নিজেকে নিঃস্ব করে সাপ-লুডু খেলা

অতর্কিতে ডাক দিলে দেখা হবে মায়াবীলতায়- এই বলে সব পথ ম্যাজিক তুলিতে সে মুছে দিয়ে বেপথু হাওয়ায় চলে গেল। দূর কোনো হলুদের বনে। আর বসে রইলুম আমি। সূর্য অস্ত গেল কিশোরী নদীর ভরা বুকে। সেখানে গোপন কথা গভীর জলের মতো নির্বাক, স্থির। অগোছালো ঘর আর রাজ্যির আবর্জনা নিয়ে ঘনঘোর কুয়াশায় বসে রইলাম...।

এসব শুধুই কি ছবি? ক্লান্ত দুপুর-রাত যখন এক বুক পিপাসা নিয়ে কাছে আসে, চলমান নগরীর সব কান্না চেটে খায় দিন, কার কাছে যাব আমি? সাদা পৃষ্ঠার হিজিবিজি অক্ষর, রেখা আমাকে উড়িয়ে আনে। একটানে ছুড়ে দেয়ে কবিতা-ডাঙায়। নিয়তি-নির্ধারিত সেই পথে দিনরাত দাসানুদাসের মতো ঘোরাঘুরি। দিনের শেষে খুঁদ-কুড়ো যেটুকু যা জোটে তাই নিয়ে মোচ্ছব, শব্দের কাটাকুটি খেলা। পুরনো চিঠির খাম, ভাঙা পেন্সিল, একটানে এঁকে যাওয়া মুখের আদল মাথার মধ্যে অনবরত ঘুরপাক খায়। মনে হয়, কোথাও যাবার ছিল যেন। কেউ কি অপেক্ষায় ছিল ভাঙা ব্রিজের ওপাশে সেই নির্জন হলুদের বনে? নাকি কোনও বিভ্রম, শব্দের আরও কাছে আসা! হঠাৎ বৃষ্টি নামে। বৃষ্টির ঘেরাটোপে ভিজে যায় পরিচয়লিপি। আর একটার পর একটা লাইন জল টপকে এগিয়ে আসে। ডায়েরির সব পাতা তুমুল ভিজিয়ে দিয়ে কে যেন লিখিয়ে নেয়-
যুবতী মেঘেরা আজ বড় বেশি জলজ, কাঙাল
কেবলই স্নানের ছল
আঁশটে গন্ধ নিয়ে ছুটে যায় দ্রুতগামী লন্ঠন হাতে...।
একটা একটা করে মুহূর্তেই নিঃশেষিত হয় বুকজুড়ে জমে থাকা শব্দ-পাহাড়। আর ক্রমশ নিঃস্ব হয়ে উঠি। ভেতরের সেই তুমুল ছটফটানি কে যেন নিংড়ে নিয়েছে দ্রুত। আমার ঘুম পায়। দূর থেকে ভেসে আসে খিলখিল হাসি।
এভাবে শব্দ ছুঁয়েই দিন কাটে। রাশি রাশি অক্ষরে ভরে ওঠে কবিতার খাতা। আমি আহ্লাদে হাত-পা ছুড়ি। কুণ্ঠিত দেহখাঁজে খুঁজে যাই শস্যের অনাবাদি জমি। বুনো ফুলের গন্ধ, ঝরা পাতার গান শুনতে শুনতে লিখে ফেলি-
দগ্ধ আগুন নিয়ে খেলে যাচ্ছি
গিলে খাচ্ছি রাতের বিষাদ...।
তারপর? তারপর সারাটা দুপুর, সারারাত উন্মুখ বসে থাকি। শব্দেরা উঁকি দেয়, তবু নিমেষে উড়িয়ে দেয় ভাবনার সুর। বৃষ্টি ডাকবে বলে যে যে ভাবে উইপোকা দলবেঁধে নিজেদের মৃত্যুকে ডাকে, চারপাশে জমে থাকা বর্ণমালারা সেভাবেই উবে যায়। দৃশ্যের ফাঁদে। আমি কেবলই বনবন ঘুরি। খুঁজে যাই চোরাপথ, সাঁকোর দোসর। আর ব্যর্থ সমর্পণ শেষে আদিগন্ত কাঁটাতার-এ ঘা খেতে খেতে হেঁটমুন্ড। ঠিকানা হারানো পথে ফিরে ফিরে হাঁটি। খুব রাগ হয়। সজোরে বন্ধ করি কবিতার খাতা। মাথা জুড়ে বেড়ে ওঠে ফনার দাপট।
তারপর বহুদিন ছুঁয়েও দেখি না কবিতার খাতা। আড্ডায়, ভুল-রোদে নিজেকে ছড়িয়ে দিই। এভাবেই উপবাস। নিজেকে নিঃস্ব করে সাপ-লুডু খেলা। আর কেবলই পিছলে পড়ি। নিজেকে গুটিয়ে ফেলি শামুকের মতো। তখনই দরজায় মৃদু শব্দ টের পাই। টের পাই আবছা পায়ের শব্দ মিলিয়ে যাচ্ছে দূরে। বাতাসে কাঁপছে এক বিটকেল হাসি।
দরজা বন্ধ বলে যে নাকি চলে গেছে শব্দের ওপারে, তার জন্য রোজ তাই ধূপ-ধুনো, সুগন্ধিত চান। ধ্যানের ভঙ্গিমা যত প্রতি রাতে যেভাবে পাল্টাই, ক্লান্ত শেকড় তুলে যেভাবে সাজিয়ে রাখি পাখির বাসর- সে সকলই নিবেদন, কবিতার আরও কাছে আসা। নাম ধরে ডাকা রোজ। ছুঁয়ে দেখা অক্ষর-যতি। এভাবে প্রতিটি দিন, এভাবে প্রতিটি রাত ছেনে রোমকূপে জেগে ওঠা অশ্রুত কান্নার ধ্বনি ক্যানভাসে জড়ো করি। এঁকে ফেলি শূন্যের ছবি।
এমত নিজের কাছে বারবার ফেরা। উন্মুখ চোখ খুঁজে হেঁটে যাওয়া তপ্ত-প্রহর।

সাম্প্রতিক দেশকাল ইউটিউব চ্যানেল সাবস্ক্রাইব করুন

মন্তব্য করুন

Epaper

সাপ্তাহিক সাম্প্রতিক দেশকাল ই-পেপার পড়তে ক্লিক করুন

Logo

ঠিকানা: ১০/২২ ইকবাল রোড, ব্লক এ, মোহাম্মদপুর, ঢাকা-১২০৭

© 2024 Shampratik Deshkal All Rights Reserved. Design & Developed By Root Soft Bangladesh

// //