বেনাপোল স্থলবন্দরে ভয়াবহ পণ্যজট

যশোরের বেনাপোল বন্দরে পণ্যজট ভয়াবহ আকার ধারণ করেছে। অবস্থা এমন পর্যায়ে পৌঁছেছে যে, একটি ট্রাক ভারত থেকে প্রবেশ করে পণ্য খালাস করার পর আরেকটি প্রবেশ করছে। 

বন্দর কর্মকর্তারা বলছেন, করোনাভাইরাস মহামারির কারণে বন্দর দীর্ঘদিন বন্ধ থাকার পর শুধুমাত্র জুলাই মাসে আমদানি হয়েছে প্রায় দেড় লাখ মেট্রিক টন ও চলতি আগস্ট মাসের ১০ দিনে আমদানি হয়েছে ৪৩ হাজার মেট্রিক টন পণ্য। যে কারণে বন্দরে পণ্য রাখার জায়গা নেই। তবে তারা আশা করছেন, আগামী ১০ দিনের মধ্যে ব্যবসায়ীরা সব পণ্য খালাস নিয়ে নেবেন।

বেনাপোল বন্দর সূত্রে জানা গেছে, ৮৭ কোটি টাকা ব্যয়ে নতুন ইয়ার্ড নির্মাণ করা হয়েছে। বর্তমানে বন্দরে ৩২টি শেড ও ১০টি ইয়ার্ড রয়েছে। যেখানে পণ্য ধারণ ক্ষমতা মাত্র ৫১ হাজার মেট্রিক টন। বর্তমানে বন্দরটিতে পণ্য রয়েছে এক লাখ মেট্রিক টনের বেশি পণ্য। জায়গা সংকটের জন্য অনেক পণ্য রাখা যাচ্ছে না। বাইরে যত্রতত্রভাবে ফেলে রাখা হচ্ছে। এতে করে পণ্য চুরিসহ নানাভাবে আর্থিক ক্ষতির শিকার হচ্ছেন আমদানিকারকরা। 

ভারত থেকে আসা এক হাজার থেকে ১২শ’ পণ্য বোঝাই গাড়ি বেনাপোল স্থলবন্দর দিয়ে প্রতিদিন বাংলাদেশে প্রবেশ করার কথা। কিন্তু জুলাই মাসে প্রবেশ করেছে ৪ থেকে ৫শ’ গাড়ি। আর এখন পেট্রাপোলে অপেক্ষা করছে হাজার হাজার গাড়ি। 

ইন্দো-বাংলা চেম্বার অব কমার্সের বেনাপোল শাখার চেয়ারম্যান মতিউর রহমান জানান, বেনাপোল বন্দরে জায়গা সংকট দীর্ঘদিনের। আমরা বারবার জায়গা বাড়ানোর দাবি করলেও কেউ শুনছেন না। বন্দরে জায়গা সংকটের কারণে পেট্রাপোলে হাজারো পণ্যবাহী গাড়ি দাঁড়িয়ে রয়েছে। সেখানে তারা নানাভাবে হয়রানির শিকার হচ্ছে। এখন সময় এসেছে বন্দরের আশপাশে বেসরকারিভাবে ওয়ারহাউজ নির্মাণ ও আইসিটি গড়ে তুলতে হবে।

যশোর চেম্বার অব কমার্সের সাবেক সভাপতি মিজানুর রহমান খান জানিয়েছেন, বেনাপোলে ঢোকার জন্য পণ্যবাহী গাড়ি পেট্রাপোলে দাঁড়িয়ে থাকে বলে সঠিক সময় ওই আমদানি পণ্য পাওয়া যাচ্ছে না। আবার ওপারে দাঁড়িয়ে থাকার কারণে প্রতিদিন ৩ হাজার টাকা অতিরিক্ত গুনতে হয়। কোনো কোনো গাড়ি ১০ দিনও পেট্রাপোলে দাঁড়িয়ে থাকছে। অতিরিক্ত এই টাকা গুনতে হচ্ছে বলেই ব্যবসায় লোকসান হচ্ছে। এর সাথে নষ্ট হচ্ছে আমদানি করা পণ্য ও মূল্যবান সময়।

বাংলাদেশ ও ভারতের মধ্যে স্থল বাণিজ্যের প্রধান মাধ্যম হচ্ছে বেনাপোল স্থলবন্দর। এই বন্দর দিয়ে বছরে প্রায় ২০ হাজার কোটি টাকার পণ্য আমদানি-রফতানি হয়ে থাকে। এছাড়াও ১৩ লাখ যাত্রীর যাতায়াত হয় এই বন্দর দিয়ে। এর মাধ্যমে বছরে ৫ হাজার কোর্টি টাকার রাজস্ব জমা হচ্ছে সরকারি কোষাগারে। 

দেশের অর্থনীতিতে গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখলেও বন্দরের অবকাঠামোগত উন্নয়ন কিছুই হয়নি বলা চলে। এ কারণে ব্যবসায়িক কার্যক্রমের জন্য বেনাপোল স্থলবন্দর অনুপযোগী বন্দরে পরিণত হতে চলেছে। এখানে পণ্যজট অসহনীয়। বন্দরে ট্রাকজটও পীড়াদায়ক। আর পণ্য লোডিং-আনলোডিংয়ের জন্য পর্যাপ্ত যন্ত্রপাতি ও সরঞ্জাম (ইক্যুইপমেন্ট) নেই এখানে। 

চট্রগ্রামের বিএসআরএমের নির্বাহী পরিচালক তপন সেন গুপ্ত জানান, করোনার কারণে পণ্য আমদানি বাড়ায় বেনাপোলে জট লেগেছে। আমরা ১০ দিন পর সোমবার পণ্য খালাস করতে পেরেছি। তবে অন্য সময় খালাস প্রক্রিয়া স্বাভাবিক থাকে। 

যশোর মোটরাপার্টস ব্যবসায়ী সমিতির সভাপতি ও আমদানিকারক শাহিনুর হোসেন জানান, বর্তমানে বেনাপোলে পণ্যজট ভয়াবহ আকার ধারণ করেছে। ওপার থেকে বেনাপোলে প্রবেশ করতে ১০ দিন সময় লাগছে। আবার তাড়াহুড়া করে পণ্য খালাস করায় অনেক সময় পণ্য নষ্ট হয়ে যাচ্ছে।

বেনাপোল সিঅ্যান্ডএফ অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি মো. মফিজুর রহমান সজন বলেন, বেনাপোল স্থলবন্দর গুরুত্বপূর্ণ বন্দর। স্থলবন্দরটি খুবই অচলাবস্থার মধ্যে দিয়ে খুঁড়িয়ে চলছে। ধীরে ধীরে বন্দরটি ব্যবসায়িক কার্য্ক্রমের অনুপযোগী হয়ে পড়ছে। এই বন্দরকে আরো গতিশীল করে তোলার জন্য প্রথমেই দূর করতে হবে জায়গার সংকট। জায়গা সংকটের কারণে অনেক পণ্য রাখা যাচ্ছে না। এখন একটি ট্রাক খালাসের পর আরেকটি প্রবেশ করছে। এ কারণে ভারতের পেট্রাপোল বন্দর থেকে আমদানিকৃত পণ্য নিয়ে গাড়িকে বেনাপোলে প্রবেশের জন্য দীর্ঘ অপেক্ষায় থাকতে হয়। এখনো বেনাপোলে ঢোকার অপেক্ষায় পেট্রাপোলে কমপক্ষে পাঁচ হাজার গাড়ি লাইনে দাঁড়িয়ে রয়েছে।

তিনি বলেন, বেনাপোল স্থলবন্দরকে বাণিজ্যের উপযোগী করে তুলতে এর ধারণক্ষমতা বাড়াতে হবে। পাশাপাশি নির্মাণ করতে হবে প্রয়োজনীয় অবকাঠামো। বাড়াতে হবে বন্দরের ইক্যুইপমেন্ট। এ বিষয়ে সরকার যদি দ্রুত পদক্ষেপ গ্রহণ না করে, তাহলে বন্দরটির কর্মচাঞ্চল্য কমতে কমতে এটি খুব শিগগিরই অচল হয়ে পড়বে। 

বন্দর সূত্রে জানা গেছে, ২০১৪-১৫ অর্থবছরে ১৩ লাখ ৭৯ হাজার ৩৫০ মেট্রিক টন, ২০১৫-১৬ অর্থবছরে ১২ লাখ ৮৮ হাজার ৯৩৮ মেট্রিক টন, ২০১৬-১৭ অর্থবছরে ১৩ লাখ ৯৩ হাজার ৩১৯ মেট্রিক টন, ২০১৭-১৮ অর্থবছরে ১৯ লাখ ৮৮ হাজার ৩৫৭ মেট্রিক টন ও গেল ২০১৮-১৯ অর্থবছরে আমদানি হয়েছে ২১ লাখ ৮১ হাজার ১২৩ মেট্রিক টন পণ্য আমদানি করা হয়। আর ২০১৯-২০ অর্থবছরে বেনাপোল বন্দর দিয়ে ১৭ লাখ ৭৮ হাজার ৬২৮ মেট্রিক টন বিভিন্ন ধরনের পণ্য আমদানি হয়েছে।

বেনাপোল স্থলবন্দরে আসা পণ্য লোডিং-আনলোডিংয়ের জন্য মাত্র ছয়টি ক্রেন ও পাঁচটি ফর্কলিফট রয়েছে। তবে এদের মধ্যে বেশিরভাগ যন্তপাতি অচল অবস্থায় থাকে বলে অভিযোগ ব্যবসায়ীদের। বেনাপোল আমদানি-রফতানি সমিতির সিনিয়র সহসভাপতি আমিনুল হক বলেন, বেনাপোল বন্দরে পণ্য লোড-আনলোড করার জন্য একটি ক্রেন ব্যবহার করা হচ্ছে। বাকিগুলো ঠিকভাবে কাজ করছে না। 

এ বিষয়ে বেনাপোল স্থলবন্দর কর্তৃপক্ষের উপপরিচালক মামুন কবির তরফদার বলেন, বন্দরের জায়গা সংকট ও ইক্যুইপমেন্ট স্বল্পতার বিষয়ে ব্যবসায়ীরা আমাদের জানিয়েছেন। এই সমস্যাগুলো সমাধানে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণের জন্য আমরা কর্তৃপক্ষকে জানিয়েছি। ইতোমধ্যে আমাদের ৮৭ কোটি টাকা ব্যয়ে বৃহৎ দু’টি ইয়াড নির্মাণকাজ হয়েছে। এতে পণ্য ধারণ ক্ষমতা বেড়েছে। ২৫ একর জায়গা আমরা অধিগ্রহণ করেছি। আরো সাড়ে ১৬ একর অধিগ্রহণের প্রস্তাবনা রয়েছে। শিগগিরই ২৮৯ কোটি টাকা ব্যয়ে বোনপোলে কার্গো ভেহিক্যাল টার্মিনাল স্থাপনের কাজ শুরু হবে। ৪৫ কোটি টাকা ব্যয়ে সিসিটিভি স্থাপন করা হবে। এসব বাস্তবায়ন হলে এই বন্দরে আর কোনো সমস্যা থাকবে না। 

তিনি বলেন, করোনার বন্ধের কারণে জুলাই মাসে আমদানি বেড়েছে। গেল জুলাই মাসে পণ্য আমদানি হয়েছে এক লাখ ৩০ হাজার মেট্রিক টন। আর চলতি আগষ্ট মাসের ১০ দিনে আমদানি হয়েছে ৪৩ হাজার মেট্রিক টন। যে কারণে পণ্যজট লেগেছে। তবে আগামী ৮-১০ দিনের মধ্যে সব পণ্য খালাস হয়ে যাবে। 

সাম্প্রতিক দেশকাল ইউটিউব চ্যানেল সাবস্ক্রাইব করুন

মন্তব্য করুন

Epaper

সাপ্তাহিক সাম্প্রতিক দেশকাল ই-পেপার পড়তে ক্লিক করুন

Logo

ঠিকানা: ১০/২২ ইকবাল রোড, ব্লক এ, মোহাম্মদপুর, ঢাকা-১২০৭

© 2024 Shampratik Deshkal All Rights Reserved. Design & Developed By Root Soft Bangladesh

// //