পেঁয়াজে স্বয়ংসম্পূর্ণ হতে বাধা কোথায়

খাদ্য উৎপাদনে সুবর্ণ সময় পার করছে বাংলাদেশ। সোনালি ইলিশেও এসেছে প্রাচুর্য। তিন বছর ধরেই কোরবানির পশুর জন্য বাংলাদেশ আর ভারতের ওপর নির্ভরশীল নয়। চলতি বছরের বিশ্ব খাদ্য পরিস্থিতি প্রতিবেদন অনুসারে বাংলাদেশ এখন ধান উৎপাদনে বিশ্বে চতুর্থ এবং আলু, আম ও পেয়ারা জাতীয় ফল উৎপাদনেও ষষ্ঠ অবস্থানে রয়েছে। সবজি উৎপাদনেও অনেক দেশের চেয়ে ভালো অবস্থানে রয়েছে বাংলাদেশ।

তবে বড় সমস্যা পেঁয়াজে। এ পণ্যটির জন্য ভারতনির্ভরতা কিছুতেই কাটাতে পারছে না বাংলাদেশ। দেশে চাহিদার তুলনায় পেঁয়াজের উৎপাদন কম হওয়ায় মাঝেমধ্যে সংকটে পড়তে হয়। আমদানি বন্ধ বা নিয়ন্ত্রিত হলে চলে যায় দাম নাগালের বাইরে। নতুন করে বড় সংকটে পড়েছে বাংলাদেশ। পেঁয়াজ রপ্তানিতে ৪০ শতাংশ শুল্ক আরোপ করেছে ভারত সরকার। ফলে প্রতি কেজিতে ১০ টাকা বাড়তি খরচ হবে। এর ফলে ভারত থেকে পেঁয়াজ আমদানি করতে কেজিপ্রতি দাম পড়বে ৫০ থেকে ৫৬ টাকা। অথচ জাতিসংঘের খাদ্য ও কৃষি সংস্থার (এফএও) হিসাবে, বাংলাদেশ পেঁয়াজ উৎপাদনে বিশ্বে অষ্টম স্থানে। তবুও পেঁয়াজের সংকট কাটছে না। সমস্যাটা কোথায়? কেন পেঁয়াজে স্বয়ংসম্পূর্ণ হতে পারছে না বাংলাদেশ?

সংশ্নিষ্টরা বলছেন, কৃষিপ্রধান দেশ হয়েও পেঁয়াজের পুরো চাহিদা পূরণ করতে না পারার কারণ সংরক্ষণাগারের অভাব, পণ্যটি নষ্ট হওয়া, বীজের সংকট, কৃষকদের প্রশিক্ষণ না থাকা, অপ্রতুল গবেষণা, দামের ওঠানামা, কৃষকের জন্য প্রণোদনা না থাকা ও গ্রীষ্মকালীন পেঁয়াজের উৎপাদন কম হওয়াসহ নানা সমস্যা। তবে আশার কথা হচ্ছে, এসব সংকট উতরানোর পথে হাঁটছে সরকার।

সংরক্ষণের অভাবে নষ্ট ৩০ শতাংশ: বাংলাদেশে পেঁয়াজ সংরক্ষণের জন্য কোনো কোল্ডস্টোরেজ নেই। কৃষকরা নিজেদের বাড়িতে দেশীয় পদ্ধতিতে সংরক্ষণ করে থাকেন। কিন্তু তাতে পেঁয়াজ বেশি নষ্ট হয়। পেঁয়াজ সংরক্ষণের জন্য যে আধুনিক তাপ নিয়ন্ত্রণব্যবস্থা থাকা দরকার, তা সরকারি-বেসরকারি কোনো পর্যায়ে নেই। 

কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের তথ্যমতে, ২০১৯-২০ সালে দেশে দুই লাখ ৩৭ হাজার ৯০০ হেক্টর জমিতে পেঁয়াজ উৎপাদন হয় ২৫ লাখ ৬৬ হাজার ৭০০ টন। এ সময় আমদানি হয়েছে ১০ লাখ টন। সে হিসাবে ধারণা করা হয়, দেশে পেঁয়াজের চাহিদা প্রায় ৩৪-৩৫ লাখ টন। অর্থাৎ ঘাটতি প্রায় ১০ লাখ টন। তবে যে পরিমাণ পেঁয়াজ আমদানি করতে হয়, প্রায় ততটাই নষ্ট হয়।

মসলা গবেষণা কেন্দ্রের গ্রীষ্মকালীন পেঁয়াজ প্রকল্পের প্রকল্প পরিচালক মো. নূর আলম চৌধুরী বলেন, সংরক্ষণের সময় সব ধরনের পেঁয়াজ ৩০ ভাগ অপচয় হয়। সংরক্ষণের ব্যবস্থা না থাকায় অনেক কৃষক গ্রীষ্মকালীন বারি জাতসহ নানা উন্নত জাতের পেঁয়াজ চাষে তেমন আগ্রহী নন। তিনি বলেন, বাংলাদেশের চাহিদার পুরোটা পূরণ করতে হলে দেশেই অন্তত ৩৫ লাখ টন পেঁয়াজের উৎপাদন করতে হবে। তাহলে যেটুকু নষ্ট হবে, তা বাদ দিয়ে বাকি পেঁয়াজ দিয়ে দেশের চাহিদা পূরণ সম্ভব।

বাংলাদেশ কৃষি গবেষণা ইনস্টিটিউটের এক গবেষণায় বলা হয়েছে, পৃথিবীর প্রধান পেঁয়াজ উৎপাদনকারী দেশগুলোর চেয়ে বাংলাদেশের আবহাওয়া ব্যতিক্রম। এটি উৎপাদন করতে কমপক্ষে তিন থেকে চার মাস নিরবচ্ছিন্ন শীত থাকতে হয়। কিন্তু বাংলাদেশের মোট বৃষ্টিপাত ও গড় তাপমাত্রা বেশি।

সরবরাহে সমন্বয়হীনতা: পেঁয়াজে ভারতনির্ভরতাকে প্রধান সমস্যা হিসেবে চিহ্নিত করে ইন্টারন্যাশনাল ফুড পলিসি রিসার্চ ইনস্টিটিউট (ইফপ্রি) এক গবেষণায় বলেছে, অক্টোবর ও নভেম্বরে পণ্যটির বাজারে সরবরাহ রাখা নিয়ে সমন্বয়হীনতা রয়েছে। উপকরণ সহায়তা ও সমন্বিত নীতির প্রয়োগের মাধ্যমে উৎপাদন বৃদ্ধির সম্ভাবনাকে দ্রুত কাজে লাগিয়ে এ সংকটকে সহজেই মোকাবিলা করা সম্ভব।

আবাদ এলাকা কম: সব জমিতে পেঁয়াজের ফলন না হওয়াকে উৎপাদন কম হওয়ার কারণ হিসেবে মনে করছেন বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক ড. মোহাম্মদ জহিরুদ্দিন। তিনি বলেন, বাংলাদেশের উত্তর-পশ্চিমের জেলাগুলোতে পেঁয়াজের ফলন ভালো হয়। কিন্তু সিলেট বা দক্ষিণে চট্টগ্রামের উঁচু বা নিচু ভূমিতে এর ফলন হয় না। কারণ জমিতে পানি জমে যাওয়ার আশঙ্কা থাকে।

তবে বাংলাদেশ কৃষি গবেষণা ইনস্টিটিউটের কৃষি অর্থনীতি বিভাগের মুখ্য বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা ড. মো. আব্দুর রশীদ বলেন, সিলেট বিভাগের বিস্তীর্ণ এলাকা রবি মৌসুমে অনাবাদি থাকে। পেঁয়াজ চাষে খুবই কম পানির প্রয়োজন হয়। ফলে এসব এলাকার এক লাখ হেক্টর জমি পর্যায়ক্রমে পেঁয়াজ চাষের আওতায় আনতে পারলে ১০-১২ লাখ টন পেঁয়াজ উৎপাদন করা যেতে পারে। তিনি বলেন, দেশের অন্যান্য জেলায়ও শীতকালীন অন্য ফসলের সঙ্গে আন্তঃফসল হিসেবে পেঁয়াজের চাষ করেও দৈনন্দিন চাহিদা অনেকাংশে মেটানো সম্ভব।

বীজের অভাব: মানসম্পন্ন ও উন্নত বীজের অভাবে পেঁয়াজ চাষে আশানুরূপ ফলন পাওয়া যায় না। পেঁয়াজের বীজ উৎপাদন ও বিপণনে বেসরকারি খাতকে আকৃষ্ট করা যাচ্ছে না। আবার সরকারিভাবেও বীজ উৎপাদনে খুব বেশি নজর নেই। বাংলাদেশে মসলা জাতীয় ফসলের গবেষণা জোরদারকরণ প্রকল্পের পরিচালক ড. শৈলেন্দ্রনাথ মজুমদার বলেন, দেশে বছরে ১১০০ টন পেঁয়াজের বীজ দরকার হয়। এর মধ্যে সরকারিভাবে মাত্র পাঁচ-ছয় টন, বেসরকারিভাবে আরও ৫০-৬০ টন পেঁয়াজ বীজ উৎপাদিত হয়। বাকিটা কৃষকরা উৎপাদন করেন।

সুবিধা পাচ্ছেন না কৃষক: কৃষক পর্যায়ে পেঁয়াজের ন্যায্য দাম নিশ্চিত করা নিয়ে কার্যকর তদারকি ব্যবস্থা নেই। বৃষ্টি কিংবা সংরক্ষণের অভাবে নষ্ট হওয়ার ক্ষতি মোকাবিলা করার ক্ষমতাও অধিকাংশ কৃষকের নেই। ফলে মাঝেমধ্যে পেঁয়াজ চাষ লাভজনক থাকছে না। এতে কৃষকরা ঋণগ্রস্ত হয়ে পড়েন এবং শেষ পর্যন্ত চাষে আগ্রহ হারিয়ে ফেলেন। বিশেষজ্ঞরা পেঁয়াজ উৎপাদনে কৃষকদের প্রণোদনা দেওয়ার সুপারিশ করেছেন।

খাদ্য নিরাপত্তা নেটওয়ার্কের কেন্দ্রীয় সেক্রেটারি নুরুল আলম মাসুদ বলেন, কখনো কৃষক দাম না পেয়ে চাষাবাদ করে লোকসানের মুখে পড়েন। আবার কখনো অতিরিক্ত দামের কারণে বীজ পেঁয়াজ বিক্রি করে দেন। তিনি বলেন, কৃষকের চাষাবাদের খরচ বিবেচনায় রেখে পেঁয়াজের সর্বনিম্ন ও সর্বোচ্চ দাম নির্ধারণ করে দেওয়া উচিত। কৃষিপণ্যের দাম নির্ধারণে একটি স্বাধীন জাতীয় মূল্য কমিশন থাকা জরুরি। এছাড়া কৃষকের সুরক্ষার ব্যবস্থা ও কমিউনিটি পর্যায়ে হিমাগার স্থাপনসহ নানা সুযোগ-সুবিধার ব্যবস্থা করলে পেঁয়াজ চাষ বাড়বে।

গ্রীষ্মকালীন পেঁয়াজ চাষ বাড়ানোয় জোর: বাংলাদেশ কৃষি গবেষণা ইনস্টিটিউটের বিজ্ঞানীরা জানিয়েছেন, দেশে এখন পেঁয়াজের জনপ্রিয় জাত রয়েছে ১০টি। এর মধ্যে গ্রীষ্মকালীন পেঁয়াজের জাত আছে তিনটি। বাকিগুলো শীতকালীন। গাজীপুরে অবস্থিত বাংলাদেশ কৃষি গবেষণা ইনস্টিটিউটের (বারি) প্রধান বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা শৈলেন্দ্র নাথ মজুমদার বলেন, গ্রীষ্মকালীন পেঁয়াজ চাষ বাড়ালে চাহিদার বড় অংশ জোগান দেওয়া সম্ভব। এসব ফসল যখন উঠবে, তখন পেঁয়াজের দামও বেশি থাকে। ফলে কৃষকও লাভবান হবেন। আবার সারা বছর দেশে পেঁয়াজের উৎপাদন ও জোগান অব্যাহত থাকবে।

কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর জানিয়েছে, ২০১৯-২০ সালে গ্রীষ্মকালীন পেঁয়াজের আবাদ ছিল মাত্র ৩৪০ হেক্টর। সারা দেশে সম্ভাবনাময় স্থান নির্ধারণ করে আরও মোট ৫০০ হেক্টর জমিতে গ্রীষ্মকালীন পেঁয়াজের আবাদ বাড়ানো হয়েছে। বিগত অর্থবছর কৃষকরা প্রায় ৪০ হাজার মেট্রিক টন পেঁয়াজ মাঠ থেকে পেয়েছেন।

স্বয়ংসম্পূর্ণ হতে সরকারি উদ্যোগ : আগামী দুই বছরের মধ্যে পেঁয়াজে স্বয়ংসম্পূর্ণ হতে প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের নির্দেশে বাণিজ্য, কৃষি এবং অর্থ মন্ত্রণালয় গ্রহণ করেছে সমন্বিত উদ্যোগ। এর মধ্যে রয়েছে- বীজের সরবরাহ বাড়ানো, চাষাবাদে ভূমির পরিমাণ বৃদ্ধি করা, হিমাগার নির্মাণ, কৃষকের ন্যায্যমূল্য নিশ্চিতে সঠিকভাবে বাজারজাতকরণ ও গ্রীষ্মকালীন উৎপাদনে গবেষণা কার্যক্রম জোরদার করা। এজন্য পেঁয়াজ উৎপাদনে সমৃদ্ধ চার জেলাকে নিয়ে বিশেষ পরিকল্পনা গ্রহণ করা হয়েছে। বীজ, সার ও কীটনাশক কেনায় বিশেষ ভর্তুকি পাবেন কৃষক। এ ছাড়া ‘পেঁয়াজ ঋণ’ নামে একটি কর্মসূচি চালু করবে কেন্দ্রীয় ব্যাংক।

কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের মহাপরিচালক বাদল চন্দ্র বিশ্বাস বলেন, দেশের চরাঞ্চলে পেঁয়াজের আবাদ বাড়ানোর পাশাপাশি যেসব এলাকায় পণ্যটির উৎপাদন ভালো হয়, সেখানে আরও চাষাবাদের মহাপরিকল্পনা নেওয়া হয়েছে। আশা করছি, আগামী দুই বছরেই পেঁয়াজ উৎপাদনে স্বয়ংসম্পূর্ণ হবে বাংলাদেশ।

পেঁয়াজ রপ্তানিতে ভারত ৪০ শতাংশ শুল্ক আরোপ করলেও ‘বাংলাদেশে দামে তেমন প্রভাব পড়বে না’ জানিয়ে কৃষিমন্ত্রী বলেন, মাঠ পর্যায়ে খোঁজ নিয়ে দেখা গেছে, কৃষকদের কাছে এখনো তুলনামূলকভাবে পেঁয়াজের মজুদ আছে। কাজেই ভারত পেঁয়াজ রপ্তানিতে ৪০ শতাংশ শুল্ক আরোপ করলেও দেশে দামে তেমন প্রভাব পড়বে না। শুল্ক আরোপের ঘোষণায় এখন দাম কিছুটা বাড়লেও কয়েক দিন পর কমে আসবে। তুরস্ক, মিশর ও চীন থেকে পেঁয়াজ আমদানির চেষ্টা করা হবে বলেও জানান মন্ত্রী।

সাম্প্রতিক দেশকাল ইউটিউব চ্যানেল সাবস্ক্রাইব করুন

মন্তব্য করুন

Epaper

সাপ্তাহিক সাম্প্রতিক দেশকাল ই-পেপার পড়তে ক্লিক করুন

Logo

ঠিকানা: ১০/২২ ইকবাল রোড, ব্লক এ, মোহাম্মদপুর, ঢাকা-১২০৭

© 2024 Shampratik Deshkal All Rights Reserved. Design & Developed By Root Soft Bangladesh

// //