দেশের নারী ক্রীড়াবিদদের অগ্রদূত রানী হামিদ

ক্রীড়া ক্ষেত্রে যে ক’জন মানুষ সাফল্যের শীর্ষে উঠে নিজেকে অনুপ্রেরণাময় ব্যক্তিত্বে পরিণত করেছেন, রানী হামিদ তাদের মধ্যে অন্যতম। দেশের নারীরা যখন ঘরের বাইরে পা ফেলার কথা ভাবতেও পারতেন না, তখনই দাবার আন্তর্জাতিক অঙ্গনে বাংলাদেশের বিজ্ঞাপন হয়ে ওঠেন রানী হামিদ। কেবল দাবা খেলেই অর্জন করেছেন বিশ্বজোড়া খ্যাতি। তার জন্ম যেন দাবার জন্যই। তার সময়ে বা তার পরে আরও অনেকেই দাবা খেলেছেন; যাদের অধিকাংশই হারিয়ে গেছেন দাবার জগৎ থেকে; কিন্তু চার দশকের বেশি সময় ধরে তিনি দাবার সাম্রাজ্যে একের পর এক জয় করে চলেছেন। ৭৬ বছর বয়সেও দাবার প্রতি আকর্ষণ বিন্দুমাত্র কমেনি রানী হামিদের। বরং এই বয়সে জাতীয় দাবা চ্যাম্পিয়ন হয়ে গিনেস বুক অব রেকর্ডসে নাম ওঠানোর স্বপ্ন দেখছেন। 

দাবার রানীর শৈশব

রানী হামিদের পুরো নাম সৈয়দ জসিমুন্নেসা খাতুন। ডাক নাম রানী। বিয়ের পর স্বামীর নাম যুক্ত করে হন রানী হামিদ। ক্রীড়াঙ্গনে তিনি এই নামেই পরিচিত। দাবার উজ্জ্বল নক্ষত্র রানী হামিদ তার সাফল্যকে শুধু নিজ দেশের মধ্যে সীমাবদ্ধ রাখেননি। দেশের বাইরেও খুব সম্মানের সঙ্গে উচ্চারিত হয় তার নাম। এক অসাধারণ কৃতিত্ব দেখিয়ে ব্রিটিশ মহিলা দাবায় তিনবার চ্যাম্পিয়ন (১৯৮৩, ১৯৮৫ ও ১৯৮৯ সাল) হবার বিরল কৃতিত্ব অর্জন করেন তিনি। সেই সঙ্গে উপমহাদেশের সেকালের বিশ্বখ্যাত দাবা খেলোয়াড় গ্রেট মীর সুলতান খানের ত্রিশ দশকের রেকর্ডটিও স্পর্শ করেন। এ ছাড়া ব্রিটিশ মহিলা চ্যাম্পিয়নশিপে তিনবার, লয়েড ব্যাঙ্ক মাস্টার্স দাবায় একবার ও বিশ্বদাবা জোনাল চ্যাম্পিয়নশিপে একবার রানার্স আপ হবার কৃতিত্ব দেখান। শহীদ মুফতি কাসেদ আন্তর্জাতিক দাবা, সার্ক এয়ারলাইন্স দাবা ও এশিয়ান সিটি চেস চ্যাম্পিয়নশিপে চ্যাম্পিয়ন হবার কৃতিত্ব দেখান। ১৯৮৪ সালে আন্তর্জাতিক দাবা ফেডারেশন থেকে ‘ফিদে’ খেতাব অর্জন করেন তিনি।

অসাধারণ এই প্রতিভাবান নারীর জন্ম ১৯৪৪ সালে সিলেট জেলায়। বাবার চাকরির সুবাদে শৈশব কেটেছে বিভিন্ন জেলায়। ছোটবেলায় সারাগ্রাম ঘুরে বেড়ানো, কাঁচা আম খাওয়া, ভাই-বোনদের সঙ্গে দুষ্টুমি করা এখনো ভুলতে পারেননি। সেসব স্মৃতি তাঁকে এখনো শৈশবে ফিরিয়ে নিয়ে যায়। নিজের অজান্তে হারিয়ে যান গ্রামের পথে-প্রান্তরে। ছোটবেলা থেকে দাবার বোর্ডের দিকে খুব ঝোঁক ছিল রানী হামিদের। ঝোঁকটা আরও বেড়ে যায় যখন দেখেন, বাবা সৈয়দ মমতাজ আলী প্রতি সন্ধ্যায় বন্ধুদের নিয়ে দাবা খেলতেন। স্কুলজীবনে ভালো ব্যাডমিন্টন খেলোয়াড় ও অ্যাথলেট হওয়া সত্ত্বেও দাবাই ছিল রানীর প্রধান ভালোবাসা। বাবার চাকরির সুবাদে চট্টগ্রাম নন্দনকানন গার্লস হাইস্কুলে একাডেমিক পড়াশোনা শুরু। এরপর কুমিল্লায় মিশনারি গার্লস হাইস্কুলে এক বছর, ফয়জুন্নেসা গার্লস হাইস্কুলে সপ্তম শ্রেণি পর্যন্ত পড়েন। তার বাবার পোস্টিং রাজশাহী সারদায় হলে সেখানে চলে যান। সেখানে মেয়েদের কোনো আলাদা স্কুল না থাকায় রাজশাহী জেলা স্কুল থেকে বিশেষ অনুরোধে ম্যাট্রিক পরীক্ষায় অংশ নিয়ে সফলতা পান।

তার জীবনের একটি অন্যতম গর্বের বিষয় রাষ্ট্রভাষা বাংলার দাবিতে আন্দোলনের মিছিলে অংশগ্রহণ। যদিও সে সময় এসব বোঝার মতো বয়স ছিল না তার। ১৯৫২ সালে তিনি সরাসরি দ্বিতীয় শ্রেণিতে ভর্তি হয়েছিলেন। সে সময় প্রায়ই স্কুলের ওপরের শ্রেণির ছাত্রীরা তাদের মিছিলে ডেকে নিয়ে যেতেন, তবে রানী হামিদ বুঝতে পারতেন না কিসের মিছিল। পরে জানতে পারেন, তা ছিল রাষ্ট্রভাষা বাংলার দাবিতে আন্দোলনের মিছিল। তিনিও ঐতিহাসিক ভাষা আন্দোলনের একজন অংশগ্রহণকারী, এ অনুভূতি তাকে সবসময় নাড়া দেয়। সেই সব মিছিলে অংশগ্রহণ করতে পেরেছিলেন বলে এখন তিনি গর্ব বোধ করেন। সে সময় মুসলিম পরিবারে মেয়েদের শিক্ষার সুযোগ আজকের মতো ছিল না। লেখাপড়ার প্রতি আগ্রহ থাকায় প্রতিকূল সময় ও পরিবেশ কাটিয়ে রানী হামিদের গ্র্যাজুয়েশন ডিগ্রি অর্জন করা সম্ভব হয়েছে। এক্ষেত্রেও আজকের নারীমুক্তি আন্দোলনের নারীদের জন্য রানী হামিদ এক উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত। 

শৈশবের স্মৃতিচারণ করতে গিয়ে রানীর মনে ভেসে ওঠে-স্কুলের স্পোর্টসের সময় প্রত্যেক খেলায় আগে গিয়ে নাম লেখাতেন। শৈশবে তিনি দৌড়ে খুব ভালো ছিলেন। দৌড়সহ অন্যান্য প্রতিযোগিতায় অংশগ্রহণ করে প্রথম হওয়া ছিল স্বাভাবিক বিষয়। সেসময় স্কুলের খেলাধুলায় জগ, গ্লাস, প্লেট, তোয়ালে ইত্যাদি পুরস্কার হিসেবে দেওয়া হতো। রানী হামিদ বলেন, ‘স্কুলের প্রতিযোগিতায় অংশগ্রহণ করে পুরস্কার হিসেবে এত টাওয়াল বাড়িতে জমেছিল যে মা বলতেন, তোর বিয়ের সময় টাওয়াল কেনা দরকার হবে না। শ্বশুরবাড়িতেও এসব টাওয়াল নিয়ে যেতে পারবি। সত্যিই বিয়ের সময় টাওয়াল কেনার প্রয়োজন হয়নি। আমার মনে আছে আমি অনেক টাওয়াল শ্বশুরবাড়ি নিয়ে এসেছিলাম।’ 

তিনি যখন কুমিল্লা কলেজের ছাত্রী, তখন তার শিক্ষকদের খুব আগ্রহ ছিল যেন তিনি জাতীয় পর্যায়ে দৌড় প্রতিযোগিতায় অংশগ্রহণ করেন। সুযোগ পেলে তিনি হয়তো একজন নামকরা অ্যাথলেট হতে পারতেন; কিন্তু পরিবারের মেয়ে দৌড়ানোর জন্য ঘরের বাইরে যাবে, এটা তার বাবা মায়ের পছন্দ ছিল না। পরিবারের অনুমতি না পাওয়ার কারণে তিনি দৌড়বিদ হওয়ার সুযোগ হারিয়েছেন। রানী হামিদের বাড়িতে দাবা ও টেনিস খেলার চর্চা ছিল। বিশেষ করে এ দুটি খেলার প্রতি তার বাবার ছিল বিশেষ আগ্রহ। বাবার আগ্রহ থেকেই রানী হামিদের দাবার প্রতি আগ্রহ সৃষ্টি হয়। সুযোগ পেলেই তিনি ছোট ভাইয়ের সঙ্গে দাবা খেলতেন। সব সময় দাবা খেলা যেত না। বিশেষ করে বাবা যখন বাড়িতে থাকতেন না তখন রানী ভাইদের সঙ্গে দাবা খেলতেন। সব সময় দাবা খেলা বাবা মা পছন্দ করতেন না। দাবা খেলার প্রতি আগ্রহ থাকলেও পর্দাপ্রথা ও সামাজিক দৃষ্টিভঙ্গির কারণে বিয়ের আগে রানী দাবা খেলার জন্য বেশিদূর অগ্রসর হতে পারেননি। 

বিয়েই টানিং পয়েন্ট

তখন আইয়ুব খানের মার্শাল ল চলছিল। পরিস্থিতি অনুকূলে না থাকা সত্ত্বেও বিয়ের প্রস্তাব আসতে শুরু করলে বাবা তার বিয়ে দেন। দশম শ্রেণিতে পড়া অবস্থায় শুরু হয় জীবনের নতুন অধ্যায়। ১৯৫৯ সালে তিনি সেনাবাহিনীর তৎকালীন ক্রীড়াবিদ ক্যাপ্টেন আবদুল হামিদের সঙ্গে পরিণয় সূত্রে আবদ্ধ হন। স্বামী ক্রীড়াবিদ হওয়ায় দাবা খেলার ব্যাপারে সব ধরনের সহযোগিতা পান তার কাছ থেকে। মূলত রানী পেশাদারি দাবা খেলা শুরু করেন বিয়ের পরে। তখন তিনি পাকা গৃহিণী। সংসারে আসে নতুন অতিথি। মুক্তিযুদ্ধ-পরবর্তী সময়ে তারা পাকিস্তানের পেশোয়ারে আটকে গিয়েছিলেন। ১৯৭১ সালের অক্টোবরের দিকে তার স্বামীর এক বন্ধুর সহযোগিতায় ভারতে আসেন। সেখান থেকে দেশ স্বাধীন হবার পর ১৯৭২ সালে জানুয়ারির শেষ দিকে ঢাকা সেনানিবাসে আসেন রানী। তারপর সেনানিবাস থেকেই প্রাইভেটে ইডেন কলেজ থেকে সফলতার সঙ্গে ইন্টারমিডিয়েট পাস করেন। সেখান থেকে বিএ ডিগ্রি শেষ করেন। ভেবেছিলেন মাস্টার্সও শেষ করবেন; কিন্তু আটকে গেলেন দাবার প্রতি ভালো লাগা, ভালোবাসায়। তাই সেখানেই শেষ হয়েছিল তার একাডেমিক পড়াশোনার অধ্যায়।

খেলাধুলার প্রতি তার স্বামীর আগ্রহ ও উৎসাহ থাকায় তিনি দাবা খেলার প্রতি জোর দেন। রানী বলেন, ‘আমাদের সময় প্রিন্ট ও ইলেকট্রনিক মিডিয়ার এত সহজলভ্যতা ছিল না। এ জন্য দাবা বিষয়ে কোনো তথ্য জানা খুব কঠিন ছিল। তাছাড়া দাবার বই বা কোচিং দেওয়ার মতো কাউকে পাওয়া যেত না; কিন্তু আমার স্বামী আব্দুল হামিদ প্রতিকূল পরিবেশ কাটিয়ে আমাকে দাবা অনুশীলনের সুযোগ করে দিয়েছেন। বিয়ের পর স্বামীর অনুপ্রেরণায় আমি দাবাড়ু হিসেবে খ্যাতি অর্জন করতে পেরেছি। তিনি সহযোগিতা ও সুযোগ তৈরি করে না দিলে হয়তো আমাকে আজকের স্থানে আসতে অনেক কষ্ট করতে হতো। এ জন্য আমি আমার স্বামী আব্দুল হামিদের প্রতি কৃতজ্ঞ।’ 

তিনবার ব্রিটিশ মহিলা দাবা প্রতিযোগিতায় চ্যাম্পিয়ন রানী হামিদ নিজের পুরনো দিনগুলোর কথা মনে করে রোমাঞ্চিত হন। ব্রিটিশ মহিলা দাবায় চ্যাম্পিয়ন হওয়ার স্মৃতি রোমন্থন করতে গিয়ে তিনি বলেন, ‘এই অনুভূতি ভাষায় প্রকাশ করার মতো নয়। অনেক বেশি খুশি লেগেছিল সেদিন। ব্রিটিশরা আমাদের অনেকদিন শাসন করেছে। সেই ব্রিটিশদের হারিয়েই আমি চ্যাম্পিয়ন হয়েছিলাম। তারপর আরও দু’বার ব্রিটিশ মহিলা ওপেনে চ্যাম্পিয়ন হয়েছি; কিন্তু প্রথমবারের জয়ের অনুভূতি কখনো ভোলার নয়। আর আন্তর্জাতিক মাস্টারের প্রথম নর্ম পাওয়ার মুহূর্তটিও আমার কাছে ছিল বিশেষ আনন্দের। আমার জানাই ছিল না, আমি নর্ম পেয়েছি।’ 

তিনি জাতীয় মহিলা দাবায় ১৮ বার চ্যাম্পিয়ন হন। যদিও ১৯৭৭, ১৯৭৮ ও ১৯৭৯ সালে আরও তিনবার জাতীয় মহিলা দাবায় জিতেন তিনি; কিন্তু তখন রেকর্ড রাখা হতো না। 

ক্রীড়াবান্ধব পরিবার

তার বাবা ও স্বামী উভয়ের সংসারই ক্রীড়াবান্ধব। স্বামী লে. কর্নেল (অব.) আবদুল হামিদ ছিলেন এ দেশের হ্যান্ডবলের পথিকৃৎ। বড় ছেলে কায়সার হামিদ জাতীয় ফুটবল দলে খেলেছেন। মেজ ছেলে সোহেল হামিদ স্কোয়াশ, হ্যান্ডবল, ক্রিকেট ও ফুটবল খেলেছেন। এখন তিনি স্কোয়াশ অ্যান্ড র‌্যাকেটস ফেডারেশনের সাধারণ সম্পাদক। ছোট ছেলে শাহজাহান হামিদ ববি জাতীয় হ্যান্ডবল দলের সাবেক খেলোয়াড়। মেয়ে জেবিন হামিদ দাবা খেলেছেন। মজার ব্যাপার হচ্ছে তিনি নিজে, তার স্বামী এবং ছেলে প্রত্যেকেই জাতীয় পুরস্কারপ্রাপ্ত ক্রীড়াবিদ। 

১৯৭৭ সাল থেকে এই পর্যন্ত সব ধরনের প্রতিযোগিতামূলক আসরে অংশ নিয়ে আসছেন রানী হামিদ। শুরুতে তিনি খুব অ্যাটাকিং খেলোয়াড় ছিলেন। পরে পজিশনাল খেলার দিকে নজর দেন। তিনি ‘মজার খেলা দাবা’ ও ‘দাবা খেলার আইন কানুন’ নামে দুটি বই লিখেছেন। 

যেভাবে দাবা খেলার শুরু

১৯৭৪/৭৫ সালে ঢাকা সেনানিবাসের কোয়ার্টারে থাকার সময় রানী হামিদ জাতীয় দাবা চ্যাম্পিয়ন ড. আকমল হোসেনের প্রতিবেশী ছিলেন। তার সহযোগিতায় তিনি ১৯৭৬ সালে প্রথম মহসিন দাবা প্রতিযোগিতায় অংশগ্রহণ করেন। তার সঙ্গে ঢাকা মেডিক্যাল কলেজের ছাত্রী দীপ্তি ও বীথিসহ কয়েকজন নারী দাবা খেলায় অংশগ্রহণ করেছিলেন। ১৯৭৭ সালে ‘নবদিগন্ত সংসদ’ দাবা ফেডারেশনের সহযোগিতায় নারীদের জন্য প্রথমবারের মতো আলাদাভাবে দাবা প্রতিযোগিতার আয়োজন করে। এই অয়োজন ৭৮ ও ৭৯ সালেও করা হয়। তিনবারই রানী হামিদ চ্যাম্পিয়ন হন। ১৯৭৯ সালে ঢাকায় উন্মুক্ত দাবা প্রতিযোগিতায় অংশগ্রহণ করে রানী হামিদ চ্যাম্পিয়ন হন। অর্থাৎ, একই বছর তিনি দু’বার চ্যাম্পিয়ন হন। এরপর থেকে আর পেছন ফিরে তাকাতে হয়নি। একের পর এক জাতীয় ও আন্তর্জাতিক প্রতিযোগিতায় অংশগ্রহণ এবং কৃতিত্ব অর্জন করেন। আন্তর্জাতিক মানের কোনো কোচিং ও অভিজ্ঞতা ছাড়াই প্রথমবারের মতো তিনি ১৯৮১ সালে ভারতের হায়দারাবাদে প্রথম এশীয় চ্যাম্পিয়নশিপে অংশগ্রহণ করে সুনাম অর্জন করেন। তিনি কমনওয়েলথ এর একজন শীর্ষ দাবা খেলোয়াড়, আন্তর্জাতিক মহিলা মাস্টার, জাতীয় ব্রিটিশ নারী দাবা চ্যাম্পিয়ন। এ পর্যন্ত তিনবার ব্রিটিশ নারী দাবা চ্যাম্পিয়ন হবার গৌরব অর্জন করেছেন রানী হামিদ। এই গৌরব অর্জন বাঙালি নারীদের জন্য এখন অসম্ভব হয়ে পড়েছে। কারণ ব্রিটিশ মহিলা দাবা খেলোয়াড়রা যখন বাঙালি নারী রানী হামিদের কাছে পরাজিত হচ্ছিলেন তখন তাদের মধ্যে সম্ভবত এক ধরনের হীনম্মন্যতাবোধ কাজ করে। তারা দাবি তোলেন, ব্রিটিশ মহিলা জাতীয় চ্যাম্পিয়নশিপে অন্যদেশের নারীরা খেলতে পারবে না। পরে অন্যদেশের নারীদের ব্রিটিশ জাতীয় চ্যাম্পিয়নশিপে খেলা বন্ধ করে দেওয়া হয়। এখন শুধু ব্রিটিশ নারীরা খেলে এবং তারাই চ্যাম্পিয়ন হয়। তবে রানী হামিদ তিনবার ব্রিটিশ ওমেন দাবা চ্যাম্পিয়ন হয়ে গর্বিত। এই গর্ব বাংলাদেশেরও। রানী হামিদ দাবা অলিম্পিয়াডে ৫ম মহিলা, যিনি যোগ্যতার ভিত্তিতে অলিম্পিয়াডে জাতীয় পুরুষ দলের হয়ে খেলেছেন। 

দাবার বাইরের জগত

খেলা শুরুর আগে গল্পের বই, উপন্যাসের খুব নেশা ছিল তার। অবসর সময় কাটতো বইয়ের সঙ্গে। বিভিন্ন শিল্পীদের হিট গানগুলো উপভোগ করতেন ভীষণ। আর্মি এরিয়ায় থাকলেও খুব বেশি বাইরে যাওয়ার সুযোগ ছিল না তার, তবে দলবেঁধে বিভিন্ন সময় সিনেমায় যেতেন। স্টেডিয়ামে খেলা দেখতে যেতেন। পরিবারের সঙ্গে অনেক ভালো সময় কাটানোর কথা এভাবেই বললেন দেশ সেরা দাবা খেলোয়াড় রানী হামিদ। তিনি আরও বলেন, পরে দাবার নেশা আমাকে বেরসিক করে দিয়েছে। কোনো অবসর ছিল না। খেলা শুরুর পর, সবকিছু হয়েছে পর।

তিনি যখন ফিদে আন্তর্জাতিক মহিলা মাস্টার হন, তখন আমাদের অনেকের জন্মই হয়নি; কিন্তু এখনো তার চাল-চলন আর জীবনযাত্রা যেন বয়সকে হার মানায় প্রতিদিন। এই বয়সেও দুর্দান্ত স্মার্ট রানী হামিদ। অনেকেই তার রূপের রহস্য নিয়ে নানা সময় নানা প্রশ্ন করেছেন; কিন্তু তার কাছে স্বাচ্ছন্দ্যে পরিপাটি চলাচল করাই ফ্যাশন। একটা ব্যাপারে তিনি খুবই সচেতন। আর সেটা হলো শাড়ির সঙ্গে ব্যাগ ও জুতা সব সময় ম্যাচিং করে পরা। শাড়ি খুবই প্রিয় পোশাক রানী হামিদের। সুযোগ পেলেই শাড়ি কেনেন। শাড়ির বিশাল সংগ্রহ রয়েছে তার। আর হালকা ধরনের গয়না তার বরাবরের মতো পছন্দ। অল্প বয়সের স্মৃতিচারণ করতে গিয়ে বললেন, অল্প বয়সে চুলে দুই বেণি করতেই স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করেন। বিয়ের পর নায়িকা শবনমের একটা খোঁপার স্টাইল খুব ভালো লেগেছিল তার, তখন ওই খোঁপাটাই করতেন চুলে। তবে স্বামী প্রয়াত কর্নেল এম এ হামিদের পছন্দ ছিল খোলা চুল। তাই তার সঙ্গে বের হলে চুল খোলা রাখার চেষ্টাই করতেন সবসময়। মজার ব্যাপার হচ্ছে, রানী হামিদের লাইফস্টাইলে তার স্বামীর ভূমিকা অনেক বেশি। তিনি নিজেও স্বামীর পছন্দ-অপছন্দকে বেশ প্রাধান্য দিতেন।

খেলা ও সংসার দুটি স্বতন্ত্র কর্মক্ষেত্রে তিনি একজন সফল নারী। তিনি সন্তানদের সুশিক্ষা দিয়েছেন। সন্তানরা তার পেশা গ্রহণ করেননি বলে কোনো দুঃখবোধ নেই। বরং যার যার পছন্দ অনুযায়ী নিজেদেরটা বেছে নেওয়াতেই তিনি বেশি খুশি। মেয়েদের পারিবারিক ও সামাজিক জীবনে সেকালের চেয়ে একালকে ভালো মনে করেন রানী হামিদ। কারণ, এখন সন্তানদের ব্যাপারে বাবার চেয়ে মা বেশি সচেতন। যে বিষয়ে সন্তানদের আগ্রহ তাকে প্রাধান্য দিয়ে তাদের উৎসাহিত করেন মা। সেকালে মায়েরা সন্তানের প্রতি খেয়াল রাখতে পারতেন না। সাংসারিক পরিবেশ এমন ছিল, মতামত ব্যক্ত করার ক্ষমতাও তাদের ছিল না। গৃহকর্তা যা বলতেন তা-ই মানতে বাধ্য হতেন তারা। তবে আমাদের দেশে আজও নারীরা বৈষম্যের শিকার বলে মনে করেন তিনি। রানী হামিদ মনে করেন, এ বৈষম্য বেশি দিন থাকবে না। দরকার কেবল মানসিকতার পরিবর্তন।

দেশের নারী দাবাড়ুদের নিয়ে রানী হামিদের আক্ষেপ রয়েছে এখনো। তিনি মনে করেন নারীরা বিভিন্ন সেক্টরে পুরুষদের সমানতালে কাজ করলেও এখনো আমরা পিছিয়ে আছি। যার অন্যতম উদাহরণ হতে পারে আমাদের দাবায়। দাবা খেলার প্রতি নারীদের আগ্রহ তেমন নেই। যে ক’জন নারী দাবা খেলোয়াড় রয়েছেন, তাদের নামও সাধারণ মানুষ জানেন না। এটা অনেক বড় একটা শূন্যতা বলে মনে করেন তিনি। এই শূন্যতার পেছনে তিনি সরকারি পৃষ্ঠপোষকতার অভাবকে দায়ী বলে মনে করেন। তিনি বলেন, ‘অন্যান্য খেলাকে যেমন সরকার থেকে সহযোগিতা করা হয়, আমাদের দাবা ততটাই অবহেলিত। এখন দাবা প্রতিযোগিতা খুব কম হয়। প্রযুক্তির সঙ্গে পাল্লা দিয়ে দেশ উন্নতির দিকে এগোলেও অভিভাবকদের মনমানসিকতারও তেমন প্রভাব পড়েনি।’ তিনি আক্ষেপ করে বলেন, আমি যখন খেলা শুরু করি তখন আমার স্বামী আমাকে যে সাপোর্ট দিয়েছিল, আজ এত বছর পরে এসেও স্বামী তো দূরের কথা মেয়েরা বাবা-মায়ের কাছেও দাবা খেলার জন্য এরকম সহযোগিতা পাচ্ছে না। তাহলে দীর্ঘ এই সময়টাতে প্রতিটি ক্ষেত্রেই নারীর অগ্রযাত্রায় এই চ্যালেঞ্জটা থেকেই গেল। এই চ্যালেঞ্জগুলো কাটিয়ে উঠতে সরকারি পৃষ্ঠপোষকতা খুবই জরুরি। দেশে অনেক মেধাবী নারী দাবাড়ু রয়েছেন। তাদের খেলার জন্য স্পেস এবং পরিবেশ দিতে হবে। আর না হলে দাবায় নারীর স্বতঃস্ফূর্ত অংশগ্রহণের আগ্রহ কমে যাবে।  

সাম্প্রতিক দেশকাল ইউটিউব চ্যানেল সাবস্ক্রাইব করুন

মন্তব্য করুন

Epaper

সাপ্তাহিক সাম্প্রতিক দেশকাল ই-পেপার পড়তে ক্লিক করুন

Logo

ঠিকানা: ১০/২২ ইকবাল রোড, ব্লক এ, মোহাম্মদপুর, ঢাকা-১২০৭

© 2024 Shampratik Deshkal All Rights Reserved. Design & Developed By Root Soft Bangladesh

// //