সয়াবিন তেলের দাম যেন বানরের তৈলাক্ত বাঁশ

‘কোনো জিনিসের দাম বাড়তে সময় লাগে না, রাতারাতি হু হু করে বেড়ে যায়; কিন্তু দাম কমানোর বেলায় ব্যবসায়ীদের যেন বেজায় কষ্ট। কেবল তেল না, সব জিনিসপত্রেই এমনটা ঘটছে। এটাই যেন এখন রীতিতে পরিণত হয়েছে।’

রাজধানীর কারওয়ানবাজারে গত ১৮ জুলাই সয়াবিন তেল কিনতে এসে এভাবেই আক্ষেপ প্রকাশ করেছিলেন বেসরকারি চাকরিজীবী রবিউল ইসলাম। দেশের বাজারে সয়াবিন তেলের দাম লিটারে প্রথমে ৬ এবং পরে ১৪ টাকা কমানোর ঘোষণা এলেও বাজারে তার প্রভাব পড়েনি। এখনো সেই আগের দাম ১৯৯ টাকা লিটারেই বিক্রি করছেন খুচরা বিক্রেতা। রাজধানীর কোথাও কোথাও আবার ২০৫ টাকা লিটারে সয়াবিন তেল বিক্রি হচ্ছে। দাম কমানোর সিদ্ধান্তের পরও বেশি দামে তেল কিনে ক্ষুব্ধ ভোক্তারা। আর বিক্রেতারা বরাবরের মতোই দাঁড় করাচ্ছেন সেই পুরনো অজুহাত- অনেকের কাছে আগের তেল রয়ে গেছে। তাই পূর্বের বাড়তি দামেই বিক্রি করছেন তারা।

শাহজাদপুরের মাহি জেনারেল স্টোরের ব্যবসায়ী জাহাঙ্গীর আলম বলেন, ‘অনেক দোকানেই আগের কেনা তেল এখনো শেষ হয়নি। তাই পুরনো দামেই বিক্রি হচ্ছে। নতুন দামের বোতল এলে নতুন দামে বিক্রি হবে।’ 

বিশেষজ্ঞরা বলছেন, আন্তর্জাতিক বাজারে সয়াবিনের মূল্যবৃদ্ধির সঙ্গে সঙ্গেই দেশে বাড়াতে তোড়জোড় শুরু করে দেন ব্যবসায়ীরা। অনেক সময় সরকারি সিদ্ধান্তের অপেক্ষা না করে লোকসান দেখিয়ে নিজেরাই বাড়িয়ে দেন; কিন্তু আন্তর্জাতিক বাজারে দাম কমলে তখন আর দীর্ঘ সময়েও সমন্বয় করা হয় না। আলোচনা-সমালোচনার মুখে নানা কাঠ-খড় পুড়িয়ে কিছু কমানো হলেও তা বাস্তবায়ন করতেই কেটে যায় আরও সময়। আর এ সুযোগে ব্যবসায়ীরা বাড়তি কামিয়ে ঠকান ভোক্তাদের। 

আন্তর্জাতিক বাজারের চিত্র বলছে, গত দুই মাসের ব্যবধানে সয়াবিনের দাম ৩২ শতাংশ পর্যন্ত কমেছে। পাম তেলের দাম কমেছে আরও বেশি, ৪৮ শতাংশ পর্যন্ত। বিশ্ববাজারের এবারের এমন ধস ২০০৮ সালকেও ছাড়িয়ে গেছে। 

যুক্তরাষ্ট্রের কমোডিটি এক্সচেঞ্জ শিকাগো বোর্ড অব ট্রেডের তথ্যে দেখা যায়, গত মে মাসের প্রথম সপ্তাহে পরিশোধিত সয়াবিন তেলের দর ছিল টনপ্রতি ১ হাজার ৯৫০ ডলার। চলতি মাসের গত সপ্তাহে তা নেমে আসে টনপ্রতি ১ হাজার ৩১৮ ডলারে। এমন বড় দরপতন আগে কখনো দেখা যায়নি। অপরদিকে মালয়েশিয়ার কমোডিটি এক্সচেঞ্জ বুশরা মালয়েশিয়া ডেরিভেটিভসের তথ্য বলছে, গত ৫ মে অপরিশোধিত পাম তেলের দর ছিল ৭ হাজার ৩৮২ মালয়েশিয়ান রিঙ্গিত। চলতি মাসের গত সপ্তাহে তা ৩ হাজার ৮৫০ রিঙ্গিতে নেমে আসে। 

আন্তর্জাতিকে এত বড় দরপতনের পর দেশের বাজারে ভোজ্যতেলের দাম লিটারে এবার ১৪ টাকা করে কমাতে সম্মত হয়েছেন মিল মালিকরা। গত ১৭ জুলাই মন্ত্রণালয়ের এক বৈঠকে এ সিদ্ধান্ত হয়। নতুন দাম অনুযায়ী, প্রতিলিটার বোতলজাত সয়াবিন তেলের দাম পড়বে ১৮৫ টাকা, খোলা সয়াবিন তেল ১৬৬ টাকা ও পাম তেল ১৫২ টাকা। এর আগে গত ২৬ জুন মন্ত্রণালয় ও মিল মালিকদের যৌথ সিদ্ধান্ত অনুযায়ী, প্রতিলিটার বোতলজাত সয়াবিন তেল ছয় টাকা কমিয়ে ১৯৯, খোলা সয়াবিন তেল ১৮০ ও পাম তেলের দর ১৫৮ টাকা নির্ধারণ করা হয়েছিল। মূলত আন্তর্জাতিক বাজারে ঊর্ধ্বমুখী প্রবণতার মধ্যে ব্যবসায়ীদের দাবির মুখে চলতি বছরে ফেব্রুয়ারি থেকে ৯ জুন পর্যন্ত তিন দফায় ভোজ্য এই তেল লিটারপ্রতি ৫৫ টাকা বাড়ানো হয়েছিল। 

এদিকে রাজধানীর বাড্ডা, রামপুরা, মালিবাগ, যাত্রাবাড়ী, কদমতলীসহ কয়েকটি এলাকায় খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, অনেক মহল্লার দোকানে এখনো প্রতিলিটার বোতলজাত সয়াবিন তেল বিক্রি হচ্ছে ২০৫ টাকায়। আর খোলা তেল মিলছে প্রতিলিটার ১৯০ থেকে ১৯৫ টাকায়। বাজারের দোকানগুলোতে অবশ্য ১৯৯ থেকে ২০০ টাকা লিটার দরে তেল বিক্রি শুরু হয়েছে। তবে নতুন ঘোষণা অনুযায়ী তেল বিক্রি, সে তো দূরঅস্ত। 

উত্তর বাড্ডার মুদি দোকানি সোহেল রানা বলেন, ‘ঈদের আগেও অনেক দোকানে ২০৫ টাকা লিটার দরে সয়াবিন বিক্রি হয়েছে। বর্তমানে দাম ২০০ টাকায় নেমে এসেছে। তবে এলাকার মুদি দোকানগুলোতে এখনো সেই আগের দামেই তেল বিক্রি হচ্ছে। সেগুলো হয়তো আগের কেনা। তাই বাড়তি দাম রাখছে।’ 

মালিবাগ বাজারে তেল কিনতে আসা মোবারক হোসেন জানান, চৌধুরীপাড়ায় তার বাসা। এলাকার একাধিক দোকান ঘুরেও নতুন দামে তেল কিনতে পারেননি। অবশেষে বাজারে এসে ১৯৯ টাকা দরে কিনেছেন। কথা হলে তিনি বলেন, ‘দাম কমানো হয়েছে জুনের শেষে। এখন জুলাইয়ের শেষে এসেও তা বাস্তবায়ন হয় না। কই দাম বাড়ানোর সময় তো দোকানিরা বলেন না যে- নতুন বোতল এখনো আসে নাই। কম দামেই নেন! দাম বাড়তেও তো সময় লাগে।’

ভোজ্যতেলের বাজারে অস্থিরতা অবশ্য হঠাৎ শুরু হয়নি। এর শুরুটা হয় ২০২০ সালের শেষ দিকে। করোনার প্রকোপে বিশ্ববাজারের পাশাপাশি দেশেও অস্থিরতা দেখা দেয়। এর মধ্যে গত ফেব্রুয়ারিতে ইউক্রেন-রাশিয়া যুদ্ধ বৈশ্বিক বাজারে আরও উত্থান ঘটায়। কেননা বিশ্বে সূর্যমুখী তেলের চাহিদার এক-তৃতীয়াংশ জোগান দেয় এ দুটি দেশ। যুদ্ধের কারণে সেই তেলের সরবরাহ বন্ধ হওয়ায় চাপ পড়ে প্রধান দুটি ভোজ্যতেল পাম ও সয়াবিনের উপর। অন্যদিকে গত এপ্রিলের শেষ দিকে ইন্দোনেশিয়া সয়াবিনের কাঁচামাল রপ্তানিতে নিষেধাজ্ঞা আরোপ করায় এ চাপ আরও বাড়িয়ে দেয়। এ ছাড়া আর্জেন্টিনাও রপ্তানি সীমিত করায় অস্থিরতা আরও বেড়ে যায়। দাম নিয়ন্ত্রণে রাখতে তাই গেল রোজার আগে ভোজ্যতেল আমদানি, উৎপাদন ও সরবরাহ পর্যায়ে দুই দফা মূল্য সংযোজন কর কমায় সরকার। তবে এর সুফল পায়নি ভোক্তারা।

আন্তর্জাতিক বাজারে মূল্যবৃদ্ধির কারণ দেখিয়ে উল্টো গত ৯ জুন সয়াবিনের দাম বাড়িয়ে প্রতি লিটার ২০৫ টাকা নির্ধারণ করেন ব্যবসায়ীরা। গত মার্চেও যা ছিল ১৬০ টাকা। সেখান থেকে বেড়ে এপ্রিলে দাঁড়িয়েছিল ১৯৮ টাকা। চলতি বছরের ফেব্রুয়ারিতে অবশ্য ছিল ১৬৮ টাকা। ২০২১ সালের অক্টোবরে ছিল ১৬০ টাকা। একই বছরের সেপ্টেম্বরে ১৫৩ এবং মে মাসে ১৪১ টাকা দরে সয়াবিন তেলের লিটার বিক্রি হয়। মূলত বাজার ব্যবস্থাপনায় ঘাটতি এবং আমদানি-মজুদ-সরবরাহের তথ্যে নজরদারি না থাকা, মূল্য সমন্বয়ে বিলম্ব, ত্বরিত সিদ্ধান্তের অভাব- এসব কারণে বাজারে অস্থিরতার সুযোগ তৈরি হয় বলে মনে করেন বেসরকারি গবেষণা প্রতিষ্ঠান সিপিডির বিশেষ ফেলো ড. মোস্তাফিজুর রহমান।

তিনি বলেন, ‘দাম বাড়ানোর বেলায় দ্রুততা থাকলেও কমানোর ক্ষেত্রে বিলম্ব দেখা যায়। ভোজ্যতেলের সঙ্গে কোটি কোটি ভোক্তার স্বার্থ জড়িত। সুতরাং এ ক্ষেত্রে অবশ্যই ত্বরিত সিদ্ধান্ত নিতে হবে। আবার দাম কমালেও আন্তর্জাতিক বাজারে যে পরিমাণ কমে দেশের বাজারে সে পরিমাণ কমে না। এ ক্ষেত্রে সামঞ্জস্য থাকা জরুরি। এছাড়াও কী পরিমাণ আমদানি, মজুদ ও সরবরাহ হচ্ছে সেদিকেও সরকারের কড়া নজরদারি থাকতে হবে।’ 

তিনি বলেন, ‘আমাদের ভোজ্যতেলের বাজারে হাতে গোনা কয়েকটি বড় প্রতিষ্ঠান আমদানি ও সরবরাহ করে থাকে। এখানে খতিয়ে দেখা প্রয়োজন যে, এ খাতে নতুন প্রতিষ্ঠানের প্রবেশের ক্ষেত্রে কোনো বাধা রয়েছে কি-না। পাশাপাশি কোনো সিন্ডিকেট রয়েছে কি-না। এসব থাকলে তা ভাঙতে হবে।’

পণ্যের দাম বাড়ানোর বেলায় যে পদ্ধতি অবলম্বন করা হয় কমানোর ক্ষেত্রে তা ব্যবহার করা হয় না বলে মনে করেন কনজুমার্স অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের (ক্যাব) সভাপতি মো. গোলাম রহমান।

বর্তমানে সয়াবিন তেলের কমানো দাম আন্তর্জাতিক বাজারের সঙ্গে কতটা সামঞ্জস্যপূর্ণ হয়েছে তা নিয়ে প্রশ্ন তুলে তিনি বলেন, ‘বিশ্ববাজারের সঙ্গে সমন্বয় করে অবশ্যই দাম বাড়াতে হবে। তেমনি দাম কমানোর বেলাতেও কালক্ষেপণ না করে একই পদ্ধতি ব্যবহার করে কমাতে হবে। যদিও ডলারের বিপরীতে টাকার দাম ওঠানামা করায় সমস্যা তৈরি হচ্ছে। তারপরও সবকিছু বিবেচনায় রেখে নিয়মিত মূল্য সমন্বয় করা জরুরি। আবার দাম কমার ঘোষণা দিলেই কাজ শেষ হয়ে যায় না। তা পুরোপুরি বাস্তবায়নও করতে হবে। বাজার নজরদারিতে ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণে অধিদপ্তরকে আরও তৎপর হতে হবে। নইলে ক্ষতিগ্রস্ত হবে ভোক্তা।’

সাম্প্রতিক দেশকাল ইউটিউব চ্যানেল সাবস্ক্রাইব করুন

মন্তব্য করুন

Epaper

সাপ্তাহিক সাম্প্রতিক দেশকাল ই-পেপার পড়তে ক্লিক করুন

Logo

ঠিকানা: ১০/২২ ইকবাল রোড, ব্লক এ, মোহাম্মদপুর, ঢাকা-১২০৭

© 2024 Shampratik Deshkal All Rights Reserved. Design & Developed By Root Soft Bangladesh

// //