পুরো নাম হাজি মো. ফজলুল ইসলাম; কিন্তু এ নামে তাকে কয়জন চেনেন। তাকে বরং সবাই চেনেন ‘ওস্তাদ ফজলু’ নামে। বাংলাদেশের হকিতে যার পরিচিতি একনামে। ‘ওস্তাদ ফজলু’-এর জনপ্রিয়তার নিচে ঢাকা পড়েছে ‘ফজলুল ইসলাম’। পুরোদস্তুর একজন হকি অন্তঃপ্রাণ মানুষ। স্টিক আর বল সেই যে ছোটবেলায় ভালোবেসেছিলেন, ছাড়তে পারেননি বয়স পঞ্চাশ পেরিয়ে যাওয়ার পরও। হকির জন্য নীরবেই কাজ করে যাচ্ছেন পুরান ঢাকার এই কোচ। এ মানুষটিকে যেন বাঁচিয়ে রেখেছে হকি।
এশিয়া কাপে বাংলাদেশ হকি দলের অপরিহার্য চার খেলোয়াড় রাসেল মাহমুদ জিমি (অধিনায়ক), নাঈম উদ্দিন, মো. আরশাদ ও ইমরান হাসান। ওস্তাদ ফজলুর হাত ধরেই জাতীয় দলের জার্সি গায়ে চাপিয়েছেন তারা। তবে শুধু এই চারজনই নন, ফজলুর হাত ধরে জাতীয় দল ও যুব দলে নাম লিখিয়েছেন ২০ জনের মতো খেলোয়াড়। তাদের মধ্যে রফিকুল ইসলাম কামাল, মাকসুদ আলম হাবুল, আবদুস সাজ্জাদ রয়েছেন। রফিকুল ইসলাম কামাল বর্তমান এশিয়া কাপ হকি দলের ম্যানেজার।
ওস্তাদ ফজলুর সকাল শুরু হয় হকি দিয়ে, আবার মধ্যরাতে ঘুমাতে যান হকির কথা চিন্তা করে। পুরান ঢাকার বেগম বাজারের গলি পেরিয়ে সামনে এগোতেই ‘ওস্তাদ ফজলু’র বাড়ি। একেবারে ছিমছাম আর সাদামাটা মানুষের মতোই তার গোলাপি রঙের বাড়িটি। দেয়ালে দেয়ালে সাজানো রয়েছে খেলোয়াড়ি জীবন থেকে শুরু করে প্রথম জীবনের ক্যারিয়ারে পাওয়া সাফল্যের স্মারকগুলো। এখানকার ৮ নম্বর নাবালক মিয়া লেনে তার পরিচিতি একটু বেশি। সব বয়সের মানুষের কাছেই তার পরিচিতি ‘ওস্তাদ’ হিসেবে। বাড়িতে পুরান ঢাকার ঐতিহ্য অনেকটাই ধরে রাখা হয়েছে। তবে তিনতলার ছাদে গেলে অনেকটা হতচকিত হওয়ার মতো অবস্থা হবে সবার। বাড়ির ছাদে শখ করে সবাই বাগান করে; কিন্তু তিনি করেছেন হকির আস্ত একটি মাঠ! যাদের শেখাচ্ছেন তাদের একরকম বিনা পয়সায় হকি খেলার হাতেখড়ি দিচ্ছেন তিনি। নিজের ‘ছাদ হকি’তে বসেই জীবনের নানা অজানা গল্প শুনিয়েছেন এই প্রতিবেদককে।
যেভাবে হকি খেলা শুরু
পুরান ঢাকার আরমানিটোলার নাবালক মিয়া লেনে জন্ম নেওয়া ‘ওস্তাদ ফজলু’রা পাঁচ ভাই-বোন। অবস্থানগত দিক থেকে সবার ছোট তিনি। বয়স এখন ৫০ ছুঁই ছুঁই। আজকের এই অবস্থানে আসার পেছনে তিনি বারবারই বলেন, আব্দুর রাজ্জাক সোনা মিয়ার কথা। সেই সময়ের কথা মনে করিয়ে দিয়ে তিনি বলেন, ক্লাস সিক্সে পড়ার সময় হঠাৎই একদিন আরমানিটোলা স্কুলে যান খেলা দেখতে। দেশের হকির কিংবদন্তি আবদুর রাজ্জাক সোনা মিয়ারা সে সময় খেলছেন। পাশে দাঁড়িয়ে থেকে খেলা দেখছেন। মাঠের বাইরে যাওয়া বলগুলোতে কুড়িয়ে আবার মাঠে ফেরত দিচ্ছেন। এভাবে প্রায় প্রতিদিনই খেলা দেখতে মাঠে যেতেন। বিষয়টি নজরে আসে সোনা মিয়ার। ফজলুকে খেলার প্রস্তাব দিলে তিনি কোনো চিন্তা না করে লুফে নেন। যদিও শুরুতে হকিস্টিক, বল কিংবা জার্সি কিছুই তার ছিল না। এরপর সোনা মিয়া দুটি ভাঙা হকিস্টিক এনে জোড়া দিয়ে খেলার কথা বলেন, ‘এটি নে, জোড়া দিয়ে খেল। আর কষ্ট কর, তাহলে দেখবি খেলাটির প্রতি ভালোবাসা জন্মেছে।’ ভাঙা হলেও সেই স্টিক পেয়ে খুশির কোনো অন্ত ছিল না তার। এরপর ভালো খেলার সুবাদে আরমানিটোলা স্কুল দলে সুযোগ পেয়ে যান। আক্রমণভাগে খেলে জাতীয় স্কুল হকিতে তিনবার চ্যাম্পিয়ন করালেন আরমানিটোলা উচ্চ বিদ্যালয়কে। এরপর সরাসরি প্রথম বিভাগে খেলার সুযোগ পেলেন। পিডব্লিউডি, সাধারণ বীমা, ভিক্টোরিয়াসহ অনেক দলের হয়ে মাঠ মাতিয়েছেন। এখন তার হাতে গড়া খেলোয়াড়রাই জাতীয় দলে দেশকে প্রতিনিধিত্ব করছেন।
একমাত্র মেয়ে নাদিয়া ইসলাম নাগমাকেও হকির প্রাথমিক পাঠটি দিয়েছেন। যদি সে খেলোয়াড় হতে চায় তাহলে পরিবারের পক্ষ থেকে কোনো বাধা দেওয়া হবে না। নাগমাও বাবার দেখানো পথে হাঁটতে চান। এ ছাড়া ফজলুর স্বপ্ন এখন একাডেমিকে ঘিরে। করোনার কারণে এখনো আরমানিটোলা স্কুল মাঠে অনুশীলন শুরু করতে পারেননি। সে কারণে ছেলেরা তাকে খুব যন্ত্রণা দেয়। হকির কারণে অন্য কিছু করা হয়নি। অনটনের মধ্যেই দিন কাটে; কিন্তু শেখাতে তিনি কোনো অর্থও নেন না। উল্টো জার্সি-জুতা কিনে নিজেই গরিব ছেলেমেয়েদের দেন। সিনিয়র খেলোয়াড়দের পুরনো স্টিক চেয়ে নিয়ে নিজেই কেটে ছোট করে নেন নবীনদের জন্য। ‘ফজলু ওস্তাদের মুখের বুলি, চলো সবাই হকি খেলি’Ñপুরান ঢাকার পাড়া-মহল্লায় এ ছড়া সবাই বাড়ি বাড়ি ঘুরে অভিভাবকদের বোঝান, নেশার ভয়ংকর জগৎ থেকে বাঁচাতে সন্তানদের খেলাধুলায় পাঠানোর বিকল্প নেই।
দেড় যুগের খেলোয়াড়ি জীবন
আরমানিটোলা সরকারি উচ্চ বিদ্যালয়ে দারুণ খেলার সুবাদে এলাকায় নামডাক পড়ে যায় ফজলুল ইসলামের। ঢাকার প্রথম বিভাগ হকি লিগে সরাসরি খেলার সুযোগ আসে। ১৯৭৭ সাল থেকে সেই যে ঢাকার হকিতে নিজের নাম লিখিয়েছেন, সেটি কাটাতে ১৮ বছর লেগে যায়। প্রথম বিভাগ পেরিয়ে প্রিমিয়ার ডিভিশনে খেলারও সুযোগ মিলে যায়। পিডব্লিউ দিয়ে শুরু করে এরপর একে একে ভিক্টোরিয়া স্পোর্টিং ক্লাব, সাধারণ বীমা ক্রীড়া সংঘ, মোহামেডান স্পোর্টিং ক্লাব, উষা ক্রীড়া চক্র, ঢাকা ওয়ান্ডারার্স ক্লাবে খেলেন। এর মধ্যে প্রথম বিভাগে সাধারণ বীমার হয়ে শিরোপা জেতার রেকর্ড রয়েছে তার।
একটি দুর্ঘটনাই তাকে কোচিংয়ে নিয়ে আসে
১৯৮৪ সালের কথা। প্রথম বিভাগে সাধারণ বীমায় খেলার সময় দুর্দান্ত ফর্মে ছিলেন ফজলুল ইসলাম। তার একক নৈপুণ্যে দল চ্যাম্পিয়ন হওয়ার কৃতিত্ব অর্জন করে। সেই সুবাদে সুযোগ পেয়ে যান জুনিয়রদের জাতীয় দলে খেলার। খেলতে যেতে হবে মালয়েশিয়ায়। সে সময় চলছে লিগের খেলা। ভিক্টোরিয়া বনাম ঊষার খেলা চলছিল। খেলা শেষ হওয়ার মিনিট সাতেক আগে চোখের ওপর লাগে স্টিকের আঘাত। গুনে গুনে ১৩টা সেলাই। ‘সেই চোটের কারণেই পরে আর জাতীয় দলের জার্সি গায়ে চাপাতে পারিনি,’ চোখের পানি মুছতে মুছতে কথাগুলো বলছিলেন ফজলু। সেই দুঃখ আজও বয়ে বেড়ান। এরপর আর খেলা হয়নি জাতীয় দলে। তবে ফজলুকে সবাই চেনেন তার খেলোয়াড়ি জীবনের কল্যাণে। জুনিয়র জাতীয় দলের চৌকাঠ মাড়ানোর আগেই ঘটে স্বপ্নের অপমৃত্যু। তবে এটিকে শেষ হিসেবে না ধরে নতুন এক মিশনে নেমে পড়েন। জাতীয় দলে খেলার দুঃখ ঘোচাতে নেমে পড়লেন খেলোয়াড় তৈরিতে। একটি স্বপ্ন ভেঙে গিয়ে আরেকটি স্বপ্নের শুরু হলো এখানেই। নিজের জাতীয় দলে খেলা স্বপ্নটি পূরণ করতে না পারার কষ্ট আর যন্ত্রণা শিষ্যদের দিয়েই পূরণ করতে চান। আশির দশকে যে স্বপ্নের শুরু, সেটি এখনো বহতা নদীর মতো প্রবাহমান রয়েছে। বয়স পঞ্চাশ পেরিয়ে গেলেও এখনো এতটুকু ক্লান্তি নেই তার মধ্যে। একের পর এক রত্ন উপহার দিয়ে চলেছেন ‘ওস্তাদ ফজলু’। যা থেকে সবচেয়ে বেশি উপকৃত হচ্ছে দেশের হকি।
করোনায় ছাদে বানিয়েছেন হকি মাঠ
গেল বছরের মার্চ মাসে করোনা ভাইরাসের প্রাদুর্ভাব শুরু হলে বন্ধ হয়ে যায় সব ধরনের খেলাধুলা। সঙ্গে বন্ধ করে দেওয়া হয় সব সরকারি-বেসরকারি শিক্ষা প্রতিষ্ঠান। বাড়ির পাশের আরমানিটোলা সরকারি উচ্চ বিদ্যালয়ের মাঠটি নিজের আরেকটি ঘর ‘ওস্তাদ ফজুল’র; কিন্তু করোনার বিস্তারের সময় বন্ধ হয়ে যায় প্রিয় স্কুল ও সেখানকার খেলার মাঠ। শুয়ে-বসে যে কোনোভাবেই সময় কাটছিল না। বিকল্প ভাবনায় মনটি আচ্ছন্ন্ন হতে থাকে। নিজেকে ফিট রাখার পাশাপাশি শিষ্যদের কীভাবে ফিট রাখা যায়, সেই চিন্তাই করতে থাকেন। অবশেষে পেয়েও যান সমাধান। মনটি নাচন দিয়ে ওঠে এই ভেবে যে, আমার বাড়ির ছাদেই তো একটি মাঠ বানিয়ে ফেলা যায়। যেখানে প্রতিবকন্ধকতা বলতে কিছুই থাকবে না। যেই ভাবনা সেই কাজ। ছাদে থাকা ফুলের টব আর অন্যান্য জিনিস দ্রুততম সময়ের মধ্যে অন্যত্র সরিয়ে, এটিকে মাঠ বানিয়ে ফেলা হয়। এরপর থেকে পালা করে এখনো চলছে ছাদে হকি খেলার প্রশিক্ষণ। খেলাটিতে প্রতিনিয়ত নতুন নতুন খেলোয়াড়ের জন্ম দেওয়া এই ‘ওস্তাদ’ এখন আর মাঠের অভাব অনুভব করেন না। তবে বড় মাঠের পাশাপাশি ঘাসে অনুশীলনের সুযোগ না পাওয়ার হতাশা তার মধ্যে কাজ করছে। সে সব নিয়ে চিন্তা না করে যত দ্রুত সম্ভব পরিস্থিতি স্বাভাবিক হওয়ার অপেক্ষায় রয়েছেন তিনি।
একাডেমি থেকে খেলোয়াড় সরবরাহ
বয়সভিত্তিক হকি মানেই ওস্তাদ ফজলু। একেবারে কুড়ি না ফোটানো শিশুদের নিয়েই কাজ করে থাকেন তিনি। যার ফল এখন পায় আরমানিটোলা সরকারি উচ্চ বিদ্যালয়। এখানে স্বাভাবিক পরিস্থিতিতে দিনে দুইবার অনুশীলন করানো হয়। হকির জন্য বিখ্যাত এই স্কুলটি স্কুল হকিতে একাধিকবার শিরোপা জিতেছে। নিজের একাডেমি থেকে খেলোয়াড় তৈরি করে শুরুতে আরমানিটোলা স্কুলকে দেন। পরে তারা ঢাকার বিভিন্ন ক্লাবে খেলে থাকেন। ঢাকার হকিতে ঢাকা ওয়ান্ডারার্স, কমবাইন্ড স্পোর্টিং ক্লাব, বাংলাদেশ পুলিশ দলের কোচের দায়িত্ব পালন করেছেন। বাংলাদেশ হকি ফেডারেশনের প্যানেলভূক্ত কোচ হিসেবে নতুনদের নিয়ে কাজ করছেন। খেলা ছাড়ার পর কোচিংটি একেবারে রক্তের মধ্যে ঢুকে গেছে। সে কারণে অন্য কিছু নিয়ে ভাবার সময়ই পান না ফজলু। তৃণমূল পর্যায়ে হকির মৌলিক বিষয়গুলো শেখানোতে ওস্তাদ ফজলুর যে কোনো জুড়ি নেই, সেটি ফেডারেশনের কর্মকর্তারা অবলীলায় স্বীকার করে থাকেন। জাতীয় স্কুল হকি, জাতীয় যুব হকি কিংবা মেয়েদের নতুন করে খেলা শেখাতে ডাক পড়ে অভিজ্ঞ এই কোচের। হকির জন্য নিজেকে নিবেদন করা এ মানুষটিকে ২০১২ সালে সম্মাননা দিয়েছে বাংলাদেশ হকি ফেডারেশন। ২০১৬ সালে তৃণমূলে কোচ হিসেবে পুরস্কার দিয়েছে বাংলাদেশ ক্রীড়ালেখক সমিতি।
স্বপ্ন দেখেন এশিয়া কাপ জয়ের
২০১৭ সালে ঢাকার মওলানা ভাসানী জাতীয় হকি স্টেডিয়ামে সর্বশেষ এশিয়া কাপের আসর বসে। সেখানে বাংলাদেশ ভালো পারফরম্যান্স প্রদর্শন করে। এই আসরে ওস্তাদ ফজলুর চারজন শিষ্য লাল সবুজ জার্সি গায়ে খেলেন। রাসেল মাহমুদ জিমি, মোহাম্মদ নাঈমউদ্দিন, আরশাদ হোসেন ও ইমরান হাসান পিন্টু। জাপানের বিপক্ষে প্রস্তুতি ম্যাচে ২-১ গোলে জেতার পরেই তাই তিনি দারুণ খুশি হয়েছিলেন। এর বাইরে অনেকেই বিভিন্ন ক্লাব দলের হয়ে খেলে থাকেন। তবে জাতীয় দল নিয়ে একটি স্বপ্ন দেখেন ওস্তাদ ফজলু। এ প্রসঙ্গে তিনি বলেন, ‘২০১৭ সালে এশিয়া কাপ হকিতে আরও ভালো করার কথা ছিল। সেই থেকে আমি স্বপ্ন দেখছি বাংলাদেশ এশিয়া কাপ চ্যাম্পিয়ন হবে। পাশাপাশি বিশ্বকাপে খেলার একটি স্বপ্ন আমার অনেকদিনের পুরনো। তবে এশিয়া কাপ জিততে পারলে একজন সাবেক খেলোয়াড়ের পাশাপাশি বর্তমান একজন কোচ হিসেবে দারুণ খুশি হবো’।
২০১৬ সালে অনেকটা হঠাৎই মস্তিষ্কে রক্তক্ষরণ হয় তার। তিনদিন কোনো জ্ঞানই ছিল না তার। এরপর দিন পনের হাসপাতালে থেকে বাড়ি ফিরে আসেন। বলা যায় নতুন একটি জীবন পেয়েছেন ফজলু। সাধারণ আর হকিপ্রেমী মানুষের ভালোবাসায় আবারও বেঁচে যান তিনি।
স্বপ্নের ওস্তাদ ফজলু হকি একাডেমি
যেভাবে ওস্তাদ আবদুর রাজ্জাক সোনা মিয়া তার হাতে হকিস্টিক তুলে দিয়েছিলেন, সেভাবেই এখন একই কাজ করে যাচ্ছেন ওস্তাদ ফজলু। পুরান ঢাকার আরমানিটোলা সরকারি উচ্চ বিদ্যালয় প্রাঙ্গণে নিয়ম করে বাচ্চাদের হকি খেলা শুরু করেন। যদিও করোনাকালে এই রুটিনে কিছুটা পরিবর্তন এসেছে। তবে শিষ্যদের নিয়ে ব্যস্ততায় এতটুকু অবসর নেই তার। সাহেব বাজারের নবালক মিয়া লেনের এই বাসিন্দা বাড়ি বাড়ি ঘুরে খেলোয়াড় জোগাড় করে নিয়ে আসেন। অভিভাবকদের বোঝাতে থাকেন এই বলে, আপনার সন্তান যদি খেলাধুলায় ব্যস্ত থাকেন, তাহলে নেশা কিংবা অপরাধ জগতে প্রবেশ করবে না। যাদের সামর্থ্য রয়েছে তারা তো স্টিক আর বল নিয়ে আসেন; কিন্তু যাদের অর্থ নেই তাদেরকে বিনামূল্যে শিখিয়ে থাকেন। কোন খেলোয়াড়কে শিখিয়ে একটি টাকাও নেন না। অন্যদের চেয়ে এখানেই ‘ওস্তাদ ফজলু’র বিশেষত্ব।
শিষ্য হিসেবে যাদেরকে তৈরি করেছেন
বাংলাদেশের হকির আলোকিত নামগুলোর একটি রফিকুল ইসলাম কামাল। ‘ওস্তাদ ফজলু’র ছাত্রদের মধ্যে সবচেয়ে আগে রাখতে হবে তাকে। দীর্ঘদিন জাতীয় দলে খেলার পাশাপাশি দেশকে অনেক সাফল্য উপহার দিয়েছেন। ওস্তাদকে দেখলেই মাথা অবনত হয়ে আসে তার। দেশের হকির সুপারষ্টার এই খেলোয়াড়কে নিজের পছন্দের তালিকায় সবার ওপরেই রেখেছেন তিনি। এরপরের নামটি রাসেল মাহমুদ জিমি। বাবা সোনা মিয়া যেখানে ফজলুর ওস্তাদ আর জিমির ওস্তাদ এই ফজলু। ছোট ভাই রাকিন মাহমুদও তারই হাতেগড়া খেলোয়াড়। এরপর মাকসুদুল আলম হাবুল, নাঈম উদ্দিন, আরশাদ হোসেন, শওকত হোসেন, ইকবাল নাদের প্রিন্স, ফয়সাল, আবদুস সাজ্জাদ জন, মামুন, রাজীব, সুমন, ইমরান, রনি, লিটন সরাসরি ওস্তাদ ফজলু’র ছাত্র। পুরনো আর সিনিয়র খেলোয়াড়দের মধ্যেÑ রফিকুল ইসলাম কামাল, মডেল ও খেলোয়াড় ফয়সাল আহসানউল্লাহ, তারেক মোহাম্মদ আদেল, জাভেদ ওমল বেলিম গোল্লা, আবেদ, তারা, এহতেশাম, কায়সার ও নাসির। এছাড়া ভবিষ্যতের জন্য তৈরি করছেনÑ ছোট মামুন, আফসার উদ্দিন, রশিদ, রকিব, সজল, কালা, ইমন, আকিব, অনিক, রাজন, সায়েম, সায়মন, মনোজ, রাকি, সিহাব, সাফিন, আবেদসহ আরো অনেকে।
হকির বুনিয়াদ আরমানিটোলা
দেশের হকিতে সবচেয়ে বেশি খেলোয়াড় সরবরাহ করেছে আরমানিটোলা সরকারি উচ্চ বিদ্যালয়। স্কুল হকিতে সবচেয়ে বেশিবার শিরোপাজয়ী তারা। এখন পর্যন্ত দেশের হকিতে আলোকিত একটি নাম আরমানিটোলা। একটি সময় ফরিদপুর, রাজশাহী, ময়মনসিংহ থেকে অনেক খেলোয়াড় উঠে এলেও এখন সেটি একপ্রকার বন্ধ হয়ে আছে। এই যেমন যদি রাসেল মাহমুদ জিমির কথা বলা হয় তাহলে বলতে হবে, এই স্কুলে হকির অবাধ খেলাধুলা করার সুযোগ পাওয়ার কারণেই জাতীয় তারকা হওয়ার সুযোগ পেয়েছেন। শুরুতে বাহাতি হকি খেলোয়াড় থাকলেও পরে স্কুল কোচের মার খেয়ে ডানহাতি খেলোয়াড় হয়ে যান। ১৯০৪ সালে প্রতিষ্ঠিত স্কুলটির প্রতিটা গাথুনিতে রয়েছে হকি। দেয়ালে যেভাবে লেখা ‘এসো সবাই হকি খেলি’ এটিতেই বড় স্বার্থকতা। ২০১১ সালে জাতীয় স্কুল ও মাদ্রাসা ক্রীড়া সমিতির শীতকালীন হকি লিগে আরমানিটোলা স্কুল সেরাদের সেরা হয়েছে। উপ-আঞ্চলিক পর্যায়ে ফরিদপুর, নারায়নগঞ্জ, গাজীপুর আর ঢাকা জেলাকে হারিয়ে আঞ্চলিক শীর্ষ স্থান পায় তারা। এরপর জাতীয় পর্যায়ে রাজশাহী, খুলনা ও চট্টগ্রামকে হারিয়ে চ্যাম্পিয়ন ট্রফি জিতে নেয় তারা। এছাড়া ২০০৮, ২০০৯ ও ২০১০ সালে হকি ফেডারেশন আয়োজিত ঢাকা বিভাগ স্কুল শিরোপা জিতেছে আরমানিটোলা। বিদ্যালয়ের অফিস কক্ষে তাই ট্রফি আর মেডেলের অভাব নেই। উপ-আঞ্চলিক পর্যায়ে চ্যাম্পিয়ন হওয়ার পাশাপাশি বিগত দুই দশকেরও বেশি সময় ধরে তারা চ্যাম্পিয়ন দল। আর স্কুলটির হকির আজকের এই উত্থানের পেছনে সবচেয়ে বেশি অবদান ওস্তাদ ফজলুর। দীর্ঘ ২৫ বছরেরও বেশি সময় ধরে স্কুলটির হকি কোচ হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন। ব্রিটিশ আমল থেকেই এই স্কুলটিতে হকি খেলার শুরু। এই স্কুলের খেলোয়াড়দের মধ্যে রাসেল মাহমুদ জিমি, মাকসুদুল আলম হাবুল ও ইমরান হাসান পিন্টুরা জাতীয় দলে নেতৃত্ব দিয়েছেন।
আরশাদ হোসেনকে ‘চড়’
বর্তমানে জাতীয় হকি দলের নিয়মিত সদস্য আরশাদ হোসেন। তিনি আবার ওস্তাদ ফজলু’র ছাত্র। অনেকটা জোর করেই তাকে খেলোয়াড় বানিয়েছেন তিনি। প্রতিভা চিনতে তার কখনো ভুল হয়নি। একদিন হকি খেলবে না বলে অনুশীলন থেকে চলে যেতে চাইল আরশাদ। কোচ হিসেবে ফজলু রেগে গিয়ে চড় মেরে বসেন তাকে! পরে এই ঘটনাই তাকে খেলোয়াড় হতে সহায়তা করেছে। সেই কথা বলতে গিয়ে স্মৃতিকাতর ফজলু বলেন, ‘আরশাদকে দেখে আমার কাছে মনে হয়েছিল তার মধ্যে সম্ভাবনা আছে; কিন্তু সে হকি খেলবে না বললে আমার মেজাজ গরম হয়ে যায়। তাকে তখন চড় মেরে বসি। এরপরই তার মধ্যে একটি পরিবর্তন লক্ষ্য করি। এর কিছুদিন পর হঠাৎই বলে ওস্তাদ আমার খুব শখ বিমানে উঠব। আমি তখন তাকে বলেছিলাম, তুই একবার নয় বারবার বিমানে উঠতে পারবি। আজকে ও বাংলাদেশ বিমান বাহিনীতে চাকরিও করছে, আবার খেলছেও।’
হকির কারণে বিয়েতে বিলম্ব!
১৯৬৭ সালে জন্ম নিলেও বিয়ে করার কথা যেন ভুলেই গিয়েছিলেন। হকি অন্তপ্রাণ এই মানুষটি অবশেষে গাটছাড়া বাধেন ২০১০ সালে। গুনে গুনে বয়সটা তখন ৪৩ পেরিয়েছে। বিয়ে নিয়ে বিলম্বের বিষয়ে ফজলু বলেন, ‘সত্যি কথা বলতে কি আমার বিয়ে করার কথা মনেই ছিল না। মনে হতো যাকে বিয়ে করব সে যদি হকি পছন্দ না করেন; কিন্তু আমার স্ত্রী দারুণভাবে আমাকে সহায়তা করে যাচ্ছেন। কখনো হকি নিয়ে কোন প্রশ্ন তোলেন না। তার সহায়তা না পেলে আমার পক্ষে এভাবে দিন-রাত মাঠে পড়ে থাকা কোনোভাবেই সম্ভব হতো না। সংসারের সবকিছু তো ওই সামলাচ্ছে।’ একমাত্র মেয়ে নাদিয়া ইসলাম নাগমাকে নিয়ে তার সুখের সংসার।
পুলিশকে চ্যাম্পিয়ন করানোর গল্প
স্কুল হকি, জাতীয় যুব হকির পর কোচিংয়ে ক্ষুদ্র জাতিসত্তা হকির শিরোপাও জিতেছেন ফজলুল ইসলাম। যখন যেখান থেকে ডাক এসেছে কাউকে নিরাশ করেননি তিনি। অকাতরে নিজের মধ্যে থাকা প্রতিভাকে বিলিয়ে দিয়েছেন শিশু-কিশোরদের মাঝে। ২০০৮ সালে বাংলাদেশ পুলিশ হকি ক্লাবকে প্রথম বিভাগের শিরোপা জিতিয়েছিলেন। সেবার কোনো ম্যাচ না হেরে অপরাজিত চ্যাম্পিয়ন হয়েছিল এ বাহিনীটি। সেই দলের কোচ হিসেবে কৌশলে নতুনত্ব ও পরিবর্তন আনায় প্রতিপক্ষ দলগুলো তেমন একটি সুবিধা করতে পারেনিনি। সেবার লিগের প্রায় সব ম্যাচেই একতরফা খেলেছে পুলিশ। সে সময় বেশি বেশি অনুশীলন করানোর পাশাপাশি স্লাবের ওপর খেলায়াড়দের খেলোনোর পাশাপাশি দ্রুততম সময়ের মধ্যে কৌশলে পরিবর্তন এনেই সাফল্য পেয়েছেন। সেবার শহীদ স্মৃতি হকিতে চ্যাম্পিয়ন হয়েছিল আরমানিটোলা উচ্চ বিদ্যালয়। এছাড়া বিজয় দিবস হকিতে তারই কোচিংয়ে ওল্ড ঢাকা হকি ডেভেলপমেন্ট বোর্ড শিরোাপা জেতে। সেবার এক মৌসুমে তিনটি শিরোপা জিতে দারুণ রেকর্ড গড়েন তিনি। এ ছাড়া একই বছর এএইচএফ কাপ হকিতে অপরাজিত চ্যাম্পিয়ন দলের অধিনায়ক হিসেবে ‘ওস্তাদ ফজলু’র সরাসরি ছাত্র ছিলেন মাকসুদুল আলম হাবুল।
ভেটারান হকি ও মহল্লার মানুষের ভালোবাসা
মূলত পাড়ার একজনকে হকি খেলার জন্য ধরে নিয়ে আসলে তাকে দেখে বাকিরা আসে। এভাবেই ওস্তাদ ফজলু হকি একাডেমি’র জন্য ছাত্র তৈরি করে থাকেন। এখন বাংলাদেশ হকি ফেডারেশনের প্যানেলভূক্ত কোচ হিসেবে কাজ করছেন। কোচিংটা একরকম রক্তের মধ্যে প্রবেশ করেছে। একবেলা না খেয়ে থাকতে পারবেন; কিন্তু হকি ছাড়া ফজলু’র বেঁচে থাকা যেন অসম্ভব। জাতীয় স্কুল হকি, যুব হকি অথবা মেয়েদের নতুন করে খেলা শেখাতে ডাক পড়ে অভিজ্ঞ এই কোচের। হকির জন্য নিজেকে নিবেদন করা এ মানুষটিকে ২০১২ সালে সম্মাননা দিয়েছে বাংলাদেশ হকি ফেডারেশন। এটিকে জীবনের সেরা অর্জন বলছেন তিনি। এ ছাড়া জড়িয়ে রয়েছেন ভেটারান হকিতে। নিয়ম করে প্রতি শুক্রবার হকির তীর্থস্থান হিসেবে পরিচিত মওলানা ভাসানী ষ্টেডিয়ামে সাবেকদের মেলা বসে। কিছুদিন পূর্বে ইংল্যান্ড ভেটারান দলের সঙ্গে সিরিজ খেলে জিতেছে বাংলাদেশ দল। হকি খেলে দেশের মানুষের ভালোবাসা যেমন পেয়েছেন ঠিক তেমনি নিজের জন্মস্থানের মানুষও তাকে অসম্ভব ভালোবাসে। রাস্তায় বের হলেই সম্মান দিয়ে সবাই কথা বলে থাকেন। কয়েক বছর আগে ওস্তাদ ফজলু’র এলাকার মানুষ হকিতে তার অবদানের জন্য একটি প্রশংসাপত্র উপহার হিসেবে দিয়েছে। খেলোয়াড় থেকে কোচ হওয়া তার জন্য এটি অনেক বড় পাওয়া।
সাম্প্রতিক দেশকাল ইউটিউব চ্যানেল সাবস্ক্রাইব করুন
বিষয় : হবি ওস্তাদ মোয়াজ্জেম হোসেন রাসেল
© 2024 Shampratik Deshkal All Rights Reserved. Design & Developed By Root Soft Bangladesh