ফিলিস্তিনি গল্প

তুই যদি ঘোড়া হতিস

ফিলিস্তিনির আশ্চর্য জনপ্রিয় ঔপন্যাসিক, প্রখ্যাত শিল্পী এবং বিশিষ্ট একজন মুক্তিযোদ্ধা ঘাসান কানাফানির জন্ম ১৯৩৬ সালে, আক্রায়; কিন্তু অন্য বহু উদ্বাস্তু পরিবারের মতো নানান জায়গা ঘুরে শেষে ১৯৪৮ সালে আস্তানা গাড়েন দামাস্কাসে। পড়াশোনা শেষ করে প্রথমে সিরিয়া, পরে কুয়েতে শিক্ষকতা ও সাংবাদিকতা পেশায় যুক্ত হন। ১৯৬৯ সালে চলে আসেন বৈরুতে এবং বহু সংবাদপত্র ও মুক্তি আন্দোলনের সঙ্গে ওতপ্রোতভাবে জড়িত থাকেন। ১৯৭২ সালে মাত্র ছত্রিশ বছর বয়েসে প্রচণ্ড এক বোমা বিস্ফোরণে বিপ্লবী এই কথাশিল্পীর মৃত্যু ঘটে। অত্যন্ত স্বল্পায়ু জীবনেও তিনি পাঁচটি উপন্যাস, পাঁচটি গল্পসংকলন, দুটি নাটক এবং শিল্প, সাহিত্য ও রাজনীতির ওপর অজস্র প্রবন্ধ রেখে যাবার অবকাশ পান।

‘তুই যদি ঘোড়া হতিস, আমি সোজা তোর মাথায় গুলি করে মারতাম।’  ঘোড়া কেন? কুকুর বেড়াল ইঁদুর কিংবা অন্য কোনো জীব নয় কেন? অন্য কোনো জীব হলেও তো যে কেউ তার মাথায় গুলি করে মারতে পারে? 

যখন থেকে সে শব্দগুলোর মানে বুঝতে শিখেছে, অবশ্য ঠিক কবে থেকে সেটা তার স্পষ্ট মনে নেই, তখন থেকেই সে বাবার মুখে এই কথাগুলো শুনে আসছে। ব্যাপারটা সত্যিই ভারি অদ্ভুত, নিজের ছেলেকে ঘোড়া হিসেবে ধরে নেওয়ার এই যে ইচ্ছে, এ পৃথিবীতে একমাত্র তার বাবাকেই সে কেবল প্রকাশ করতে শুনেছে। স্রফে ঘোড়া, আর অন্য কিছু নয়! এর চাইতে যেটা আরও অদ্ভুত ব্যাপার, বাবা কিন্তু কখনই চাইতেন না অন্য আর কেউ ঘোড়া হোক, তা তিনি তার ওপর যত ক্রুদ্ধ হোন বা তাকে তিনি যতই অপছন্দ করুন না কেন। প্রথম প্রথম সে ভাবতো বাবা বুঝি অন্য কিছুর চাইতে ঘোড়াদেরই বেশি অপছন্দ করতেন, তাই কারও ওপর প্রচণ্ড রেগে গেলে তিনি বলতেন, ‘তুই যদি ঘোড়া হতিস, আমি তোকে গুলি করে মারতাম।’ মনে মনে সে আরও ভাবতো, বাবা বুঝি নিজের ছেলের চাইতে এ পৃথিবীতে আর কাউকে এত ঘৃণা করতেন না, আর সেই জন্য তিনি অন্য কাউকে কখনই বলতেন না, ‘তুই যদি ঘোড়া হতিস, আমি সোজা তোর মাথায় গুলি করে মারতাম।’ সময় বদলানোর সঙ্গে সঙ্গে তার সেই ছেলেমানুষি ধারণাটাও সম্পূর্ণ বদলে যায়। কেননা সে আবিষ্কার করতে পারে এক সময়ে বাবা ঘোড়া অসম্ভব ভালোবাসতেন। ঘোড়া সম্পর্কে তাঁর অভিজ্ঞতাও ছিল অপরিসীম। কেবল গ্রাম ছেড়ে আসার পর থেকেই ঘোড়া সম্পর্কে তাঁর আর কোনো উৎসাহ ছিল না।

একবার, স্বভাবের তুলনায় বাবা যখন বেশ হাসিখুশি আর সরিফ মেজাজে ছিলেন, সুযোগ বুঝে সে জানতে চেয়েছিল- ‘আচ্ছা, আমাকে তোমার কাছ থেকে সরিয়ে রাখার জন্য তুমি সব সময় কেন চাও, বলো তো যে- আমি একটা ঘোড়া হই?’

চকিতে ভ্রু কুঁচকে বাবা গম্ভীর গলায় বলেছিলেন- ‘এ সব তুই বুঝবি না। কখনও কখনও এমন একটা সময় আসে যখন কোনো ঘোড়াকে গুলি করে মারাটা অত্যন্ত জরুরী হয়ে পড়ে।’

‘কিন্তু বাবা, আমি তো ঘোড়া নই!’

‘জানি। আমি খুব ভালো করেই জানি। আর সেই জন্যই তো মাঝে মাঝে বলতে ইচ্ছে করে- ঈশ্বর তোকে একটা ঘোড়া বানালেই ভালো করতেন।’

এই বলে তার বাবা চওড়া কাঁধ ফিরিয়ে হাঁটতে শুরু করেছিলেন। ছেলে কিন্তু কয়েক পা এগিয়ে গিয়ে বাবার পথ রোধ করে দাঁড়িয়ে ছিল। থমকে বাবা মর্মভেদী দৃষ্টিতে ছেলের আপাদমস্তক একবার দেখে নিয়েছিলেন। ছেলেও বৃথাই চেষ্টা করে ছিল বাবার মনের ঠিকানা খুঁজে পাওয়ার।

‘তুমি আমাকে এত ঘেন্না করো?’

‘আমি তোকে একটুও ঘেন্না করি না।’

‘তাহলে?’

‘আমি তোকে ভয় পাই।’

মুহূর্তের জন্য নিশ্চুপ থাকার পর সে বাবার পথ ছেড়ে সরে দাঁড়িয়েছিল। চওড়া সিঁড়িটায় উনি যখন বাঁক নিচ্ছিলেন, তখনই সে বুঝতে পেরেছিল জীবনের প্রায় সবটাই নির্জনতায় নিঃসঙ্গ কাটিয়ে দেওয়া এই হতভাগ্য বৃদ্ধ মানুষটা তাকে কি ভীষণই না ভালোবাসেন। তাঁর সারাটা যৌবনই কেটেছে ঘোড়ার নেশায়, তারপর হঠাৎই সবকিছু ছেড়ে দেন। স্ত্রীর মৃত্যুর পর সদ্যজাত শিশুপুত্রটিকে নিয়ে তিনি চলে আসেন শহরে। সামরা, বেদা, বার্ক, সাবা প্রভৃতি তাঁর প্রিয় সব ঘোড়াগুলো, এমন কি ঘোড়া-বিচরণের দুর্লভ সুন্দর মাঠগুলোকেও তিনি বিক্রি করে দেন। কেন তিনি এ কাজ করলেন, তরুণ যুবকটির কখনও সুযোগ হয়ে ওঠেনি বাবাকে এ প্রশ্ন করার। আর করলেও সে নিশ্চয়ই কোনো জবাব পেতো না। বাবাকে সে খুব ভালো করেই চেনে, সে জানে বাবার অতীত যেন হাজারটা চাবি দেওয়া কাঠের ভারি একটা সিন্দুক, যেটাকে ছুঁড়ে ফেলে দেওয়া হয়েছে অতল সমুদ্রে। কাহিনীটার প্রতি আকৃষ্ট হয়েই সে মনে মনে স্থির করেছিল, সুযোগ পেলেই সে এই রহস্যের যবনিকা উন্মোচন করবে। যেহেতু গ্রামে তখনো বাবার কিছু বন্ধু-বান্ধব আর আত্মীয়-স্বজন রয়ে গিয়েছিল, তাই একবার তিনি যখন সেখানে বেড়াতে গিয়েছিলেন, ছেলে তখন চুপিচুপি বাবার ঘরে ঢুকেছিল, যেখানে সে আগে প্রায় ঢোকেনি বললেই চলে। এই প্রথম সে আবিষ্কার করলো আশ্চর্য সুন্দর সুন্দর সব ঘোড়ার ছবি টাঙানো রয়েছে সারা দেওয়াল জুড়ে। টেবিলের টানার ফাঁকে ছুরির ফলা চালিয়ে সে ড্রয়ারটা খুললো, খুঁজে পেলো কালো চামড়ায় বাঁধানো ছোট একটা খাতা। আরামকুসিতে আয়েশ করে বসে সে খাতাটা পড়তে লাগলো।

হতাশ হতেও তার খুব একটা বেশি সময় লাগলো না। কেবল সংখ্যা, দাম এবং বংশতালিকা ছাড়া খাতাটাতে প্রায় আর কিছুই ছিল না। দাম বলতে যে দামে ঘোড়াগুলোকে কেনা- বেচা করা হয়েছিল আর বংশতালিকাগুলো ছিল বিগত কয়েকশো বছর ধরে বিস্তৃত। খাতার একপাশে রয়েছে অত্যন্ত অমনোযোগের সঙ্গে, যেন স্বপ্নের ঘোরে লেখা কিছু অসমাপ্ত মন্তব্য।

‘ ২০.৪.১৯২৯ : ওরা আমাকে বললো ওটাকে বিক্রি করে দিতে কিংবা মেরে ফেলতে।’

গভীর আগ্রহে সে পাতা উলটে চললো। উত্তেজনায় স্নায়ুপুঞ্জ এমন টান টান হয়ে উঠেছে যেন একটা দড়ির শেষ প্রান্তে এসে পৌঁছেছে, যেকোনো মুহূর্তে হাতটা ফসকে যেতে পারে।

‘১.১২.১৯২৯ : ওটা আমার সব চাইতে মূল্যবান সম্পদ, কোনোমতেই আমি ওটাকে হাতছাড়া করতে পারি না! তবু ওরা আমাকে এখনও উপদেশ দিচ্ছে হয় ওটাকে বিক্রি করে দিতে নয়তো মেরে ফেলতে।’

‘২০.০৩.১৯৩০ : এগুলো সত্যিই বিরক্তিকর কুসংস্কার। বার্ক আমার জীবনে দেখা সব চাইতে দুর্লভ অশ্ব এবং খুবই শান্ত। আমি ওকে কিছুতেই মেরে ফেলতে পারবো না।’

রহস্যময় দিনলিপিটার শেষ পৃষ্ঠায় কাঁপা কাঁপা হাতে লেখা রয়েছে চরম পংক্তি কয়টি -

‘২৭.৭.১৯৩০ : প্রচণ্ড একটা ঝাঁকুনিতে বার্ক ওকে ফেলে দিলো নদীর পাড়ে, খুরের চাঁটে মাথার খুলিটা একেবারে গুঁড়িয়ে দিলো, তারপর সামনের পায়ের ধাক্কায় ওকে ছিটকে ফেলে দিলো নদীর জলে। শেষ পর্যন্ত আবু মহম্মদই বার্কের মাথায় গুলি করে মারল।’

বাবার এক বন্ধু বলল-‘মাকে তোমার নিশ্চয়ই মনে নেই। মনে থাকার কথাও নয়। উনি ছিলেন ভারি চমৎকার মহিলা, সবাই ওঁকে খুব ভালোবাসতো। তোমার বাবা, আল্লাহ ওঁকে সুখী করুন, তোমার মাকে পাগলের মতো ভালোবাসতেন। তোমার বাবার মতো এত মহব্বত কেউ তাঁর স্ত্রীকে কখনও করেছে বলে অন্তত আমরা শুনিনি। তোমার মা ছিলেন যেমন খুবসুরত, তেমনি বুদ্ধিমতী। আমার যতটুকু মনে পড়ছে, শাদির পর বছরখানেক ওঁরা দু’জনে একসঙ্গে থাকতে পেরেছিলেন, তারপর তোমার জন্মের কিছুদিন পরেই ঘোড়াটা ওঁকে নদীর পাড়ে আঁছড়ে ফেলে দেয়।

‘তুমি জানতে চাইছো কেন আমরা ঘোড়াটাকে মারতে চেয়েছিলাম? বেটা, এ প্রশ্নের জবাব দেওয়া খুবই কঠিন। এ প্রশ্নের জবাব কেবল তাঁরাই দিতে পারেন যাঁরা অভিজ্ঞ আর জ্ঞানী, এবং অভিজ্ঞ আর জ্ঞানী মানুষ ছাড়া সেই জবাবের মানে বোঝাও খুব মুশকিল। আমি বুড়ো-হাবড়া মানুষ। তুমি বরং অন্য কাউকে জিজ্ঞেস করলে না কেন? ‘তবে আমি খুব ভালো করেই জানি, তোমার বাবা তোমাকে ঘেন্না করেন না, উনি তোমাকে ভয় পান। তুমি যখন খুব ছোট ছিলে, যখন একটা ছোট্ট নুড়িও তুলতে পারতে না, সেই তখন থেকেই উনি তোমাকে ভয় পেয়ে আসছেন। আমি হলে নিশ্চয়ই এ সম্পর্কে তাঁকে কখনও কোনো প্রশ্ন করতাম না।’ কিন্তু কেন, কেন তার বাবা, শুধু মাত্র তার বাবাই তাকে ভয় পান? হাসপাতালের প্রতিটা সহকর্মি আর বন্ধুরাই তো তাকে একজন শান্তিপ্রিয় আর নিরহঙ্কারী মানুষ হিসেবে জানে। জীবনে সে কখনও ছোট্ট একটা পতঙ্গেরও জীবন নষ্ট করেনি। তাহলে অন্য কেউ না হয়ে তার বাবাই বা কেন তাকে ভয় পেতে যাবেন? তাঁর শল্যচিকিৎসার ধারালো ছুরির ফলাকে রোগীরা পরম নির্ভরতার সঙ্গেই গ্রহণ করে। কই, ওরা তো কখনও তাকে ভয় পায় না! তাহলে বাবাই বা কেন তাকে ভয় পেতে যাবেন? তার মুখে কি এমন কোনো ভয়ঙ্কর অভিব্যক্তি ফুটে ওঠে, যার জন্য শুধু তার বাবাই তাকে ভয় পান? একদিন রাত্রের ঘটনায় এর কিছুটা আভাস পাওয়া গেল। নিজের ঘরেই সে শুয়েছিল, হঠাৎ বাবার ঘর থেকে ভেসে এলো একটা তীক্ষ্ণ আর্তনাদ। পড়ি কি মরি করে সিঁড়ি ভেঙে সে ওপরে এলো, দমকা বাতাসের মতো ঢুকে পড়লো ঘরের ভেতরে, দেখল বিছনায় দুমড়ে-মুচড়ে বাবা ছটফট করছেন। বৃদ্ধ মানুষটা যে উপাঙ্গ বৃদ্ধির অসহ্য যন্ত্রণায় কষ্ট পাচ্ছেন এবং ওটা যেকোনো মুহূর্তে ফেটে যেতে পারে, সেটি আবিষ্কার করতে তার খুব একটা বেশি সময় লাগলো না। 

আর্দালীরা যখন চাকাওয়ালা নিচু গাড়িতে করে ঠেলতে ঠেলতে তাঁকে অস্ত্রোপচারের ঘরের দিকে নিয়ে যাচ্ছে, বাবা তখন জানতে চাইলেন, ‘অস্ত্রোপচারটা কে করবে?’ আর্দালীদেরই একজন জবাব দিলো, ‘ কেন, আপনার ছেলে, শহরের যিনি সেরা সার্জন।’ বৃদ্ধ চকিতে উঠে বসলেন, চেষ্টা করলেন চেপে-ধরা বলিষ্ঠ হাতগুলো থেকে নিজেকে ছাড়িয়ে নেওয়ার। সে প্রচেষ্টা যখন ব্যর্থ হলো, উনি তখন তারস্বরে চেঁচাতে শুরু করলেন- ‘না না, কিছুতেই তা হবে না! আমার ছেলে ছাড়া আর যে কেউ অস্ত্রোপচার করতে পারে... এমন কি কোনো সকাই হলেও চলবে, কিন্তু আমার ছেলে নয়!’ ‘সে কি, উনি তো যথেষ্ট সাফল্যের সঙ্গেই হাজার হাজার অস্ত্রোপচার করেছেন!’ বৃদ্ধ কিন্তু অদম্য। যন্ত্রণায় আতঙ্কে প্রাণ প্রায় বেরিয়ে যাবার যোগাড়, তবু উঁনি চেঁচাচ্ছেন। অবচেতন করার আসন্ন প্রচেষ্টাকে প্রতিহত করার প্রাণপণ চেষ্টা করছেন। 

‘ও আমাকে মেরে ফেলবে! ও আমাকে মেরে ফেলবে!’ ‘কি আজেবাজে বকছেন?’ ‘আজেবাজে হোক বা না-ই হোক। আমি চাই না আমার ছেলে এ ঘরে ঢুকুক। এমন কি ও দেখুক সেটাও আমার পছন্দ নয়।’ এর পরেও তর্ক করাটা অর্থহীন। ছেলে অন্য কারুর চাইতে বাবাকে খুব ভালো করেই জানে, তাই হাল ছেড়ে দেওয়ার ভঙ্গিতে সে ওয়েটিং রুমে ফিরে এলো। যে শল্যচিকিৎসক অস্ত্রোপচার করেছিলেন, তিনি বললেন- ‘বিশ্বাস করো, তোমার বাবাকে অস্ত্রোপচার করতে গিয়ে এমন কঠিন সমস্যার সম্মুখীন আমাকে কখনও হতে হয়নি। অবেদনিক প্রয়োগ করার পরে অনুভূতি লোপ পাওয়া তো দূরের, অস্ত্রোপচার চলাকালীন সারাটা সময়ই উনি সমানে বকবক করে গেলেন। আর ওঁর ধারণা, আবু মহম্মদ... ভদ্রলোক কে আমি ঠিক জানি না... অত্যন্ত দুর্বোধ্য আর নিষ্ঠুর প্রকৃতির মানুষ। সেই জন্যই একটা ঘোড়াকে উঁনি অমন নির্মমভাবে মারতে পেরেছিলেন, অথচ ঘোড়ার যিনি মালিক হাজার চেষ্টা করেও তিনি তা পারেননি। ‘তোমার বাবা তাঁর যৌবনের দিনগুলোর কথা এমন সুন্দরভাবে বলছিলেন- আমার মনে হয় শুনলে তোমার নিশ্চয়ই খুব ভাল লাগবে। উঁনি বার বারই তোমার মার, বিশেষ তাঁর রূপের কথা বলছিলেন। বলছিলেন- তাঁর মৃত্যুর জন্য নাকি বার্কই দায়ী। আচ্ছা, এই বার্কটা কে?’ 

‘তাছাড়া, তোমার বাবা ত্রিশ বছর আগেকার একটা ঘোড়ার কথাও বলছিলেন। নিখুঁত বংশের একটা ঘুড়ীর সঙ্গে গভীর মরুভূমি থেকে আনা বেদুঈন একটা ঘোড়ার মিশখাওয়ানো সেই ঘোড়াটা জন্মেছিল একটা ঝড়ের রাতে। তোমার বাবার চোখে ওটা ছিল পৃথিবীর সবচাইতে সুন্দর ঘোড়া। কোথায় অন্য কোনো রঙের চিহ্নবিহীন সম্পূর্ণ ধুসর বর্ণের। অশ্ব শাবকটাকে দেখা মাত্র তোমার বাবা খুশিতে উচ্ছল হয়ে উঠেছিলেন এবং নিচু একটা পাঁচিলের ওপর লাফিয়ে উঠে শাবকটাকে দাঁড় করানোর চেষ্টা করেছিলেন। শাবকটা যখন তার পায়ের ওপর দাঁড়াতে পারলো, সবাই দেখল- গলার পাশ থেকে সারাটা ডানদিক জুড়ে অসমান্তরাল একটা লালচে দাগ রয়েছে। তোমার বাবা বলছিলেন প্রথমে দাগটা ওঁর ভালোই লেগেছিল, কিন্তু পাঁচিলের ওপার থেকে আবু মহম্মদ সঙ্গে সঙ্গে বলে উঠেছিল- ‘শাবকটা এক্ষুনি মেরে ফেলুন, হুজুর।’ তোমার বাবা রেগে গিয়ে জিজ্ঞেস করেছিলেন- ‘কেন?’ আবু মহম্মদ বলেছিল- ‘আপনি কি ওই লালচে দাগটা দেখতে পাচ্ছেন না? ওটার মানে শাবকটা একদিন আপনার কোনো প্রিয়জনের মৃত্যুর কারণ হয়ে দাঁড়াবে। জন্ম থেকেই ও নিহতের সেই রক্ত তার শরীরে বহন করছে। তাই বড় হয়ে ওঠার আগেই শাবকটাকে মেরে ফেলতে হবে।’

‘ওই ধরনের কুসংস্কারকে তোমার বাবা আদৌ আমল দিতে চাননি, তাই ঘোড়াটাকে মারেননি। উনি বলেছিলেন ওটার পিঠে চড়া যে খুব সহজ ছিল শুধু তাই নয়, ঘোড়াটা ছিল যেমন বাধ্য, তেমনি বুদ্ধিমান। এবং সামান্য একটা মাছিকেও বিরক্ত না করে বেশ কয়েক বছর নিজের চারণভূমিতেই কাটিয়ে দিয়েছে। ‘এই পর্যন্ত বলে তোমার বাবা চুপ করে গিয়েছিলেন। সত্যি বলতে কি, এতে আমি খুশিই হয়েছিলাম। উনি যতক্ষণ কথা বলছিলেন, আমি কিছুতেই মনোঃসংযোগ করতে পারছিলাম না। ‘আচ্ছা, এই ধরনের অদ্ভুত কাহিনী তুমি কখনও শুনেছো- একটা ঘোড়া জন্মের মুহূর্ত থেকে নিহতের রক্ত তার দেহে বহন করে চলেছে? অথচ তোমার বাবা এমন রহস্যময় ভঙ্গিতে কথাগুলো বলছিলেন, আমি অবাক হয়ে গিয়েছিলাম। আচ্ছা, এই ধরনের আজগুবি গল্প প্রসঙ্গে তুমি কখনও বাবার সঙ্গে তর্ক করোনি?’

বাড়ির দিকে সে যখন ফিরে চলেছে তখন প্রায় রাত্রি শেষ। সহকর্মীর কথাগুলো তখনও তার মাথার মধ্যে ঘুরপাক খাচ্ছে। তাহলে ব্যাখ্যাটা এই। এই বৈরি মনোভাবই বাবা ত্রিশ বছর ধরে তাঁর মনের মধ্যে পোষণ করে আসছেন! এই জন্যই তিনি তাকে ভয় পান এবং একই কারণে তিনি চাইতেন তাঁর ছেলে যদি ঘোড়া হতো তাহলে সোজা তার মাথায় গুলি করে মারতেন! কৈফিয়তটা তাহলে এই-ই! তার দেহ আর পিঠের ডানদিক বরাবর আঁকাবাঁকা গাঢ় একটা বাদামি রঙের রেখা, ঠিক যে ধরনের চিহ্ন বার্কের দেহে দেখা গিয়েছিল, নিহতের সেই রক্তরেখাই তাহলে এই উপ-কাহিনির সঙ্গে সম্পৃক্ত? 

যে চিহ্নটাকে ছুঁয়ে তার বান্ধবী একদিন বলেছিল- ‘এত বড় জড়ুল আমি কখনও দেখিনি; কিন্তু এটাকে এমন লাল, ঠিক জমাট-বাঁধা রক্তের মতো দেখতে কেন?’ এটা কি তাহলে সেই চিহ্ন! বার্ক যেমন তার মাকে দেখার আগে, মার মাথার খুলিটা গুঁড়িয়ে তাকে নদীতে ফেলে দেওয়ার অনেক বছর আগে থেকেই মার রক্ত নিজের দেহে ধারণ করেছিল, সেও ঠিক তেমনি ভাবে জন্মমুহূর্ত থেকে নিহতের রক্তচিহ্ন নিজের দেহে ধারণ করছে বলেই হতভাগ্য বাবা তাকে ভয় পান! এই মর্মান্তিক যন্ত্রণাই উনি আজ ত্রিশ বছর ধরে ভোগ করে আসছেন আর সেই জন্যই উনি চান ওঁর ছেলে যদি ঘোড়া হতো, তাহলে সোজা তার মাথায় গুলি করতেন। অর্থহীন, নির্বোধ কোনো কাহিনীও মানুষের জীবনকে নষ্ট করে দিতে পারে, ঠিক যে নির্বুদ্ধিতার মধ্যে তার বাবা জাবনের ত্রিশটা বছর কাটিয়ে দিয়েছেন। বাবা আর ছেলের মাঝখানে গড়ে উঠেছে আতঙ্কের অদৃশ্য একটা প্রাচীর; কিন্তু কেন? যেহেতু আবু মহম্মদ ওই গাঢ় বাদামী দাগটার পেছনে যে জটিল রহস্য তার নিতান্ত সরল বৈজ্ঞানিক ব্যাখ্যাটা জানতো না। যেহেতু তার বাবা...

সহসা রাস্তার মাঝখানেই থমকে দাঁড়িয়ে সে ভাবতে লাগলো- ‘পৌরাণিক এই ধারণাটাকে বাবা নস্যাৎই করে দিয়েছিলেন, উনি চেয়েছিলেন এই কুসংস্কারের বিরোধিতাই করতে; কিন্তু তাতে কী লাভ হলো? আবু মহম্মদই তো জয়ী হলো, উনি গেলেন হেরে, আর তার জন্মে তাঁকে চরম মূল্যও দিতে হলো।’ 

‘লালচে-বাদামি একটা দাগ। এর কারণটা কি আমরা জানি, কিন্তু আমরা জানি না এটা ঠিক একই জায়গাতে কেন, কেন আর অন্য কোনো জায়গায় নয়! এটা তো অন্য কোনো ধরনের চিহ্নও হতে পারে? আবু মহম্মদ বলেছে আরোহী হিসেবে আমার মা ছিলেন যেমন চমৎকার, তেমনি ঘোড়াদের সম্পর্কে ওঁর অভিজ্ঞতাও ছিল অপরিসীম। তাহলে বার্ক কেন ওঁকে খুন করতে গেল? কেন মাথার খুলিটা গুঁড়িয়ে ওঁকে নদীতে ফেলে দিতে গেল? ওঁকে খুন করতে গিয়ে বার্কের এই ধরনের প্রবণতাই বা কাজ করল কেন? ‘এই যুদ্ধে আবু মহম্মদই জয়ী হলো, হেরে গেলেন আমার হতভাগ্য বাবা। সেই সঙ্গে হারিয়ে গেল ওঁর যৌবন। এখন এই নিঃসঙ্গ বৃদ্ধকে চালিয়ে যেতে হচ্ছে অন্য আর এক যুদ্ধ- এবার আমার সঙ্গে। আমাদের দুজনের মধ্যে কে জয়ী হবে?’ সামান্য একটু এগিয়ে গিয়ে সে আবার থমকে গেল। দুর্বিষহ একটা ভাবনা তার মাথার মধ্যে কেবলই বিস্ফোরণ ঘটিয়ে চলেছে। ‘নিতান্তই স্বেচ্ছায় আমি কৌতূহলী প্রগলভ বন্ধুটিকে অস্ত্রোপচারের অনুমতি দিয়েছিলাম, যেহেতু মুমূর্ষু রোগীটির অসমীচীন উক্তিতে আমি সত্যিই মর্মাহত হয়েছিলাম; কিন্তু কর্তব্যের প্রতি অবহেলার ফলে ও তো বৃদ্ধকে মেরেও ফেলতে পারতো, কেননা ওর মন তখন পড়েছিল কাহিনিটার দিকে। যদি তাই হয়, তাহলে ওঁর মৃত্যুর জন্য আমিই দায়ী। ক্রোধে উনি যতই উন্মাদ হয়ে উঠুন না কেন, আমি অনায়াসে ওঁর অস্ত্রোপচারের কাজ সুসম্পন্ন করতে পারতাম। নির্বোধ, এ তুই কি করলি!’

কয়েক মুহূর্তের জন্য সে নিশ্চল দাঁড়িয়ে রইল, তারপরেই ছুটতে শুরু করলো হাসপাতালের দিকে। পুব আকাশে সূর্য তখন সবে উঁকি দিচ্ছে আর শিশির ভেজা পাথরে তার ত্রস্ত পায়ের শব্দ মনে হচ্ছে ঠিক যেন ধাবন্ত কোনো ঘোড়ার খুরের প্রতিধ্বনি।

ভাষান্তর : রজতশুভ্র রায় চৌধুরী

সাম্প্রতিক দেশকাল ইউটিউব চ্যানেল সাবস্ক্রাইব করুন

মন্তব্য করুন

Epaper

সাপ্তাহিক সাম্প্রতিক দেশকাল ই-পেপার পড়তে ক্লিক করুন

Logo

ঠিকানা: ১০/২২ ইকবাল রোড, ব্লক এ, মোহাম্মদপুর, ঢাকা-১২০৭

© 2024 Shampratik Deshkal All Rights Reserved. Design & Developed By Root Soft Bangladesh

// //