অভিশপ্ত জীবন

দুপুরে মঈন সাহেবের ঘুমের তেমন অভ্যাস নেই। তবু কিছুদিন ধরে খাওয়ার পর বিছানায় কিছুক্ষণ গড়াগড়ি করে নিতে ভালোই লাগে। আজও খাওয়ার পর বিছানায় গিয়েছেন সেই সময়ই কলিং বেলটা বেজে উঠল। এই মুহূর্তে তিনি সম্পূর্ণ একা বাসায়। কেউ দরজার ওপাশে আসলে দরজাটা তাকেই খুলতে হবে। অনিচ্ছা ভরে চোখ রাখলেন লুকিং গ্লাসে। একটা তরুণী মেয়ে দাঁড়িয়ে দরজার ওপাশে। নীতুর বান্ধবী হবে হয়তো; কিন্তু জানা দরকার ছিল নীতু এ সময় অফিসে থাকে। বিরক্তির সঙ্গে দরজা খুললেন মঈন সাহেব।
‘আসসালামু আলাইকুম স্যার।’ স্যার সম্বোধন যখন করেছে নীতুর বান্ধবী হবে না, হয়তো ভুল করে এই ফ্ল্যাটে বেল বাজিয়েছে।
অপরিচিত দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকার কারণে তরুণী জবাব দিল, ‘আমাকে চিনতে পারছেন না স্যার? আমি কলি।’
‘কোন কলি?’ নির্ঘাত এই মেয়ে ভুল ফ্ল্যাটে চলে এসেছে।
‘আমি কলি স্যার। মগবাজারে বাসা আমার। সিদ্ধেশ্বরী স্কুলে পড়তাম। আমার বাবা শিক্ষা ভবনে চাকরি করতেন।’
মঈন সাহেব এবার চিনতে পারলেন, সঙ্গে একটু পরিতৃপ্তির শ্বাস নিলেন। যাক স্মৃতিশক্তি এখনো এতটা দুর্বল হয়ে যায়নি। অনেক দিন আগের কথা তো, তাই ভুলে গেছেন, প্রায় পঁচিশ বছর তো হবে। এতকাল আগে দেখা একটা ছোট মেয়েকে ভুলে যাওয়াটা দোষের কিছু নয়।
‘ভেতরে আসতে বলবেন না স্যার? নাকি এখনো চিনতে পারেননি?’
কলির কথায় সম্বিৎ ফিরে পেয়ে লজ্জা পেয়ে গেলেন মঈন সাহেব ‘না, না চিনেছি এখন। সরি ভুল হয়ে গেছে। এসো ভেতরে এসো।’ ভেতরে আসতে বললেও মনে মনে যথেষ্ট বিরক্ত হয়েছেন মঈন সাহেব। হুট করে ভরদুপুরে ছাত্রী উপস্থিত হওয়ায় একটু অপ্রস্তুতও হয়ে গেছেন।
‘অসময় এসে আপনাকে বিরক্ত করলাম না তো স্যার? আপনি বোধ হয় রেস্ট নিচ্ছিলেন।’
মঈন সাহেব ব্যস্ত হয়ে বললেন, ‘না, না, বিরক্ত হব কেন? এই বয়সের একটা ধর্ম কি জানো তো? সারাক্ষণ কথা বলতে ইচ্ছে করে; কিন্তু কথা বলার মানুষই খুঁজে পাওয়া যায় না। আর রেস্টের কথা বলছ, সারাদিন তো রেস্টের ওপরই থাকি।’
কলি ভেতরে এসে চারপাশে চোখ বুলাল।
‘ভালো কথা, তোমার লাঞ্চ হয়েছে তো?’
‘আপনি প্লিজ ব্যস্ত হবেন না স্যার। আমি লাঞ্চ করে এসেছি।’
‘তাহলে চা দেই।’
‘সত্যি বলছি স্যার আপনি একদম ব্যস্ত হবেন না। আমি এখন কিছুই খাব না। আপনি শুধু একটু বসুন। আমি কিছুক্ষণ কথা বলেই চলে যাব।’
মঈন সাহেব সোফায় বসতে বসতে বললেন, ‘তোমার আন্টি আবার গ্রামে গিয়েছেন জরুরি কাজে। নীতুও অফিসে, থাকলে পরিচয় করিয়ে দেওয়া যেত। তারপর কেমন আছ বলো। অনেক বড় হয়ে গেছ। সেই কোন ছোটবেলায় দেখেছিলাম। তোমার বাবা-মা ভালো আছেন? কি করছ আজকাল?’
‘একটা প্রাইভেট জব করছি স্যার।’
‘আজ অফিস নেই?’
‘ছিল স্যার, একটা জরুরি কাজ ছিল তো তাই যাইনি।’
‘বিয়ে করেছ?’
কলি মুচকি হেসে জবাব দিল, ‘না, স্যার। বিয়েটা এখনো করা হয়নি।’
‘সেকি কেন?’
‘ভয়ে স্যার, সম্পর্কের ভয়।’
মঈন সাহেব অবাক হয়ে গেলেন, ‘সম্পর্কের ভয় মানে?’ তারপরই হেসে বলতে লাগলেন, ‘এইসব ভয়টয় কোনো ব্যাপারই না। বিয়ে নিয়ে মেয়েদের মধ্যে এক ধরনের ইনসমনিয়া কাজ করে ঠিক; কিন্তু বিয়ের পরপরই তা কেটে যায়। আমার মেয়েটাও বিয়ে করতে চায় না, বলে আগে স্বাবলম্বী হই তারপর। ছুটির দিনে একদিন বাসায় এসো, নীতুর সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দিব।’
কলি মিষ্টি হেসে জবাব দিল, ‘নীতুর সঙ্গে আমার পরিচয় আছে স্যার। সত্যি বলতে কি আপনার বাসার ঠিকানাটা আমি ওর কাছ থেকেই পেয়েছি।’
মঈন সাহেব অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করলেন, ‘ওর সঙ্গে তোমার পরিচয় হলো কী করে?’
‘নীতু এবং আমার অফিস একই বিল্ডিংয়ে স্যার। আমি আপনাকে একদিন নীতুর অফিসের বাইরে দেখি, নিজেই একদিন ওর সঙ্গে পরিচিত হই। খুব খুশি হয়েছিল বাবার ছাত্রীর সঙ্গে কথা বলে। অনেক কথা হলো। আপনার সম্পর্কে জিজ্ঞেসও করেছিল, খুব হিংসেও করেছিল আমাকে।’
‘হিংসে? কেন?’
কলি একটু চুপ থেকে জবাব দিল, ‘আসলে ওর ছোটবেলাটা ভালো যায়নি তো। ও যার কাছে প্রাইভেট পড়ত তিনি ওর সঙ্গে খুব খারাপ আচরণ করতেন।’
মঈন সাহেব অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করলেন, ‘খারাপ আচরণ করত মানে? কি বলছ তুমি এসব?’
কলি মাথা নিচু করে জবাব দিল, ‘জ্বি স্যার, সত্যি বলছি। আপনার এক ভাগ্নে নীতুকে পড়াত, রবিন নাম। সে নীতুকে খারাপভাবে স্পর্শ করত, আরও অনেক বাজে কাজ করত আপনাকে কিভাবে বলব বুঝতে পারছি না। নীতু আন্টিকেও এ ব্যাপারে কিছু বলতে পারত না, রবিন ওকে শাসাত বিভিন্ন উপায়ে। অবশ্য বেশি দিন সুযোগ পায়নি রবিন, আন্টির কাছে ধরা পড়ে যায় একদিন।’
প্রচণ্ড রাগে হাত মুষ্টি করে ক্রুদ্ধ স্বরে বলতে লাগলেন মঈন সাহেব, ‘এত বড় একটা ঘটনা ঘটে গেল, আমি কিছু জানি না? শুয়োরের বাচ্চা আমার মেয়েটার এত বড় একটা ক্ষতি করেছে? আজকে আমি ওকে খুনই করে ফেলব।’ এই বলে মঈন সাহেব টেলিফোনের দিকে এগিয়ে গেলেন কাউকে ফোন করার জন্য। রিসিভার ধরে হুট করে কলির দিকে ক্রুদ্ধ দৃষ্টিতে তাকিয়ে বললেন, ‘এই মেয়ে তুমি এসব বানিয়ে বলছ না তো? যদি বানানো কথা হয়ে থাকে তাহলে কিন্তু তোমার খবর আছে বলে রাখলাম।’
কলি শান্ত দৃষ্টিতে তাকিয়ে বলল, ‘আমি কেন আপনার মেয়ের সম্পর্কে মিথ্যে কথা বলতে যাব?’
‘তুমি আমার মেয়ের সম্পর্কে মিথ্যে কথা বলবে কারণ-’
‘কারণ?’ কলির জিজ্ঞাসু দৃষ্টির সামনে মাথা অবনত করে ফেললেন মঈন সাহেব। ধীরে ধীরে রিসিভার নামিয়ে রাখলেন। একজন পরাজিত মানুষের সমস্ত ক্লান্তি যেন হঠাৎ করে ভর করল তার ওপর।
কলি সোফা থেকে উঠে এসে মঈন সাহেবের চোখে চোখ রেখে বলল, ‘কারণ রবিন আপনার মেয়ের সঙ্গে যা যা করেছে আপনি আমার সঙ্গে তাই তাই করেছেন স্যার। দিনের পর দিন করেছেন, মাসের পর মাস করেছেন। আমার অশিক্ষিত মা একবারের জন্য বুঝতে পারেননি মনোযোগ দিয়ে পড়াশোনা করার বাহানায় তার মেয়ের শিক্ষক মেয়েকে দিনের পর দিন সেক্সুয়ালি হ্যারাস করেছেন। কত বয়স হবে আমার তখন? দশ কি এগার বছর। আমার শরীরের সব অঙ্গ পরিপূর্ণভাবে গড়েও ওঠেনি। তারপরও আপনি বার বার আমাকে আঘাত করেছেন- শারীরিকভাবে, মানসিকভাবে। পশুর মতো আঁচড়ে দিতেন আমার পুরো শরীর। খুব ব্যথা করত আমার, কাঁদতাম। আপনি বলতেন কিছু হবে না খুকী, একটু নরম হও, ভালো লাগবে তোমার। ছিঃ।’ বলেই ঘৃণায় অন্যদিকে মুখ সরিয়ে নিল কলি।
‘কিন্তু এসব কথা এখন কেন?’ তখন সদ্য নতুন চাকরিতে যোগ দিয়েছেন। স্ত্রী-কন্যা গ্রামের বাড়িতে থাকে। মেসে গিয়ে অনেকটা সময় একা থাকতে হয়। ছোটবেলা থেকেই নারী দেহ তার কাছে এক বিস্ময়ের বস্তু। কলির চেহারায় এক অপরূপ মাধুর্য ছিল। চার দেয়ালের রুমে মেয়েটাকে একা পেয়ে হিতাহিত জ্ঞান হারিয়ে ফেলেছিলেন। ভুলেই গিয়েছিলেন মেয়েটা তার মেয়ের চেয়ে কয়েক বছরের বড় মাত্র। কলি ঘাবড়ে গিয়ে কান্নাকাটি করলে বলতেন, ‘তুমি এসব কথা বাসায়  বোলো না, তোমাকে অনেক মারবে, হয়তো মেরেও ফেলবে।’
মঈন সাহেবের কণ্ঠ নরম হয়ে এল, ‘দেখ, আমার তখন বয়স কম ছিল, ভুল হয়ে গিয়েছিল। আমি তার জন্য সত্যিই দুঃখিত। পারলে আমাকে ক্ষমা করে দিও। ভালো হয় সবকিছু ভুলে তুমি নতুন করে শুরু করলে।’
কলি হেসে বলতে লাগল, ‘সব কিছু নতুন করে শুরু করব? এত সহজ স্যার? দিনের পর দিন আপনার পশুর মতো আচরণে আমি মানসিকভাবে বিপর্যস্ত হয়ে পড়ি। কারও সঙ্গে মিশতে পারতাম না। খেলার মাঠে আমার বন্ধুরা ডাকত খেলার জন্য, আমার নিজেকে অস্পৃশ্য মনে হতে থাকে। কোনো বন্ধু ছিল না আমার, আজও নেই। প্রত্যেক মানুষের কাছে তার ছোটবেলার স্মৃতি খুব মূল্যবান। আর আমার কাছে ছোটবেলার স্মৃতি মানে সেই বীভৎস দিনগুলোর যন্ত্রণা। কারও কাছে এই যন্ত্রণাগুলোর কথা শেয়ার করতে পারতাম না, ভয় হতো ওরা যদি আমাকে ভুল বোঝে, আমাকে খারাপ ভাবে। ইউনিভার্সিটিতে একজনকে পছন্দ হয়েছিল। সেই দিনগুলোর অভিজ্ঞতার জন্য কোনোদিন কাউকে আপন করে নিতে পারিনি। আমার পুরো জীবনটা ধ্বংস হয়ে গেছে, শুধু আপনার জন্য, আপনার লালসার কারণে।’
মঈন সাহেব চাচ্ছেন কলি তাড়াতাড়ি বাসা থেকে চলে যাক, ‘বললাম তো সরি, তোমার কানে কথা ঢুকছে না? আর এতকাল আগের কথা এখন বলে কি লাভ? কেউ বিশ্বাস করবে না তোমার কথা।’
‘ঠিক বলেছেন স্যার। কেউ বিশ্বাস করবে না। আপনার মেয়েকেও বলেছিলাম। সেও বিশ্বাস করেনি। তার বাবা তার কাছে একজন মহামানব, তার জীবনের আদর্শ। সেই আদর্শ অন্য মানুষের জীবনে অভিশাপ হয়ে দাঁড়াবে সে বিশ্বাস করতে পারেনি। আপনার মেয়েকে বিশ্বাস করানোর জন্যই আজ আমার এখানে আসা।’
মঈন সাহেব অবাক চোখে তাকালে কলি বলল, ‘আমি এই বাসায় ঢোকার আগেই আমি নীতুকে ফোন দিয়েছি। নীতু আমার সঙ্গে অন কলে আছে। আমাদের সব কথা নীতু শুনছে। আপনি আর ওর কাছে আদর্শ হয়ে থাকতে পারছেন না স্যার।’
মঈন সাহেবের খুব খারাপ লাগছে। বুকের বামপাশে চিনচিনে ব্যথা অনুভূত হচ্ছে। নিজেকে আর সামলাতে পারছেন না। মনে হচ্ছে তার দুই পা ধরে কেউ তাকে টেনে নিচে ফেলে দিতে চাইছে। নিচে পড়ে যেতে যেতে বলতে লাগলেন- ‘কেন তুমি এমন করলে? আমার মেয়ের কাছে কেন আমাকে ছোট করলে?’
মঈন সাহেব অসুস্থবোধ করছেন, কলি এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে। নিজের জীবনের কষ্টকর মুহূর্তগুলোর প্রতিচ্ছবি যেন ভেসে উঠছে তার চোখের সামনে। বাবার কণ্ঠস্বর শুনে নীতু বুঝতে পেরেছে তার বাবা অসুস্থ হয়ে পড়েছেন। চিৎকার করে কলিকে বলতে লাগল, ‘প্লিজ, আমার বাবাকে বাঁচান। মাত্র চার মাস আগে বাবার বাইপাস সার্জারি হয়েছে। আপনার পায়ে পড়ি আপনি প্লিজ আমার বাবাকে বাঁচান।’ কলি ফোন কেটে দিল। মঈন সাহেবের কাছে গিয়ে শীতল কণ্ঠে বলল, ‘রবিন নীতুর সঙ্গে কিছু করেনি স্যার। আপনার মুখ থেকে সত্য কথা বের করার জন্যই মিথ্যেটা বলা। সরি স্যার।’ এই বলে ঘর থেকে বের হয়ে গেল। অনেক বছর বাদে নিজেকে ভারশূন্য মনে হচ্ছে। প্রাণ ভরে শ্বাস নিতে পারছে। জীবনের সমস্ত ক্লান্তিকে আজ সে বিদায় দেবে। অভিশপ্ত জীবনের সমাপ্তি হবে আজ তার।

সাম্প্রতিক দেশকাল ইউটিউব চ্যানেল সাবস্ক্রাইব করুন

মন্তব্য করুন

Epaper

সাপ্তাহিক সাম্প্রতিক দেশকাল ই-পেপার পড়তে ক্লিক করুন

Logo

ঠিকানা: ১০/২২ ইকবাল রোড, ব্লক এ, মোহাম্মদপুর, ঢাকা-১২০৭

© 2024 Shampratik Deshkal All Rights Reserved. Design & Developed By Root Soft Bangladesh

// //