মুক্তিযুদ্ধের গল্প
এক.
বিলাপের জন্য পাখিবিবির নতুন একটি ভাষা লাগবে। থানাওয়ালারা যাতে কান্নার ভাষাটি বুঝতে পারে। যে কাঁদন সাতষট্টি বছরের জীবনে আগে কখনোই কাঁদেনি সে। আউয়াল মাঝি ওরফে আউলা, পাখিবিবির স্বামী, বিনা বিচারে হাজতে। পাঁচ দিন আগে পাড়ার চ্যাংড়া পোলাপানদের একদল এসে জানাল তারা দেখেছে কারা যেন তাকে গাড়িতে তুলে নিয়ে গেছে। হাজতেই আজ নিয়ে তিন দিন। তার আগে দুই দিন কোথায় ছিল কেউ জানে না। লোকটির হুঁশজ্ঞান তেমন নেই আজকাল। এক কথা বলতে অন্য কথা বলে। এক দিকে যেতে গিয়ে অন্যদিকে চলে যায়। দুনিয়ার কোনো কিছুই তার মনে থাকে না। বৌ ছেলের নামও ভুলভাল বলে প্রায়ই। তিনবেলা নিয়ম করে ওষুধ না খাওয়ালে হেঁচকি বাড়ে। শ্বাসকষ্ট বাড়ে।
হাজতের বাইরে এভাবে কতক্ষণই বা বসে থাকা যায়? হাবাগোবা ছেলেটা আছে। ছেলেবৌটাও পাশে আছে যদিও। পাখিবিবি ছেলেবৌ রোশনিকে জিজ্ঞেস করে দুনিয়ার সব মানুষ একই ভাষায় কান্দে কি-না। রোশনির উত্তর ‘হ্যা’! পাখিবিবির প্রশ্ন বাড়ে- তাহলে থানাভর্তি মানুষগুলোর মন গলে না কেন? আর্জি-অনুনয় কোনো কিছুই তো আমলে নিল না! এভাবে সেভাবে কতভাবেই তো কেঁদেছে পাখিবিবি। রোশনি এবার আর উত্তর দেয় না। তার চোখেও ঝিরি। সে কাঁদে। সংক্রামক কান্না। শাশুড়ির কাঁদন তাকে কাঁদায়। অথচ খোকাকে বিয়ে করার সময় তার একটাই নিয়ত ছিল। বুড়িকে টাইটে রাখবে। শুরুতেই বিলাই না মারলে, শাশুড়িকে টাইটে না রাখলে, বুড়িগুলা নাকি বউদের মাথা যাঁতায় পিষে পিষে খায়। রোশনির খুব গর্ব হয়। বিলাই মারতে হয়নি। তার সিধাসাদা শ্বশুর-শাশুড়ি দু’জনের একজনও খাণ্ডার-খাণ্ডারনি নয়। পাখিবিবি একজন দালাল ধরেছে। দালাল বলেছিল সে নিজে ভেতরে গিয়ে আউয়াল মাঝিকে তিনবেলা ওষুধ খাইয়ে দিয়ে আসবে; কিন্তু পাখিবিবি গররাজি। খোকা আর রোশনিকে ছাড়া পৃথিবীর অন্য কাউকেই এখন আর বিশ্বাস করে না পাখিবিবি। তাছাড়া, আউলাকে তারই ওষুধ খাইয়ে দিয়ে আসতে হবে। দালাল খাইয়ে দিলে আউলা খানিক পরেই বলবে ওষুধ খায়নি। বেশ কিছু টাকাকড়ি খসল। তাতে কী! দালাল তো অন্তত তিনজনের তিন বেলা দেখা করে আসতে পারার ব্যবস্থাটিও করে দিতে পেরেছে। পাখিবিবি, রোশনি আর খোকা পালা করে খাবার নিয়ে যায়। গরাদের শিকের বাইরে দাঁড়িয়ে তিনবেলা ওষুধ খাইয়ে আসে মাঝিকে। প্রায় পঞ্চাশ বছর আগের পুরনো পাগলামো রোগটা আউলার মাঝে আবারও জোরেশোরেই ফিরে এসেছে। একটি বারো হাত লম্বা ছায়া পেতে মরিয়া বোকা মানুষটি। কত চেষ্টাই না করছে গত দুই হপ্তাজুড়ে। অথচ সব কটা দিনই আকাশ ছিল মেঘলা মনমরা। এমনই কপাল তার হাজতে আটকা তিন দিন বিকেল পড়লেই ঝকমকে রোদ নামছে। তাও আছরের শেষ মাগরেবের শুরুর আগে আগে। গোধূলির আগে আগে কড়া রোদ পড়লে মানুষের ছায়া সবচাইতে লম্বা হয়। এই সময়ে সূর্যকে পেছনে রেখে দাঁড়ালেই বিরাট লম্বা ছায়া পড়বেই পড়বে।
আউয়াল মাঝির ছায়া মাপার পেছনের ঘটনাটিকেও অদ্ভূতই বলা চলে। মুক্তিযুদ্ধ তখন পাঁচ মাসে পড়েছে। নারায়ণগঞ্জের রাজাকাররা টের পায় জুটমিল শ্রমিকদের মধ্যে একজন বা কয়েকজন চর আছে। জুট মিলের ভেতর রাজাকাররা ঘাঁটি গেড়েছিল। তারা টের পেতে থাকল তাদের পরিকল্পনার সবই কীভাবে কীভাবে যেন মুক্তিযোদ্ধাদের কানে পৌঁছে যাচ্ছে। আউয়াল মাঝিদের তিন সদস্যের গুপ্তচর দলটি একদিন ঠিকই ধরা পড়ল। আউয়াল সবচে’ কমবয়সী। উনিশ বছরের তরুণ। রাজাকাররা একটি স্কুলঘরকে হাজতখানা বানিয়েছিল। আসলে টর্চার সেল। সেখানে আটকে রেখেছিল তাদের। শারীরিক নির্যাতন করতে করতে বলত- ‘যুদ্ধে জিতবি, না? শখ কত! দুই ফুটি মানুষগুলো আসমান ধরতে চায়। শোন, জিততে অইলে বারো হাত লম্বা অওন লাগব। হইতে পারবি বারো হাত লম্বা?’
নির্যাতনে আউয়াল মাঝির বোধবুদ্ধি এলোমেলো হয়ে যায়। সে নিজের নাম, বাপের নাম, বাড়ি-ধাম প্রায় সবকিছুই ভুলে গিয়েছিল। ডিসেম্বরের প্রথম সপ্তায় একদিন সন্ধ্যার আগে আগে তিন বন্দিকে অন্য হাজতে নিয়ে যাচ্ছিল রাজাকাররা। চারপাশ কড়া সোনারোদ ঝলমল করছিল। সেই আলোতে পাঁচজন রাজাকার এবং তিনজন বন্দির লম্বা লম্বা ছায়া পড়ছিল জমিনে। হঠাত কি মনে করে রাজাকার কমান্ডার বলল- ‘বারেবারেব্বা, ছায়া কত লম্বা গো! আইচ্ছা, যা, ছায়া মাপি। তোরা তো’ বারো হাত লম্বা অইতে পারবি না, যুদ্ধও জিতবি না। যাহ! কথা দিলাম, তোগো বারো হাত লম্বা হওন লাগব না। তোগো ছায়া যদি বারো হাত লম্বা করার পারস, যুদ্ধে জিতবি, যাহ!’
তিনটি তরুণ ছায়া মাপবে বলে সটান দাঁড়িয়ে গেল। নির্যাতনের ভয়াবহতায় নিজেদের নাম, বাপের নাম ভুলে যাওয়া আউয়াল মাঝি এই শর্তটি বাকি জীবনে কখনোই ভোলেনি। দিন দশেক পরেই দেশ স্বাধীন হলো। এক সময়ের চটপটে তরুণ আউয়াল মাঝিসহ সব বন্দিকেই খানিকটা স্মৃতিহীন অবস্থায় উদ্ধার করল মুক্তিযোদ্ধারা। তারা মাঝিকে তার থানা সদরে নামিয়ে দিতেই অবশ্য সে ঘরবাড়ির রাস্তাঘাট চিনে নিয়েছিল।
পাখিবিবির বয়স ষোলো-সতের তখন। মাঝিদের গ্রামেরই অবস্থাপন্ন সচ্ছল ঘরের আদুরে মেয়ে সে। রাজাকারদের নির্যাতনে আলাভোলা হয়ে পড়া কুড়ি-একুশ বছরের যুদ্ধফেরত তরুণ মুক্তিযোদ্ধাটিকে তার খুব মনে ধরল। এক পশলা ঝড়ের মতো কিছু বাধা-বিপত্তিও ছিল। তবু দু’জনের বিয়ে ও সংসার করা আটকে রইল না। বিয়ের পরও আউয়াল বিশ্বাস করতে পারছিল না যে দেশ স্বাধীন হয়েছে। যেদিন যেদিন শেষ বিকেলে কড়া রোদ থাকত, সে দৌড়ে বাড়ির বাইরের উঠানে গিয়ে সূর্যকে পেছন করে দাঁড়াত। পাখিবিবির হাতে থাকত বারো হাত লম্বা ছিপ। সেই ছিপের মাপেও ছায়া কখনো সাত-আট হাতের বেশি লম্বা হতো না। মাঝির গোঁ ধরাও থামত না। বারো হাত লম্বা ছায়া তাকে যে পেতেই হবে। নইলে যে দেশ স্বাধীন হবে না। যুদ্ধে জেতা যাবে না। পাখিবিবি বাধা দেয় না। পরম মমতায় সাহচর্য দেয়। বছর দুয়েকের মধ্যেই সেরে ওঠে মাঝি; কিন্তু দু’জনের সন্তানহীন কেটে যায় পনেরটি বছর। এক সময় পাখিবিবির গর্ভেও সন্তান আসে। খোকা জন্ম নেয়। মাঝি তখন সম্পূর্ণ সুস্থ।
দুই.
হাজতে আউয়াল মাঝির কিন্তু কোনো উদ্বেগ-দুশ্চিন্তাই যেন নেই। হাজতে আসতে পেরেই যেন সে খুশি। তাকে ধরে নিয়ে যাবার দিনটির গল্প শুনিয়ে চলছে হাজতিদের সবাইকে। স্ত্রী-পুত্র-পুত্রবধূ এই তিনজনকেও গত দুই দিনে ছয়বার একই গল্প শুনতে হয়েছে। বলছিল তাকে থানায় দিয়েছে পরে। আগে একটা ক্লাবঘরে ধরে নিয়ে গিয়ে একদল যুবক যাচ্ছেতাই গালাগাল করেছে। মারও দিয়েছে। ক্যারম খেলছিল আর কতসব জেরা যে করছিল ছেলেগুলো! সিগারেট-গাঁজা-মদও চালাচ্ছিল সমানে। কী যে মুখ খারাপ তাদের! পাঁড় মাতাল চ্যাংড়াগুলো একটি মজার খেলাও খেলেছে তার সঙ্গে। জিজ্ঞেস করেছে বাংলাদেশের জাতীয় ফুলের নাম কী? সে বলেছে মনে নাই। তারপর বলল- বল দেখি জাতীয় ফল কোনটা? আউলা এমন আজব প্রশ্ন আর শোনে নাই। তাই খিকখিক হাসি হেসেছিল। বিনিময়ে মিলেছিল একের পর এক রামথাপ্পড়। একসময় মাতালের দল আউলাকে শেখাতে বসল- মনে রাখবি জাতীয় ফুল শাপলা, জাতীয় ফল কাঁঠাল, জাতীয় পাখি দোয়েল, জাতীয় পশু বাঘ। আদেশ দিল যেন সে মুখস্থ রাখে। মারটার খেলে কী হবে! খেলাটি দারুণ মনে ধরেছে আউলার। যাকে পাচ্ছে তাকেই শেখাচ্ছে- মনে রাখবা জাতীয় ফুল শাপলা, জাতীয় ফল কাঁঠাল, জাতীয় পাখি দোয়েল, জাতীয় পশু বাঘ। ভুলবা না কিন্তু, বুচ্ছ? জাতীয় ফল কাঁঠাল, জাতীয় পাখি দোয়েল, জাতীয় পশু বাঘ’।
পাখিবিবি স্বামীকে ডাকে আউলা। আউয়াল বলতে পারে না। আউয়াল নামটিই তার মুখেই আসে না। বিয়ের ঊনপঞ্চাশ বছর পার হলেও আউয়াল বলা শেখেনি। এখন ভাষা জানা না থাকায় খুব গর্ব হয় পাখিবিবির। মনে হয় আউলা বলার মালিক একমাত্র সে। অন্য কেউই তো আউলা ডাকতে জানে না। নিজের মানুষটাকে এত মায়া-দরদের ডাকে ডাকা সম্ভবত আল্লাহরই কেরামতি, আল্লাহরই নেয়ামত। কত যে মায়া আউলা ডাকে- পাখিবিবি ছাড়া আর কে বুঝবে?
তিন-তিনটি দিন চোখের পলকে হাওয়া হয়ে গেল। ছেলে আর ছেলের বউকে নিয়ে পাখিবিবি থানা-পুলিশ, কমিশনারের অফিস কিচ্ছু বাদ রাখেনি। বুঝিয়ে বলেছে পেট চালানোর দায়ে প্রেসের ছাপা বইপত্র ডেলিভারির কাজ করতে গিয়েছিল সত্তর বছর বয়সি মানুষটি। ডেলিভারি দেয় তো আসলে রকি প্রিন্টার্সের রিকশাভ্যানওয়ালা। সঙ্গে একজন ‘বুঝিয়া পাইলাম’, ‘বুঝিয়া নিলাম’ লেখার লোক লাগে। ভ্যানওয়ালা অর্ডারি ছাপার বান্ডিল ডেলিভারি দিতে গেলে ভ্যানে বসে থাকতেও তো একজনকে লাগে। নইলে ভ্যানটি চুরিদারি হবার ভয়। অভাবের ঘর। তাই প্রেসের মালিক দয়া করে তাকে পুরনো কাজটি আবার দিয়েছিলেন।
পাখিবিবি, রোশনি ও খোকা গিয়ে প্রেসের মালিককেও ধরেছিল। হাজি সাহেব দয়ালু মানুষ। বিপদে-আপদে এগিয়ে আসেন সবসময়। তিনি বলেছেন একদমই না ভাবতে। বলেছেন আউয়ালের কোনো দোষই তো নেই! ভুল করে ধরেছে। ধরনেওয়ালারা যখন ভুল হয়েছে বুঝতে পারবে, সঙ্গে সঙ্গেই ছেড়ে দিবে; কিন্তু মালিক থানায়-টানায় যাবেন না। সাফ কথা ঝামেলায় জড়াবেন না। এমনিতেই এখন ম্যালা টাকা খসবে। চাঁদা পার্টি চলেও এসেছে এই ফাঁকে। ছাপা বইগুলোতে না-কি কী কী সব কথাবার্তা ছিল ধরনেওয়ালাদের বিরুদ্ধে। ছাপার কাজই তার পেশা। কে তাকে কী ছাপতে দিয়েছে না দিয়েছে সেইসব দেখা তাঁর কাজ নয়। ডেলিভারি দিতে নেওয়া ছাপা বইপত্রগুলোতে কী ছিল কী ছিল না তিনি কী করে জানবেন? তার কাছ থেকে টাকাটুকা খসানোর জন্য কিডন্যাপকারীরাই যে জাল পাতেনি সেটিই বা কে বলবে? তিনি কী করে জানবেন কী আছে বই আর কাগজপত্রগুলোতে? তাঁর ঘটে ছাপাখানা চালানোর বাইরে তেমন কোনো বিদ্যা নেই। আর আউয়াল তো একেবারে মূর্খই! অতশত ঝামেলা যে আদৌ কখনো হতে পারে তিনি সেইসব কিছু বুঝতে পারেন নি। তাগাদার কাজ। তাই মেশিন পিটিয়ে ছেপেও দিয়েছেন। সেইসব কথা থানায় বলতে গেলে আরও কত রাজ্যের ঝামেলা-হুজ্জতে যে পড়তে হবে কে জানে! তাই তিনি ওইসব হাঙ্গামায় যাবেন না। তবে তিনি থানা পুলিশ করার জন্য পাখিবিবির হাতে ত্রিশ হাজার টাকা গুঁজে দিয়েছেন। বলেছিলেন- রাখো, এইটা লাগবে। এখন হতে টাকা ছাড়া নিঃশ্বাসও আর তোমাদের নাকে ঢুকবে না।
তিন.
এখনো আসমানে ঝকমকি রোদ। আসরের আজান হয়ে গেছে বেশ খানিকক্ষণ আগে। রোশনি শাশুড়ির চেহারা পড়তে লাগল। খোকা চোখ বদলাবদলি করে একবার দেখছিল মাকে, অন্যবার স্ত্রীকে। পাখিবিবির সত্তর ছুঁইছুঁই চোখ জানে আউলার কথাই ভাবছে তারা তিনজন। এই সময় আউলা বাইরে থাকলে কী যে খুশি হতো! পাখিবিবি প্রশ্ন করেন শ্বশুরের কোন কাজটা রোশনির বেশি পছন্দ। উত্তর তার জানাই। তবুও। রোশনিও জানে কোন উত্তরটিতে খুশির প্লাবন নামবে শাশুড়ির চোখে। কিছু কিছু কথা ভাষায় লেখা যায় না। চোখে চোখে লেখা হয়। তিনজন মানুষ হাসে। সেই হাসিতেই ফট করে বিকেলের সোনা আলো আরও খানিকটা উজ্জ্বল হয়ে জ্বলে ওঠে যেন। পাখিবিবি কাঁদতে কাঁদতে বলে চলে- খোকারে, এইরকম রোইদ পাইলে তোর বাপ আইজও বারো হাত ছায়া মাপতে যাইত! সুরুজ ডোবার ঠিক আগে আগের ছায়াডা বিরাট লম্বা হয়! আইজ বোধ হয় বারো হাত হইতোই হইতো!
আজ মাঝিকে নিয়ে রোদে যেতে পাখিবিবির মন আনচান করে। একটু বাড়াবাড়ি বেশিই সেই আনচান। বিয়ের পরের প্রথম যৌবনের মমতা দিনগুলোর মতো। অস্থির জিজ্ঞাসা তার- আইচ্ছা রোশনি, হাজি সায়েব যে দিলো সেখানে আট হাজার টাকার মতো হাতে আছে। টাকাটা দিয়া দিলে থানাওয়ালারা তোর শ্বশুররে ছাইড়া দিব না? একটু রোইদে নিতাম! রোশনি ঝরঝর করে কেঁদে ফেলে- এই এক্কই কথাইতো ভাবতে ছিলাম আম্মা। খোকা রোশনির কাঁধে হাত রাখে। তারও উচ্চারণ- আম্মা, আমিওত এক্কই কথাই ভাবতেছিলাম!
এ সময় তিনজনেরই নজরে এলো দালালটি এদিকেই আসছে। তিনজনের বিশ্বাস এইবার অলৌকিক কিছু ঘটবে। মাঝিকে রোদে নেওয়া যাবে; কিন্তু আর কিছুক্ষণ পর তো সূর্যই ডুবে যাবে। তিনজনই বসা হতে হন্তদন্ত উঠে দাঁড়াতে না দাঁড়াতেই দালাল বলল- এক্ষুণি আসেন, এস আই সাহেব আপনাদের তিনজনের কথা শুনবে। ক্যামনে কী নিয়মকানুন বুঝাবে। আসেন! এসআইর অফিসে আট-দশটি কিশোর-তরুণ ছড়িয়ে ছিটিয়ে দাঁড়ানো। একজন পাখিবিবির চোখে চোখ রেখে বলল- মুরুব্বি, আপনার স্বামীরে আমরা ছাড়ানের ব্যবস্থা করমু। মুরুব্বি মানুষ। খালি শত্রুগোর লগে মিইশ্যাই আকামডা করছে। আমরা কিছু কতাবার্তা শিখাইয়া দিমু নে। আমরা য্যামনে য্যামনে শিখায়া দিমু, ত্যামনে ত্যামনে কইলেই খালাস মিলব। পাখিবিবির হঠাৎ কী যে হয়, ছেলেটির কথা শেষ করতে না দিয়ে মুহূর্তেই প্রশ্ন করে বসে- আপনারা নি আপনেগো মুরুব্বিরে শিখাইছিলেন জাতীয় ফুল শাপলা, জাতীয়...?
পাখিবিবিকে থামিয়ে দিয়ে এসআই সাহেব বলে ওঠেন- শোনেন, আমার হাতে একদম টাইম নাই। আমারে অন্য জায়গায় যাইতে হবে আরেকটা ইনভেস্টিগেশনে। আপনেগো এখানে বইসা থাইকা কোনো কাম নাই। ঘরে যান গা। আপনার স্বামীর ছাড়া পাইতে ম্যালা সময় লাগব। এখন আপনেরা একজন একজন কইরা কইবেন। একেকজন যা কইবার দুই মিনিটে কইবেন। একেকজন দুই মিনিট। খালাম্মা, আগে আপনি।
সূর্যের আলো পড়ে যাচ্ছে। বারো হাত ছায়া পেতে হলে এক্ষুণি বাইরে বেরিয়ে পড়তে হবে। পাখিবিবি ঝড়ের গতিতে বলতে শুরু করে- জাতীয় ফুল শাপলা, জাতীয় ফল কাঁঠাল, জাতীয় পাখি দোয়েল, জাতীয় পশু...। এসআই রেগে কাঁই। পাখিবিবিকে থামিয়ে দিয়ে খোকাকে বললেন- আপনি বলেন। খোকা বলতে শুরু করল- জাতীয় ফুল শাপলা, জাতীয় ফল কাঁঠাল, জাতীয় পাখি দোয়েল, জাতীয় পশু...। এসআই ক্ষেপে গিয়ে রোশনিকে বললেন- আপনিও কি এই একই...? ততক্ষণে রোশনি নিজ হতেই বলতে শুরু করে দিয়েছে- জাতীয় ফুল শাপলা, জাতীয় ফল কাঁঠাল, জাতীয় পাখি দোয়েল, জাতীয় পশু... অল্প কিছুক্ষণের মধ্যেই সূর্যের আলো নিবে যাবে। পাখিবিবি দৌড়ে যেতে থাকে থানার মাঠের দিকে। তার পিছুপিছু দৌড়াচ্ছে খোকা ও রোশনি। সূর্যকে পেছনে রেখে দাঁড়াল পাখিবিবি ও রোশনি। ছায়ার দৈর্ঘ্য হাতের মাপে মেপে চলছে খোকা।
এগারো হাত হইছে, মা। তোরটাও এগারো হাত হইছে রোশনি- আনন্দে উত্তেজনায় চেঁচায় খোকা। রোশনি পাখিবিবিকে বুদ্ধি দেয়- আম্মা, বুইড়া আঙুলের ওপর খাড়ান। শাশুড়ি-বৌ দু’জন বুড়ো আঙুলের ওপর ভর দিয়ে শরীর উঁচিয়ে দাঁড়ায়। হাঁড়গোড় ভেঙে যাবে যেন দু’জনেরই। খোকা পাখিবিবির ছায়া আগে মাপে। তার উল্লাস- মা, তোমার ছায়া বারো হাত হইছে। এবার রোশনির ছায়াটি মাপে সে। আবারো চিৎকার- তোর ছায়াও বারো হাত হইছে, রোশনি! তাইলে আমারটাও বারো হাত হইছে। বাবারটাও বারো হাত হইছে। খোকা মা ও রোশনিকে দুই হাতে দুই দিক হতে পেঁচিয়ে ধরে। পরমানন্দে তিনজন মানুষ হাউমাউ করে কাঁদে। গলা জড়াজড়ি করে কাঁদে। হৈ-হল্লা শুনে থানাভর্তি লোকজন বাইরে বেরিয়ে আসে। সেই শেষ বিকেলে যেন সূর্য আর ডুবলই না। সোনালু আলো ফেলে ঠায় দাঁড়িয়ে অপলক তাকিয়ে রইল তিনজন বারো হাত মানুষের দিকে।
সাম্প্রতিক দেশকাল ইউটিউব চ্যানেল সাবস্ক্রাইব করুন
© 2024 Shampratik Deshkal All Rights Reserved. Design & Developed By Root Soft Bangladesh