সরকার নির্ধারিত দাম মানছেন না ব্যবসায়ীরা

সরকার খুচরা বাজারে ছয়টি পণ্যের দাম নির্ধারণ করে দিয়েছে; কিন্তু দাম নির্ধারণের এক সপ্তাহ পরও বাজারে এর বাস্তবায়ন চোখে পড়েনি। প্রায় সবখানেই অতিরিক্ত দামে এসব পণ্য বিক্রি করতে দেখা যায়।

ঢাকার কাঁচাবাজারে ঘুরে দেখা যায়, আলু বিক্রি হচ্ছে ৪৫ থেকে ৫০ টাকা কেজি দরে। আমদানি করা পেঁয়াজের দাম প্রতিকেজি ৬০ থেকে ৭০ টাকা এবং স্থানীয় পেঁয়াজ বিক্রি হচ্ছে ৮০ থেকে ৯০ টাকা কেজিতে। এ ছাড়া এক হালি ডিম পাওয়া যাচ্ছে ৫০ থেকে ৫৫ টাকায়।

গত বৃহস্পতিবার সরকার খুচরা পর্যায়ে প্রতিটি ডিমের দাম সর্বোচ্চ ১২ টাকা, প্রতিকেজি আলু ৩৫ থেকে ৩৬ টাকা এবং দেশি পেঁয়াজ ৬৪ থেকে ৬৫ টাকা নির্ধারণ করে দেয়। তবে কাঁচাবাজারের খুচরা বিক্রেতারা এই দামের সমালোচনা করে বলছেন, এটি সমস্যায় প্রলেপ দেওয়ার চেষ্টা; কিন্তু সমাধান নয়।

তারা বলছেন, সরবরাহ শৃঙ্খলে দাম না কমলে খুচরা পর্যায়ে দাম কমানো সম্ভব নয়। এজন্য ভোক্তা ও নিয়ন্ত্রক কর্তৃপক্ষের মাঝখানে পড়ে খুচরা বিক্রেতারা এক বিরূপ পরিস্থিতিতে পড়েছেন বলে জানান।

ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদপ্তর বিগত গত এক সপ্তাহে বাজারে অভিযান চালিয়ে পাঁচ শতাধিক প্রতিষ্ঠানকে প্রায় ২০ লাখ টাকা জরিমানা করেছে। ভোক্তা অধিকার সংগঠন কনজ্যুমারস অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের (ক্যাব) সভাপতি ও সাবেক বাণিজ্যসচিব গোলাম রহমান বলেন, মুক্তবাজার অর্থনীতিতে দাম বেঁধে দিয়ে বাজার নিয়ন্ত্রণ করা যায় না। তবে ক্ষেত্রবিশেষে সেটা করতে হলে কতগুলো বিষয় বিবেচনায় নিতে হবে। তার একটা হলো- মূল্যস্ফীতির লাগাম টানতে যেসব উপায়-উপকরণ আছে, তার সঠিক ব্যবহার করা। সেই কাজটা বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের জন্য করা কঠিন। এটা হতে হবে বাংলাদেশ ব্যাংক ও অর্থ মন্ত্রণালয়ের সমন্বয়ে। গোলাম রহমান আরও বলেন, উৎপাদনস্থলে গিয়ে খোঁজখবর না নিয়ে বাজার অভিযানের মতো পদক্ষেপে হয়তো খুব বেশি লাভ হবে না। এসব পদক্ষেপ বাস্তবায়নে যথেষ্ট জনবল আছে কিনা, তা নিয়েও প্রশ্ন আছে। কারণ অভিযানকালে পণ্যের দাম কম নিলেও, পরে জরিমানার টাকাসহ বিক্রেতারা উশুল করে নেন। তখন দেখার কেউ থাকে না।

প্রতিকেজি আলু ৪৫ টাকায় বিক্রি করছিলেন কারওয়ানবাজারের ব্যবসায়ী আলী হোসেন। সরকার নির্ধারিত মূল্যে বিক্রি না করার বিষয়ে তিনি বলেন, ‘সরকার প্রতিকেজি ৩৫ থেকে ৩৬ টাকা দাম নির্ধারণ করেছে; কিন্তু এই দামে আলু পাইকারি কিনতেও পারছি না।’ তিনি বলেন, ‘শ্যামবাজার পাইকারি বাজার থেকে প্রতিকেজি ৪০-৪২ টাকায় আলু কিনতে হয়। তার পর পরিবহন এবং প্যাকেজিং খরচ যোগ করতে হয়। আমি প্রতিমাসে দোকানভাড়া হিসেবে ১৫,০০০ টাকা দেই ও দুজন বিক্রয়কর্মীর বেতনও দেই। এখন যদি আমরা সরকার নির্ধারিত দামে বিক্রি করতে চাই তবে আমাদের দোকান বন্ধ করতে হবে।’ তিনি জানান, সরবরাহ শৃঙ্খলের ওপর থেকে দাম নির্ধারণ করা হয়, অথচ তাদের মতো ক্ষুদ্র ব্যবসায়ীদের ভোগান্তিতে পড়তে হয়। তিনি আরও বলেন, ‘এখানে আমাদের কোনো প্রভাব নেই, আমরা বেশি দামে কিনছি, তাই বেশি দামে বিক্রি করতে হচ্ছে।’

দেশি পেঁয়াজ ৮০ থেকে ৮৫ টাকা ও আমদানি করা পেঁয়াজ ৬০ টাকায় বিক্রি হচ্ছে। কারওয়ানবাজারের আরেক ব্যবসায়ী শাহজাহান বলেন, ‘আলুর দাম বেশি হওয়ায় ক্রেতারা তাদের ওপর ক্ষুব্ধ। ডিএনসিআরপির মতো সরকারি সংস্থা তাদের ব্যবসা প্রতিষ্ঠানে বারবার অভিযান চালাচ্ছে।’ তিনি বলেন, ‘আমরা বেশি দামে বিক্রি করি কারণ আমরা বেশি দামে কিনি।’ সেলিম উদ্দিন নামে আরেক ব্যবসায়ী বলেন, ‘সরকারের নির্ধারিত দামে আমরা পেঁয়াজ-আলু কিনতে পারিনি। তা হলে এই দামে আমরা কীভাবে বিক্রি করব।’ এজন্য ব্যবসায়ীরা সরবরাহ শৃঙ্খলের সিন্ডিকেটের দিকে নজর দেওয়ার আহ্বান জানান।

বাংলাদেশ এনার্জি রেগুলেটরি কমিশন (বিইআরসি) প্রতিমাসে রান্নার জ্বালানি তরলীকৃত পেট্রোলিয়াম গ্যাসের (এলপিজি) দাম ঠিক করে দেয়। সেটাও ক্রেতারা নির্ধারিত দামে কিনতে পারেন না। লাগামহীন এই পরিস্থিতির কারণে মূল্যস্ফীতি বাড়ছে। সরকার তা নিয়ে চিন্তায় রয়েছে। পরিকল্পনা প্রতিমন্ত্রী শামসুল আলম গত সোমবার ইকোনমিক রিপোর্টার্স ফোরামের (ইআরএফ) এক কর্মশালায় বলেন, সরকারের পক্ষ থেকে বিভিন্ন পদক্ষেপ নেওয়া হলেও মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে আসছে না- এটা সরকারকে ভাবাচ্ছে। তিনি বলেন, নতুন ফসল উঠলে এবং সরবরাহ বাড়লে মূল্যস্ফীতি কমে আসবে। সংগ্রহ কম হয়েছে। ফলে দাম কিছুটা বাড়তি থাকার কথা। দাম বেঁধে দিয়ে বাজার নিয়ন্ত্রণ সম্ভব নয়।

কারওয়ানবাজারের কাঁচাবাজারের সামনে বিভিন্ন ধরনের ডিম বিক্রি করছেন ব্যবসায়ীরা। এক ব্যবসায়ী জানান, তারা ফার্মের ডিম এক হালি ৫০ টাকায় ও প্রতি ডজন ১৫০ টাকায় বিক্রি করছেন। তবে গ্রাহকরা বেশি পরিমাণে কিনলে তিনি সরকারের নির্ধারিত মূল্য মেনে চলার ইঙ্গিত দেন।

খুচরা দোকানে কেমন দাম
কারওয়ানবাজার, মোহাম্মদপুর টাউনহল মার্কেট, বাড্ডাবাজার ও শ্যামপুরবাজারের মতো বড়ো কাঁচাবাজার ছাড়াও আশপাশের দোকান ও ছোট বাজারে দাম কিছুটা বেশি থাকে। কল্যাণপুর (মিরপুর এলাকা) নতুনবাজারে দেখা যায়, খুচরা বিক্রেতারা প্রতিকেজি আলু ৫০ টাকা, দেশি পেঁয়াজ ৯০ টাকা কেজি ও আমদানি করা পেঁয়াজ ৬০-৬৫ টাকা কেজি দরে বিক্রি করছেন। এই এলাকায় দেখা যায় চার পিস ডিম পাওয়া যাচ্ছে ৫০-৫৫ টাকায়। তবে বেশিরভাগ সুপারশপে প্রতিহালি ডিম বিক্রি হচ্ছে ৪৮ টাকায় ও প্রতিডজন ১৪৪ টাকায়।

আলু উৎপাদন, তথ্যের অমিল
কৃষি সম্প্রসারণ অধিদফতর (ডিএই) ও বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) হিসাব অনুসারে বাংলাদেশে প্রতিবছর ৯০ লাখ টন আলুর চাহিদা রয়েছে। এ বছর উৎপাদন হয়েছে ১৪-১১.২ মিলিয়ন টন আলু।

তবে হিমাগার মালিকরা এই প্রতিবেদনের সঙ্গে দ্বিমত জানান। সম্প্রতি এক সংবাদ সম্মেলনে বাংলাদেশ কোল্ড স্টোরেজ অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি মোস্তফা আজাদ বলেন, ‘ডিএই জানিয়েছে, এ বছর ১১.২ মিলিয়ন টন আলু উৎপাদন হয়েছে, যেখানে চাহিদা ৯ মিলিয়ন টন।’ তিনি বলেন, ‘হিসাব অনুযায়ী ২.২ মিলিয়ন টন আলু উদ্বৃত্ত থাকবে; কিন্তু কোল্ড স্টোরেজ খালি আছে।’ তিনি আরও বলেন, ‘কোল্ড স্টোরেজে ২০% জায়গা খালি আছে। আমাদের তথ্য অনুযায়ী এ বছর উৎপাদন ৮.৫ মিলিয়ন টনের বেশি নয়।’

এই সংগঠনটি বলছে, গত কয়েক বছরে কৃষক ও আলু ব্যবসায়ীরা লোকসানের মুখে পড়েছেন। তারা সরিষা, গম এবং ভুট্টা চাষ বাড়িয়ে দিয়েছেন। ফলে আলু উৎপাদন কমেছে। তারা আরও জানান, ২০২২ সালে ১০.৭ মিলিয়ন টন আলু কোল্ড স্টোরেজে রাখা হয়েছিল, যা এই বছর কমেছে।

সাম্প্রতিক দেশকাল ইউটিউব চ্যানেল সাবস্ক্রাইব করুন

মন্তব্য করুন

Epaper

সাপ্তাহিক সাম্প্রতিক দেশকাল ই-পেপার পড়তে ক্লিক করুন

Logo

ঠিকানা: ১০/২২ ইকবাল রোড, ব্লক এ, মোহাম্মদপুর, ঢাকা-১২০৭

© 2024 Shampratik Deshkal All Rights Reserved. Design & Developed By Root Soft Bangladesh

// //