ফুটবলের ‘রাজা’ শুধুই পেলে

২০২২ সাল শেষ হলো ফুটবলের রাজা পেলের মহাপ্রয়াণে। এডসন আরান্তেস দো ন্যাসিমেন্তো নামের মানুষটিকেই সবাই পেলে নামে চিনত। গত ২৯ ডিসেম্বর ক্যান্সারের কাছে হার মেনে ব্রাজিলের সাও পাওলোর আলবার্ট আইনস্টাইন হাসপাতালে ৮২ বছর বয়সে শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন তিনি।

বিশ্ব ফুটবলের ইতিহাসে অন্যতম সৌভাগ্যবান খেলোয়াড় পেলে। বিশ্ব ফুটবলের শাসক সংস্থা ফিফার বিবেচনায় ‘প্লেয়ার অব দ্য সেঞ্চুরি’ও তিনি। তার নামের সঙ্গে যুক্ত আছে ‘ফুটবলের রাজা’ বিশেষণ। ইতিহাসের একমাত্র ফুটবলার হিসেবে পেলের রয়েছে ১৯৫৮, ১৯৬২ আর ১৯৭০ সালে বিশ্বকাপ জয়ের অনন্য রেকর্ড। ১৯৫৮ সালে ১৮ বছর পূর্ণ হওয়ার আগেই পেয়েছিলেন বিশ্বকাপের সেরা উদীয়মান তারকার পুরস্কার।

সুইডেনে অনুষ্ঠিত সেই আসরের সেমিফাইনালে সবচেয়ে কম বয়সে হ্যাটট্রিক আর ফাইনালে জোড়া গোল করেন তিনি, যে রেকর্ড এখনো অক্ষুণ্ন। ১৯৭০ সালে জিতেছেন ‘গোল্ডেন বল’। মেক্সিকোয় অনুষ্ঠিত সেই আসরে পেলে নিজে করেন চারটি গোল আর ৫৩% গোলে ছিল তার অবদান। ১৯৭০ সালের বিশ্বকাপ ‘পেলের বিশ্বকাপ’ হিসেবেই পরিচিত।

‘ফুটবলের রাজা’ পেলে ১৯৪০ সালের ২৩ অক্টোবর (যদিও সনদে লেখা ২১ অক্টোবর) ব্রাজিলের দক্ষিণ-পূর্বাঞ্চলীয় শহর ট্রেস কোরাকোসে জন্মগ্রহণ করেন। হতদরিদ্র পরিবারে জন্ম নেওয়া পেলে ছোটবেলায় স্থানীয় রেস্তোরাঁয় কাজ করে পরিবারকে সহায়তা করেছেন। বাবার কাছে ফুটবলে হাতেখড়ি। পেলে বড় হয়েছেন কাপড়ের দলা পেঁচিয়ে বানানো বলে খেলে। কিন্তু কোনো প্রতিকূলতাই ঈশ্বরপ্রদত্ত প্রতিভার অধিকারী পেলের ফুটবল ‘রাজত্ব’ দখলে বাধা হয়ে দাঁড়াতে পারেনি। 

১৯৫৬ সালে ১৬ বছর পেরানোর আগেই ব্রাজিলের বিখ্যাত সান্তোস ক্লাবে পেলের অভিষেক। খেলেছেন টানা ১৯৭৪ সাল পর্যন্ত। জাতীয় দলে পেলের অভিষেক ১৯৫৭ সালের ৭ জুলাই আর্জেন্টিনার বিপক্ষে। চিরপ্রতিপক্ষের বিপক্ষে ব্রাজিল ম্যাচ হেরে যায় ১-২ গোলে। কিন্তু সেই ম্যাচেই পেলে ১৬ বছর ৯ মাস বয়সে গোল করে অর্জন করেন আন্তর্জাতিক অঙ্গনের সর্বকনিষ্ঠ গোলদাতার রেকর্ড।

নিজ দেশের ক্লাব সান্তোস ছাড়া পেলে ক্যারিয়ারের শেষ তিনটি মৌসুম খেলেছেন যুক্তরাষ্ট্রের কসমস ক্লাবে। সান্তোসের জার্সিতে সব প্রতিযোগিতা মিলিয়ে তার গোলের সংখ্যা ৬৫৬ ম্যাচে ৬৪৩টি। আর শেষ তিন বছর কসমস ক্লাবের হয়ে ১০৭ ম্যাচে আছে ৬৪ গোল। জাতীয় দলের হয়ে ১৯৫৭ থেকে ১৯৭১ পর্যন্ত ৯২ ম্যাচে ৭৭ গোল করেছেন পেলে। সব মিলিয়ে ক্যারিয়ারে পেলের গোলের সংখ্যা ৭৮৪টি।

অনেকেই বলে থাকেন, পেলে কখনো ইউরোপে খেলেননি। সেই কারণে ভূরি ভূরি গোলের দেখা পেয়েছেন। কিন্তু পেলের ক্যারিয়ার পরিসংখ্যান দিয়েই তথ্যটি ভুল প্রমাণ করা যায়। পেলে তার ক্যারিয়ারে দুটি ইন্টারকন্টিনেন্টাল কাপ জিতেছেন। যা অনুষ্ঠিত হতো ল্যাটিন আর ইউরোপের সেরা ক্লাবের মধ্যে।

১৯৬২ সালের ইন্টারকন্টিনেন্টাল কাপে সান্টোসের প্রতিপক্ষ ছিল পর্তুগালের বেনফিকা। সেখানে দুই লেগের ম্যাচে পেলে করেন পাঁচ গোল। দ্বিতীয় লেগে বেনফিকাকে ৫-২ গোলে হারায় সান্তোস। লিসবনে অনুষ্ঠিত সেই ম্যাচে হ্যাটট্রিক করেন পেলে। যা ছিল তার ক্যারিয়ারের অন্যতম সেরা পারফর্ম্যান্স।

মূলত এই ম্যাচের পরেই ইউরোপে দর্শকদের কাছে সুপারস্টার বনে যান পেলে। পরের বছর একই আসরে ইতালির মিলানের বিপক্ষেও দুই লেগে চার গোল করেন পেলে। অর্থাৎ তিনি যখনই ইউরোপের মাটিতে ইউরোপিয়ান ক্লাবের বিপক্ষে খেলেছেন তখনই জ্বলে উঠেছেন।

পেলের অবদানকে খাটো করার জন্য অনেকেই তর্ক জুড়ে দেয় হালের ‘ব্যালন ডি’অর’ কিংবা ফিফা বর্ষসেরা পুরস্কারের প্রশ্নে। অথচ পেলের সময়ে ব্যালন দেওয়া হতো ইউরোপের খেলোয়াড়দের। আর ফিফা বর্ষসেরার তো প্রচলনই হয়নি তখন। ২০১৬ সালে খোদ ব্যালন কর্তৃপক্ষ ঘোষণা দেয়, শুরু থেকে আন্তর্জাতিক পর্যায়ে দেওয়া হলে পেলের নামের পাশে কমপক্ষে সাতটি ব্যালন থাকত।

ফ্রান্স সাময়িকীর হিসেবে ১৯৫৮, ১৯৫৯, ১৯৬০, ১৯৬১, ১৯৬৩, ১৯৬৪ ও ১৯৭০ সালে ব্যালন ডি’অর জিততেন পেলে। ফ্রান্স ফুটবল, এমনকি একটি ম্যাগাজিনের প্রচ্ছদও ছাপিয়েছে যেখানে ব্যালন ডি’অরের সঙ্গে পেলেকে দেখা যাচ্ছে এবং হেডলাইনে লেখা, ‘পেলে ৭ ব্যালন ডি’অর।’ 

পেলে ইউরোপে খেলুন না খেলুন, ফুটবলে তার শ্রেষ্ঠত্ব নিয়ে প্রশ্ন তোলা অর্থহীন। এক সময় দিয়াগো ম্যারাডোনা কিংবা হালের লিওনেল মেসি আর ক্রিশ্চিয়ানো রোনালদোরা পেলের অনেক রেকর্ডে ভাগ বসিয়েছেন। কেউ হয়েছেন আর্জেন্টাইন ফুটবল ঈশ্বর, কেউ আর্জেন্টিনার খুদে জাদুকর আবার কেউ পর্তুগিজ যুবরাজ।

কিন্তু ‘ফুটবলের রাজা’ হিসেবে সিংহাসনে আসীন ছিলেন একজন, তিনি কালো মানিক পেলে। ফুটবলের যে কোনো ইতিহাস রচনা করতে পেলের নাম সবার আগে উচ্চারণ করতে হবে, বাকিদের নাম আসবে পর্যায়ক্রমে। হ্যাঁ, এটাই ফুটবল নামক পৃথিবীর সবচেয়ে জনপ্রিয় খেলার ‘ধ্রুবসত্য’।

সাম্প্রতিক দেশকাল ইউটিউব চ্যানেল সাবস্ক্রাইব করুন

মন্তব্য করুন

Epaper

সাপ্তাহিক সাম্প্রতিক দেশকাল ই-পেপার পড়তে ক্লিক করুন

Logo

ঠিকানা: ১০/২২ ইকবাল রোড, ব্লক এ, মোহাম্মদপুর, ঢাকা-১২০৭

© 2024 Shampratik Deshkal All Rights Reserved. Design & Developed By Root Soft Bangladesh

// //