আমিও পারব পুরুষ হকিতে বাঁশি বাজাতে: মহুয়া

ক্রিকেট অথবা ফুটবল মাঠে পুরুষ আম্পায়ার-রেফারি দাপিয়ে বেড়ায় পুরো মাঠ। কোনো খেলোয়াড় ভুল করলেই বাঁশি বাজিয়ে ঠিক করার নির্দেশ দেয়। দেশে ফুটবলে নারী রেফারিও রয়েছেন। 

কিন্তু হকিতে নারী আম্পায়ার! হকির প্রতি দর্শকদের এবার অবাক হওয়ার পালা! এমনটিই হতে যাচ্ছে ঢাকার মওলানা ভাসানী হকি স্টেডিয়ামের টার্ফে। রীতিমতো কোর্স করে, হাতে-কলমে পরীক্ষা দিয়ে বাংলাদেশের প্রথম হকি নারী আম্পায়ার হয়েছেন আয়েশা পারভীন মহুয়া।

টাঙ্গাইলের ঘাটাইল থানার নাগবাড়ী গ্রামের মেয়ে আয়েশা। শৈশবে শীর্ণকায় ও রুগ্ণ থাকার কারণে ডাক্তাররা তাকে লাফালাফি, নাচানাচি করতে নিষেধ করেছেন। কিন্তু হৃদয়ে যার মাঠের টান, তিনি কেন শুনবেন চিকিৎসকের এসব বারণ! শোনেননি এ তরুণী। বরং খেলাধুলাকেই প্রাধান্য দিয়ে রোগ-বালাইকে জয় করেছেন। 

এ প্রসঙ্গে মহুয়া বলেন, শৈশবে আমি খেলাধুলা করতাম। আমার বাবা আতাউল হক সিদ্দিকী খেলাধুলা করতে আমাকে ভীষণ উৎসাহ দিতেন। বাবার চাকরির সুবাদে আমার শৈশব কেটেছে দিনাজপুরে। সেখানে সেন্ট ফিলিপস হাইস্কুলে লেখাপড়া করি। স্কুল থেকে বাড়ি ফিরে খাওয়া-দাওয়া সেরে বিশ্রাম নিতাম। বিকাল হলেই বাবা আমাকে দিনাজপুর জিমনেশিয়ামে নিয়ে যেতেন। হাতে ধরে সাইক্লিং শেখাতেন। এভাবেই বাবা আমাকে একটু একটু করে তৈরি করেছেন। স্কুলে খেলাধুলার সব ইভেন্টেই অংশ নিতাম। সব খেলায়ই আমি জিতে আসতাম।

মহুয়া এসএসসি পাস করে ভর্তি হন দিনাজপুর মহিলা কলেজে। কলেজে পড়ার সময়ে খেলাধুলার প্রতি আরো ঝোঁক বেড়ে যায়। হ্যান্ডবল, ভলিবল সবগুলোতেই প্রথম হতেন মহুয়া। 

তিনি আরো জানালেন, সপ্তম কিংবা অষ্টম শ্রেণির ছাত্রী আমি। তখন দিনাজপুর মহিলা ক্রীড়া সংস্থার হয়ে হ্যান্ডবল খেলার সুযোগ পেলাম। 

আর এরই সূত্র ধরে ২০০৪ থেকে ২০০৮ সাল পর্যন্ত বাংলাদেশ ক্রীড়া শিক্ষা প্রতিষ্ঠান (বিকেএসপি) থেকে অ্যাথলেটিকসে গ্র্যাজুয়েশন করেন মহুয়া।

জাতীয় অ্যাথলেটিকসে গোলক নিক্ষেপ ইভেন্টে স্বর্ণপদক জয় করেন তিনি। ব্যক্তিজীবনে সবকিছুতেই বাড়তি কৌতূহল মহুয়ার। কোনো কিছু দেখলে সেটি জানার ভীষণ আগ্রহ তার।

বিকেএসপিতে থাকাকালে একদিন দেখলেন তীর-ধনুকের খেলা হচ্ছে। কৌতূহল নিয়ে তিনিও তীর-ধনুক ছুড়লেন। ব্যস সবার নজর কাড়লেন মহুয়া। শুরু হয়ে গেল তীর-ধনুক নিয়ে লড়াই। সেখানেও সাফল্য। খেলেছেন আরচারি বিশ্বকাপে। ইন্দোবাংলা গেমসে দলীয় ইভেন্টে পদক জয় করেছেন।

কিন্তু আরচারি খেললেও হকিই তাকে টানে বেশি। কারণ তার রক্তে মিশে রয়েছে হকি। বাবা আতাউল হক সিদ্দিকী ও দাদা আব্দুর রশিদ সিদ্দিকীও হকি খেলোয়াড় হিসেবে সুনাম কুড়িয়েছেন। বংশ পরম্পরায় নিজের অজান্তেই ভালোবেসে ফেলেছেন হকিকে।

এ প্রসঙ্গে মহুয়া জানান, যখন শুনলেন ৪২ বছর পর বাংলাদেশে নারী হকি দল গঠিত হয়েছে। তখনই নিজেকে জড়াতে চেয়েছেন। তবে সেটি স্টিক হাতে নয়। বাঁশি হাতেই মহিলা দলের সঙ্গে থাকতে চান তিনি। এজন্য তিন দিনব্যাপী আম্পায়ার কোর্স করেছেন। ওই কোর্সে ২৮ জনের মধ্যে একমাত্র তিনি ছিলেন নারী। প্রতিনিয়তই শিখতে চান। কারণ শেখার কোনো বিকল্প নেই।

ফুটবলে যদি জয়া চাকমা, সালমা ও আলো পাইওনিয়ার, তৃতীয় বিভাগ, বাংলাদেশ গেমস, যুব গেমসে বাঁশি বাজাতে পারেন তাহলে তিনি পারবেন না কেন? ২০১৫ সালে বিএএফ শাহীন কলেজে শিক্ষকতা করতে গিয়ে আবার নতুন। কৌতূহল উঁকি দেয় তার মনে। প্রতি বছর আন্তঃশাহীন হকি টুর্নামেন্ট হয়। মহুয়ার ওপর এই টুর্নামেন্টের দায়িত্ব পড়ল। শিক্ষার্থীদের ভুল শেখানোর চেয়ে জেনে শেখানো অনেক ভালো।

 খোঁজ করলেন কোথায় গেলে, কীভাবে এগুলে হকির নিয়ম শেখা যাবে। অদম্য এ নারী হকি ফেডারেশনের আম্পায়ারিং কোর্সে নাম লিখালেন। যেখানে পুরুষরা সেরা আম্পায়ারিং করার লড়াইয়ে ব্যস্ত, সেখানে একই কাতারে দাঁড়িয়ে চ্যালেঞ্জ নিয়ে অংশ নিলেন মহুয়া। তার চেষ্টা, পরিশ্রম সফল হয়েছে। 

বিএএফ শাহীন কলেজের শারীরিক শিক্ষক মহুয়ার মতে, বিএএফ শাহীন স্কুলের সাতটি শাখার মধ্যে আন্তঃস্কুল হকি খেলা অনুষ্ঠিত হয়। আমার আম্পায়ারিংয়ের শুরুটা ওখান থেকেই। একটা সময় মেয়েরা নিয়মিত মাঠে খেলবে। দলের সংখ্যা বাড়বে। পরিস্থিতি পাল্টে যাবে। আমি বাঁশি নিয়ে মাঠে নামলে অনেক নারীই উৎসাহ পাবে। আমাকে দেখে স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করবে। তাছাড়া ফুটবলে যদি নারী রেফারি পুরুষদের ফুটবলে বাঁশি বাজাতে পারে- তাহলে আমিও পারব পুরুষ হকিতে বাঁশি বাজাতে।


সাম্প্রতিক দেশকাল ইউটিউব চ্যানেল সাবস্ক্রাইব করুন

মন্তব্য করুন

Epaper

সাপ্তাহিক সাম্প্রতিক দেশকাল ই-পেপার পড়তে ক্লিক করুন

Logo

ঠিকানা: ১০/২২ ইকবাল রোড, ব্লক এ, মোহাম্মদপুর, ঢাকা-১২০৭

© 2024 Shampratik Deshkal All Rights Reserved. Design & Developed By Root Soft Bangladesh

// //