লু শুনের দুইটি গল্প

চীনের সাহিত্যে লু শুন একটি উজ্জ্বলতম নাম। কবি, গল্পকার ও প্রাবন্ধিক লু শুনের আসল নাম- চৌ সু-রেন। চীনের সাংস্কৃতিক বিপ্লবে সক্রিয় ভূমিকা রেখেছিলেন তিনি, এ কারণে তাকে শ্রদ্ধার সঙ্গে স্মরণ করা হয়। ১৮৮১ সালে চীনের চেচিয়াং প্রদেশের শাও সিং শহরে লু’য়ের জন্ম। তিনি চীন দেশে বিদ্যালয়ের শিক্ষা সমাপ্ত করে তিনি চিকিৎসাবিদ্যা অধ্যয়নের জন্য জাপানে যান; কিন্তু চিকিৎসাবিদ্যার পাঠ অসমাপ্ত রেখে স্বদেশে প্রত্যাবর্তন করেন। চিকিৎসক হওয়ার পরিবর্তে তিনি গ্রহণ করেন শিক্ষকতার পেশা। আর সেই সঙ্গে সাহিত্যচর্চা তো ছিলই। এরই মধ্যে দিয়ে তিনি এ সময়ে বিপ্লবের কাজেও যুক্ত হন। ১৯১৭ সালে রুশ বিপ্লবের সাফল্যে দারুণ অনুপ্রাণিত হন। লু শুনের বহু লেখার মধ্যে বৈপ্লবিক চিন্তার প্রতিফলন রয়েছে। প্রগতিশীল চিন্তার এই লেখক আজীবন সর্বহারা মানুষের পক্ষে ছিলেন, ভাবতেন তাদের জন্য। ১৯৩৬ সালে তিনি মৃত্যুবরণ করেন। ‘য়ে ছাও’ ইংরেজিতে ‘ওয়াইল্ড গ্রাস’ বা ‘বুনো ঘাস’ গ্রন্থটি অত্যন্ত বিখ্যাত পৃথিবীর সাহিত্যপ্রেমীদের কাছে। এটি ভিন্ন ধরনের চর্চার একটি গদ্যকবিতার গ্রন্থ। কারও কারও কাছে এটি একটি গল্পগ্রন্থও। সেই ‘য়ে ছাও’ গ্রন্থের অন্তর্গত দুইটি লেখা এখানে প্রকাশ করা হলো। ভাষান্তর : সাবিহ ওয়ালী। 


একটি মতপ্রকাশ প্রসঙ্গে

স্বপ্ন দেখলাম আমি একটা প্রাথমিক স্কুলের ক্লাসঘরে বসে রচনা লেখার চেষ্টা করছি, আর শিক্ষককে জিজ্ঞেস করছি কেমন করে মত প্রকাশ করতে হয়। 

‘সেটা খুবই শক্ত!’ চশমার ওপর দিয়ে আমার দিকে আড়চোখে দেখে তিনি বললেন : তোমাকে তাহলে একটা গল্প বলি-

‘কোনো এক পরিবারে যখন এক পুত্রসন্তান জন্মাল, তখন খুশি হয়ে উঠল সমস্ত পরিবার। যখন তাঁর বয়স একমাস, তখন তারা অতিথিদের দেখাবার জন্য তাকে বাইরে নিয়ে গেল- অবশ্যই কিছু প্রশংসার প্রত্যাশা ছিল। 

একজন বলে : ‘এই ছেলে ধনী হবে।’ তখন তাকে ধন্যবাদ জানানো হয়। 

একজন বলে : ‘এই ছেলে একজন অফিসার হবে।’ বিনিময়ে তাকে ধন্যবাদ জানানো হয়। 

একজন বলে : ‘এই ছেলে মারা যাবে।’ তখন তাকে পরিবারের সকলে মিলে প্রচণ্ড প্রহার করে। 

‘ছেলেটি যে মারা যাবে এটা অনিবার্য, যেখানে ধনী হবে কিংবা বড় অফিসার হবে বলাটা মিথ্যা হতে পারে। তবু মিথ্যাটাই পুরস্কৃত হয়, অথচ অনিবার্যতার বিবৃতির জন্য জোটে প্রহার। তুমি। ...’ 

‘আমি মিথ্যা বলতে চাই না, স্যার, আবার আমি প্রহৃত হতেও চাই না। তাই আমার কী বলা উচিত?’

সেক্ষেত্রে বলবে : ‘আহা! ছেলেটিকে একবার দ্যাখো! আমার ভাষায়। ...ওঃ, আমার! ও হো! হে হে! হে, হে হে হে হে হে!’

জুলাই ৪, ১৯২৫



এইরকম এক যোদ্ধা

এইরকম এক যোদ্ধা হবে! যে মানুষটি মসৃণ বন্দুক-কাঁধে আফ্রিকার অধিবাসীর মতো অজ্ঞ নয়, কিংবা চীনের স্বয়ংক্রিয় পিস্তলধারী সবুজ-পতাকা-বাহিনীর মতো তালিকাবিহীন নয়। সে নির্ভর করে না ষাঁড়ের চামড়া কিংবা ছাঁট লোহার তৈরি বর্মের ওপর। আপন সত্তা ছাড়া তার আর কিছুই নেই, আর তার একমাত্র অস্ত্র হলো বর্বর মানুষের ব্যবহৃত বর্ষা। সে শূন্যতার পথে হেঁটে চলে, সেখানে যাদের সঙ্গেই তার দেখা হয় তারা একইভাবে মাথা নোয়ায় তার কাছে। সে জানে এই মাথা নোয়ানোটা শত্রুর ব্যবহৃত বিনা রক্তপাতে হত্যা করবার একটি অস্ত্র, যাতে বহু যোদ্ধার প্রাণ সংহার হয়েছে। কামানের গোলার মতো, এটা সাহসী মানুষের শক্তিকে নিষ্ক্রিয় করে দেয়।

তাদের মাথার ওপরে ঝোলে সবরকমের উপাধি চিহ্নিত সবরকমের পতাকা আর ব্যানার : লোকহিতৈষী, পণ্ডিত লেখক, প্রবীণ, নবীন, সমঝদার, ভদ্রলোক। ... নিচে সবরকমের সুন্দর নাম লেখা নানা ধরনের বিশিষ্ট আলখাল্লা: পাণ্ডিত্য, নৈতিকতা, জাতীয় সংস্কৃতি, জনমত যুক্তি, ন্যায় বিচার, প্রাচ্য সভ্যতা...। 

কিন্তু সে তার বর্শা তোলে। 

তারা যৌথভাবে এই পবিত্র প্রতিশ্রুতি দেয় যে, তাদের হৃৎপিণ্ড আছে তাদের বুকের মাঝখানে, অন্যান্য কুসংস্কারাচ্ছন্ন মানুষের তা নেই। তারা তাদের কোটের বুকের ভাঁজ দিয়ে প্রমাণ করতে চায় যে, তারা নিজে নিজে বিশ্বাস করে তাদের হৃৎপিণ্ড আছে বুকের মাঝখানেই। 

কিন্তু সে তার বর্শা তোলে। 

সে হাসে এবং তার বর্শা নিক্ষেপ করে একপাশে, আর তা হৃৎপিণ্ডের ভিতর দিয়ে তাদের বিদ্ধ করে। সবাই ছিন্নভিন্ন হয়ে যায় এবং মাটিতে পড়ে যায়, কেবল একটা বিশিষ্ট আলখাল্লা পড়ে থাকে, যার ভিতরে কিছুই নেই। শূন্যতা পলাতক এবং সে বিজয়ী। কারণ সে এখন এমন এক অপরাধীতে পরিণত হয়েছে যে লৌকহিতৈষী এবং বাকিদের হত্যা করেছে। 

কিন্তু সে তার বর্শা তোলে। 

সে দীর্ঘ পদক্ষেপে শূন্যতার ভেতর দিয়ে হেঁটে যায়, আর পুনর্বার দেখতে পায় একইরকম মাথা নোয়ানো, একই ব্যানার এবং বিশিষ্ট আলখাল্লা...। 

কিন্তু সে তার বর্শা তোলে। 

অবশেষে সে বৃদ্ধ হয় এবং বার্ধক্যের জন্য শূন্যতার পথেই সে মারা যায়। মোট কথা সে যোদ্ধা নয়, এবং শূন্যতাই বিজয়ী।

এইরকম একটি জায়গায় যুদ্ধের কান্না শোনা যায় না, কিন্তু সেখানে শান্তি থাকে। শান্তি...। 

কিন্তু সে তার বর্শা তোলে!

ডিসেম্বর ১৪, ১৯২৫

* চিং বংশের হান বাহিনীর সময়কালে, যারা ছিল দরিদ্র যোদ্ধা, সবুজ পতাকা দিয়ে তাদের পৃথক করা হতো। 

সাম্প্রতিক দেশকাল ইউটিউব চ্যানেল সাবস্ক্রাইব করুন

মন্তব্য করুন

Epaper

সাপ্তাহিক সাম্প্রতিক দেশকাল ই-পেপার পড়তে ক্লিক করুন

Logo

ঠিকানা: ১০/২২ ইকবাল রোড, ব্লক এ, মোহাম্মদপুর, ঢাকা-১২০৭

© 2024 Shampratik Deshkal All Rights Reserved. Design & Developed By Root Soft Bangladesh

// //