মৃত্যুর পরে

আমি স্বপ্ন দেখলাম আমি রাস্তার ধারে মরে পড়ে আছি। 

আমি কোথায়, কীভাবে সেখানে গেলাম, কিংবা কীভাবে আমার মৃত্যু হলো, সবটাই একটা রহস্য। যাই হোক, আমি জানলাম আমার মৃত্যু হয়েছে, আমি সেখানে মৃত অবস্থায় পড়ে ছিলাম। 

আমি শুনতে পেলাম ম্যাগপাই পাখিরা চিৎকার করছে, তারপর কাকেরাও। মাটির ঝাঁঝালো গন্ধ বয়ে আনলেও বাতাস ছিল খুবই টাটকা- ভোর হতে আর দেরি নেই। আমি চোখ খুলবার চেষ্টা করলাম; কিন্তু চোখের পাতা নড়ল না, যেন তারা আমার কেউ নয়। তারপর আমি চেষ্টা করলাম আমার হাত দুটি তুলতে; কিন্তু সেক্ষেত্রেও তাই হলো। 

আমার হৃৎপিণ্ডে হঠাৎ ভয়ের ছুরিকাঘাত অনুভব করলাম। যখন আমি বেঁচেছিলাম তখন আমি এই ভেবে মজা পেতাম : যদি মানুষের মৃত্যু কেবল তার চালিকা-স্নায়ুর অচলাবস্থা হয়, আর তার সংবেদনশীলতা বজায় থাকে, তাহলে তা সম্পূর্ণ মৃত্যুর চেয়েও ভয়ংকর হবে। কে জানত যে আমার ভবিষ্যদ্বাণী সত্যি হয়ে উঠবে, অথবা এই সত্য যাচাই করতে হবে আমাকে নিজেকেই?

আমি পদধ্বনি শুনলাম : একজন কেউ পাশ দিয়ে যাচ্ছে। একটা এক-চাকার গাড়ি ঠেলে নিয়ে যাওয়া হল আমার মাথার পাশ দিয়ে। সম্ভবত গাড়িটা ভারী মালে বোঝাই ছিল, কারণ তার তীব্র ক্যাঁচক্যাঁচ শব্দ আমার স্নায়ুর ওপর দিয়ে ঘষটে গেল আর দাঁতে দাঁত লেগে গেল। তারপর মনে হল সবকিছুই রক্তলাল হয়ে গেছে : সূর্য নিশ্চয়ই উঠেছে। আমি নিশ্চয়ই পূর্বমুখে আছি। তাতে কিছু এসে যায় না। মানুষের বাজে বকবকানির শব্দ- কৌতূহলী দর্শকবৃন্দ। তারা একটা ধুলোর মেঘ ওড়াল, তা আমার নাকে হাঁচির উদ্রেক করল। আমি হাঁচতে পারলাম, যদিও চেষ্টা করলাম হাঁচতে। 

তারপর আরও আরও পায়ের শব্দ এগিয়ে এল, সবগুলোই থামল আমার পাশে, সেখানে আরও ফিসফিসানি শোনা গেল : ভিড় জমেছে দারুণ। তারা কী বলছে, হঠাৎ তা শোনার ইচ্ছে হল আমার; কিন্তু তখনই আমার মনে পড়ল আমি বেঁচে থাকতে প্রায়ই বলতাম যে, সমালোচনা নিয়ে ঝঞ্ঝাটের কোনো অর্থ নেই। বোধহয় আমি যা বলতাম তা আসলে বোঝাতে চাইনি : আমার মৃত্যুর সঙ্গে সঙ্গে আমি নিজের সঙ্গে প্রতারণা করলাম; কিন্তু যদিও আমি শুনতে লাগলাম, আমি কোনো সিদ্ধান্তে পৌঁছতে পারলাম না, কারণ মন্তব্যগুলো বোধহয় এর থেকে একটু বেশিই ছিল :

‘মরে গেছে, আহা?’

‘আহা হা!...’

‘ঠিক আছে!...’

‘হায় কপাল। ...কী খারাপ। ...’

একটাও পরিচিত কণ্ঠস্বর না শুনতে পেয়ে আমি আনন্দিত হয়েছিলাম। নতুবা কেউ কেউ আমার জন্য নিশ্চয় শোকপ্রকাশ করত, কেউ কেউ খুশি হত; কেউ কেউ নৈশাহারের পর গল্প করার বিষয় পেত। এইভাবে নষ্ট করত মূল্যবান সময়; আর এই সমস্তই ভীষণ খারাপ লাগত আমার। এখন কেউ আমাকে দেখেনি, তাই ক্ষতিগ্রস্ত হবে না কেউ। ভালো। মোটকথা, আমি কারও কোনো ক্ষতি করিনি। 

কিন্তু তখন একটা পিঁপড়ে, মনে হল, আমার পিঠ বেয়ে উঠতে শুরু করেছে আর আমার জ্বালা করছে। তখন থেকে আমি নড়াচড়া করতে পারিনি, এই অবস্থা থেকে মুক্তিরও কোনো উপায় ছিল না আমার। স্বাভাবিক অবস্থায়, একটু ঘুরে আমি সরে আসতে পারতাম। এখন আর একটা আমার ঊরুতেও উঠল! নির্বোধ কীট, তোরা কী করছিস!

ব্যাপারটা খারাপ থেকে আরও খারাপের দিকে গেল : একটা গুঞ্জনধ্বনি শোনা গেল আর একটা মাছি এসে বসল আমার চোয়ালের হাড়ের ওপর। এটা কয়েক পা এগোলো, তারপর নাকের ডগা চাটবার জন্য উড়ে এসে বসল। ‘মশাই, আমি বিখ্যাত কেউ নই’, খেদের সঙ্গে মনে মনে বললাম। ‘তোমার খোশগল্পের বিষয়ের জন্য আমাকে খুঁজে বের করার কোনো দরকার নেই। ...’ কিন্তু আমি কথা বলতে পারলাম না। মাছিটা তার আঠালো জিভ দিয়ে আমার ঠোঁট চাটবার জন্য নাকের ডগা থেকে নেমে এল। তার এই ভালোবাসার প্রকাশ দেখে আমি অবাক হলাম। বাকিদের কেউ কেউ জড়ো হল আমার ভুরুর ওপর। তাদের প্রত্যেকটি পা ফেলার সঙ্গে, আমার চুলের গোড়া পর্যন্ত কেঁপে উঠছিল। ব্যাপারটা অনেকদূর যাচ্ছিল- অনেক, অনেক দূর। 

হঠাৎ একটা দমকা হাওয়ায়, ওপর থেকে কিছু একটা আমাকে ঢেকে ফেলে আর তারা সবাই উড়ে পালায়। চলে যাবার সময় তাদের বলতে শুনলাম :

‘কী করুণ!...’

 ক্ষোভে ধিক্কারে আমি প্রায় মরেই গেলাম। 

মাটির ওপর ধপ্ করে কাঠের একটা কিছু পড়ার শব্দে ও মাটির কম্পনে আমি সম্বিৎ ফিরে পেলাম। আমার কপালে খড়ের মাদুরের দাড়ির স্পর্শ পেলাম। তারপর মাদুরটা সরিয়ে নেওয়া হলো, আর তৎক্ষণাৎ আমি আবার সূর্যের জ্বলন্ত উত্তাপ অনুভব করলাম। 

‘কেন সে এখানে মরবে?’ শুনতে পেলাম কেউ একজন বলছে। 

এত কাছ থেকে কণ্ঠস্বরটা শোনা গেল যে, বক্তা নিশ্চয়ই আমার ওপর ঝুঁকে আছে; কিন্তু কোথায় একজন মানুষের মরা উচিত? আমি ভাবতাম যে, এই পৃথিবীর বুকে একজন কোথায় বাস করবে সেটা যদিও সে ঠিক করতে পারে না, কিন্তু অন্তত যেখানে খুশি সে মরতে পারে। তারপর বুঝতে পারলাম ব্যাপারটা ঠিক তা নয়, আর প্রত্যেককে সন্তুষ্ট করা অত্যন্ত কঠিন কাজ। কি দুঃখের ব্যাপার, অনেক দিন আমার কাছে কোনো কলম ও কাগজ ছিল না; এমনকি যদি থাকতও, আমি লিখতে পারতাম না; আর যদি লিখতামও, একটি লেখাও আমি কোনোখানে প্রকাশ করতে পারতাম না। কাজেই ব্যাপারটা আমি ছেড়ে দিলাম। 

কয়েকজন লোক আমাকে বয়ে নিয়ে যাবার জন্য এসেছিল; কিন্তু আমি জানতাম না তারা কারা। তলোয়ারের খাপের শব্দ থেকে অনুমান করলাম পুলিশও এসেছে, এই জায়গায় আমার মরা উচিত হয়নি। অনেকবার আমাকে ঘোরানো হলো, মনে হলো আমাকে ওপরে তোলা হল এবং নিচে নামানো হলো আবার, তারপর শুনলাম একটা ঢাকনা বন্ধ হল এবং পেরেক মারা হলো; কিন্তু, কী আশ্চর্য, তারা কেবল দুটি পেরেক মারল। তারা কি এখানে কফিনে সবসময় দুটি পেরেকই মারে?

‘ছয় দেয়ালের মধ্যে ধাক্কা খাব আমি এবার’, আমি ভাবলাম। ‘আমাকে পেরেক মেরে ভেতরে রাখা হয়েছে। সত্যিই এটা শেষ। আমার সব শেষ। ...’

‘এখানে খুব গুমোট। ...’ আমি ভাবলাম। 

বস্তুত, আমি আগের চেয়ে এখন অনেক শান্ত, যদিও আমি আগে নিশ্চিত হতে পারিনি আমাকে কবর দেওয়া হয়েছে কি হয়নি। আমার হাতের পেছনে খড়ের মাদুরের স্পর্শ পেলাম এবং আমার মনে হলো এরকম আচ্ছাদন খুব একটা খারাপ নয়। আমার দুঃখ শুধু একটাই, আমি জানলাম না কে আমার জন্য স্বেচ্ছায় সব খরচ বহন করল; কিন্তু সেই জঘন্য লোকগুলি ধ্বংস হোক, যারা আমাকে কফিনে ঢুকিয়েছে! আমার পিঠের তলায় জামার একটা কোনো ভাঁজ হয়ে গেছে; কিন্তু তারা এটাকে টেনে সোজা করে দেয়নি, আর এখন এটা আমাকে অস্বস্তিকরভাবে খোঁচা দিচ্ছে। তোমরা কি ভাবো মৃত মানুষের কোনো অনুভূতি নেই, তাই তোমরা এমন অবহেলাভরে কাজ করছ? বাঃ!

মনে হয় আমার শরীর জীবিত অবস্থার থেকে অনেক ভারী হয়েছে, তাই ভাঁজ-করা জামার ওপরে এর চাপ স্বাভাবিক অবস্থার থেকে অনেক বেশি অস্বস্তি দিচ্ছে আমাকে। 

যাই হোক, আমার মনে হলো আমাকে সত্বর এতেই অভ্যস্ত হয়ে উঠতে হবে নতুবা সত্বর আমি পচতে আরম্ভ করব; সুতরাং এটা খুব কষ্টকর হবে না। এই সময়ে বরং আমার শান্তভাবে ধ্যান করাই ভালো। 

‘মশাই, কেমন আছেন? আপনি কি মৃত?’

কণ্ঠস্বরটি অত্যন্ত চেনা। আমি চোখ খুলে দেখলাম, পোকুচাই পুস্তকবিপণির বার্তাবাহক। আমি তাকে কুড়ি বছরেরও বেশি দেখিনি; কিন্তু সে দেখতে ঠিক আগের মতোই আছে। কফিনের ছ-টা দিক আমি ভালো করে দেখলাম : সত্যিই ওগুলো অত্যন্ত রুক্ষ আর অমসৃণ, করাত-কাটা প্রান্তগুলো এখনো খরখরে। 

‘মনে করার কিছু নেই, তাতে কিছু যায় আসে না,’ একটা গাঢ় নীল রঙের কাপড়ের বান্ডিল খুলে সে বলল। ‘এই যে আপনার জন্য কুং-ইয়াংয়ের বিবৃতির মিং বংশ সংস্করণ। এটা চিয়া চিং যুগের এবং কালো মার্জিন দেওয়া। এটা রাখুন। আর এটা। ...’

‘তুমি।’ আমি সবিস্ময়ে তার চোখের দিকে তাকালাম। আমি জিজ্ঞেস করলাম, ‘তুমি কি পাগল? দেখতে পাচ্ছ না আমি কী অবস্থায় ভেতরে রয়েছি? মি. বংশ সংস্করণগুলো নিয়ে আমার কী হবে?’

‘তাতে কিছু এসে যায় না। মনে করার কিছু নেই।’

বিরক্তিতে আমি তক্ষুণি চোখ বুঝলাম। কিছুক্ষণের জন্য সেখানে কোনো শব্দ ছিল না, সন্দেহ নেই সে চলে গেছে; কিন্তু তখন আমার মনে হল আর একটি পিঁপড়ে আমার গলা বেয়ে উঠতে শুরু করেছে এবং শেষ পর্যন্ত পৌঁছেছে আমার মুখে, সেখানে আমার চোখের চারদিকে ঘুরছে। 

মানুষ মৃত্যুর পরেও তার ধারণা বদলাতে পারে এটা আমি কোনোদিন কল্পনা করিনি। হঠাৎ একটা শক্তি বিধ্বস্ত করে দিল আমার হৃদয়ের শান্তি, আর আমার চোখের সামনে ফুটে উঠল অনেক স্বপ্ন। কিছু বন্ধু কামনা করেছিল আমার সুখ, কিছু শত্রু কামনা করেছিল আমার ধ্বংস। তবু আমি সুখীও হইনি, ধ্বংসও হইনি; কিন্তু আমি কোনো ভাবে কোনো গুহ্য কারণে বেঁচে আছি, কোনো পক্ষের কোনো আশাকে পূরণ না করে। এবং এখন আমি মরে গেছি নিঃশব্দে চলে-যাওয়া ছায়ার মতো, আমার শত্রুরও অগোচরে, বিনামূল্যে যে স্বল্প আনন্দটুকু দেওয়া যায় সেটুকুও তাদের দিতে না চেয়ে। ...

আমার বিজয়োল্লাসে আমি চিৎকার করে কাঁদতে চাইলাম। মৃত্যুর পরে এটাই হবে আমার প্রথম চোখের জল। 

যদিও শেষ পর্যন্ত চোখে জল এলো না। আমার চোখের সামনে একটা ঝলক দেখা গেল, আর আমি উঠে বসলাম। 

জুলাই ১২, ১৯২৫


সাম্প্রতিক দেশকাল ইউটিউব চ্যানেল সাবস্ক্রাইব করুন

মন্তব্য করুন

Epaper

সাপ্তাহিক সাম্প্রতিক দেশকাল ই-পেপার পড়তে ক্লিক করুন

Logo

ঠিকানা: ১০/২২ ইকবাল রোড, ব্লক এ, মোহাম্মদপুর, ঢাকা-১২০৭

© 2024 Shampratik Deshkal All Rights Reserved. Design & Developed By Root Soft Bangladesh

// //