বৃদ্ধের মৃত্যু

একটি বালক বাঁশি বাজাতে বাজাতে বৃদ্ধের সামনে দিয়ে চলে যায়। উদোম গা পরনে ময়লা এক টুকরো আবরণ। চোখে মুখে শরীর উপচেপড়া প্রকৃতির শ্যামল স্নিগ্ধতা। সকাল গড়িয়ে গেছে। চৈত্রের ঝরঝরা মধ্যাহ্নপূর্ব সময়। ছোট্ট কুঁড়ে ঘরের দাওয়ায় বসে বৃদ্ধ দূর প্রান্তে অপলকে চেয়ে থাকে। আগের মতো দেখতে পারে না। ঘরের পেছনে মেঠো রাস্তা। ক্যাচর ক্যাচর শব্দে বুঝতে পারে গরুর গাড়ি যাচ্ছে। শুকনো দিন, গরুর পায়ে ওড়া ধুলা এসে লাগে বৃদ্ধের নাকে মুখে চোখে। ধুলার গন্ধে বৃদ্ধ চঞ্চল হয়ে ওঠে; কিন্তু সে কর্মক্ষম নয়, কোনো কাজ করতে পারে না। দাওয়ায় বসে ঘোলাটে চোখে শুধু দেখা। তাও যেটুকু দেখতে পারে, ক্লান্তি এলে ঝিমোয়। নিঃসঙ্গতা তার চারদিক। বুকের ভেতর মোচড় দিয়ে ওঠে, তবু বেঁচে আছে। কাছে কোলে কাউকে পায় না, যার সঙ্গে দু-চারটা কথা বলতে পারে। সবাই যার যার কাজে ব্যস্ত। 

মাঝে মাঝে জোমেলা আসে। সে এ বাড়িতে কাজ করে। সকালের নাস্তা, দুপুর রাতের খাবার গোসলের পানি, জোমেলা সব করে থাকে। সচরাচর অন্য কেউ আসে না। ছেলেরা ভোর থেকে সন্ধ্যা অবধি মাঠের কাজে ব্যস্ত থাকে। বৃদ্ধের খোঁজ নেবে সে সময় তাদের নেই। বউদের কথা নাই বা বললাম। রাতে বিছানায় বিনিদ্র কাটে। চোখের ঘুম যে কোথায় গেছে। হাহাকার, ঘুমের হাহাকার, সঙ্গীর হাহাকার। কথা না বলার কষ্ট যে কী, আগে  কখনো বোঝেনি। 

জোমেলাকে দেখলে বৃদ্ধের চোখ দুটি উজ্বল হয়ে ওঠে। বৃদ্ধের দৃষ্টি জোমেলার শরীর রঙিয়ে তোলে, জোমেলা তা বুঝতে পারে না। বৃদ্ধ তাকে ছাড়তে চায় না। ছোটখাটো ফাই ফরমাশে যতক্ষণ কাছে রাখতে পারে রাখে।

সকালটা ছিল উজ্জ্বল, চকচকে রোদে ভরা। বাঁশ বনের ঝরা পাতার ধ্বনির সঙ্গে ভেসে আসে ঘুঘুর ডাক। সকাল গড়িয়ে দুপুর আসে বিকাল। বিকালটা ম্লান ফ্যাকাশে হয়ে নীরবে নামে সন্ধ্যা। আকাশ হয়ে ওঠে গভীর থমথমে। প্রকৃতি শান্ত নীরব, টস টস শব্দে বৃষ্টি ঝরতে থাকে। দূরে মাঠের শেষে আবছা কুয়াশার মতো ভেসে আসে রাতের জোয়ার। বৃদ্ধের মন উতল হয়, কর্মহীন দিনযাপনের সীমাহীন প্রসারতায়। বাইরে জোরে বৃষ্টি পড়তে থাকে। গাছের পাতায় বৃষ্টির শব্দ, বাতাসে গুঞ্জন, আন্ধকার রাত। বৃদ্ধ বসে থাকতে থাকতে অস্থির, ঘরের ভেতর পায়চারী করে। তার মনে হয় এ বিশ্ব চরাচরে জনমানুষের কোনো চিহ্ন নেই। সব বিলুপ্ত হয়ে গেছে, হারিয়ে গেছে রহস্যময় আঁধারে।

জোমেলা খাবার নিয়ে আসে। বৃদ্ধ তাকে দেখে নিজের নিঃসঙ্গভাব কাটিয়ে ওঠার চেষ্টা করে। অভিযোগে প্রশ্ন করে, এত দেরি করে খাবার আনলি?

সব কাজ শেষ করি তবে আসতি হয়।

বেশ বুঝি, সব বুঝি, এখন আমার কথা মনে রাখার দরকার করনি। বৃদ্ধ দ্রুত শ্বাস নিতে থাকে।

জোমেলার মুখে বৃষ্টির পানি লেগে আছে, চুল থেকে পানি ঝরতে থাকে। ময়লা তেলচিটচিটে শাড়ির কিছু অংশ ভিজে গেছে। গায়ে ছেঁড়া ব্লাউজ। বগলের কাছে ছেঁড়া। শাড়ি ব্লাউজে ঘামের ঝাঁঝালো গন্ধ বৃদ্ধের নাকে লাগে। সে তার গামছা বাড়িয়ে দেয়, নে গা মাথা মুছে ফেল, অসুখ করবে।

আপনি খায়ে নেন, থালা বাসন নিয়ে যায়, অনেক রাত হইছে, বাড়ি যাব।

বাইরে অঝর ধারায় বৃষ্টি পড়ে, মাঝে মাঝে বিদ্যুতের ঝিলিক আলোকিত করে তোলে আঁধার রাত।

এই বৃষ্টিতে তুই যাবি কেমনে? একটু বস বৃষ্টি থামুক, বৃদ্ধ তাকে ছাড়তে চায় না।

জোমেলা বৃদ্ধের ভাব দেখে বিরক্ত হয়, মনে মনে ভাবে, বুড়োর কি হলো, এমন তো কোনো দিন করে না।

বৃদ্ধ জোর করে চৌকির ওপর তাকে বসায়। কথা বলার চেষ্টা করে, সাড়া পায় না। বৃদ্ধ নিরাশ হয়, খুব খারাপ বোধ করে। হঠাৎ তার মনে পড়ে, এতদিন যা যত্নে লুকিয়ে রেখেছে, কেউ জানে না। ছেলেরা বা তাদের বৌ সব জানলে যে করেই হোক নিয়ে নিত। সে যত্নের মতো আগলে রেখেছে। এখন মনে হয় ওটা রেখে কী হবে, কার জন্য রাখবে। বৃদ্ধ তার ভাঙা কিন্তু গোপনে যেটা সংরক্ষণ করেছে সেই বাক্সের দিকে হাত বাড়ায়। চৌকির নিচে এক কোণে ধুলায় আচ্ছাদন বাক্সটা টেনে বের করে। জোমেলা অবাক হয়ে বৃদ্ধকে লক্ষ্য করে, ভাবে কেন সে ওটা বের করে? বৃদ্ধ তার কোমরে পেঁচানো সুতো থেকে চাবি নিয়ে বাক্সের তালা খুলে অনেক আজেবাজে জিনিসের মধ্য থেকে বের করে আনে একটি জিনিস। অ্যাড়াবাতির আলোয় জোমেলার চোখে চকচক করে, জোমেলা উজ্জ্বল হয়ে ওঠে। 

বৃদ্ধ জোমেলার সামনে মেলে ধরে, এটা তোকে দেব আমি আর কি করব, তোর কাজে লাগবে।

জোমেলা বৃদ্ধের হাতে ধরা জিনিসটার দিকে একভাবে চেয়ে থাকে। সে ভাবে, এমন একটা জিনিস পেলে জীবনে কোনোদিন এমন জিনিসের নাগাল সে পাবে না! 

বৃদ্ধ আদুরে গলায় বলে, আয় তোর গলায় এটা পরিয়ে দিই।

বৃদ্ধ বাতির আলো কমিয়ে দেয়। ঘরের ভেতর আলো-আঁধারি পরিবেশ। বাইরে অবিরাম বৃষ্টি। বৃদ্ধ জোমেলার শরীর থেকে শাড়ি খুলে ফেলে। জোমেলা বিহ্বল বসে থাকে। সে কিছু করতে পারে না, তার গলায় শোভা পায় বৃদ্ধের এত দিনকার যত্নের জিনিসটি। 

জোমেলার যৌবন বৃদ্ধকে ভাসিয়ে নেয়, তার হাত তিরতির কাঁপে, গলা শুকিয়ে আসে, বুকের ধুঁকপুক বাড়তে থাকে। নিরাভরণ জোমেলা বৃদ্ধের তক্তপোষের ওপর চিত হয়ে শুয়ে থাকে। 

বৃদ্ধ আর এগোতে পারে না। সে ধসে পড়ে।

বৃষ্টি থেমে যায়। রাতের আঁধার কেটে ভোর কোমল সজীব।

বালকটি নতুন সকালে কাঁচি হাতে গরু নিয়ে চলে যায় ফসল ভরা ক্ষেতে। বৃদ্ধের বন্ধ ঘরের ভেতর নিকশ অন্ধকার, সেখানে ভোরের আলোর রেশ পৌঁছেনি।

সাম্প্রতিক দেশকাল ইউটিউব চ্যানেল সাবস্ক্রাইব করুন

মন্তব্য করুন

Epaper

সাপ্তাহিক সাম্প্রতিক দেশকাল ই-পেপার পড়তে ক্লিক করুন

Logo

ঠিকানা: ১০/২২ ইকবাল রোড, ব্লক এ, মোহাম্মদপুর, ঢাকা-১২০৭

© 2024 Shampratik Deshkal All Rights Reserved. Design & Developed By Root Soft Bangladesh

// //