মুক্তিযুদ্ধের গল্প

খটখট...

বেয়াই ঘুমিয়েছিলেন ঠিকভাবে? নাহ, সিরাজউদ্দিন শোয়া থেকে বসেন। দেখে ক্লান্ত মনে হচ্ছে। ঘুমটা ভালো হয়নি। এই বয়সে ঘুম না হলে শরীর ভেঙে পড়ে।
ঠিকই; কিন্তু কেন ঘুম হয়নি আপনার? অবাক আফসার আহমেদ। বসেন বিছনার পাশে, বলুন আমাকে কেন রাতে ঘুমুতে পারেননি?
মাথার ওপর বন্ধ ফ্যানটা ইঙ্গিত করে দেখান সিরাজউদ্দিন, ফ্যানের শব্দে।
আফসার আহমেদ অবাক। রুমের ফ্যান বন্ধ। গরমের সময়ে ফ্যান বন্ধ! তিনি দেখলেন, রুমের পূর্ব দিকের তিনটি জানালা খোলা। অল্প অল্প বাতাস আসছে; কিন্তু জুনের শেষ দিক যদিও, গরম কম না। ঢাকা শহরে কেউ ফ্যান বন্ধ করে ঘুমানো চিন্তাও করতে পারে না। গ্রাম থেকে আসা মানুষ বলেই কী...।
ফ্যানটা পুরনো, অনেক বছরের...। হ্যাঁ, একটা খট খট শব্দ হয় বটে কিন্তু শোনাই যায় না; কিন্তু আপনি বেয়াই এই ফ্যানের শব্দের জন্য সারা রাত ঘুমুতে পারেন নি? আমাকে ডাকলেন না কেন?
রাত যত গভীর হয়েছে, খট খট শব্দ তত বেড়েছে। শব্দটা কান দিয়ে একেবারে বুকের মধ্যে কলিজায় গিয়ে আঘাত করেছে। অত রাতে আপনাদের ডেকে আর বিরক্ত করতে চাইনি। শেষে ফ্যান বন্ধ করে জানালা খুলে ঘুমিয়েছি...।
নাস্তা নিয়ে ঢোকে কল্যাণী, বাবা ওঠেন। দু’জনের জন্য নাস্তা এনেছি। শ্বশুরের দিকে তাকিয়ে বলে আর ট্রলি ট্রে থেকে খাবারের প্লেটটা নামিয়ে টি টেবিলের ওপর রাখতে থাকে।
বিছানা থেকে নেমে স্যান্ডেল পায়ে বাথরুমে ঢোকেন সিরাজউদ্দিন। আফসার আহমেদ উঠে ফ্যান ছাড়েন। গরম ঘুমোট ভাবটা- মুহূর্তে কেটে যায়। ঘূর্ণায়মান ফ্যানের দিকে তাকিয়ে কল্যাণী প্রশ্ন করে পিতাকে, আব্বা ফ্যান বন্ধ ছিল কেন?
তোর শ্বশুর বন্ধ করে রেখেছিল, খাবারের টেবিলের সামনে সোফায় বসতে বসতে বলেন। অবাক কল্যাণী, কেন ফ্যান বন্ধ করেছিলেন বাবা?
ফ্যানে শব্দ হয় রাতে।

  • শুনছেন? আরও হতভম্ব কল্যাণী, কি শুনছেন? মৃদু হাসেন সিরাজউদ্দিন, আমি যা শুনছি তুমি সেটা কোনোদিনও শুনবে না মা। চলো, যাই...। বাসায় এসে দেখেন ইলেকট্রিক মিস্ত্রি পুরনো ফ্যান খুলে ফেলেছে। নতুন ফ্যান লাগাচ্ছে। চোখে নতুন চশমা নিয়ে টেবিলের ওপর পুরনো ফ্যানটা দেখেন সিরাজউদ্দিন। দেখতে দেখতে চিৎকার করে ডাকেন, বৌমা! বৌমা! দৌড়ে আসে কল্যাণী, কি বাবা? দেখো! সিরাজউদ্দিন হাতের ইশারায় দেখান পুরনো ফ্যানটা...

কল্যাণী প্রশ্নবোধক দৃষ্টিতে পিতার দিকে তাকায়। আফসার আহমেদ বলেন, বাড়িটা পুরনো। ফ্যানও অনেক দিনের। আমরাতো এই রুমে খুব একটা আসি না। তোর শ্বশুর এলে বড় রুম ভেবে থাকতে দিলাম ওনাকে; কিন্তু সারা রাত ফ্যানের খট খট খট শব্দে ঘুমাতে পারেনি বেয়াই। শেষ ফ্যান বন্ধ করে জানালা খুলে ঘুমিয়েছেন।
ঢোকে মিথুন। বছর তিনেক আগে মিথুনের সঙ্গে বিয়ে হয়েছে কল্যাণীর। সিরাজউদ্দিনের ছেলে মিথুন। গ্রামের মানুষ তিনি। স্কুলে পড়াতেন। চার বছর হলো অবসরে গেছেন। চোখে এখন একটু কম দেখেন সিরাজউদ্দিন। বাবাকে ভালো চিকিৎসার জন্য ঢাকায় নিয়ে এসেছে মিথুন। বিশাল বাসার বড় রুমটাতেই থাকতে দিয়েছেন বেয়াইকে; কিন্তু ফ্যানের খট খট খট শব্দে...।
কল্যাণীরা দুই বোন। ওর ছোট বোন পার্বণী। পার্বণী কলেজে পড়ে। বিয়ের পর শ্বশুর বাড়িতে থাকছে মিথুন। কারণ, চারতলা বিশাল বাড়ি। দোতলায় ছোট-বড় আটটা রুম নিয়ে থাকেন আফসার আহেমদ। মিথুন শুরুতে থাকতে না চাইলেও স্ত্রীর অনুরোধে থাকছে। শর্ত একটা, মাস শেষে ভাড়ার টোকেন হলেও একটা অংশ নিতে হবে।
আফসার বলেন তখন, মানে আমি তোমার শ^শুর। মেয়ে বিয়ে দিয়েও তোমার বাবা হতে পারলাম না।
মিথুন মাথা নিচু করে, সরি বাবা।
সিরাজউদ্দিন বাথরুম থেকে বের হয়ে এক সঙ্গে নাস্তা খেতে বসেন। খেতে খেতে সিদ্ধান্ত হয়, নাস্তার পর কল্যাণী শ্বশুরকে নিয়ে চোখের ডাক্তারের কাছে যাবে। মিথুন চলে যাবে অফিসে। আর আফসার আহমেদ ইলেকট্রিক মিস্ত্রি ডেকে ফ্যান সারাবেন। যথারীতি কল্যাণী শ্বশুরকে নিয়ে ডাক্তারের কাছে যায়। ডাক্তার পরিচিত। দেখে বলেন, ডায়াবেটিসের কারণে চোখের পাওয়ার কিছুটা কমেছে। তিনি একটা চশমা দিলেন। ডাক্তারের চেম্বারের লাগোয়া দোকানে চশমা বানাতে দিলেন সিরাজউদ্দিন। কল্যাণী বলে, আব্বা আপনার বেয়াইতো এই দোকান থেকে চশমা নেন।
ঠিকাছে, আমাকেও দাও।
মিথুন বলছিল, আপনি নাকি বাড়িতে প্রচুর বই পড়েন।
হাসেন সিরাজউদ্দিন, হ্যাঁ মা। অবসর জীবনে কী আর করব। শৈশব থেকে বই পড়ার নেশা। আমার মনে হয় কি জানো, দুনিয়ার শ্রেষ্ঠ বা প্রয়োজনীয় বইটি এখনো পড়তে পারিনি।
কিন্তু আপনার চোখে তো চাপ পড়ছে...
পড়–ক, পড়া ছাড়া বাঁচতে পারব না।
বাড়িতে এসে দেখলেন, বিয়াই আসফার আহমেদ ইলেকট্রিক মিস্ত্রি এনে ফ্যান ঠিক করে রেখেছেন। ফ্যান চলছে। প্রচুর বাতাস। দুই বেয়াই গল্পে মেতে উঠলেন; কিন্তু পরের রাতে সিরাজউদ্দিন ফ্যানের একই শব্দ শুনলেন, খটখটখট...। রাত যত গভীর হয়, ফ্যানের শব্দ তত বাড়ে। অসহ্য যন্ত্রণায় সিরাজউদ্দিন বিছানা থেকে চাদর নিয়ে দুই রুমের মাঝখানের প্যাসেজে ঘুমান। সকালে সিরাজউদ্দিনকে প্যাসেজে শুয়ে থাকতে দেখে বিস্মিত আফসার আহমেদ, কল্যাণী, মিথুন।
ঘটনা কি? আপনি এখানে কেন? জিজ্ঞেস করে কল্যাণী।
বিব্রত সিরাজউদ্দিন বলেন, মা আমি বোধহয় অসুস্থ হয়ে গেছি।
কেন? কি হয়েছে?
তোমার বাবা আমার বেয়াই গতকালইতো মিস্ত্রি ডেকে ফ্যানটা ঠিক করাল; কিন্তু রাত যত গভীর থেকে গভীর হয়, ফ্যানের মধ্যে থেকে সেই খট খট খট শব্দটা পাই। আমার মাথার মধ্যে খুব যন্ত্রণা করে। বাধ্য হয়ে এখানে ঘুমিয়েছি মা। রাতে ঘুম না হলে শরীর খুব খারাপ করে।
বেয়াইসাব, কি বলছেন বুঝতে পারছি না। যাই হোক, আজকে পুরনো ফ্যানটাই রাখব না। নতুন একটা ফ্যান লাগিয়ে দেবো আপনার রুমে।
সেটাই করুন বাবা, পিতাকে সমর্থন করে মেয়ে কল্যাণী। আর আপনি এখন উঠুন, শ্বশুরকে তাগাদা দেয়। আজকে আপনার চশমা আনতে যেতে হবে।
মিথুন মামুন বিব্রত। আজব ঘটনা, রাত যত বাড়ে ততই ফ্যানের রেগুলেটর থেকে খট খট খট শব্দ বের হয়। বাবা কি মানসিকভাবে অসুস্থ? নাকি কল্যাণীর সঙ্গে আমার বিয়ে মেনে নিতে পারেনি এখনো। কল্যাণীর সঙ্গে বিয়ের সময়ে বাবা আসেনি। তিনি মিথুনকে গ্রামের মেয়ে বিয়ে করাতে চেয়েছিলেন; কিন্তু মিথুন যখন জানিয়ে দেয়, কল্যাণীকে ছাড়া আর কাউকে কখনো বিয়ে করবে না, তখন ইচ্ছের বিরুদ্ধে বিয়ের অনুমতি দিয়েছিলেন; বিয়ের সময়ে আসেননি; কিন্তু বিয়ের পর কল্যাণী বাড়ি গেলে, ওকে দেখে গ্রহণ না করে পারেন নি।
বাবা এমনিতে খুব সহজ সরল কিন্তু কোনো বিষয়ে একবার প্রশ্ন তুললে, সহজে ভোলেন না। মিথুন পিতাকে চেনে। কোনো খেলা শুরু করেছেন? কিন্তু কি করতে পারে মিথুন? শ্বশুর আফসার আহমেদ মাটির মানুষ। ঢাকা শহরের বুকের ওপর বাড়ি, আরও আছে কয়েকটা, সবই পিতার সূত্রে পেয়েছেন। কোনো অহংকার নেই। এই সহজ সরল মানুষটাকে অপদস্থ করার কোনো...।
কি ভাবছো? জিজ্ঞেস করে কল্যাণী।
চায়ের কাপে চুমুক দিতে দিতে উত্তর দেয় মামুন, বলতে পার বাবা ফ্যানের শব্দের রহস্যটা কী?
রহস্য কী! শব্দ হয়, ফ্যানের কয়েলের মধ্যে নিশ্চয়ই কোনো ঝামেলা আছে।
কিন্তু ইলেকট্রিশিয়ান না ঠিক করল গতকাল।
আরে আজকাল ইলেকট্রিশিয়ানদের কিছু ঠিক আছে? চিন্তা কর না। বাবা তো আজকেই নতুন ফ্যান লাগিয়ে দিচ্ছেন।
দেখি, কি হয়। আমি অফিসে যাই- মিথুন মামুন চলে যায়।
কল্যাণী প্রস্তুত হয়ে শ্বশুরকে নিয়ে চোখের ডাক্তারের কাছে যায়। ডাক্তারের কাছ থেকে নতুন চশমা চোখে দিয়ে বেশ আরাম বোধ করেন সিরাজউদ্দিন। রাস্তার পাশে বসে চা খেলেন পুত্রবধূকে সঙ্গে নিয়ে। বাসায় ফেরার সময়ে কল্যাণীকে জিজ্ঞেস করেন সিরাজউদ্দিন, মা সোহরাওয়ার্দী উদ্যান কি দূরে?
না বাবা, যাবার পথেই পড়বে। যাবেন?
একটু যেতাম।
সোহরাওয়ার্দী উদ্যান পার হওয়ার সময়ে কল্যাণী গাড়ি থামায়। শ্বশুরকে নিয়ে উদ্যানে ঢোকে। প্রায় ঘণ্টাখানেক ধরে নিঃশব্দে হেঁটে বেড়ালেন তিনি। অবাক কল্যাণী, শ্বশুর এত নীরব কেন? সাধারণত এমন নীরব থাকেন না। জিজ্ঞেস করে, বাবা চুপ হয়ে গেলেন যে!
শুনছি মা।
শুনছেন? আরও হতভম্ব কল্যাণী, কি শুনছেন?
মৃদু হাসেন সিরাজউদ্দিন, আমি যা শুনছি তুমি সেটা কোনোদিনও শুনবে না মা। চলো, যাই...।
বাসায় এসে দেখেন ইলেকট্রিক মিস্ত্রি পুরনো ফ্যান খুলে ফেলেছে। নতুন ফ্যান লাগাচ্ছে। চোখে নতুন চশমা নিয়ে টেবিলের ওপর পুরনো ফ্যানটা দেখেন সিরাজউদ্দিন। দেখতে দেখতে চিৎকার করে ডাকেন, বৌমা? বৌমা?
দৌড়ে আসে কল্যাণী, কি বাবা?
দেখো! সিরাজউদ্দিন হাতের ইশারায় দেখান পুরনো ফ্যানটা।
ফ্যানের দিকে তাকিয়ে কি করবে বুঝতে পারে না কল্যাণী, বাবা কি দেখব?
দেখ কি লেখা! নির্দিষ্ট জায়গায় তর্জনি রেখে দেখান তিনি। অবাক চোখে কল্যাণী দেখে, ফ্যানের ওপর লেখা মেইড ইন পাকিস্তান। ফ্যানের দিক থেকে চোখ এনে আরও বিস্ফোরিত দৃষ্টিতে তাকায় কল্যাণী শ্বশুরের দিকে, বাবা!
তোমরা ভাবছো, আমি পাগল হয়ে গেছি! না, আমি ঠিকই আছি। মেইড ইন পাকিস্তান লেখা একটা ফ্যানের বাতাস একজন মুক্তিযোদ্ধা কখনোই সহ্য করতে পারে না।
কল্যাণী নির্বাক চোখে নতুন একজন মানুষকে দেখে।

সাম্প্রতিক দেশকাল ইউটিউব চ্যানেল সাবস্ক্রাইব করুন

মন্তব্য করুন

Epaper

সাপ্তাহিক সাম্প্রতিক দেশকাল ই-পেপার পড়তে ক্লিক করুন

Logo

ঠিকানা: ১০/২২ ইকবাল রোড, ব্লক এ, মোহাম্মদপুর, ঢাকা-১২০৭

© 2024 Shampratik Deshkal All Rights Reserved. Design & Developed By Root Soft Bangladesh

// //