মুক্তিযুদ্ধের গল্প

মুছে না ফেলা দুপুর

সেই দুপুরের কথা হয়তো আমাদের পরিবারের কারো মনে নেই অথবা আছে, না থাকার মতো কোনো রকমে ঝাপসা আকারে; কিন্তু আমার মনে আছে, পুরো দাগ কেটে মনে আছে। কারণ মানুষের স্মৃতি সময়ের সঙ্গে সঙ্গে ম্লান হতে থাকলেও, কিছু বিষয় মন থেকে একবারে মুছে ফেলা যায় না। দুপুর বা সন্ধ্যার বিশেষত্ব কী? বিশেষত্ব হলো সেই দুপুর বা সন্ধ্যায় ঘটে যাওয়া বিশেষ কিছু ঘটনা যা মনে দাগ কেটে ফেলে। সেই দুপুরের ঘটনাটা শুধু বিশেষ নয় ঐতিহাসিকও বটে! তাই আমার সেই দুপুরকে ঐতিহাসিক দুপুরও বলা যেতে পারে। 

তখন গরম পড়ে গেছে। এখন বুঝি সেটা ছিল এপ্রিল মাসের কোনো এক দুপুর। তারিখ মনে নেই। কারণ তখন আমার বয়স তিন বছরের সামান্য বেশি। আমি আর বাবা একসঙ্গে খাওয়া-দাওয়া শেষ করে বিছানায় শুয়ে আছি। একটা হালকা ভাত ঘুমের আয়োজন আরকি! আমাদের মাথা দক্ষিণ দিকে আর পা উত্তর দিকে। বাবা টুকটাক উপদেশ দিচ্ছেন- সেসব কিছু ঠিকঠাক মনে নেই। তবে দুর্জয় দুপুরে রোদে ঘোরাঘুরি করা ঠিক নয়। খেলাধুলা বিকেলে করা উচিত, এই টাইপের কিছু। আমিও বেশ মনোযোগ দিয়ে শুনছি। হঠাৎ আমাদের পায়ের দিকের জানালায় একজন কালো উঁচু-লম্বা টাইপের মানুষ এসে জানালার শিকে মাথা ঠেকিয়ে চরম উদ্বিগ্নতার সঙ্গে ডাকল- বড়কা, চালনায় তো গুলি শুরু হয়ে গেছে। আগুন জ্বলছে। যুদ্ধ মনে হয় শুরু হয়ে গেছে! নদীর এপার থেকে সব দেখা যাচ্ছে। আমরা এখন কী করব- বড়কা? বাবা একলাফে উঠে পড়লেন এবং তাকে সঙ্গে নিয়ে বাইরে দুপুরের রোদের মধ্যে চলে গেলেন। ওই লোকটা কী বলল- আমি কিছুই বুঝে উঠতে পারলাম না। আরও বুঝতে পারলাম না বাবা আমাকে এতক্ষণ যে আলাপগুলো করলেন, তার উপদেশ এবং বিশ্রাম নেওয়ার তাড়না সেগুলো এক মুহূর্তের মধ্যে ভুলে গিয়ে নিজেই কেন রোদের মধ্যে নেমে পড়লেন!

আমাদের বাড়ির সামান্য দূরে একটা কুলুকুলু টাইপের নদী। এই নদীতে বড় কোনো ঢেউ ওঠে না, যেমনটা পশুর কিংবা শিবসা নদীতে ওঠে। তবে জোয়ার-ভাটা খেলা করে। আমাদের দারুণ একটা যৌথ পরিবার, যেখানে বাবার সিদ্ধান্তের খুব গুরুত্ব। ঠিক সন্ধ্যার দিকে আমরা বাড়ির সবাই মালপত্র যা সঙ্গে নেওয়া গেল, সেগুলো নিয়ে ওই নদীর কিনারার কাছাকাছি একটা নারিকেল গাছের তলায় এসে জড়ো হলাম। বাবা সদ্য বাচ্চা দেওয়া ছাগলটি ছানাসহ নিয়ে আসলেন সেই নদীর ঘাটে। বয়স্করা বলতে লাগল, আমাদের জীবন সংকটের মধ্যে তুমি আবার এদের নিয়ে কী করবে? বাবা উত্তর দিলেন- ওদের রেখে গেলে রাজাকাররা মা ছাগলটাকে খেয়ে ফেলবে তখন বাচ্চাদের কী হবে! বাবা বন্দুক কাঁধে নিয়ে এদিক ওদিক হাঁটাহাঁটি করছেন। আমি অনেকবার বাবার সঙ্গে শিকারে গিয়েছি। আমার একমাত্র কাজ নৌকায় বসে থাকা আর পাখি মারলে সেগুলোর পালকে মমতায় হাত বুলানো। জীবিত পাখি পেলে মাঝে মাঝে আমার ইচ্ছে হতো আমি পাখি পুষবো; কিন্তু সেই ইচ্ছেটা আমার পূরণ হয়নি কোনোদিনই। তাই শিকার করতে যাবার মধ্যে তো গুপ্ত আগ্রহ আছেই। আমি মাকে জিজ্ঞাসা করেই ফেললাম- মা, বাবা কী শিকার করতে যাবে এখন? মা খুব সিরিয়াসলি বললেন আমাকে- চুপ কর, বাবা! আমরা দেশ ছেড়ে চলে যাচ্ছি। দেশ কী আর ছেড়ে যাওয়াই-বা কী আমি তেমন কিছু বুঝে উঠতে পারিনি। তবে এটুকু বুঝলাম বাবা শিকারে যাবে না।

আমরা পরদিন সকালে একটা বড় ছই দেওয়া নৌকায় উঠলাম। কিছু খাবার-দাবার সঙ্গে আছে। বেশ কিছু দূর যাবার পর নৌকার মধ্যে শোরগোল শুরু হলো। পাকিস্তানি গানবোট আসছে। আমরা দ্রুত নৌকা থেকে নেমে কাছাকাছি একটা বাড়িতে আশ্রয় নিলাম। দেখে বোঝা যাচ্ছে বাড়িটা পরিত্যক্ত। ঘর পড়ে আছে, ধানের গোলা পড়ে আছে, পুকুর পড়ে আছে। গোলার পাশে একটা ডালিম গাছ। লাল ডালিম ধরে আছে। হঠাৎ গুলির আওয়াজ। মারাত্মক গোলাগুলি শুরু হলো। বাবা সবাইকে শুয়ে পড়তে বললেন। সবাই মাটির ওপর শুয়ে পড়লো। আমিও। বৃষ্টির মতো গুলি আমাদের মাথার ওপর দিয়ে যেতে লাগল। গুলির আঘাতে অ্যালুমিনিয়ামের তৈজসপত্র চরম শব্দে ফেটে পড়ল। পুরোবাড়িটা একেবারে লণ্ডভণ্ড করে দিতে থাকল। বাবা বারবার সতর্ক করে দিচ্ছেন- কেউ মাথা তুলবে না। অমান্য করলাম আমি। কারণ আমার চোখ ওই ডালিম গাছের দিকে। আমার পাশে চরম আতঙ্কে শুয়ে থাকা মাকে বললাম- মা ডালিম খাবো। মা খুব বিরক্ত হয়েছিলেন। কারণ ওই বাক্যটা নেওয়ার মতো মানসিক অবস্থা তার ছিল না। জীবন মৃত্যুর খাদের কিনারায় দাঁড়িয়ে হয়তোবা কারও সেই অবস্থাটা থাকে না। এরপর গুলি থামল। আরও কিছুক্ষণ পর আমরা আবার নৌকায় এসে উঠলাম। বেশ কিছুক্ষণ নৌকা চলার পর কারা যেন খবর দিল বাবার ছোট কাকাকে, মানে আমার ছোট দাদুকে পাকসেনারা বেয়োনেট চার্জ করেছে। নৌকার মধ্যে কান্নার রোল বয়ে গেল। কোনো এক পুকুরের পানিতে ফেলে তাকে আরও অনেকের সঙ্গে বেয়োনেট দিয়ে খোঁচানো হয়েছে। দাদু মরার মতো পড়ে ছিল। পরে ওরা মৃত মনে করে চলে গেছে। এরপর তার ছেলেরা তাকে খুঁজে নিয়ে ভারতের পথে রওনা দেয়। এসব কথা আমরা পরে শুনেছি।

বাবা নৌকার সামনে বসে দূরবীন দিয়ে বহুদূর পর্যন্ত দেখে মাঝিকে নির্দেশনা দিচ্ছেন- সামনে দুটি নৌকা আছে, লঞ্চ আছে ইত্যাদি। আমরা সবাই ভেতরে আছি। নৌকার ঠিক মাঝ বরাবর পানিফেলা ডেরায় রাখা হয়েছে ছাগলগুলো। হঠাৎ বাবা সন্ত্রস্ত হয়ে নৌকার ভেতরে ঢুকলেন। সবাইকে সতর্ক করে দিলেন, যে পাকিস্তানি গানবোট আসছে। এখান থেকে তীর অনেক দূরে। তীরে নামা যাবে না। সবাই চুপ করে থাকবে। টুঁ শব্দটি করবে না। যাদের ছোট বাচ্চা আছে তাদের সাবধানে রাখো। এর আগে বাবা মাঝিকে পরামর্শ দিয়ে এসেছেন যে কী করতে হবে, কীভাবে সামলাতে হবে বিষয়টা। তিনজন মাঝির দু’জনকে সামনে দাঁড় করিয়েছেন এবং একজন হালে। সামনের একজনের মুখে চাপ দাড়ি আছে। বয়স চল্লিশের কাছাকাছি। অল্প কিছুক্ষণের মধ্যে গানবোট আমাদের নৌকার কাছে আসল এবং নৌকার সঙ্গে ছোট একটা ধাক্কা খেল। মাকে খুব ভীত দেখাচ্ছিল। প্রকৃতপক্ষে সবার বুক শুকিয়ে কাঠ- অবস্থা। শুধু ঈশ্বরকে ডাকছিল সবাই। তখন রৌদ্রোজ্জ্বল দুপুর। একজন পাকিস্তানি সেনা জিজ্ঞাসা করল- ক্যা হ্যায় ইসকো অন্দর? দাড়িওয়ালা মাঝিটি বাংলায় কায়দা করে বলল- এর মধ্যে লুট করা মাল আছে। লুট করে আমরা বাড়ি নিয়ে যাচ্ছি। ঠিক তখন ছাগলটি ডেকে উঠল-ম্যা ম্যা। আর তখন কে একজন গানবোট থেকে বলল- ‘ছোড় দে উসকো। লুটেরা মাল হ্যায়।’ আমাদের নৌকায় ওরা উঠতে যেয়েও উঠল না। আমাদের নৌকা ছেড়ে দিল। মাঝি বাবার কাছে দূরবীনটা উপহার হিসাবে চাইল। বাবা রাজি হলেন। কারণ তারা আমাদের এতগুলো জীবন বাঁচিয়েছে। সামান্য দূরবীন। এরপর কিছুদূরে যেয়ে একজন মাঝি বাম তীরে নেমে পড়ল। 

আর বাবাকে বলল, সেই একই পারে বড়দল নামক জায়গায় সবাইকে গোসল করে খাওয়া দাওয়া শেষ করতে। বাবা সম্মত হলেন। কারণ সবার অবস্থা খুবই খারাপ। বড়দল যেয়ে আমাদের নৌকা কিছুক্ষণ দেরি করতেই চারপাশ থেকে অনেকগুলো রাজাকারদের নৌকা ঘিরে ফেলল। বাবা অবস্থা দেখে বন্দুক নদীতে ফেলে দিলেন। এরপর আমাদের তারা সর্বস্বান্ত করে ফেলল। বাবাকে ঘিরে ধরে রাখল। তাকে গুলি করে মেরে ফেলবে। এই নদী তীরবর্তী সালিশে মা সাহসী ভূমিকা রেখেছিলেন। এরপরও তার অনেক অনুরোধের পর বাবাকে মুক্তি দিল। দূরবীন আর ছাগলগুলো মাঝি নিয়ে নিল। বাবা মাঝির এই বিশ্বাসঘাতকতার কারবারটা অনেক পরে এসে বুঝতে পেরেছিলেন। আমরা ভারতে এসে আশ্রয় পেলাম। অনেক দুপুর আমাদের মাথার ওপর দিয়ে চলে গেল।

দেশ স্বাধীন হলে আমরা বাড়ি ফিরে এলাম। উঠোনটা বড় বড় ঘাসে ভরে গেছে। বারান্দায় ছেঁড়া বইয়ের পৃষ্ঠা মেঝের ওপর আটকে গেছে এমনভাবে যে মেঝের ওপর দাগ পড়ে গেছে। দরজা জানালা সব খুলে নিয়ে গেছে। আসবাবপত্র সব নিয়ে গেছে। আমাদের দুধের গাভী ফিরিয়ে দিয়ে গেছে এক মুসলমান। সে লুটেরাদের কাছ থেকে জোর করে ছিনিয়ে নিয়েছিল। আমাদের আসার খবর পেয়ে সে বাড়িতে দিয়ে গেছে। গরুটা উঠোনে মনোযোগ দিয়ে ঘাস খাচ্ছে। আমাদের রাইস মিল ও স’মিলের মিস্ত্রি মতি কাকা এসেছেন আমাদের খবর নিতে যে আমরা কেমন আছি? আর মিলের খবরই-বা কী? এসেই সে মিলঘরে গিয়ে দেখল কিচ্ছু নেই। মতি কাকার চোখ ফেটে পানি পড়ছে। অথচ বাবা অনেকটা স্বাভাবিক। এটা বাবার প্রত্যাশিত ছিল। তাই হয়তো তার চোখে পানি নেই অথবা তার অন্তর ভিজে যাচ্ছে। আমরা দেখতে পাচ্ছি না। মতি কাকা আমাদের মিলের মাইনে করা কর্মচারি। কতটা মিলের প্রতি বা কাজের প্রতি মমতা থাকলে অন্যের লোহার কিছু যন্ত্রপাতির জন্য চোখের পানি ফেলা যায়, সেটা মতি কাকাকে দেখলে বোঝা যায়। হয়তো সেগুলো তার কাছে শুধু লোহা-লক্কড়ই নয় বরং তার চেয়ে বেশি কিছু। রেঞ্জ, প্লাস, হাতুড়ি দিয়ে তাদের জীবন্ত করে তোলা, বাক্সময় করে তোলা তার নিয়মিত কাজ ছিল। বড় হুইল ঘুরিয়ে মেশিন স্টার্ট দেওয়া এবং বিকট শব্দে মেশিনটি চালু হয়ে জীবন্ত করে তোলা- এসব যখন সে ঘটায় তখন সেটা আর জড়বস্তু থাকে কই? মতি কাকার মনটা চরম খারাপ হয়ে আছে। বাবা মতি কাকার মন ভালো করার জন্য উপায় খুঁজতে লাগলেন। মতি কাকার সুন্দর চেহারা। গায়ের রঙ উজ্জ্বল গৌর বর্ণ। চমৎকার পুরুষালি উচ্চতা। 

ক্লিন সেভ করত; কিন্তু আজ তার মুখে দাড়ি দেখে বাবা মজা করে প্রশ্ন করলেন- কী ব্যাপার মতি, তোমার তো পুরো চেহারা পাল্টে গেছে। আমি তো আগে খেয়ালই করিনি! যুদ্ধে তো তোমার বিরাট পরিবর্তন এসেছে? মতি কাকা হেসে বললেন- জ্বি বড়দা! যুদ্ধ আমাকে অনেক শিক্ষাও দিয়েছে। তাহলে শুনুন- আমাকে রাজাকাররা ধরে নিয়ে গিয়েছিল। আমি নাকি মুক্তিবাহিনীকে সাহায্য করি। খবরটা অবশ্য সত্যি। এরপর আমাকে মারার জন্য একটা খালের পাশে নিয়ে গেল। জিজ্ঞাসা করল তোর শেষ ইচ্ছা কী? আমি বললাম একটু পানি খাব। ওরা পানি খুঁজতে লাগল। আমি আল্লাহকে ডাকতে লাগলাম। হে আল্লাহ আমি কোনোদিন নামাজ-রোজা করিনি সত্য; কিন্তু তুমি আমাকে বাঁচাও, একটা সুযোগ দাও। আমি তোমার পথে থাকব, তোমাকে স্মরণ করব। ওরা কোথাও একটু পানি জোগাড় করতে পারল না। এদিকে সন্ধ্যা অতিক্রম করে রাত ঘনিয়ে আসছে। তখন যে মারার জন্য প্রস্তুত তার কী যেন মনে হলো। সে বলল- যা, তোকে তো পানি খাওয়াতে পারলাম না। যা তোকে ছেড়ে দিলাম। তবে পালিয়ে দূরে কোথাও চলে যা। এই তল্লাটে যেন তোকে আর না দেখি। আমি চলে এলাম। এরপর থেকে আমার এই বেশ এবং আমি পাঁচবার নামাজ পড়ি। আর আমার সব পাল্টে গেছে বড়দা। মতিকাকা বাবাকে উদ্দেশ্য করে বলল- বড়দা আল্লাহ বলেন, আর ঈশ্বর বলেন কেউ একজন আছেন। নইলে আমি লাশ হয়ে যেতাম সেদিন। আমি মৃত্যুর দরজা থেকে ফিরে এসেছি। ওই নরপশুদেরও মতি ফেরাতে পারেন আমার আল্লাহ।

বাবা বললেন- মতি, দুঃসময়ে ঈশ্বর আমাদের অনেক শিক্ষা দেন, সেগুলো পাথেয় করেই ভবিষ্যতে পথ চলতে হয়। আমরাও বেঁচে ফিরতে পারতাম না যদি আমি একটু মানবিকতার জন্য ছাগলগুলোকে নৌকায় না নিতাম।

আমি তাকিয়ে দেখলাম দু’জনের মুখে আনন্দের অনুভব খেলা করছে। আর তার সঙ্গে যুক্ত হয়েছে দুপুরের আলোকিত রোদের ঝলকানি।

সাম্প্রতিক দেশকাল ইউটিউব চ্যানেল সাবস্ক্রাইব করুন

মন্তব্য করুন

Epaper

সাপ্তাহিক সাম্প্রতিক দেশকাল ই-পেপার পড়তে ক্লিক করুন

Logo

ঠিকানা: ১০/২২ ইকবাল রোড, ব্লক এ, মোহাম্মদপুর, ঢাকা-১২০৭

© 2024 Shampratik Deshkal All Rights Reserved. Design & Developed By Root Soft Bangladesh

// //