সময়ের ছায়াশরীর

এক.
কি-যে করি ভেবে পাই না। করবো বলে যা মনে করি তা-ই অর্থহীন মনে হয়। আদতে যেন কিছুই করার নেই এখন। তবুও ইচ্ছে করে, তবুও মনে হয় জীবনটাতো একটাই, তাকে ভয়ের ঘেরাটোপে রাখি কেন। এই ‘কেন’ ঠিক প্রশ্ন নয়, প্রশ্নের আদলে সিদ্ধান্ত হয়ে ওঠে। করোনাকালে, জীবনটাকে যখন অদেখা প্রতিপক্ষের চোরাগুপ্তা হামলার ভয়ে সুরক্ষিত রাখার চেষ্টা করি, কেবলি সাবধানতা, কেবলি অস্থিরতার ভেতর দিয়ে সময় পার করি তখন জীবনকে প্রকৃতির বিপরীতে খুবই প্রিয় মনে হয়। ভাবি, এই যে এতগুলো বছর চলে গেল, সময়-অসময়ের প্রহর যাপন-উদযাপনের মধ্যদিয়ে পেরিয়ে এলাম, কই ভাবিনি তো জীবনকে এত ভালোবাসি। আমি অন্য সবার মত এত সাহসী উচ্চারণ করতে পারি না যে কি আর হবে? এই কি আর হবে বলতে কত কি যে মনের মধ্যে ভিড় করে তার ইয়ত্তা নেই। মনে হয়, হয়তো এই যে দু’চোখ ভরে ভোর কিংবা বিকেল দেখা হবে না। নদীর পাড়ে দাঁড়িয়ে নদীর জলে পা ডুবিয়ে নৌকার গলুইয়ে বসে থাকা হবে না। খুব বেশি চাওয়া নয়, সূর্যের আলোটুকু অনুভব করা, দু’চোখ ভরে গাছের পাতায় রোদ লেগে থাকা দেখা, এই আর কি। কি অদ্ভুত সুন্দর পৃথিবী নামের এই গ্রহটি। কত যে মায়া এর প্রতিটি ধূলিকণায়, ঘাসে ঘাসে, ভোরের শিশিরে। এখানেই প্রকৃতির সন্তান মানুষের মুক্তি।

রবীন্দ্রনাথের গানটি মনের ভেতরে সুরের বন্ধন ভেঙেচুরে বাণী হয়ে আমারই অন্তরের খুব গভীরতর চাওয়াকেই ‘আমার মুক্তি আলোয় আলোয় এই আকাশে আমার মুক্তি ধুলায় ধুলায় ঘাসে ঘাসে এই আকাশে’ ছড়িয়ে দেয়, আকাশ-পৃথিবীর যাবতীয় দৃশ্যকল্পের সঙ্গে মিলিয়ে আমার একান্ত এক অনুবিশ্বে রূপান্তরিত করে। আমার অনুবিশ্বে বাঁশির সুর আছে। সে সুরে মহাবিশ্বের নিয়ম মেনে চলা চন্দ্র-সূর্য-পৃথিবীর ঘূর্ণনের ধ্বনি-প্রতিধ্বনির স্পন্দনটুকু টের পাই। আমার মনের কথাগুলো বাঁশির সুরে অনূদিত, নাকি বাঁশির সুর আমার কথায় অনূদিত হয়ে বর্তমানের এক দিগন্তব্যাপী শূন্যতাকে মুহূর্তে ভরাট করে দেয়। মনে হয়, এইতো আমি এখনও আছি, এখনো সূর্যতারায় নিজের ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা রূপটিকে প্রাণের ভেতরে অনুভব করতে পারছি। তাই তো বলি, মানুষ নিঃশেষিত হয় না কখনো, ফুরিয়ে যাবার সময় হলে আবার জীবন ভরে ওঠে রূপে-রসে-গন্ধে। সে যে বিস্ময়ের ভেতরে বিস্ময়! আর তখনি মনে হয়, ‘আমারে তুমি অশেষ করেছ, এমনি লীলা তব-/ফুরায়ে ফেলে আবার ভরেছ, জীবন নব নব।’

দুই.
আজ আমার জন্মদিন। আগে যেভাবে মনে পড়তো এই দিনে, এখন তেমন করে আর মনে পড়ে না। তবুও দিনটি এলে, ভোরবেলায় এই ভাবনাটি এক সুদূরকালের স্মৃতির গন্ধ নিয়ে আমার সত্তাকে আমোদিত করে। এ আনন্দ কেবল নিজের কাছে ফিরে যাওয়ার আনন্দ। মধ্যরাতে, ঠিক বারোটায়, আমার পিএইচডি ছাত্র ড. নির্ঝর অধিকারী এলো কাঁধে বাঁশির বাকস ঝুলিয়ে। ওর মনে হয়েছে আমাকে এই রাতে বাঁশি শোনাবে। সে চলে এসেছে ওর স্ত্রী দীপাবলীকে সঙ্গে নিয়ে। এই সময়ে মানুষ যখন ঘর খোলে না, দোর খোলে না- অবিশ্বাস নিয়ে ইতিউতি তাকায় তখন ওরা এলো, নির্ঝর বাঁশিতে বাজাল আমার সুর করা সেলিম স্যারের (সেলিম আল দীন) গান ‘ছায়ার নিচে বসবো ভেবে তাকিয়ে দেখি লঘু/মেঘের রূপান্তরে তুমি উড়াল দিয়েছো।/ রূপান্তরের ঋতুচিহ্ণে আকাশ নীলাম্বরী/ অবাক তারা হাজার তারায় জোনাক জ্বলেছে/ তুমি উড়াল দিয়েছো।’ এই তো রূপান্তরের খেলা। ফুরিয়ে তাই ফুরোয় না, রূপান্তরিত হয়, গঠিত হয় প্রকৃতির অণু-পরমাণুর লীলা বিলাসে, রচিত হয় ব্যক্তির না ফুরানো অনুবিশ্ব। বাঁশির সুরে বদলে যায় মধ্যরাত। সুর মিলিয়ে যেতে থাকে, ভেসে যেতে থাকে বাতাসে, ভেসে যেতে যেতে অন্য কোথাও অন্য কারও মনে অন্যভাবে অন্য কোন দৃশ্যকল্পে অনূদিত হয়। আমার কাছে আমার নিটোল জলের নদী কালিগঙ্গা, থই থই জলের শাপলা শালুকে ভাসা ভুলদা বিল, আমার গ্রামের দিগন্ত বিস্তারী ফসলের মাঠ অনূদিত হয়, রূপান্তরিত হয় স্মৃতির সমষ্টিতে। জীবনটাই যে স্মৃতির সমষ্টি। ফেলে আসা সেই স্মৃতিরা আজ মধ্যরাতে ডাক দিয়ে যায় নির্ঝরের বাঁশির সুরে, সেই সুদূর কালের ফেলে আসা আমাকেই প্রাণের ডাক দিয়ে গেল। আমার জন্মদিনের প্রথম ক্ষণটুকু আমার সত্তাকে আমোদিত করে।

এই করোনাকালে, অনেক দিন ধরে লেখা হয় না, অলসতা নয়; না লিখবার নানা মানে এসে ভিড় করে দাঁড়ায়। আমার জন্মদিনে, না লিখবার অক্ষমতার ঝুরঝুরে মাটিতে আবার দাঁড়াতে চাইলাম কিন্তু নিরন্তর শব্দ খুঁজি, শব্দেরা আসে না। মন বলে কি হবে লিখে? আমিতো শব্দে শব্দে একটি ভাস্কর্য বানাতে পারি না। পাথরের কঠিন শরীরে আলোছায়ার খেলা তৈরি করতে পারি না। দিনের পর দিন বসে থাকতে পারি না একটি সঠিক শব্দ খুঁজবো বলে। এই সময়টার বিশ্বাস-অবিশ্বাস, সন্দেহ-শঙ্কা কিংবা প্রবল কোনো অনুরাগ উঠে আসে না লেখায়। জাঁ পল সার্ত্রে তাঁর ‘হোয়াট ইজ লিটারেচারে’ বলেছিলেন লেখা জীবন নয়। লেখক তার পৃথিবীটাকে, তার চারপাশকে এমনভাবে তুলে ধরবেন যাতে পাঠক এমনটি ভেবে না বসেন লেখক তাঁর চারপাশে যা ঘটে চলেছে সে সম্পর্কে একেবারেই অনাসক্ত। আমার মনে হয় লেখা যদি জীবন না হয় তবে কি জীবনটাই উঠে আসে লেখায়? আমি ক্রমাগত না-এর পর না সাজিয়ে একটি ধনাত্মক রূপকল্প বানাতে থাকি। এই অস্থির ও বিপর্যয়ের সময়ে মানুষের কপালে মানুষের করতলের মানবিক স্পর্শই যদি না থাকে তবে মানুষকে অনুভব করব কী করে। মানুষ এখন সরে যাচ্ছে স্পর্শ বাঁচিয়ে, নিজের সঙ্গে বিচ্ছিন্নতা তৈরি করছে অজান্তে; অস্তিত্বে এই যে বিচ্ছিন্নতার সুর বাজছে সেখান থেকে আর কবে ফিরে আসবে? এক সময়ে বদলে যাবে বিশ্ব, বদলে যাবে মানুষের সম্পর্কের ধরন। লেখা কি পারবে সেই পরিবর্তিত সময়কে অঙ্গে ধারণ করে সময় ও জীবনের রূপকল্প তৈরি করতে? মধ্যরাতে, আমি ভাবতেই থাকি, লেখকই পারবে বদলে যাওয়া সময়টাকে ধরে সময়ের ভায়োলিন বাজাতে। বর্তমান সময়ের বিচ্ছিন্নতাকে পূঁজি করে পরবর্তীকালের লেখক ও পাঠকরা মিলে সময় থেকে আলাদা হয়ে অতীত, বর্তমান ও ভবিষ্যতের আলোছায়ায় বিচরণের মওকা পাবে।

করোনাকালে, আমার সকল না-এর ভেতর থেকে বেরিয়ে আসে হ্যাঁ-য়েরা, আমার চারপাশে পুঞ্জীভূত হতে থাকে অস্তি-সকল; আমি নির্ঝরের বাঁশির সুরে মধ্যরাতে ভেসে যেতে যেতে ‘জাগিয়া উঠিল প্রাণ’ প্রবলভাবে অনুভব করি; আমার চেতনায়, বোধে ও বিশ্বাসে আমার অনুবিশ্বের সূর্যালোক, স্তব্ধ মধ্যরাত কিংবা আমার নদী কালিগঙ্গার কল্লোলে-কলতানে এই সত্য ধ্বনিত হয় : শোনো, সভ্যতার গড়নে-ভাঙনে, সময়ের বিপর্যয়ে সময়কে নতুন করে নির্মাণ কর। আমি সে সব কথা শুনি, শুনি সারারাত সময়ের পদধ্বনি।

সাম্প্রতিক দেশকাল ইউটিউব চ্যানেল সাবস্ক্রাইব করুন

মন্তব্য করুন

Epaper

সাপ্তাহিক সাম্প্রতিক দেশকাল ই-পেপার পড়তে ক্লিক করুন

Logo

ঠিকানা: ১০/২২ ইকবাল রোড, ব্লক এ, মোহাম্মদপুর, ঢাকা-১২০৭

© 2024 Shampratik Deshkal All Rights Reserved. Design & Developed By Root Soft Bangladesh

// //