হাভাতে সময়

সকালজুড়ে বৃষ্টি। বৃষ্টির জল কাচের আয়নায় জীবন্ত কুয়াশা। কারও কারও চোখের আয়নায় কু-আশা। জলবিন্দু গড়িয়ে আরেক জলবিন্দু স্পর্শ করতেই বয়ে যায় স্রোতধারা। এই মেঘডাকা সকালেও নড়ে ওঠে দরজার কড়া। আছিয়া। গেরস্ত মহিলা। দুদিন অন্তর অন্তর করে দিয়ে যায় এ বাসার জমানো সব কাজ। ঘর ঝাড়–, ঘর মোছা, বাসন মাজা, কাপড় ধোয়া, আরও আনুষঙ্গিক। আছিয়া, অল্প বয়সেই গর্ভধারণ করে হয়েছে যে বিধবা। বাসায় মা আর এক সন্তান। উপার্জনের মানুষমাত্রই আছিয়া। তাই চার-পাঁচ বাড়ির রোজের কাজ দিয়ে পূর্ণ হয় সপ্তাহের তালিকা।

এই বৃষ্টির মধ্যেও বাসার কাজে আছিয়ার সঙ্গী তার ছোট্ট মেয়ে সুষমা। সমস্ত ঘরে পায়ের ছাপ এঁকে দিয়ে অস্থির এক দুরন্ত সময় পার করে সে। মায়ের সঙ্গে কখনো ঘর ঝাড়– দেয়, কখনো বারান্দায় গাছে পানি দেয়, কখনো বারান্দা থেকে চুপ করে তাকিয়ে থাকে দূরে, কখনো একা একাই কথা বলে বিড়বিড় স্বভাবে। মোটেও মনোযোগী নয় পড়াশোনায়। মাঝে মধ্যে বই নিয়ে এসে পড়তে বসে এ বাসার মালিকের বউ মেহেরের কাছে। মনে থাকে না তার কিছুই। আজকে যেই বধঃ শব্দের অর্থ খাওয়া কালকে সেটা হয়ে যায় যাওয়া, আজকে যেই নরৎফ শব্দের অর্থ পাখি কালকে সেটা হয়ে যায় ফাঁকি। এভাবে রুই হয়ে যায় দুই, তাল হয়ে যায় খাল আর তিন হয়ে যায় মিস্টার বিন! বানিয়ে বানিয়ে গল্প বলায় তার জুড়ি মেলা ভার। কল্পনা শক্তিও প্রখর। তার গল্প শুনতে শুনতে খেই হারিয়ে ফেলে মেহের। কখনো সিঁড়ি থেকে পড়ে গিয়ে মেঘের সঙ্গে ধাক্কা খায়, কখনো পুকুরে ঝাঁপ দিয়ে আগুনে পুড়ে যায়। তালগোল পাকানো গল্পে বানায় শাপলার সুতো, যেখানে ঝিলের শাপলায় ফুল হয়ে ফোটে কদম, মাছের পুকুরের তলদেশে বুক টান করে হেঁটে বেড়ায় কাঠ ঠোকরা আর তার ছানাপোনা!

আজকের মতো সব কাজ শেষ। বাসার খালাম্মার কাছ থেকে বিদায় নেয় আছিয়া। কে জানতো বৃষ্টির এই কুয়াশার সকালে তার জন্য অপেক্ষা করছে অসময়ের কু-আশা! গত এক মাসের টাকার সঙ্গে এক হাজার টাকা বাড়িয়ে দিয়ে করোনা শেষ হওয়ার আগ পর্যন্ত বাসায় আসতে মানা করে দিলেন খালাম্মা। আছিয়ার চোখে এসে বাসা বাঁধতে চায় সমস্ত কুয়াশা। চুপ করে টাকা নিয়ে গম্ভীর হয়ে ফিরে আসে তার বাসায়। হয়তো তার মাথার চারপাশে ভনভন করছে আগত দিনগুলোর বিবর্ণ সময়।

পাশের মহল্লাতেই করোনায় প্রথম মৃত্যু।
এক...তিন...ছয়...নয়...
বাড়তে থাকল আক্রান্তের সংখ্যা ও মৃত্যু।
লকডাউন হয় পাশের মহল্লা। এরপর সমস্ত পাড়া...জেলা...এখন পুরো দেশ। বলতে গেলে পুরো পৃথিবী!
হাজারো মৃত্যুর স্তূপে ভারী হয়ে উঠছে পৃথিবী।
জমানো টাকায় ঘুণ ধরে। ফুরোয় সময়।
বাড়ে ভাতের হাহাকার।
ঘরে থাকতে বলা হচ্ছে বার বার, যাদের ঘর নেই, যাদের নেই কোনো ঠিকানা কিংবা গন্তব্য?
ঘরছাড়া কিংবা ঘরওয়ালা দিশেহারা হাজারো মানুষ পথহারা হয়ে তাকিয়ে থাকে পথেই,
চোখ খোঁজে ত্রাণের সন্ধান!
না,
এ পাড়ায় ত্রাণ আসে না। শুনেছে তাদের কমিশনার এখন জেলখানায়, চাল চুরির দায়।
বাধ্য হয়েই আছিয়া হানা দেয় কাজের বাড়িতে। দরজায় কড়া নাড়তে সাহস পায় না সে । জানালায় এসে ডাক দেয় মিনমিনে গলায়

খালাম্মা খালাম্মা...
-কে?
আমি আছিয়া। কোনো কাম কাইজ করা লাগব খালাম্মা?
-না বাফু, করোনা শ্যাষ অউক, তারপরে আইয়্যো।

ভিক্ষুক না হয়েও আছিয়ার চোখেমুখে করুণ ভিক্ষুকের আকুতি। আর কোনো কথা বের হয় না তার মুখ থেকে। উচ্চস্বরে মনে মনে সমস্ত শক্তি দিয়ে বলে যায় তার সমস্ত অভিযোগের কথা-
‘সবাই খালি করোনার কতা কয়, খালি গরে থাকতে কয়, খামু, আইবো কইত্তে হেইডা কয় না! করোনা ছাড়াই গরে থাইক্যা না খাইয়্যা যে মইরা যামু হেইডা কেউ বুজে না’

আছিয়ার মাথায় ভনভন করে দুঃসময়ের মাছি
মলিন হয়ে তার দৃষ্টি চলে যায় সুষমার মুখে
সুষমার মুখের চারপাশজুড়ে এখন হাভাতে সময়।

সাম্প্রতিক দেশকাল ইউটিউব চ্যানেল সাবস্ক্রাইব করুন

মন্তব্য করুন

Epaper

সাপ্তাহিক সাম্প্রতিক দেশকাল ই-পেপার পড়তে ক্লিক করুন

Logo

ঠিকানা: ১০/২২ ইকবাল রোড, ব্লক এ, মোহাম্মদপুর, ঢাকা-১২০৭

© 2024 Shampratik Deshkal All Rights Reserved. Design & Developed By Root Soft Bangladesh

// //