ভাষার গল্প

ডাইনোসরদের নাম নিশ্চয় শুনেছ তোমরা। দেখতে কী কিম্ভূতকিমাকার! কত বিচিত্র তাদের আকার! আসলে একসময় দুনিয়া কাঁপাত ওই প্রাণীরা! তবে চিরটাকাল চলেনি তাদের রাজত্ব। একসময় তারা হারিয়ে গেল চিরকালের মতো। মজার ব্যাপার হলো, অত যে দাপুটে জানোয়ার, তার মুখে কিন্তু ছিল না কোনো ভাষা। আর শুধু ডাইনোসরের কথা বলছি কেন, আজকের দুনিয়ার তাবৎ প্রাণীর মধ্যে মানুষ ছাড়া আর কার মুখে ভাষা আছে?

নেই, কারোরই নেই। শুধু মানুষই পারে কথা বলতে। আসলে সেটাও মানুষের বুদ্ধির জোরেই। মানুষের মগজে এমন কিছু আছে, যার জোরে মানুষ কথা বলতে পারে। অন্য কোনো প্রাণীরই মগজ এতটা উন্নত নয় যে সে কথা বলতে পারবে।

এবারে মানুষের কথাই একটু শোনো। মানুষ কথা বলতে শিখেছে বহুকাল আগে। তারপর কেটে গেছে হাজার হাজার বছর। মানুষ ছড়িয়ে পড়েছে গোটা দুনিয়ায়। তাদের মধ্যে সৃষ্টি হয়েছে নানা জাতি, সৃষ্টি হয়েছে বহু ভাষা। নানা জাতির নানা ভাষা। আদি ভাষাগুলোও একটু একটু করে বদলেছে। আদি ভাষার শব্দসংখ্যা অল্প ছিল।

একদম শুরুতে অবশ্য মানুষ কাজ সারত ইশারা-ইঙ্গিতে। যখন প্রথম ভাষা আবিষ্কার করল, তখনো ইশারা-ইঙ্গিতের বেশ কদর ছিল। সেই ইশারা কি এখনো নেই? আছে। চোখের ইশারা, হাতের ইশারা, মাথা দুলিয়ে ইশারা এসব আমরা করি এখনো। তার মানে ইশারা বিদায় নেয়নি আজও।

তো, আদিকালের যাযাবর মানুষ যখন জায়গা বদল করল, তখন নিত্যনতুন সমস্যাও এল, নতুন নতুন জিনিস দেখল, নতুন ধরনের কাজের সাথে পরিচয় হলো। ফলে, বাধ্য হয়েই নতুন নতুন জিনিসকে বোঝানোর জন্য নতুন নতুন শব্দ তাদের দরকার হলো। দিনে দিনে একাধিক জাতির মানুষের মধ্যে দেখা-সাক্ষাৎ বাড়ল। এক ভাষার মধ্যে ঢুকতে লাগল অন্য ভাষার শব্দ। এভাবেই বদলাতে লাগল মানুষের ভাষা। সৃষ্টি হতে লাগল নতুন নতুন ভাষা। নদী চলতে চলতে তার জলের রং যেমন বদলায়, ভাষার ব্যাপারটাও অনেকটা তেমনই।

একটা ভাষা চিরকাল যে বেঁচে থাকবে, তেমন কোনো কথা কিন্তু নেই। কারণ, মানুষ কোনো ভাষায় কথা বললেই সেই ভাষা বেঁচে থাকে। কথা না বললে সেই ভাষা মরে যায়। পৃথিবীর অনেক বিখ্যাত ভাষা মরে গেছে। যেমন হিব্রু ও লাতিন। সেসব ভাষার চর্চার মাধ্যমে সেগুলোকে বাঁচিয়ে রাখার চেষ্টা চললেও মানুষ আর মাতৃভাষা হিসেবে সেগুলোর ব্যবহার করছে না। একেকটা ভাষা হলো বিশেষ জনগোষ্ঠীর পরিচয়চিহ্ন। মানে মানুষের জাতি চিহ্নিত করার একটি উপায় হলো তার ভাষা।

আবার যেসব জাতি ভাষার পরিচয়ে গড়ে ওঠে, সেগুলোকে বলে ভাষা-জাতি। যেমন বাঙালি। পৃথিবীতে যত মানুষ বাংলা ভাষায় কথা বলে, তারা সবাই মিলে তৈরি হয়েছে বাঙালি নামের এই ভাষা-জাতি। যদি বাংলা ভাষা পৃথিবী থেকে হারিয়ে যায়, তাহলে জাতি হিসেবে বাঙালিও নিশ্চিহ্ন হয়ে যাবে। তাই নিজের জাতিগত পরিচয় অটুট রাখার জন্যই বাঁচিয়ে রাখতে হবে নিজের ভাষাকে। আমরা উদাসীন হলে অন্য কেউ এসে বাঁচিয়ে দেবে না আমাদের ভাষাকে।

বিভিন্ন সময়ে বাংলা ভাষার ওপরে অনেকবার বড় বড় বিপদ এসেছে। বাঙালি নিজেদের মাতৃভাষাকে প্রাণ দিয়ে ভালোবাসে বলেই সেসব বিপদকে রুখে দিয়েছে। বাংলা ভাষার জন্য প্রধান তিনটি আন্দোলন হয়েছে। বাংলাদেশে ১৯৪৭ থেকে পঞ্চাশের দশকের মাঝামাঝি পর্যন্ত, পশ্চিমবঙ্গের পুরুলিয়ায় চল্লিশের দশকের শেষভাগ থেকে পঞ্চাশের দশকের মধ্যভাগ পর্যন্ত, আসামের বরাক উপত্যকার শিলচরে ১৯৬১ সালে ভাষা আন্দোলন হয়েছিল। তিনটি আন্দোলনই শেষ পর্যন্ত সফল হয়েছে।

ভাষার জন্য আন্দোলন করেই পুরুলিয়া জেলা বিহার থেকে পশ্চিমবঙ্গেও অন্তর্ভুক্ত হয়েছে। শিলচরের ভাষা আন্দোলনের ফলেই আসাম সরকার বরাক উপত্যকায় সরকারি ভাষা হিসেবে বাংলাকে স্বীকৃতি দিতে বাধ্য হয়েছিল। বাংলাদেশের ভাষা আন্দোলন ছিল বিরাট বড় একটি ঘটনা। এই ঘটনা গোটা দুনিয়ায় আলোড়ন তুলেছিল। এই আন্দোলনের ফলেই বাংলা ভাষা পৃথিবীতে প্রথমবারের মতো একটি দেশের রাষ্ট্রভাষার মর্যাদা পায়। ভাষা আন্দোলনের পথ বেয়ে আন্দোলন-সংগ্রাম করেই বাংলাদেশ নামের একটি স্বাধীন দেশের সৃষ্টি হয়েছে। আর বাংলাদেশ হলো পৃথিবীর সেই একমাত্র দেশ যে দেশের একমাত্র রাষ্ট্রভাষা ও জাতীয় ভাষা বাংলা।

বাংলাদেশ রাষ্ট্রের ভিত্তি ভাষা আন্দোলন হওয়ায় এ দেশের সব সরকারি কাজকর্মে এবং অফিস-আদালতে বাধ্যতামূলকভাবে বাংলা ভাষার ব্যবহার করতে হয়। দেশের ভেতরে কোনো সরকারি কাজে অন্য কোনো ভাষার ব্যবহার নিষিদ্ধ। এত সব কারণে বাংলাদেশের ভাষা আন্দোলন সারা বিশ্বে মাতৃভাষার মর্যাদা প্রতিষ্ঠার প্রতীক। ১৯৫২ সালের ২১ ফেব্রুয়ারি বাংলা ভাষার মর্যাদা প্রতিষ্ঠার জন্য পুলিশের গুলিতে বাঙালির আত্মদানের ঘটনার স্মরণে জাতিসংঘের স্বীকৃতি অনুযায়ী এখন সারা বিশ্বে একসঙ্গে পালিত হয় ‘আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস’। এই ভাষা দিবস তাই শুধু বাঙালির নয়, এখন গোটা পৃথিবীর গৌরব।

সাম্প্রতিক দেশকাল ইউটিউব চ্যানেল সাবস্ক্রাইব করুন

মন্তব্য করুন

Epaper

সাপ্তাহিক সাম্প্রতিক দেশকাল ই-পেপার পড়তে ক্লিক করুন

Logo

ঠিকানা: ১০/২২ ইকবাল রোড, ব্লক এ, মোহাম্মদপুর, ঢাকা-১২০৭

© 2024 Shampratik Deshkal All Rights Reserved. Design & Developed By Root Soft Bangladesh

// //