‘বক্সিং’ প্রচণ্ড শারীরিক শক্তিনির্ভর খেলা। বক্সিং প্রতিপক্ষের বিপক্ষে সরাসরি যুদ্ধ। ইস্পাত-কঠিন মুষ্টাঘাতে প্রতিপক্ষকে কাবু করায় ঘটে যায় রক্তারক্তি ঘটনাও। অনেকে তো ভায়োলেন্সের অভিযোগ এনে বক্সিংকে ‘খেলা’ হিসেবেই স্বীকৃতি দিতে নারাজ; কিন্তু তাই বলে মুষ্টিযুদ্ধ বা বক্সিংয়ের জনপ্রিয়তা বিশ্বব্যাপী কম নয়। প্রয়াত মোহাম্মদ আলী ইতিহাসের সেরা ক্রীড়াবিদে পরিণত হয়েছেন মুষ্টিযুদ্ধ করেই। ইভান্ডার হলিফিল্ড, জর্জ ফোরম্যান, মাইক টাইসনরাও পেয়েছেন বিশ্বব্যাপী জনপ্রিয়তা।
বাংলাদেশে তুলনামূলক বক্সিংয়ের চর্চা কম। সম্ভবত ইউরোপ, আমেরিকা কিংবা আফ্রিকানদের তুলনায় শারীরিক শক্তি আর গঠনে পিছিয়ে থাকা বাংলাদেশিদের বক্সিংয়ে খুব ভালো কিছু করার সুযোগ কম। আবার হতে পারে, শান্তিপ্রিয় বাংলাদেশিরা বক্সিংয়ের মতো মারদাঙ্গা খেলায় স্বাভাবিকভাবেই আগ্রহ বোধ করে না। বাংলাদেশের বক্সিংচর্চা যতটুকু হয় বা হচ্ছে সবই সৌখিন/অপেশাদার পর্যায়ে। সম্প্রতি পেশাদার বক্সার হিসেবে ক্যারিয়ার শুরু করেছেন সুরকৃষ্ণ চাকমা। ইতিমধ্যে এশিয়ান বক্সিং ফেডারেশনের ‘সুপার লাইট ওয়েট ইন্টার কন্টিনেন্টাল চ্যাম্পিয়নশিপ’ বেল্ট জয় করে বাংলাদেশের মুখ উজ্জ্বল করেছেন। পেশাদার বক্সিং রিংয়ে টানা জয়ে উঠে আসছেন বিশ্ব র্যাংকিংয়ে। চলতি বছর থাইল্যান্ড ও ভারতের বক্সারকে হারিয়ে এক লাফে পেশাদার বক্সিংয়ের র্যাংকিংয়ে ৬০০ ধাপ ওপরে উঠে এসেছেন তিনি। তার বর্তমান র্যাংকিং ২২৪। এই তালিকা মূলত লাইটওয়েট বক্সারদের। যেখানে মোট ২২৮৩ জন পেশাদার বক্সার রয়েছেন সারা বিশ্বে।
এদিকে বক্সিংয়ের মতো ঝুঁকিপূর্ণ খেলাতে এগিয়ে আসছে বাংলাদেশের নারীরাও, যার শুরুটা করেছিলেন তামান্না হক। তিনিই বাংলাদেশের প্রথম পেশাদার নারী বক্সার। ২০১৪ সালে বক্সিং ক্যারিয়ার শুরু। শখের বশে না, দেশকে কিছু দেওয়ার স্বপ্ন নিয়েই বক্সিং রিং জগতে পদার্পণ তার। যদিও এক দশক পেরিয়ে গেলেও আন্তর্জাতিক পর্যায়ে তার প্রাপ্তির ভান্ডার শূন্য! যার পেছনে তার নিজের দায় কমই বলে মনে করেন তামান্না।
তামান্না জানান, ‘আমাদের দেশের পেশাদার বক্সিং শুরু হয়েছে মাত্র দুই-তিন বছর। আমি যখন বক্সিং শুরু করেছিলাম, তখন অনেক সমস্যার সম্মুখীন হতে হয়েছে। মেয়েদের বক্সিং নিয়ে চিন্তাও করা হয়নি। আমার উচ্চতা পাঁচ ফুট আট ইঞ্চি। আমার হাইটের প্রতিদ্বন্দ্বী খুঁজে পাওয়াও ছিল দুষ্কর। আমাকে অনুশীলন করতে হয়েছে ছেলেদের সঙ্গে। আবার আন্তর্জাতিক প্রতিযোগিতায় অংশ নেওয়ার সুযোগটাও পাওয়া যায়নি।’
তামান্না আরও বলেন, ‘বাংলাদেশের ফুটবল, ক্রিকেটের মতো খেলা নিয়েই সব মাতামাতি। আবার এমন কিছু খেলা আছে, যেখানে আমরা বিশ্বমানের ধারেকাছে নেই; কিন্তু তারা সবাই সংশ্লিষ্ট ফেডারেশন আর সরকারের সহযোগিতা পাচ্ছে। পাচ্ছে বিভিন্ন করপোরেট হাউসের পৃষ্ঠপোষকতা। অথচ আমরাও সুযোগ পেলেও দেশের জন্য সুনাম বয়ে আনতে পারি, এই আত্মবিশ্বাস রয়েছে।’
মজার ব্যাপার হচ্ছে, তামান্না ছোটবেলা থেকেই সাধারণ দশটি মেয়ের চেয়ে আলাদা পছন্দ নিয়ে বেড়ে উঠেছেন। কোনো হিন্দি বা বাংলা সিরিয়াল-সিনেমা নয়, তামান্না বুঁদ হয়ে টিভিতে দেখতেন রেসলিং। একটা বয়সে মেয়েরা প্রেমে পড়ে কোনো ফিল্মস্টার, মডেল কিংবা সুদর্শন গায়কের; কিন্তু তামান্নার পছন্দ ছিল ‘ডব্লিউডব্লিউই’ সুপারস্টার ট্রিপল এইচ! এ ছাড়া স্বপ্নের নায়কদের মধ্যে আছেন ব্রুস লি এবং মাইক টাইসন।
কিশোরীবেলা থেকে বাংলাদেশের কয়টা মেয়ের পছন্দের তালিকায় ট্রিপল এইচ, ব্রুস লি আর টাইসনরা আছেন-এটা নিয়ে গবেষণা করা যায়; কিন্তু এখানেই তামান্না সবার চেয়ে আলাদা। স্বকীয়। ছোটবেলা থেকেই যেন পণ করেছিলেন, নারীদের জন্য সমাজের তথাকথিত শেকল তিনি ভাঙবেন। সেটা তিনি ভেঙেছেন। প্রথম পেশাদার বক্সার হয়ে।
বক্সার হিসেবে তামান্নার আদর্শ ছিলেন লায়লা আলী। গ্রেট মোহাম্মদ আলীর কন্যা। বলা যায়, নারী বক্সিংকে পৃথিবীব্যাপি পরিচিত করে তুলেছেন লায়লা। বাবার মতোই রিংয়ে অপ্রতিরোধ্য ছিলেন তিনি। পেশাদার ক্যারিয়ারের ২৪টি লড়াইয়ে কখনও হারেননি। ২১ ম্যাচেই নক আউট করেছেন প্রতিপক্ষকে।
তামান্না বলেন, ‘ছোটবেলা থেকেই আমি ডানপিটে স্বভাবের। বাঙালি মেয়ে শিশুদের প্রথাগত পুতুল খেলা আমাকে কখনও আকৃষ্ট করেনি। আমি ছেলেদের মতোই দুরন্ত ছিলাম। সব সময় চাইতাম চ্যালেঞ্জিং কিছু করতে। ছোটবেলায় কোনো এক পত্রিকায় লায়লা আলীর একটি ফিচার দেখেছিলাম। তার ছবি আমাকে আকৃষ্ট করে। বক্সিং গ্লোভস নিয়ে লায়লা আলীর পোজ মনেও গেঁথে যায়। শিশুবেলাটা খুব অদ্ভুত। কখন কি মনে দাগ কেটে যায়, বলা মুশকিল। আমার মনেও স্থায়ী জায়গা করে নিলেন লায়লা আলী। মনে মনে সিদ্ধান্ত নিলাম, বক্সার হব।’
চাইলেও তো হবে না। আমাদের সমাজ মেয়েদের বক্সিং ভালো চোখে দেখে না। মেয়েরা বক্সিং করছে, এমন রেকর্ড আমাদের দেশে নেই; কিন্তু প্রচণ্ড ইচ্ছাশক্তির জোরে তামান্না মাঠে নামলেন বক্সার হওয়ার স্বপ্ন সার্থক করতে। নিজ পরিবার থেকেও বাঁধা এসেছিল। সরকারি চাকরিজীবী বাবাসহ পরিবারের গুরুজনেরা ভাবতে নারাজ ছিলেন, তামান্না বক্সিং করবেন; কিন্তু ছোটবেলা থেকে একগুঁয়ে, জেদি আর সাহসী তামান্না পরিবারসহ সমস্ত প্রতিকুলতার বিরুদ্ধে একাই লড়লেন। সময় লাগলেও পরিবারকে বোঝাতে পেরেছেন। জয় করতে পেরেছেন সামাজিক প্রতিকূলতা।
তামান্না নিজে প্রথা ভাঙ্গার সাহস দেখিয়েছেন। বক্সার হওয়ার স্বপ্ন পূরণ করেছেন। তামান্নার বক্সার হয়ে ওঠার পেছনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখেন মোহাম্মদ আলী বক্সিং ফেডারেশনের হেড কোচ মহিউদ্দিন। তিনি তামান্নাকে অনুপ্রেরণা দিয়েছেন, ‘তুমি পারবে। অবশ্যই পারবে।’
দুঃখজনক ব্যাপার হচ্ছে, প্রতিভা থাকা স্বত্ত্বেও তামান্না বক্সিং ছেড়ে দিয়েছেন। প্রতিকুল পরিবেশ আর ভবিষ্যৎ অনিশ্চয়তায় করেছেন জীবনের বাঁক পরিবর্তন। বক্সিং ছেড়ে তিনি নিয়েছেন নিজেকে বিস্তৃত করার প্রয়াস। এখানেও তামান্না চ্যালেঞ্জ নিয়েছেন। বেছে নিয়েছেন জিম ইন্সট্রাক্টর আর ফিটনেস ট্রেনারের মতো কঠিন এবং অপ্রচলিত পেশা, যেখানে বাংলাদেশের নারীরা নিজেদের ভাবতেই নারাজ। তিনি মনে করেন, ‘বাংলাদেশে শুধু বক্সিংকে ক্যারিয়ার হিসেবে নেওয়া প্রায় অসম্ভব। সেই সময় এখনও আসেনি।’
তামান্না বর্তমানে পুরোপুরি ব্যাট কমব্যাট স্পোর্টস নিয়ে। ইন্টারন্যাশনাল শাওলিন অ্যান্ড উদাং কুংফু একাডেমিতে প্রশিক্ষণ নিচ্ছেন শিফু রেজাউল করিমের তত্ত্বাবধায়ানে। সমাপ্ত করেছেন ক্রাভ মাগার মতো আন্তর্জাতিক মিলিটারি সেল ডিফেনস ট্রেনিং, যা কিনা সারা বিশ্বে মূল্যায়িত। ক্রাভ মাগা অব বাংলাদেশের চিফ হেড ইন্সট্রাক্টর খসরু পারভেজের তত্ত্বাবধায়নে তিনি এই প্রশিক্ষণ নিয়েছেন। ইংল্যান্ডের শীর্ষ পর্যায়ের সেলফ ডিফেন্স ইন্সট্রাক্টর ডেভ টরটনের (ASMMA-SDF) কাছেও প্রশিক্ষণ নিয়েছেন তামান্না। এ ছাড়া আন্তর্জাতিক স্বীকৃতিপ্রাপ্ত ‘ফিটনেস’ প্রশিক্ষক হিসেবে কাজ করছেন বাংলাদেশ ফিটনেস ফাইট ক্লাবসহ একাধিক জিমনেশিয়ামে।
তামান্না জানিয়েছেন, ইসরায়েলি সেনাবাহিনীর প্রশিক্ষণের জন্য উদ্ভব হয়েছিল ক্রাভ মাগা। যা খালি হাতে আত্মরক্ষার কার্যকরী কৌশল। মিক্সড মার্শাল আর্টে ব্ল্যাক বেল্ট পেয়েছেন তামান্না। বলেন, ‘আমি ফার্স্ট ডিগ্রি মার্শাল আর্ট ব্ল্যাক বেল্ট হোল্ডার। এটি স্ট্রিট মিক্সড মার্শাল আর্টের কৌশল। এটিও আত্মরক্ষার একটি কৌশল।’
তামান্না নারী উন্নয়ন বিষয়ক নানা উদ্যোগের সঙ্গেও সম্পৃক্ত। রেপ ভিকটিম ও নারীদের সেল্ফ-ডিফেন্স নিয়ে কয়েক বছর ধরে কাজ করছেন। নারীর প্রতি সহিংসতা রোধে সবাইকে সচেতন করাই তার প্রয়াস। তামান্না জানিয়েছেন, বাংলাদেশের নারীরা বর্তমানে অতীতের যে কোনো সময়ের তুলনায় নিজেদের অধিকার আদায়ে বেশি সচেতন। দীর্ঘদিন ধরে রাষ্ট্রীয় ক্ষমতার কেন্দ্রবিন্দুতে রয়েছে নারী। বর্তমান প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা নারীদের নিরাপত্তা আর অধিকার প্রশ্নে আপসহীন; কিন্তু তা স্বত্বেও সমাজের আনাচে-কানাচে নারীদের প্রতি সহিংসতা বন্ধ হয়নি। নিজের পরিবারেই বহু নারী নিপীড়নের শিকার হচ্ছেন।
তামান্না মনে করেন, শুধু শারীরিক নয়, মানসিকভাবেও নারীদের শক্তিশালী হতে হবে। ফিটনেস ট্রেনার হিসেবে তিনি নারীদের মানসিক শক্তির বিকাশেও ভূমিকা রাখতে চান। তাতেই নারীদের প্রতি সহিংসতা অনেকাংশে কমবে বলে বিশ্বাস করেন তিনি। অর্থাৎ নারী অবলা নয়-প্রমাণের দায়িত্ব নিতে হবে খোদ নারীকেই।
নানা প্রতিকূলতায় তামান্না বক্সার হিসেবে পথচলা অব্যাহত রাখতে পারেননি। তিনি এখন বক্সিং ছেড়ে পুরদস্তুর কমব্যাট ফাইটার। তামান্না স্বপ্ন দেখছেন, কমব্যাট স্পোর্টসে ইউরোপ থেকে একটা চ্যাম্পিয়নশিপ জয়, যা হবে দেশের ক্রীড়া জগতে নারীদের জন্য নতুন ইতিহাস।
তামান্না ঢাকার মেয়ে। জন্ম আর বেড়ে ওঠা ঢাকা ক্যান্টনমেন্ট, কচুক্ষেতে। বাবা নুরুল হক আর মা নাসরিন আক্তারের সংসারে দুই মেয়ের মধ্যে বড় তামান্না। বাবা চাকরি করতেন বিসিএসআইআর-এ। ফ্যাশন ডিজাইনিংয়ে পড়াশোনা করা তামান্না দারুণ ক্যারিয়ার সচেতন। আপাতত সব মনোযোগ তার ক্যারিয়ারের প্রতি।
ফ্যাশন সচেতন তামান্নার মাথাভর্তি সোনালি চুল। আধুনিক পোশাকে নিজের সজ্জিত রাখেন। বাংলাদেশের নারীদের চিরায়ত শাড়ি থেকে শুরু করে ওয়েস্টার্ন আউটফিট-যে কোনো পোশাকেই নজর কাড়েন আলাদাভাবে। শারীরিক গঠন আর উচ্চতা মডেল কিংবা অভিনেত্রী হবার জন্য আদর্শ। তামান্নার কাছে প্রশ্ন ছিল, সুযোগ পেলে চলচ্চিত্রে অভিনয় করবেন কি না।
মার্শাল আর্ট কিংবা কুংফু কারাতেতে পারদর্শী ব্রুস লি, জ্যাকি চ্যানরা সিনেমার মাধ্যমেই বিশ্বব্যাপী জনপ্রিয় হয়েছেন। বাংলাদেশের রুবেল শুধু মার্শাল আর্টকে পুঁজি করেই দীর্ঘ সময় রুপালি পর্দা শাসন করেছেন। তামান্না জানালেন, ‘মার্শাল আর্টবিষয়ক চলচ্চিত্রের প্রস্তাব পেলে বিষয়টি নিয়ে ভেবে দেখা যেতে পারে।’
তামান্না বিশ্বাস করেন, পর্যাপ্ত সুযোগ আর সহযোগিতা পেলে বাংলাদেশের নারীরা যে কোনো ক্ষেত্রে বিশ্ব পর্যায়ে সুনাম অর্জনে সক্ষম। সঙ্গে প্রয়োজন মোটিভেশন। সেটাই করে চলেছেন তিনি। তিনি নতুন প্রজন্মের নারীদের মধ্যে রোপণ করতে চান আত্মবিশ্বাসের বীজ। নারীরা কোনো কিছুতেই পিছিয়ে নেই-বিশ্বাস করাটাই জরুরি। বিশ্বাসটা থাকলে নিজ দেশ তো বটেই, আন্তর্জাতিক পর্যায়েও বাংলাদেশের নারীরা মাথা তুলে দাঁড়াতে পারবে-বিশ্বাস তামান্নার।
সাম্প্রতিক দেশকাল ইউটিউব চ্যানেল সাবস্ক্রাইব করুন
বিষয় : বক্সিং তামান্না তামান্না হক খেলাধুলা
© 2025 Shampratik Deshkal All Rights Reserved. Design & Developed By Root Soft Bangladesh