রতিমগ্ন

আরিফ কলেজ থেকে ফিরছিলো। তীরগ্রাম কলেজের সদ্য নিয়োগপ্রাপ্ত প্রভাষক সে। আর ফেরার পথেই সেই দৃশ্যটিতে তার চোখ আটকে যায়। একটি মধ্যবয়স্ক মাদি কুকুর লেজ উঁচিয়ে আছে। তার যোনিটা ভেজা। আরিফের হঠাৎ মনে হলো, সে যেনো তার শিশ্নটি ঢুকিয়ে দিচ্ছে কুকুরটির যোনিতে। এটি তার মনে হলো। এবং সে এই দৃশ্যকল্পটিকে ঝেড়ে ফেলে দিতে চাইলো মাথা থেকে। কিন্তু পারলো না। সে নিজেকে ধিক্কার দিলো, এরকম একটি নিচু চিন্তা তার মাথায় আসার জন্য। কিন্তু কিছুতেই কিছু হচ্ছে না। তার মাথা থেকে পলকের দেখা সেই দৃশ্যপটটি কিছুতেই সরছে না। থেকে থেকে ভেসে উঠছে করোটির ভেতর। মধ্যবয়স্ক কুক্কুরী, লেজ উঁচু করে রাখা, ভেজা যোনি। তারপর কল্পনার চিত্রটি তার মাথার ভেতর থেকে সড়াৎ করে নেমে আসে দৃশ্যচিত্রটির সাথে। সে তার শিশ্ন ঢুকিয়ে দিয়েছে কুকুরটির যোনির ভেতর। একটা নরম, একটা উষ্ণ অনুভবের ভেতর দিয়ে তার শিশ্নটি ডুকে যাচ্ছে কুক্কুরীটির যোনির ভেতর। পলকের একটি যৌন সুখ অনুভব করে সে।

আরিফের সাথে পা মিলিয়ে হাঁটার চেষ্টা করছে নুসরাত মুমু। সে দ্বাদশ শ্রেণির শিক্ষার্থী। কলেজ শেষে আরিফের বাসায় যায় প্রাইভেট পড়তে। আরিফ বাংলা বিষয়ের শিক্ষক। গ্রামের কলেজ, তেমন কেউ বাংলা বিষয়ের প্রাইভেট পড়ে না। কিন্তু মুমুর শখ হয় সে আবৃত্তি শিখবে। আরিফ ছাত্রজীবনে আবৃত্তি করেছে টুকটাক। সেটিই এখন এ অজপাড়া গার কলেজটিতে সাড়া ফেলে দিয়েছে। সে যখন ভরাট গলায় আবৃত্তি করে, ‘চুল তার কবেকার অন্ধকার বিদিশার নিশা।’ তখন অনেক মেয়েরাই তার চোখে চোখ রেখে স্থির চেয়ে থাকে। আরিফ বিষয়টিকে দারুণভাবে উপলব্ধি করে। সেও তাকিয়ে থাকে ছাত্রীদের চোখের দিকে। কিন্তু সাহস করে কোনো মেয়েই তার কাছে এগিয়ে আসে না। আবার তারও অতটা নিচে নেমে মেয়েদের সাথে যেচে কথা বলার অভ্যাস নেই। তবে একবার যদি সে কোনো মেয়ের সাথে কথা বলা শুরু করে দেয় তাহলে সেই মেয়ে তার কথার যাদুতে বিমোহিত হতে বাধ্য। ব্যাপারটি আরিফের আত্মবিশ্বাসে দাঁড়িয়েছে।

মুমুই প্রথম সাহসের বাঁধ ভেঙে এগিয়ে আসে আরিফের দিকে। আজ চৌদ্দ দিন যাবৎ সে আরিফের কাছে কবিতা আবৃতি শিখছে। কিন্তু একটি বিষয় তার মাথায় কিছুতেই ঢুকছে না, সেটি হলো কবিতার উপলব্ধি। আরিফ তাকে বুঝানোর চেষ্টা করেছে, কিন্তু নুসরাত মুমু সেটি অনেক চেষ্টা করেও রপ্ত করতে পারছে না। কিছু কিছু কবিতায় তার বোধোদয় ঘটে। যেমন সে যখন পড়ে, ‘তুমি আসবে বলে হে স্বাধীনতা/ সকিনা বিবির কপাল পুড়লো/ সিঁথির সিঁদুর মুছে গেলো হরিদাসির।’ তখন তার চোখ ফেটে কান্না আসে। কণ্ঠটি ভারি হয়ে আসে। কল্পনার ভেতর খেলে যায় একটি যুদ্ধ বিধ্বস্ত দেশের মানচিত্র। আবার যখন সে পাঠ করে, ‘বাংলার মুখ আমি দেখিয়াছি/ তাই পৃথিবীর রূপ খুঁজিতে যাই না আর।’ তখনো তার মনে তার সান্ত-স্নিগ্ধ গ্রামটির ছবি ভেসে উঠে। কিন্তু যখনই পড়তে যায়, ‘আমারে দুদণ্ড শান্তি দিয়েছিলো নাটোরের বনলতা সেন’ কিংবা শিমুল চৌধুরী ধ্রুব’র ‘প্রিয়তমা/ দেখো বৃষ্টি পড়ছে/ সেদিনের মতো, প্রথম বৃষ্টি/ তোমার কি একটু সময় হবে ভিজতে?’ তখন মুমু আটকে যায়। জীবনানন্দের দু’দণ্ডের শান্তি কিংবা সেদিনের মতো কোনো স্মৃতি তার মনে পড়ে না। কী যেনো একটি আবছায়া খেলে যায় তার করোটির ভেতর। একটা অনুভূতি হয়। তবে তা নির্দিষ্ট করে সে বলতে পারে না।

আরিফ মুমুকে বলে, পড়ে যাও, পড়তে থাকো, একদিন সব বুঝতে পারবে। এ কথাটি আরিফ মুমুকে বলে। আসলে সেও অনেক কিছুই বুঝতে পারে না। এমন এমন কিছু অদ্ভুত অনুভূতিতে সেও ভোগে, কিন্তু খোলাসা করে বুঝতে পারে না। তার অবুঝতা অবশ্য অন্য বিষয়ে। এই যেমন এখন এই কুক্কুরীটিকে দেখে তার কামভাব জাগলো কেনো এর কোনো ব্যাখ্যা তার জানা নেই। সে এই চিন্তাটি থেকে বেরুনোর চেষ্টা করেও পারছে না। সে দ্রুত পায়ে কুকুরটিকে পাশ কাটিয়ে চলে যায়। একবার আড় চোখে তাকায় মুমুর দিকে। সেও কি এ দৃশ্যটি দেখেছে? সেও কি দেখেছে একটি মধ্যবয়স্ক কুক্কুরী? লেজটি উঁচু করে রেখেছে? ভেজা যোনি?

নাহ! মনে হয় না। নিজের কাছে যুক্তি দাঁড় করায় আরিফ। মুমুর এতোদিকে খেয়াল নেই, সে হাঁটছে আরিফের পায়ের ছায়া লক্ষ্য করে। আরিফ জানে, মুমু এখন তাকেই অনুসরণ করছে একান্তভাবে। মাঝে মাঝে অনুকরণের চেষ্টাও আছে। আরিফ তাকে দমিয়ে দিয়েছে এ ব্যাপারে। বলেছে, ‘অনুকরণ করো না, পারলে অনুসরণ করো।’ মুমু এই অনুকরণ আর অনুসরণের ফারাগটাও বুঝতে পারে না। কোনটা অনুসরণ আর কোনটা অনুকরণ সেটি তার কাছে স্পষ্ট নয়। আরিফকে মুমু জিজ্ঞেস করেছিলো, ‘শিল্পদৃষ্টি আসলে কী?’ আরিফ বলেছে, ‘এক্সরে আইস।’ মুমু এর কথখানি বুঝতে পেরেছে আরিফ সেটা জানে না। তবে এটুকু লক্ষ্য করেছে যে, আজকাল মুমু আরিফের দৃষ্টিরও অনুকরণ করার চেষ্টা করে। কলেজ থেকে ফেরার পথে একদিন আরিফ অন্যমনেই বলছিলো, ‘মাছরাঙাটা সুন্দর।’ মুমু প্রায় সাথে সাথেই বলেছিলো, ‘হ্যা, নীল ডানা।’ এটি ভেবে আরিফ আরো মুমূর্ষু হয়ে পড়লো। তার নিজের কাছের যুক্তিদেয়াল ভেঙে-চুড়ে গুড়িয়ে গেলো। তাহলে কি মুমুও দেখেছে, মধ্যবয়স্ক কুক্কুরী, লেজটা উঁচু হয়ে আছে, ভেজা যোনি?

আরিফ সরাসরি মুমুর চোখে তাকালো, দেখলো, তার চোখে একটি অন্যরকম পিছুটান লেগে আছে। লেগে আছে একটি লজ্জা। কুক্কুরীটি যে পথটি অতিক্রম করেছিলো তার একটি নেশাকোষ জ্বলজ্বল করছে তার চোখে, যেনো ইচ্ছে হয় একবার দৃষ্টি ফেলে অতীত চাদরে। চোখে চোখ পড়তেই মুমু তার চোখ নামিয়ে নেয়। তার গাল দুটো লজ্জায় লাল হয়ে উঠে। তার মনে হয়, আরিফ তাকে পড়ছে, খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে তাকে পড়ছে। তার মনের অবস্থা আর চিন্তার প্রতিটি কোনায় কোনায় যেনো দৃষ্টি ফেলছে আরিফ। সে একটু বিব্রত বোধ করে। আরিফ ভাবে, সে হয়তো অন্য কিছু দেখেছে নান্দিক চোখে, আর চোখে লেগে আছে সেটিরই প্রতিভা।

আরিফ আর মুমু দুজনেই প্রতিভাধর। আরিফ কবিতা লেখে শৈশব থেকেই। মুমুও কবিতা লেখার চেষ্টা করে। এই বয়েসেই চার চারটি ডায়েরি তার ভরে গেছে ছড়া কবিতায়। আরিফ তাকে সে জন্যেই কাছে রেখেছে। অন্য চোখে দেখেছে তাকে। তবে মুমুর শখ কবিতা আবৃত্তি করবে। আরিফ তাকে বলে, এটি প্রধান শখ হতে পারে, কিন্তু শপথের নাম কবিতা হোক। এ কথাটিকেও মুমু যথার্থ অর্থায়িত করতে পারে না। ভাষ্কর চৌধুরী যখন মঞ্চে জলদ গভীর কণ্ঠে জীবনানন্দ আবৃত্তি করে, তখন সে জীবনানন্দ আর ভাষ্কর চৌধুরীর তফাতটা করতে পারে না। আরিফ তাকে বলে, কবি হলো গাছ আর আবৃত্তিকার তার ফুল। তবুও মুমুর শখ সে আবৃত্তি করবে। আরিফ তাকে নিরস্ত্র করে না। আবৃত্তি শেখায়। যত্নের সাথে শেখায় ধ্বনির উচ্চারণ, ধ্বনিচিত্র  অনুধাবন, স্বর প্রক্ষেপণ ইত্যাদি।

তবে যে সময়টা মুমু আরিফের বাসায় কাটায় তার অধিকাংশ সময়ই কাটে গল্প করে। নানা প্রকার গল্পে মেতে উঠে তারা। মুমু তার জীবনের গল্প বলে, আরিফ বলে তার নিজের জীবনের গল্প। কথার ফুলঝুরিতে তাদের সময়গুলো কেটে যায়। দেখতে দেখতে সন্ধ্যা নামে। মুমু বাড়ির দিকে রওয়ানা হয়। মুমুর বাসা আরিফের বাসা থেকে সাত কিলো দূরে। সিএনজি চালিত অটোরিকশা-যোগে মুমু পৌঁছে যায় সাত কিলোমিটার উত্তরে তার নবরত্নপুর গ্রামে।

আরিফ বাসায় বসে থাকে। সিগারেটে একটা কষে টান দেয়। কবিতার খাতাটা নাড়ে চাড়ে, দুএকটি পঙক্তি লেখে, দুয়েকটি পঙক্তি হারিয়ে যায়। এমনি করেই কেটে যায় সময়। রাত নেমে এলে নিজেই রান্না চড়ায়। ভাত ডাল ডিম, কিংবা আলু ভর্তা তৈরি করে সে। নিজের হাতের অন্ন খেয়েই তাকে জীবন ধারণ করতে হয়। আরিফ বিয়ে থা করেনি। তার বাবা মা থাকেন গ্রামে। এখান থেকে দেড়শো মাইল দূর, উজানভাটিয়ায়। উজান ভাটিয়া থেকে এখানে আসতে তার সময় লাগে তিন ঘণ্টা-সাড়ে তিন ঘণ্টা। তাই কলেজের অদূরে একটি চৌচালা ঘর ভাড়া নিয়ে থাকে সে। কলেজ থেকে তিন কিলো দূরে, উত্তরে। এ পর্যন্ত সে মুমুর সাথেই আসে। আজ চৌদ্দ দিন ধরে আসছে। প্রথম প্রথম এক সাথে বসতে তার কেমন যেনো লাগতো। মুমুও সরে সরে বসতো একটু পর পর। হাতে হাত লাগলে, শরীরে শরীর লেগে গেলে তারা দুজনেই সচকিত হয়ে উঠতো। আজকাল আর তা মনে হয় না। ধীরে ধীরে অভ্যস্ত হয়ে গেছে। এখন একত্রে উষ্ণতা শুষে তারা রিকশার হুড তুলে যায়।

পাঁচ-ছ’ দিন আগের কথা, আরিফ ক্লাসে পড়াচ্ছিলো মধ্যযুগের কবি Jhon Fletcher এর কবিতা, Take, Oh, Take those lips away, `Take, oh take those lips away/ That so sweetly were forsworn/ And those eyes, like break of day,/ lights that do mislead the morn;/ But my kisses bring again,/ Seals of love, though sealed in vain.’ শুনতে শুনতে মুমু তেমন কিছু না বুঝলেও খুব বেশি আবেগপ্রবণ হয়ে পড়েছিলো। ফেরার পথে সেদিন রিকশায় সে আর সরে বসে না। ইচ্ছে করেই যেনো একটু চেপে বসে আরিফের দেহের সাথে। তড়াক করে একটি উষ্ণ রক্তের স্রোত তার সারা দেহে বয়ে যায়। টের পায়, মুমুর দেহটিও উষ্ণ হয়ে উঠেছে, পেশিগুলো টান টান হয়ে উঠেছে। আরিফ সরে বসে না, মুমুও সরে বসে না সেদিন। পরস্পর পরস্পরের উষ্ণতার স্বাদে তাদের সেদিনের যাত্রা একটি স্মৃতিময়তার স্বাক্ষর রচনা করে।

তারপর থেকে তাদের মধ্যে আর স্পর্শজনিত অস্বস্তি কাজ করে না। বরং একটু মজাই যেনো পায় দুজনে। সেদিন আরিফ হুড টানতে গিয়ে তার হাত লেগে যায় মুমুর স্তনে। সদ্য ফুলে উঠা পেয়ারার মতো স্তনে। খয়েরি উর্ণার হিজাবের নিচে তার স্তনগুলো একবার কেঁপে উঠে। পরক্ষণেই এগিয়ে যায় হাতের দিকে। আরিফ টের পাচ্ছে, উষ্ণ বলের মতো স্তন দিয়ে মুমু আরিফের হাতে মৃদু চাপ দিচ্ছে। আরিফ কি ভেবে তারাহুরো করে হাত গুটিয়ে নেয়। পরে আবার সাবধানে হাত দিয়ে হুড তুলে।

আরিফের কলেজ থেকে রিকশা পেতে একটু সমস্যা হয়। পাঁচ-দশ মিনিট হেটে আসলে তীর গ্রাম বাজার। এখান থেকে রিকশা পাওয়া যায়। এ পথটা আরিফ প্রায়ই হেটে আসে। আজও হাঁটছে, সাথে হাঁটছে মুমু। হাঁটতে হাঁটতে আরিফ এ দৃশ্যটি দেখে। দৃশ্যটি তার চোখের ভেতর থেকে সরে না। ক্ষণে ক্ষণে ভাসছে তার মনের দেয়ালে। একটি কুকুর, মাঝ বয়েসি মাদি কুকুর, লেজ উপরের দিকে তুলে রেখেছে, তার যোনিটি ভেজা। ভাবনাটি থেকে প্রাণপণে নিষ্কৃতি চায় আরিফ। অন্যকিছুর দিকে মনোযোগ দিতে চেষ্টা করে। পারে না। এমন সময় একটা রিকশা বেল বাজাতে বাজাতে আরিফের সামনে এসে দাঁড়ায়। পরিচিত রিকশা, সালাম দেয়। আরিফ আর মুমু উঠে বসে। রিকশা চলতে শুরু করে। বিকেলের মুখে মসৃণ বাতাস তাদের চোখে মুখে লাগে। মুমু বলে, ‘হুড উঠাবেন না স্যার?’ আরিফ বলে, ‘না আর দরকার নেই।’

সাম্প্রতিক দেশকাল ইউটিউব চ্যানেল সাবস্ক্রাইব করুন

মন্তব্য করুন

Epaper

সাপ্তাহিক সাম্প্রতিক দেশকাল ই-পেপার পড়তে ক্লিক করুন

Logo

ঠিকানা: ১০/২২ ইকবাল রোড, ব্লক এ, মোহাম্মদপুর, ঢাকা-১২০৭

© 2024 Shampratik Deshkal All Rights Reserved. Design & Developed By Root Soft Bangladesh

// //