পথে নামলে, পথ একদিন শেষ হবেই

বিশ্বের বিভিন্ন দেশে সাইক্লিং খেলাধুলার একটি অংশ হলেও, আমাদের দেশে তেমন একটি জনপ্রিয় নয়। 

তারপরও এটিকে তরুণদের কাছে জনপ্রিয় করে তুলতে দায়িত্ব কাঁধে নিয়েছেন তরুণরাই। তারা জানেন, পথে নামলে পথ একদিন শেষ হবেই। তাদের কেউই পেশাদার সাইক্লিস্ট নন তারপরও যেন কোনো অংশে কম নয়। তারা যখন ইচ্ছে তখনই সাইকেল নিয়ে বেরিয়ে যান নানান দিকে ছোটাছুটি করতে। 

সুন্দর এ দেশকে খালি চোখে অপলক দৃষ্টিতে চেয়ে দেখবে বলে ও বিশ্বের বুকে বাংলাদেশকে ছড়িয়ে দিতে সাইক্লিং করে যাচ্ছেন অনেকেই। এমনই চার তরুণ-তরুণীকে নিয়ে প্রতিবেদন করেছেন আশরাফুল ইসলাম আকাশ-

নতুন দেশ ও নতুন মানুষ দেখতে চাই: মোহাম্মদ শরীফুল ইসলাম

দেশের সাইক্লিং এর কথা বলতে গেলে প্রথম সারিতে যে ক’জনের নাম ওঠে আসে তাদের একজন মোহাম্মদ শরীফুল ইসলাম। অন্য সবার মতো সুখকর ভাবনা থেকে নয় জীবনের তাগিদে সাইক্লিং পেশায় নিজেকে জড়িয়ে ফেলেন তিনি। কর্মজীবনে স্বল্পমূল্যের সাইকেল দিয়ে চালানো শুরু ও পরবর্তীতে চাহিদা বেড়ে তা রূপ নেয় সাইক্লিংয়ে। নেই কোনো একাডেমিক সার্টিফিকেট তবুও বই পড়া ও গান শোনা তার খুব পছন্দ। একদিন শরীফুলের চোখে পড়ে ‘দেখা হয় নাই চক্ষু মেলিয়া, টেকনাফ থেকে তেঁতুলিয়া’। এই লেখাটি তার এতোই মনে ধরেছিল যে এটা কীভাবে বাস্তবে রূপ দেয়া যায় তা নিয়ে তার চিন্তা শুরু হয়। পরবর্তীতে নানান পরিকল্পনা করে দেশ দেখবে বলে ২০০৮ সালে টেকনাফ থেকে তেঁতুলিয়া সাইকেল চালান শরীফুল। এরপরে টানা দু’বছর নানান অ্যাডভেঞ্চার এর মধ্য দিয়েই সময় পার করে দেন তিনি। 

শরীফুল বিমানে উঠেছেন কিন্তু একা নন সঙ্গে নিয়ে যান তার সাইকেলও। নিজস্ব অর্থায়নে সাইক্লিং করে ঘুরেছেন তিনটি দেশ- শ্রীলঙ্কা (২০১১), মালয়েশিয়া (২০১৬) ও ভারত (২০১৯)। 

সাইক্লিংয়ে নেই কোনো ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা তবুও স্বপ্ন অনেক বড়। এ প্রসঙ্গে শরিফুল বলেন, পৃষ্ঠপোষকতা পেলে হয়তো বিশ্বের নানান প্রান্তে ছুটতে পারতাম, নিজের জ্ঞানের পরিধি বেড়ে যেত। নিজস্ব অর্থায়নে সাইক্লিং করি তাই নির্দিষ্ট সময়ের জন্য অপেক্ষা করতে হয়, তারপরও যদি বলি নতুন দেশ ও নতুন মানুষ দেখতে চাই তাদের সঙ্গে মিশতে চাই।

সাইক্লিং করে দেশের পতাকা নিয়ে বিশ্বের সাতটি মহাদেশেই ঘুরবো: নিয়াজ মোর্শেদ

২০১১ সালে বিডি সাইক্লিস্টের মাধ্যমে উঠে আসেন নিয়াজ মোর্শেদ। সাইকেল ট্যুরিংয়ে নিজেকে প্রমাণ করেছেন দেশসেরা হিসেবে। ইতিমধ্যেই দেশের ৬৪ জেলা সাইকেলে চষে বেড়ানোর পাশাপাশি করেছেন আটবার ক্রস কান্ট্রি। প্রফেশনাল সাইক্লিস্ট না হয়েও প্রথম বাংলাদেশি হিসেবে ২০১৬ সালে একটি আন্তর্জাতিক চ্যারিটি রাইডে অংশ নিয়ে থাইল্যান্ডের শেষ সীমানা থেকে পুরো মালয়েশিয়ার বুক চিরে সিঙ্গাপুর পর্যন্ত চারদিনে সাইকেল চালিয়েছেন ১০০০ কিলোমিটার। কাজ করছেন নতুন সাইক্লিস্টদের পথ নির্দেশক হিসেবে।

নিয়াজ মোর্শেদ জানান, মহানগরের বাইরে এই সুন্দর দেশকে দেখেছি, নানান শ্রেণি-পেশার মানুষের সঙ্গে মিশেছি ও কথা বলেছি। সাইক্লিংয়ের যে জোয়ারটা শুরু হয়েছে এটা যদি সরকারি বা বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের পৃষ্ঠপোষকতা পায় তাহলে আরো অনেক দূর এগিয়ে যাবে। দেশের নানান প্রান্তর ঘুরে দেখেছি এবার আমার সময় ও সুযোগ হলে দ্বীপের দেশ শ্রীলঙ্কা, ইরান, মিসর ও ইউরোপের ‘ভলিস’ রুটটা ঘুরে দেখব। আমার বড় স্বপ্ন সাইক্লিং করে বাংলাদেশের পতাকা মাথায় নিয়ে বিশ্বের সাতটি মহাদেশেই ঘুরবো

স্বাধীন দেশের প্রতিনিধিত্ব করতে চাই:  জিনিয়া তাবাসসুম

লাল-সবুজের নারী সাইক্লিস্টদের একজন হেমন্ত রাইডার্সের জিনিয়া তাবাসসুম। সবার সচেতনতা সৃষ্টিতে ও দেশকে ঘুরে দেখার তাগিদ থেকেই মূলত ২০১৭ সালের ফেব্রুয়ারি থেকে সাইক্লিং শুরু করেন তিনি। টেকনাফ থেকে কক্সবাজার ও আশপাশের তিন পার্বত্য জেলা সাইক্লিং করতে সময় নেন চারদিন আর এটিই ছিল জিনিয়ার প্রথম রাইড। দর্শনা থেকে ঢাকা পর্যন্ত একটানা ২২২ কিলোমিটার সাইক্লিং করেন তিনি। পরে চট্টগ্রাম শহর থেকে ঢাকায় পাড়ি জমালে হেমন্ত রাইডার্সের সাথে নিয়মিত হন। সাইক্লিং করে দেশের প্রায় ৪৬টির মতো জেলা ও চারবার ক্রস কান্ট্রি করেছেন জিনিয়া। পরিবারের বাধা উপেক্ষা করে দেশের বাইরে তিনবারে ঘুরেছেন ভারতের মেঘালয়, দার্জিলিং, মানালি ও খারদুং লাতে।

জিনিয়া জানান, ব্যক্তিগত জীবনের জন্য অনেক কিছুই সম্ভব হয়ে ওঠে না। আপাতত এই জিনিসটাই রাখছি যে এ বছরের মধ্যে দেশের ৬৪টি জেলায় সাইক্লিং করে সম্পন্ন করার। পরে সুযোগ হলে আরেকটি ক্রস কান্ট্রি দেবার ইচ্ছা আছে। বাইরের রাইডগুলোতে যখন যাই, সেখানে অনেক দেশের সাইক্লিস্ট সদস্যরা উপস্থিত থাকেন এবং তাদের অনেকেই জানেন না যে বাংলাদেশ নামক একটি স্বাধীন রাষ্ট্র রয়েছে। ইচ্ছে আছে লাল-সবুজের পতাকা নিয়ে বিশ্বের অন্যান্য রাষ্ট্রগুলোতে সাইকেল নিয়ে ঘুরে বেড়ানো। দেশের পতাকা উড়াতে সবারই ভালো লাগে আর যদি সেটা নিজের হাতে উড়াই সেই অনুভূতিটায় অন্যরকম।

সাইকেল নিয়ে ঘুরতে ভালোবাসি: মেহজাবিন ফেরদৌস প্রভা

ছোটবেলা থেকেই চাইতো কিন্তু পরিবার রক্ষণশীল হওয়াতে সাইকেল চালানো আর হয়ে ওঠেনি প্রভার। তবুও কি ইচ্ছাশক্তি দমে থাকে, বিশ্ববিদ্যালয় জীবনে এসেই সাইকেল চালানো শিখে ফেলেন তিনি। প্রথম অবস্থায় সাইকেল চালাতেন শুধু ঢাকা শহরের জ্যাম ও পয়সা বাঁচানোর জন্য। পরবর্তীতে ইউএপি সাইক্লিস্ট গ্রুপ রেডি করে ঢাকার আশপাশের জেলাগুলোতে ছোট ছোট ট্রিপের মধ্যদিয়ে শুরু হয় তার সাইক্লিং। প্রভার অনেক দিনের চাওয়া দেশটাকে দেখবে কিন্তু তা বাস্তবে রূপ দিতে সময় লেগে যায় আরো কয়েকবছর। পরবর্তীতে একটা রুট প্ল্যানিংয়ের খসরা নিয়ে হাজির হন মোহাম্মদ শরীফুল ইসলামের কাছে। এরপরে শুরু হয় তার ছুটে চলার গল্প। 

২০১৯ সালের ১৫ ফেব্রুয়ারিতে বাংলাবান্ধা জিরো পয়েন্ট থেকে রংপুর-রাজশাহীর বিভাগের ১৬টি জেলার ট্যুর। উত্তরবঙ্গের নানান দর্শনীয় স্থান ঘুরে দেখতে তার সময় লাগে ১৯ দিন। দ্বিতীয় দফায় সাইকেল ট্যুরে ঢাকা, ময়মনসিংহ ও সিলেট বিভাগ মিলে ১৬টি জেলা ১৫ দিনের ব্যবধানে ঘুরে দেখেন।

তিনি জানান, ৬৪টি জেলা ঘুরে দেশের কৃষ্টি, কালচার ও সৌন্দর্য দেখতে চাই। সাইক্লিংয়ে একা একা চলাফেরা খুব বেশি সমস্যার নয় চাইলেই সাইক্লিংয়ে নিয়মিত হওয়া সম্ভব। বাকি ৩২টি জেলা দ্রুতই শেষ করতে চাই। সাইক্লিস্ট শরীফ ভাইয়ের একটি কথা আমাকে খুব বেশি অনুপ্রাণিত করে ‘পথে নামলে, পথ একদিন শেষ হবেই’।

সাম্প্রতিক দেশকাল ইউটিউব চ্যানেল সাবস্ক্রাইব করুন

বিষয় : সাইক্লিং

মন্তব্য করুন

Epaper

সাপ্তাহিক সাম্প্রতিক দেশকাল ই-পেপার পড়তে ক্লিক করুন

Logo

ঠিকানা: ১০/২২ ইকবাল রোড, ব্লক এ, মোহাম্মদপুর, ঢাকা-১২০৭

© 2024 Shampratik Deshkal All Rights Reserved. Design & Developed By Root Soft Bangladesh

// //