথে হামলা চালায় এবং পাকিস্তান দাবি করে যে তারা কয়েকটি ভারতীয় বিমান গুলি করে ভূপাতিত করেছে- যদিও দিল্লি এই দাবিটি নিশ্চিত করেনি, তখন উভয়পক্ষ নিজেদের জয় দাবি করতে পারবে এবং পরিস্থিতি শিথিল হবে।”
অথচ এমনটা হয়নি। দুইদেশের পাল্টাপাল্টি হামলা উলটো আরও বেড়েছে। এতে কোনো সন্দেহ নেই- যে কোনো দীর্ঘস্থায়ী পাল্টাপাল্টি আক্রমণ পরিস্থিতিকে আরও বেশি বিপজ্জনক করে দিতে পারে।
অতীতের সংঘর্ষগুলো, যেমন ২০১৯ ও ২০১৬ সালের সংঘর্ষ, যখন সংঘর্ষ তীব্র হয়ে উঠেছিল তখন যুক্তরাষ্ট্র ও অন্যান্য বিশ্বশক্তি দিল্লি ও ইসলামাবাদকে চাপ প্রয়োগ করে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনতে এবং শান্তি প্রতিষ্ঠার জন্য আহ্বান জানিয়েছিল।
তবে বর্তমানে উভয়পক্ষের মধ্যে জাতীয়তাবাদী বক্তব্য তুঙ্গে পৌঁছেছে এবং প্রতিবেশী দুই দেশ আজকের দিনে অতীতের যেকোনো সময়ের চেয়ে যুদ্ধের কাছাকাছি অবস্থানে রয়েছে।
“বিশ্ব সম্প্রদায় চুপ, যা বিপজ্জনক” বলেছেন কিংস কলেজ লন্ডনের সিনিয়র ফেলো হিসেবে কর্মরত পাকিস্তানি একাডেমিক আয়েশা সিদ্দিকা।
তিনি বলেন, “যদিও এই উত্তেজনা দশকের পর দশক ধরে চলছে, কিন্তু এটা প্রথমবার যখন দুই দেশ নিজেদের মধ্যে সংঘর্ষে জড়িয়েছে- অথচ কেউ থামাতে বা পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণ করতে আসেনি।”
যদি ওয়াশিংটন আরো সক্রিয় না হয়, তাহলে ইসলামাবাদ ও নয়াদিল্লি তাদের অভিযোগ ও পাল্টা অভিযোগ চালিয়ে যেতে পারে।
যদিও মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী মার্কো রুবিও ভারত ও পাকিস্তানের শীর্ষ নেতাদের পরিস্থিতি শিথিল করার জন্য আহ্বান জানিয়েছেন, অন্যদিকে অন্য আমেরিকান নেতাদের বার্তা ভিন্ন।
ফক্স নিউজকে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে যুক্তরাষ্ট্রের ভাইস প্রেসিডেন্ট জেডি ভ্যান্স জানান, ভারত ও পাকিস্তানের মধ্যে সম্ভাব্য যুদ্ধ ‘আমাদের কাজ নয়’।
তিনি বলেন, “আমরা চাই এই পরিস্থিতি যত দ্রুত সম্ভব শান্ত হোক। তবে আমরা এই দেশগুলোকে নিয়ন্ত্রণ করতে পারি না। আমরা ভারতকে বলতে পারি না- তোমরা অস্ত্র ফেলে দাও। আমরা পাকিস্তানকে বলতে পারি না- তোমরা অস্ত্র ফেলে দাও।”
ভ্যান্স ভারত সফরের সময় ভারতীয়-প্রশাসিত কাশ্মীরে সন্ত্রাসী হামলায় ২৬ জন সাধারণ নাগরিক নিহত হয়।
এর আগে মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প ভারত এবং পাকিস্তানের মধ্যে উত্তেজনা বৃদ্ধিকে ‘লজ্জাজনক’ হিসেবে বর্ণনা করেছিলেন।
আগের ভারত-পাকিস্তান ছোটোখাটো সংঘর্ষগুলোর মতো, যেমন ২০১৯ সালে- উত্তেজনা দ্রুত প্রশমিত হয়ে গিয়েছিল যখন ভারত পাকিস্তানের ভেতরে তাদের ‘সার্জিক্যাল স্ট্রাইক’ চালানোর দাবি করেছিল।
এর পরপরই একটি ভারতীয় বিমান ভূপাতিত হয় এবং পাইলটকে পাকিস্তান আটক করে। পরে ওয়াশিংটন ও অন্যান্য বিশ্বশক্তির হস্তক্ষেপে তাকে মুক্তি দেওয়া হয়।
তবে বর্তমানে সংঘর্ষের তীব্রতা আলাদা এবং উভয়পক্ষের মধ্যে উত্তেজনা বেশি।
পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনতে একটি সম্মিলিত আন্তর্জাতিক প্রচেষ্টা নেওয়া যেতে পারে। যেখানে ট্রাম্প প্রশাসন গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করতে পারে। কিন্তু বাস্তবতা হলো তাদের অগ্রাধিকারে রয়েছে শুল্ক নীতি, চীন-তাইওয়ান ও ইউক্রেন-রাশিয়া যুদ্ধ।
এই অঞ্চলে চীনেরও একটি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রয়েছে। বেইজিং ইসলামাবাদের সঙ্গে ঘনিষ্ঠ অর্থনৈতিক এবং সামরিক সম্পর্ক বজায় রেখেছে।
চীন পাঁচ হাজার কোটি ডলারের বেশি বিনিয়োগ করেছে পাকিস্তানে। এ ছাড়া দেশটির সঙ্গে ভারতীয় সীমান্তে অমীমাংসিত বিরোধ রয়েছে এবং গত ২০২০ সালে হিমালয়ে দুই দেশের মধ্যে সীমান্ত সংঘর্ষ হয়েছিল।
তবুও, চীন ভারতীয়দের দ্বিতীয় বৃহত্তম বাণিজ্যিক অংশীদার।
সাংহাইভিত্তিক আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিশেষজ্ঞ শেন ডিংলির মতে যদি ভারত ও পাকিস্তানের মধ্যকার উত্তেজনা কমিয়ে আনতে যুক্তরাষ্ট্র আগ্রহী না হয়। তবে জাতিসংঘ নিরাপত্তা পরিষদের অন্য স্থায়ী সদস্যদের এতে জড়িত হওয়া উচিত। এটি তাদের দায়িত্বও।
যেহেতু ভারত পাকিস্তানকে কাশ্মীরি বিচ্ছিন্নতাবাদীদের সহায়তা করার অভিযোগে অভিযুক্ত করছে, যারা গত মাসে পর্যটকদের ওপর হামলা চালিয়েছে। চীনা বিশেষজ্ঞ বলেছেন, নিরাপত্তা পরিষদের স্থায়ী সদস্যরা ঘটনাটির একটি নির্ভরযোগ্য তদন্ত চালাতে পারে, যাতে ভারতের উদ্বেগ মোকাবিলা করা যায়।
উপসাগরীয় দেশগুলো যেমন কাতার, সৌদি আরব ও সংযুক্ত আরব আমিরাতও মধ্যস্ততায় ভূমিকা রাখতে পারে। কারণ দুইদেশের সঙ্গে দেশগুলোর ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক রয়েছে।
সম্প্রতি সৌদি আরবের পররাষ্ট্রমন্ত্রী আদেল আল-জুরি দিল্লি সফর করেছেন। গত শুক্রবার আরেক সৌদি মন্ত্রী ইসলামাবাদ সফরে পাকিস্তানি নেতাদের সঙ্গে বৈঠক করেন।
উপসাগরীয় দেশগুলোতে রাজ্যগুলিতে আনুমানিক ২৬ লাখ পাকিস্তানি বসবাস ও কাজ করছে। রিয়াদ পাকিস্তানে যথেষ্ট প্রভাবশালী। সৌদি আরব পাকিস্তানকে অর্থনৈতিক সংকটের সময় বহু কোটি ডলার ঋণ দিয়েছে।
বর্তমান সংকট থেকে বের হওয়ার একটি পথ হতে পারে এমন একটি পরিস্থিতি, যেখানে উভয়পক্ষ নিজেদের জয় দাবি করতে পারে এবং নিজেদের জনগণকে সন্তুষ্ট করতে পারে।
ভারত বলেছে যে, পাকিস্তান এবং পাকিস্তান নিয়ন্ত্রিত কাশ্মীরে সন্দেহভাজন সন্ত্রাসী আস্তানায় ক্ষেপণাস্ত্র হামলা চালানো হয়েছে। যা পেহেলগামের গত মাসের হামলার জন্য দায়ী ব্যক্তিদের ‘জবাবদিহি’ করার প্রতিশ্রুতি ছিল।
ভারতের অবসরপ্রাপ্ত লেফটেন্যান্ট জেনারেল ডি এস হুদা বলেন, “ভারত এরই মধ্যে তাদের লক্ষ্য অর্জন করেছে। এখন, পাকিস্তানের পালা। যদি তারা পাল্টা আক্রমণ করতে চায়, তাহলে ভারত শক্ত প্রতিক্রিয়া জানাবে।”
পাকিস্তানের মতো সামরিক ভাবে শক্তিশালী দেশের জন্য, এটি তাদের জনগণকে দেখানোর বিষয় যে তারা ভারতের বিরুদ্ধে দাঁড়াতে পারে এবং আবার একবার ভারতের বিমান বাহিনীর পাঁচটি বিমান ভূপাতিত করে তাকে শিক্ষা দিতে পারে।
ভারত তাদের কোনো বিমান ভূপাতিত হওয়ার ঘটনা এখনও স্বীকার করেনি।
তবে পাকিস্তানি একাডেমিক সিদ্দিকার মতে, বর্তমান সংকটের সমাপ্তি নির্ভর করবে ভারত কীভাবে তাদের লক্ষ্য নির্ধারণ করে।
তার মতে, “ভারতের লক্ষ্য প্রতিদিনই পরিবর্তিত হচ্ছে – পাকিস্তানকে শাস্তি দেওয়া থেকে আরও কিছু পাওয়ার দিকে।”
সাম্প্রতিক দেশকাল ইউটিউব চ্যানেল সাবস্ক্রাইব করুন
বিষয় : ভারত পাকিস্তান পেহেলগাম কাশ্মীরে হামলা
© 2025 Shampratik Deshkal All Rights Reserved. Design & Developed By Root Soft Bangladesh