একদিনের জীবন

এক
সপ্তাহের ছয় দিন তার ছুটি, অবসরের সময়, যখন তিনি যা খুশি তাই করেন। ঘুম থেকে ওঠেন দেরিতে, বিছানা থেকে না নেমে শুয়ে শুয়ে বেড টি খেতে খেতে নিউজপেপার পড়েন। পত্রিকা পড়া হয়ে গেলে তিনি বিছানা থেকে ওঠেন। বাথরুমে গিয়ে হাতমুখ ধুয়ে ডাইনিং টেবিলে এসে বসেন ধীরে সুস্থে নাস্তা খেতে। খেতে খেতেই পড়েন বাংলা কাগজ। কখনো ফোন এলে কথা বলেন; কিন্তু বেশিরভাগ সময়েই কোনো ফোন আসে না। এখন তাকে ফোন করার লোক কমে গেছে। মর্নিং ওয়াকও বন্ধ অনেক দিন হলো; যারা তার সঙ্গে হাঁটতেন, তাদের কেউ বিদেশে চলে গেছেন ছেলে-মেয়েদের সঙ্গে থাকতে। কেউ বিদায় নিয়েছেন এই পৃথিবী থেকে। এভাবে দিন দিন নিঃসঙ্গ হয়ে পড়েছেন তিনি। 

দুপুরে ভাত খাওয়ার পর ঘুম দেন। তার অনেক দিনের অভ্যাস। বিকেলে উঠে বাইরের ঘরে বসে চা নাস্তা খান। তার ছেলের স্ত্রীর ফোন আসে দিনে কয়েকবার। শিল্পী ঘন ঘন খবর নেয় তার খাওয়া-দাওয়া, ঘুম ঠিকমতো হচ্ছে কি-না জানার জন্য। এই ব্যাপারে প্রায় সব খবরের সূত্র হলো কাজের বুয়া সখিনার মা। রান্নবান্না থেকে বাসার সব কাজই সে করে তার স্ত্রী মারা যাওয়ার পর থেকে। বয়স হওয়ার পর তার স্ত্রী অবশ্য মাঝে-মাঝে রাঁধতেন, সব সময় না।

তার ছেলের বউ শিল্পী মাঝে-মাঝে বলে, খুব খারাপ লাগে বাবা।

কেন মা? কি হলো? খারাপ লাগে কেন?

এই যে আপনাকে একা রেখে আমরা মায়ের বাসায় থাকছি। এই জন্য।

শুনে তিনি বলেন, সে কি তোমরা সাধ করে থাকছ। থাকছ বাধ্য হয়ে। না হলে দাদু ভাইকে দেখত কে। তুমি তো একা সামাল দিতে পার না ওকে। ওর দাদি থাকলে তোমরা তো এই বাড়িতেই থাকতে। ওর দেখাশুনা দাদিই করত। তারপর দুঃখের সঙ্গে বললেন, উনি ওকে দেখেই যেতে পারল না। বলে একটা দীর্ঘশ্বাস ফেললেন।

বউমা শিল্পী বলে, ও আর একটু বড় হলে আমরা এ বাসায় চলে আসব বাবা। একসঙ্গে থাকব। ওর স্কুল এখান থেকে কাছে হবে।

তিনি বললেন, তোমরা যখন খুশি এসো মা। আমার কোনো অসুবিধে হচ্ছে না। তুমি দিনে কতবার ফোন করে খবরাখবর নিচ্ছ আমার। বাজার-টাজার সবই করে দিচ্ছ দু’জনে মিলে। আমাকে কিছুই করতে হয় না। কোনো কিছুর অভাব নেই আমার তোমাদের জন্য। শুধু খাই আর ঘুমাই। তারপর বললেন, হ্যাঁ দাদু ভাইকে একটু মিস করি বটে; কিন্তু সে তো এখন মোবাইলে আমার সঙ্গে কথা বলতে শুরু করেছে।

শিল্পী বলল, মোবাইলে গেমও খেলে সে। একবার হাতে পেলে ছাড়তেই চায় না।

শুনে তিনি অবাক হয়ে বলেন, বলো কি? এখুনি খেলা শুরু করেছে? কত বয়স হলো ওর? চার বছর না?

শিল্পী বলল, জ্বি। 

তিনি বললেন, মাশাল্লাহ। বেশ ইন্টেলিজেন্ট। তবে দেখো অভ্যাস যেন না হয়ে যায়। 

জ্বি, বাবা। সেটাই চিন্তার বিষয়।

এই ধরনের কথা হয় তার আর শিল্পীর মধ্যে মাঝে-মাঝেই। তার ছেলে একটু ইনট্রোভার্ট, কথা-বার্তা কম বলে, বিশেষ করে তার সঙ্গে। বেশিরভাগ সময় যা বলার স্ত্রীকে দিয়েই বলায়। তবে ছেলে কোনো বিষয়ে তার অবহেলা করে না। নিয়মিত খাবার-দাবারের ব্যবস্থা ছাড়াও সামান্য অসুখ হলেই হাসপাতালে নিয়ে যায় সঙ্গে সঙ্গে। তিনি আপত্তি করলেও শোনে না। 

হ্যাঁ, গল্পটা শুরু হয়েছিল তার ছুটির দিন নিয়ে। সপ্তাহে ছয় দিনই তার ছুটি। শুধু শুক্রবার ছাড়া। সেদিন ছেলে, বউমা আর নাতি নাস্তা খেয়েই চলে আসে এই বাড়ি। বসবার ঘরে ঢুকেই নাতি তার মাটির খেলনাগুলোর কাছে যায়। হলুদ রঙের গরু, ঘোড়া, বিড়াল, সাদা রঙের পাখি, হাঁস এসব দেখে বলে, আমি যখন ছোট ছিলাম এইসব নিয়ে খেলতাম। চার বছরের ছেলের মুখে এই কথা শুনে তিনি হাসেন। হাসি থামিয়ে বলেন, এখন তুমি কি নিয়ে খেল দাদা?

ব্যাটম্যান। স্পাইডারম্যান। ডাইনোসর। এসব। তারপর নিজের গায়ের জামার দিকে দেখিয়ে বলে, দেখছো না আমার টি শার্টে স্পাইডারম্যানের ছবি?

তিনি তাকিয়ে দেখেন নাতির টি শার্টের সামনে লাল-নীল রঙের নকশা করা একটা মানুষ লাফ দিয়ে দেয়ালে উঠছে। দেখে তিনি বলেন, এদের মধ্যে কার বেশি শক্তি। স্পাইডারম্যান না ব্যাটম্যান?

নাতি বলে, দু’জনেরই অনেক শক্তি। তারপর বলে, ক্যাপ্টেন আমেরিকারও। 

তিনি বলেন, সে আবার কে?

নাতি বলে, সুপারম্যানদের একজন। এরা সব বদমাশদের মার দেয়। যারা নটি তাদেরকে মেরে হাড় ভেঙে দেয়। কোনো বদমাশ ওদের সঙ্গে পারে না। ওরা সবাই সুপারম্যান।

এভাবে কথা বলতে বলতে নাতি মাটির তৈরি পুতুলগুলো এলোমেলো করে রাখে। তারপর সোফা থেকে ফোমগুলো নিয়ে কার্পেটের ওপর বসে একটার ওপর আরেকটা দিয়ে এস্কিমোদের মতো ঈগলু বানিয়ে ভেতরে ঢুকে ডাক দিয়ে ওঠে, কু কু।

তিনি বাইরে থেকে তার উত্তরে বলেন, কু।

এইভাবে তাদের দু’জনের খেলা চলে কিছুক্ষণ। শিল্পী রান্নাঘরে গিয়ে সখিনার মায়ের রান্না করা খাবার এনে টেবিলে সাজিয়ে দুপুরের দিকে সবাইকে খাবার জন্য ডাক দেয়। তখন সবাই টেবিলে এসে বসে। নাতি নিজের হাতে খায়, যখন সে আরও ছোট ছিল তখন থেকেই তার এই অভ্যাস। বলেছে নিজে নিজে খাব। সে খায় অর্ধেক, টেবিলে ছড়ায় বাকিটা। অর্ধেক খেয়ে চলে যায় মাটির খেলনাগুলোর সঙ্গে কথা বলতে। কখনো এসে বলে, গরুটার খিদে পেয়েছে। ভাত দিয়ে এলাম। 

খাওয়ার পর তারা বসবার ঘরেই বসে কথা বলেন। শিল্পী বলে, বাবা ঘুমোতে চাইলে একটু গড়িয়ে নেন বিছানায়। তারপর বিকেলে আমরা একসঙ্গে কফি খেতে যাব।

শুনে নাতি বলে, আজ আমরা নর্থ এন্ডে যাব। শুনে তিনি বলেন, সেখানে কেন? কাছেই কফি ওয়ার্ল্ড। আমরা তো সেখানেই যাই।

নাতি বলে, আজ আমরা নর্থ এন্ডে যাব। নতুন খুলেছে। সেখানে অনেক জায়গা। দৌড়ানো যায় ভেতরে। প্লে সেকশনও আছে।

বিকেলে তারা নর্থ এন্ডে যান। তিনি দেখলেন তার নাতি ঠিকই বলেছে। এটার ফ্লোর স্পেস অনেক বেশি। চেয়ার-টেবিলগুলো অনেক দূরে দূরে সাজিয়ে রাখা। বেশ এক ধরনের প্রাইভেসি রয়েছে।

সন্ধ্যার আগে তার ছেলে, পুত্রবধূ এবং নাতি চলে যায়। তার বেয়াইয়ের বাড়ি কাছেই, যেতে আধ ঘণ্টা লাগে। ছুটির দিনে আরও কম। তার শুক্রবারটা ইদানীং এইভাবেই শেষ হয়। সবাই চলে গেলে তিনি সখিনার মাকে হেসে বলেন, এটাই আমার কাজের দিন। বুঝলা সখিনার মা। সপ্তাহের বাকি দিনগুলো তো বেকার আমি। শুয়ে-বসে কাটাই। 

সখিনার মা বলে, আর কিছুদিন পর হগলে আইয়া পড়ব এই বাড়ি। বাবু আর একটু বড় হইয়া নিক। 

কে বলেছে তোমাকে? তিনি যেন খবরটা যাচাই করে নিতে চান।

ভাবী কইছে। আপনাকে এখানে একা রাইখা তার মনে বড় কষ্ট। 

তিনি গম্ভীর হয়ে বলেন, কষ্ট হবে কেন? ওরা তো খুব ভালোভাবেই আমার দেখাশুনা করছে। কোনো কিছুর অভাব বোধ করি না আমি। তুমি আজ পর্যন্ত কোনো দিন বলো নাই, এটা নাই, ওটা নাই।

সখিনার মা বলে, ক্যামনে কমু? কোনোকিছু শেষ হইবার আগেই বাজার কইরা দিয়া যায় দু’জনে মিলা। ভাবী ফোনে খবর নেয় রোজ সবকিছু ঠিক আছে কিনা জানার লাইগা।

তিনি বলেন, জানি; কিন্তু এখানে আসলে ওর নানির কি মন খারাপ করবে না? এতদিন কাছে রেখেছেন, মানুষ করছেন।

সখিনার মা বলে, মনে করবে ক্যান? দাদার বাড়ি মানেই তো হইল বাপের বাড়ি। আপনে এই বাড়ি ছেলেরে লিইখ্যা দিছেন না? তা হইলে এইডা তো বাবুরই বাড়ি।

তিনি বলেন, হ্যাঁ। ঠিক বলেছো সখিনার মা। এটা বাবুরই বাড়ি। আমি তার গেস্ট। তারপর একটু থেমে বলেন, সে এখানে থেকেই বড় হবে। তার বাবা-মা তার দেখাশুনা করবে। তুমিও দেখবা। আমি আর কয়দিন। সখিনার মা মৃদু ধমকের স্বরে বলেন, হেই কথা কইয়েন না। আল্লাহ আপনারে অনেক হায়াত দিব। 

দুই
শিল্পী বলে বাবা অনেক দিন আমরা যাই না আপনার কাছে। আপনি বাবুকে অনেক দিন দেখেননি। ওকে গাড়িতে করে নিয়ে আসি? আমরা গাড়িতেই বসে থাকব সবাই। মুখে মাস্ক থাকবে। আপনি দূর থেকে ওকে দেখবেন। হাত নাড়বেন।

শুনে তিনি বলেন, তাই কি হয় মা? তোমরা এসে দূর থেকে দেখা দিয়ে চলে যাবে? আমার কেমন লাগবে দেখে? বাবুও কি মানবে তোমাদের কথামতো গাড়িতে বসে থাকতে? 

শিল্পী বলে, তাহলে কি করা যায় বাবা? ক’মাস হয়ে গেল কোভিডের জন্য এই বাড়িতে আমাদের আসা বন্ধ। আপনিও বাবুকে দেখেন না, সেও আপনাকে দেখেন না।

তিনি বলেন, আরও কিছুদিন অপেক্ষা কর। অসুখটা এখনো খুব ছড়াচ্ছে। তেমন না হলে সরকার কি ছুটি বাড়িয়ে যায়? তারপর বলেন, আমাদের সামনাসামনি দেখা হয় না বটে; কিন্তু দাদুর সঙ্গে মোবাইলে তো রোজই কথা হয়। আজকাল ভিডিওতে চেহারাও দেখা যায়। আমি শুধু ওর স্কুলের পড়া নিয়ে ভাবছি। এতদিন বন্ধ। অভ্যাসটা ভুলে না যায়।

শিল্পী বলে, শুনছি অনলাইনে পড়াবে।

অনলাইনে? মানে কম্পিউটারে? বলো কি, এত ছোট ছেলে! এখনো কেজি ওয়ানেও ওঠেনি। ওকি ওইভাবে পড়তে পারবে? 

শিল্পী বলল, টিচাররা আলোচনা করছেন নিজেদের মধ্যে কি করা যায় সে সম্বন্ধে। এখনো কিছু ঠিক হয়নি। আমাদেরকে জানিয়েছেন যে একটা কিছু করবেন তারা যেন ছেলে-মেয়েরা লেখাপড়ার সঙ্গে টাচে থাকে। 

তিনি বলেন, বাবু কি বলে স্কুলের ব্যাপারে?

শিল্পী বলে, সে মহাখুশি। বলে বেড়ায় কোভিড অনেক দিন থাকবে।

শুনে প্রথমে তিনি হাসেন, তারপর গম্ভীর হয়ে যান। বলেন, সে না জেনেই বলেছে, দুষ্টুমি করে; কিন্তু আসলেই মা এই অসুখটা শিগগিরই যাবে বলে মনে হচ্ছে না। সাংঘাতিক রকমের অসুখ এটা। উন্নত দেশগুলো হিমশিম খেয়ে যাচ্ছে সামাল দিতে গিয়ে। কত লোক মারা যাচ্ছে প্রতিদিন। আমাদেরকে খুব সাবধানে থাকতে হবে। তোমরা বাইরে বের হইও না। 

তিন
রাতের বেলা বেশ জোরেসোরে জ্বর এলো তার। সেই সঙ্গে কাশি। এমন কাশি যে থামতেই চায় না। একসময় নাক দিয়ে পানিও পড়তে থাকল। তিনি উঠে পাঞ্জাবির পকেট থেকে রুমাল বের করলেন। নাকের পানি মুছলেন কয়েকবার; কিন্তু নাকের ভেতর থেকে যেন বর্ষার পানির স্রোত নেমে আসছে। দেখতে দেখতে তার রুমাল ভিজে গেল। তিনি বাথরুমে গিয়ে রুমালটা ধুইয়ে নিংড়ে নিলেন। ছোট একটা তোয়ালে ছিল টাওয়েলের হ্যান্ডলবারে। সেটা সঙ্গে করে নিয়ে বের হলেন তিনি কাশতে কাশতে। দরজা খুলে ডাইনিং টেবিলের পাশের সাইড টেবিলে রাখা ফ্ল্যাস্ক থেকে পানি ঢেলে খেলেন। শীতকালে তিনি সবসময় গরম পানি খান। এখন এপ্রিল মাস, শীত তেমন নেই; কিন্তু তিনি গরম পানি খাওয়া ছাড়েননি। রাতের বেলা ফ্ল্যাস্কে গরম পানি ভরে রাখে সখিনার মা। শিল্পী তাকে বলে দিয়েছে।

পানি খেয়ে তিনি বেডরুমে এসে কিছুক্ষণ টেলিভিশন দেখলেন। রিমোট টিপতেই সিএনএন এলো। প্রথমেই কোভিডের খবর। এ পর্যন্ত আমেরিকায় তিন লাখ মারা গেছে। প্রতিদিন চল্লিশ হাজার মারা যাচ্ছে। ইউরোপে ইতালির অবস্থা সবচেয়ে খারাপ। মৃত্যুর সংখ্যা বেড়েই চলেছে। নিউজ দেখতে দেখতে তার মাথা ঘুরতে থাকল। মনে হলো এসব খবর তার এখন না শোনাই ভালো। তিনি টিভি বন্ধ করে আলো নিভিয়ে শুইয়ে পড়লেন। তারপর তার আর ঘুম এলো না। একইভাবে কাশতে থাকলেন তিনি, নাক দিয়ে পানি পড়তে থাকল। কিছুক্ষণ পর তিনি টের পেলেন গলার ভেতর ব্যথা করতে শুরু করেছে। তিনি এতদিন কাগজ পড়ে আর টেলিভিশনের খবর শুনে জেনে গেছেন এই অসুখের সিম্পটমগুলো কী? তার মনে এখন আর কোনো সন্দেহ থাকল না। তিনি বুঝলেন তাকে কোভিড ধরেছে।

সকালে উঠলেন প্রচণ্ড জ্বর নিয়ে। কাশি হচ্ছে আগের মতো। গলার ব্যথা বেড়েছে। তিনি ডাইনিং টেবিলে বসে গরম পানি খেলেন। তারপর সখিনার মাকে বললেন, আমার কাশি হয়েছে। তুমি কাছে এসো না। মুখে কাপড় দিয়ে রাখ। বলে তিনি নিজেও মুখে মাস্ক পরলেন। 

সখিনার মা বলল, চা-নাস্তা দিমু এখন? 

তিনি একটু ভাবলেন। তারপর বললেন, দাও।

তার ব্যাংকের ম্যানেজার আতাহার খানের কিছুদিন আগে কোভিড হয়েছিল। তিনি বাড়িতে থেকেই চিকিৎসা করিয়ে সুস্থ হয়ে গেছেন। এক হাসপাতালের ডাক্তার তার খুব জানাশুনা। তার পরামর্শ অনুযায়ী তিনি বাড়িতে থেকে সবকিছু করেছেন। ঐভাবে চিকিৎসা করে তিনি ভালো হয়ে উঠেছেন। তবে তার বয়স পঞ্চাশের মতো হওয়ায় ফুসফুস আক্রান্ত হয়নি। তাকে অক্সিজেনও নিতে হয়নি। তবে ড্রাই কাশিতে খুব কষ্ট বলে জানিয়েছিলেন পরে। বলেছিলেন, কাশির সময় মনে হয় যেন হৃদপিন্ড ছিঁড়ে আসতে চাইছে।

তিনি আতাহার খানকে ফোন করলেন সকাল ১০টার পর, যখন ব্যাংক খোলে। তার কথা শুনেই আতাহার খান আঁতকে উঠলেন। উদ্বিগ্ন স্বরে বললেন, লক্ষণগুলো খারাপ। ক্ল্যাসিকাল সিম্পটমস অব কোভিড-১৯। শিগগির টেস্ট করতে হবে। 

হাসপাতালে যাব? তিনি জিজ্ঞাসা করলেন। 

আতাহার খান বললেন, না। হাসপাতালে যেতে হবে না। এক ডাক্তারের সঙ্গে আমার জানাশুনা হয়ে গেছে অসুখের সময়। খুব ভালো ডাক্তার। কোভিড অসুখ নিয়ে তার বেশ অভিজ্ঞতা হয়েছে। আমি তাকে ফোন করছি এখুনি। তিনি তার হাসপাতালের টেকনিশিয়ান পাঠিয়ে দেবে আপনার বাসায়। আমি অন্য একটি ল্যাবকেও বলব কোভিড টেস্ট করার জন্য আপনার বাড়িতে টেকনিশিয়ান পাঠাতে। 

তিনি জিজ্ঞাসা করলেন, দু’জন কেন? 

আতাহার খান বললেন, দুটি টেস্ট হলে ক্রস চেক করা যাবে। একটা ভুল করলে অন্যটায় ধরা পড়বে। তখন তৃতীয়বার টেস্ট করলে সঠিক রেজাল্ট পাওয়া যাবে। আপনি রেস্টে থাকুন। আমি ফোনে সব ঠিক করে নিচ্ছি। ওরা ঘণ্টাখানেকের মধ্যেই পৌঁছে যাবে আপনার বাসায়। ভেরি এফেসিয়েন্ট।

তিনি বিছানায় শুয়ে ভাবলেন, ছেলে আর বৌমাকে বলবেন কিনা? তারপর ঠিক করলেন তাদের না জানানোই ভালো। হয়তো তাকে সঙ্গে সঙ্গে দেখতে আসতে চাইবে। তার ছেলে হয়তো আগের মতো হাসপাতালেও নিয়ে যেতে চাইবে; কিন্তু এই রোগে কোনো আত্মীয়স্বজনকে রোগীর কাছে আসতে দেওয়া হচ্ছে না। এমনকি হাসপাতালে মারা যাওয়ার পর দাফনের সময়ও তাদের দূরে রাখা হয়। সাদা পোশাকে আপাদমস্তক ঢাকা মানুষগুলো লাশ অ্যাম্বুলেন্সে করে নিয়ে কবর দেয়। কোনো চিহ্ন বা নাম লিখে রাখে কিনা, তা তিনি বলতে পারেন না। এ বিষয়ে কিছু শোনেননি। তবে টেলিভিশনে বেশ কয়েকটা এমন দাফনের দৃশ্য দেখেছেন তিনি। আত্মীয়-স্বজন কেউ ধারে কাছে নেই। বাইরের লোক, হয়তো আঞ্জুমান মফিদুল ইসলামের কর্মচারী। তারা এসে হাসপাতাল থেকে লাশ নিয়ে যায় অ্যাম্বুলেন্সে করে। তারাই জানাজা পড়ে কয়েকজনে মিলে। তারপর কবরে রেখে মাটি চাপা দেয়। এই দৃশ্য দেখে তিনি শিউরে উঠেছেন। এখন সেটাই কি তার ভবিতব্য হতে যাচ্ছে? ভাবতেই তার হাত-পা ঠান্ডা হয়ে এল। এরপর তার মাথায় যে চিন্তা ঢুকল তা হলো রোগটা তাকে ধরল কেমন করে? লকডাউনের পর থেকে তিনি বাড়ির বাইরে যান না। বাইরের কেউ তার কাছে আসে না। ছেলে ড্রাইভারকে দিয়ে বাজার করে পাঠিয়ে দেয়। ড্রাইভার দরজার কাছে বাজার রেখে চলে যায়। হকার কাগজ দরজার বাইরে রাখে। তিনি সেগুলো ভেতরে আনেন গ্লাভস পরা হাতে। পড়া শেষ হলে কাগজ বাথরুমের এক কোণে রেখে স্প্রে করেন তিনি। সখিনার মাকে বলে রেখেছেন দশ দিনের আগে যেন না ধরে কোনো কাগজ। সংবাদপত্রে অবশ্য বড় করে বিজ্ঞাপন দিচ্ছে কাগজ পড়ায় কোনো ঝুঁকি নেই। বললেই তো আর হলো না, প্রমাণ কি? তাই সতর্কতা অবলম্বন না করে উপায় নেই। অনেকে ভয়ে কাগজ পড়া বন্ধ করে দিয়েছে। তিনিও তাই করবেন ভেবেছিলেন; কিন্তু পারেননি। সেই কবেকার অভ্যাস! কি করে হঠাৎ ছেড়ে দেন। 

তাহলে অসুখটা তাকে ধরল কেমন করে? কে ছিল তার ক্যারিয়ার? বাজারের ব্যাগ? তরিতরকারি, মাছ-মাংস? সবই তো সাবানের পানিতে ধুয়ে নেয় সখিনার মা। দেখা যাচ্ছে ভাইরাসটা খুব চতুর। খুবই গোপন তার গতিবিধি। কীভাবে যে সে তাকে ধরে ফেলেছে সেটা সেই জানে। 

মৃত্যুর জন্য ভয় নেই তার। এখন তার পঁচাত্তর বছর বয়স। তার বয়সের অনেকেই চলে গেছেন। তিনিও যাবার জন্য প্রস্তুত; কিন্তু তার খারাপ লাগে দাদা ভাইয়ের কথা ভেবে। সে তাকে খুব মিস করবে। বাবা-মাকে শুধু জিজ্ঞাস করবে, দাদা ভাই কোথায় গেল? বিদেশে? 

হ্যাঁ, এই কথাই তাকে বলবে তার বাবা-মা। বসবার ঘরে দেয়ালে তার স্ত্রীর ছবি দেখিয়ে যখন বলা হয়েছিল, এটা তোমার দাদি, সে দেখে বলেছিল, দাদি কোথায়? বাড়িতে নেই কেন? তিনি বলেছিলেন, তোমার দাদি বিদেশে।

বিদেশের কথাটার সঙ্গে তার নাতি এইভাবে বেশ পরিচিত হয়েছে। তার মামা, মামি, মামাতো বোনেরা কানাডায় থাকে। ছুটিতে ঢাকায় আসে কিছু দিনের জন্য। সে জানে তারা বিদেশে থাকে। বিদেশ মানে এমন জায়গা যেখান থেকে না এলে দেখা যায় না। সে কয়েকবার জিজ্ঞাসা করেছে, দাদি বিদেশ থেকে আসে না কেন? তিনি বলেছেন, আসবে। কাজ করে তো, ছুটি পেলেই আসবে।

তিনি চলে গেলে তার ছেলে আর পুত্রবধূও নাতির প্রশ্নের একই উত্তর দেবে। নাতি তা বিশ্বাসও করবে। এটা জেনেও তার মন খুব খারাপ হয়ে যায় নাতির জন্য। হাজার হোক তিনি তার খেলার সঙ্গী। তাকে নিয়ে সে অনেক মজা করে। বানিয়ে বানিয়ে গল্প বলে। তিনি মেসেঞ্জারে তার সঙ্গে কথা বলার সময় ভিডিওতে নানা রকমের সঙ সেজেছেন। সেসব দেখে বাবু খুব খুশি হয়েছে। তারপর সে নিজেও সেইভাবে সঙ সাজে আজকাল। খুব মজা হয় তাদের দু’জনের মধ্যে এইসব খেলা খেলে। এসব কি সে সঙ্গে সঙ্গে ভুলে যেতে পারবে? তার মনে পড়বে না তার কথা? মনে পড়লে মন খারাপ করবে না তার? 

একটু পর একজন টেকনিশিয়ান এলো। আপাদমস্তক সাদা ইউনিফর্মে ঢাকা। পার্সোনাল প্রটেকটিভ ইক্যুইপমেন্ট (পিপিই)। হাতে আইস বক্স, সোয়াব রাখার জন্য। ব্লাড স্যাম্পলও রাখবে তার ভেতর। খুব অল্প সময়েই সব কাজ শেষ করে চলে গেল সে। যাবার সময় বলল, চব্বিশ ঘণ্টা পর রিপোর্ট পাওয়া যাবে। সে যেতে না যেতেই দ্বিতীয় টেকনিশিয়ান এল। সেও একইভাবে সোয়াব নিল, ব্লাড স্যাম্পল নিল টিউবে। তবে আগেরজন শুধু নাকের সোয়াব নিয়েছিল। এখন যে এল সে মুখের ভেতর থেকেও সোয়াব নিল। নাকের সোয়াব নেওয়ার সময় যেমন সুরসুরি লেগেছিল গলার আলজিভের কাছে নেবার সময় তেমন মনে হলো না। ব্লাড নেবার সময়ও তিনি ব্যথাই পেলেন না, বলতে গেলে টেরই পেলেন না। দু’জনের ফি দু’রকম। একজন নিল ছয় হাজার টাকা। দ্বিতীয়জন নিল চার হাজার টাকা। তিনি এ নিয়ে কোনো প্রশ্ন করলেন না।

টেস্টের জন্য যা যা করার সেসব শেষ করে তিনি বেডরুমে ঢুকলেন। আলনায় তার কাপড় ঝুলেছে। পাজামা, পাঞ্জাবি, প্যান্ট-শার্ট। এগুলো কাউকে দিয়ে গেলে ভালো হতো। একজনকে না, কয়েকজনকে; কিন্তু তার জন্য যে সময় তা পাবেন না তিনি। ওয়ার্ডরোবে যেসব গরম কাপড় ঝুলছে সেগুলো এমনি থাকবে। কাল বিকেলে ঠিক এই সময় যখন পজেটিভ রিপোর্টগুলো এসে পৌঁছাবে তার আগে তিনি এই সংসারে যা কিছু তার অস্থাবর সম্পদ, কিছুই ভাগ-বাটোয়ারা করে যেতে পারবেন না। রিপোর্ট যে পজেটিভ আসবে সে বিষয়ে তার কোনো সন্দেহ নেই। সিম্পটমগুলো শরীরের ভেতর বুনো মোষের মতো দাপিয়ে বেড়াচ্ছে। হাত দিয়ে হাই ফিভার বোঝাই যায়, মাপার দরকার হয় না। কাশিটাও আছে, বরং বেড়েছে। গলার ব্যথা এখন এমন যে মনে হচ্ছে ভেতরে একটা ঘা হয়ে গেছে। না, কোনো সন্দেহ নেই, এসব ওই রোগটারই লক্ষণ যে হালাকু খানের মতো তচনচ করে বেড়াচ্ছে জনপদের পর জনপদ, এদেশে-বিদেশে। তিনি যত সামান্য মানুষই হন না কেন খড়কুটোর মতো পড়ে গেছেন সেই মত্ত হাতির পায়ের নিচে। কোভিড টেস্টের রিপোর্ট পেলেই তাকে হাসপাতালে যেতে হবে এ বিষয়ে কোনো সন্দেহ নেই। আতাহার খানই ডেকে দেবেন, তার সবকিছু জানা আছে। তাকে কিছুই করতে হবে না। শুধু হেঁটে গিয়ে অ্যাম্বুলেন্সে ওঠা। একটু আয়েশ বা নাটকীয় করতে চাইলে স্ট্রেচারে শুয়েও যেতে পারেন। নির্ভর করবে যাবার সময় তার শারীরিক অবস্থার ওপর। 

তিনি চেস্ট অব ড্রয়ারের উপরেরটা খুললেন। ভেতরে ব্যাংকের একটা চেক আর তিনটি এফডিআর ইনভেলাপে রাখা। তিনি ইনভেলাপের ওপর ছেলের উদ্দেশে লিখলেন, এর ভেতরে চেক বই আছে। আমাদের দু’জনের জয়েন্ট অ্যাকাউন্ট। তুমি একাই সই করে ব্যালেন্স যা টাকা আছে তা তুলতে পারবে। এফডিআর তিনটি ম্যাচিউর হবে এক, দুই আর তিন বছর পর যথাক্রমে। ছেলে নমিনী। তিনি লিখলেন: নমিনী হিসেবে তুমি এই টাকা তুলতে পারবে। তবে ব্যাংক তোমার ওয়ারিশানের প্রমাণ চাইবে। এলাকার ওয়ার্ড অফিসে গিয়ে ফর্ম পূরণ করলে সাকসেশন সার্টিফিকেট দেবে। এর জন্য কিছু খরচ হবে। ওরাই বলবে কত টাকা লাগবে ।

এরপর তিনি ডাইনিং টেবিলে বসে চিঠি লিখলেন তিনটি। প্রথমটা তার ছেলেকে। ছেলেকে জানালেন তাকে হাসপাতালে যেতে হচ্ছে। সেখান থেকে না ফেরার সম্ভাবনাই বেশি, কেননা এই অসুখে তার বয়সের কেউ হাসপাতালে গেলে ফেরে না। তিনি লিখলেন: সেটা মনে করে তোমার কাছ থেকে এই চিঠিতেই বিদায় নিচ্ছি। হাসপাতালে তুমি দেখতে যেতে পারবে না। কাউকে যেতে দেওয়া হয় না। শেষকৃত্যেও তুমি বা অন্য কোনো আত্মীয়-স্বজন থাকতে পারবে না। শুধু তোমাদের জানিয়ে রাখবে। এর জন্য মন খারাপ করবে না। আমি তো একা নই। এভাবে অনেকেই চলে যাচ্ছে। দাফন কোথায় করবে তা জেনে নিও, যেন পরে সব নরমাল হয়ে গেলে গিয়ে দেখতে পার। 

তিনি লিখছেন আর তার চোখ দিয়ে দরদর করে পানি পড়ছে। চোখের পানিতে তার বুকের দিকে শার্ট ভিজে গেল। সেদিকে তার খেয়াল নেই। ছেলেকে লিখছেন: কাপড়-চোপরগুলো অভাবী লোকজনকে দিয়ে দেবে। সখিনার মাকে একটা ভালো অঙ্কের টাকা দেবে। সে আমাদের পরিবারের জন্য অনেক করেছে। তার কথা মনে রাখবে। বাকি টাকা তুমি নিজে ইচ্ছেমতো খরচ করবে। তবে বাবুর জন্য যতটা পার টাকা জমিয়ে রাখলে ভালো হবে। আমার বৃদ্ধ বয়সে তোমরা দু’জন যেভাবে দেখাশুনা করেছ তার জন্য আমি তোমাদেরকে সব সময় দোয়া করেছি। এই ফ্ল্যাটটা তোমার এসে ব্যবহার না করা পর্যন্ত আর কাউকে থাকতে দিও না। অন্য লোক এসে ভাংচুর করবে, জঞ্জালে ভরে ফেলবে। তোমরা এখন যেমন সপ্তাহে একদিন শুক্রবারে এ বাড়িতে আস, আমি চলে গেলে সেভাবেই তোমরা এসে খাবে দাবে। তারপর তোমার শ্বশুর বাড়ি চলে যাবে। সখিনার মা হয়তো তার গ্রামের বাড়ি যেতে চাইবে। কেননা সেখানেই তার আত্মীয়-স্বজন রয়েছে। তোমরা এ বাড়িতে এসে উঠলে তাকে নিয়ে আসতে পার যদি সে আসতে চায়। মনে হয় আসতে চাইবে। অনেক দিন থেকে এ বাড়িতে আছে। সে এ পরিবারেরই একজন হয়ে গেছে। এই তো, আর কি লিখব। সবই তো বলা হলো। শেষ দেখা হলো না বলে দুঃখ করো না। সবই ললাট লিখন। কেউ তা এড়াতে পারে না। শুধু একটা কথা জেনো, আমি তোমার মা মারা যাওয়ার পর একদিনও কষ্টে থাকিনি, তোমার আর বৌ মা যত্ন এবং সেবার জন্য। তোমরা আমার দেখাশুনায় কোনো ত্রুটি রাখনি। বড় সুখে ছিলাম, তোমার মায়ের মৃত্যুশোক ভুলে গিয়েছিলাম খুব তাড়াতাড়ি। তোমাদের জন্যই।

আমার দাদা ভাইকে যত্ন নিয়ে মানুষ কর। যত ব্যস্ত থাক, ওকে তোমার টাইম দিও। ছুটির দিনে বাইরে বেড়াতে নিয়ে যেও। আমি এসব তোমার ক্ষেত্রে খুব বেশি করিনি। এর জন্য আমি সব সময় অনুশোচনা করেছি। 

পুত্রবধূ শিল্পীকে তিনি একইভাবে চিঠি লিখে তার বর্তমান অবস্থা ব্যাখ্যা করে জানালেন। শেষ দেখা হল না বলে দুঃখ করলেন। তাকে দেখাশুনার জন্য ধন্যবাদ দিয়ে বললেন তাকে তিনি নিজের মেয়ের মতোই দেখেছেন। তার সেবা-যত্নে তিনি মুগ্ধ। তার জন্য তার দোয়া থাকবে। 

নাতিকে লিখলেন: দাদা ভাই আমি বিদেশ যাচ্ছি। কবে আসব ঠিক নেই। তুমি পুরনো ভিডিওগুলো মাঝে-মাঝে দেখতে পার। স্কুলে ভালো করে পড়াশুনা করবে। যেন সবাই ভালো বলে। 

চিঠি তিনটি ইনভেলাপে ভরে ডাইনিং টেবিলে রেখে দিলেন বই চাপা দিয়ে। রাতের বেলা শুধু সখিনার মা যখন সুপ নিয়ে এল তিনি তাকে বললেন, আগামীকাল হয়তো আমাকে হাসপাতালে যেতে হবে। তোমাকে কি করতে হবে সে কথা তোমার ভাইয়া তোমাকে জানাবে। তবে তুমি ভুল করেও আমার বেডরুমে ঢুকবে না। আমার ব্যবহার করা কিছু ছোবে না। সাবান দিয়ে ঘনঘন হাত ধোবে। মুখ কাপড় দিয়ে বেঁধে রাখবে যখন অন্য কারও সাথে কথা বলবে। রাতে তার ঘুম এলো না। একটু কমলেও কাশি চলে গেল না। তবে নাকের ভেতর থেকে পানি আসা কমে এলো। গলা ব্যথাটা থাকল আগের মতোই। 

সকালে বউমা ফোন করলে তিনি যতটা স্বাভাবিক হতে পারেন সেইভাবে তার সঙ্গে কথা বললেন। নাতির সঙ্গেও মজা করলেন, যেমন তিনি সব সময় করে থাকেন। ছেলে অফিসে চলে গেছে, তাই তার সঙ্গে কথা বলা হয় না। তিনি বৌ মাকে বললেন, সন্ধ্যায় সখিনার মাকে যেন সে ফোন করে। সে হয়তো কিছু বলবে তাকে। কথা বলে তিনি ফোন রেখে দিলেন। ছেলেকে কিংবা বৌ মাকে আজকেও তার অসুখ সম্বন্ধে কিছু বললেন না। বললে তারা ছুটে আসবে। এই ছোয়াচে রোগ তখন তাদেরকে ধরে বসবে। তার চেয়ে তিনি হাসপাতালে যাওয়ার আগে ফোন করে তাদের জানাবেন তিনি কোথায় যাচ্ছেন? কেন যাচ্ছেন। শুধু এইটুকু। তারা কান্নাকাটি করবে, কিন্তু বুঝতে পারবে কেন তিনি এমনভাবে আগে থেকে কিছু না বলে চলে যাচ্ছেন? সারাদিন বেডরুমেই শুয়ে থাকলেন তিনি। দুপুরে খেলেন খুব সামান্য। সখিনার মাকে বললেন, টেবিলে খাবার রেখে সরে যেতে। তার খাওয়া শেষ হলে সে যেন গতকালের মতো সবকিছু সাবানের পানি ভরা বালতিতে রেখে ধুইয়ে নেয়। নিজেও হাতও যেন সেই একইভাবে ধুইয়ে নেয় সাবানের পানিতে। 

তারপর একটা ব্যাগে কয়েকটা কাপড় রাখলেন তিনি। দু’জোড়া পাজামা-পাঞ্জাবি। গেঞ্চী, তোয়ালে, সাবান, টুথপেস্ট এইসব। সেভিং কিট পড়ে থাকল। হাসপাতালে গেলে সেভ করার দরকার পড়বে না। সন্ধ্যা যত এগিয়ে এল তার ভেতরটা কেঁপে কেঁপে উঠল উত্তেজনায়। তিনি বুঝলেন তার শ্বাস পড়ছে ভারী হয়ে আর ঘন ঘন। একটু যেন হাঁপাচ্ছেন তিনি। একি অসুখটার জন্য, না টেনশনে? তিনি ঠিক বুঝে উঠতে পারলেন। একটু পর তিনি ঘামতে থাকলেন। ভেতরের গেঞ্জিটা ভিজে জবজবে হয়ে গেল। এও কি উত্তেজনায়? তিনি কিছু বুঝে উঠতে পারলেন না। সখিনার মাকে বললেন, এক কাপ চা তৈরি করে টেবিলে রেখে দিতে। তিনি নিজে নিয়ে নেবেন। 

সন্ধ্যার পর তিনি বেডরুমের দরজায় তালা ঝুলিয়ে দিলেন। ব্যাগটা এনে রাখলেন বসসার ঘরে। তারপর সোফায় বসে মোবাইলটা ধরে রাখলেন ডান হাতের মুঠোয়। 

আটটার দিকে ফোন এলো। আতাহার খানের গলা। তিনি বললেন, কনগ্রাচুলেশন্স। 

কনগ্রাচুলেশন্স কেন? তিনি খুব অবাক হলেন। এই দুঃসময়ে কিসের জন কনগ্রাচুলেশন্স? তিনি থতমতো খেয়ে জিজ্ঞাসা করলেন কনগ্রাচুলেশন্স কেন ভাই? ঠাট্টা করছেন?

আরে ছিঃ ছিঃ! কি যে বলেন স্যার? আপনি মুরুব্বি মানুষ । আমাদের এতদিনের সম্পর্ক। এই সময়ে কি ঠাট্টা করা যায়? তারপর একটু থেমে আতাহার খান বললেন, কনগ্রাচুলেশন্স জানালাম এই জন্য যে, আপনার দুটি টেস্টের রিপোর্টই নেগেটিভ। আপনার কোভিড হয়নি। মনে হচ্ছে ইনফ্লুয়েঞ্জা হয়েছে, এই সিজনে যা হয়। দুটি সিম্পটম প্রায় এক কিনা তাই আমি ভয় পেয়ে গিয়েছিলাম। তাড়াতাড়ি টেস্ট করতে বলেছিলাম। ভালোই হল। এখন নিশ্চিত হওয়া গেল। তবু সাবধানে থাকতে হবে। 

তিনি কিছুক্ষণ চুপ করে বসে থাকলেন। বুঝতে চাইলেন তিনি জেগে আছেন না ঘুমিয়ে? যেন জানতে চাইলেন এতক্ষণ যা শুনলেন তা কি সত্যি? একবার মনে হলো তার কাছে এখন কোনো ফোন আসেনি। আতাহার খান তাকে ফোন করেননি। সব তার কল্পনা। ফোন আসবে, একটু পর। দুঃসংবাদটা দেওয়া হবে তাকে তখন। সেই ফোন আসছে। চব্বিশ ঘণ্টা যার অপেক্ষা করছেন তিনি সেই খবরটা অমোঘ সত্যের মতো এসে পৌঁছাবে তার কাছে। নাহ, তিনি বড় বেশি কল্পনা করছেন। আতাহার খান তাকে ফোন করেন নি। কোনো ফোনই আসেনি তার কাছে। তিনি তার হাতের মুঠোয় রাখা মোবাইলটার দিকে তাকিয়ে থাকলেন।

ওপাশ থেকে আতাহার খান বললেন, কি হলো স্যার? চুপ করে আছেন যে? সব ঠিক তো? এত খুশির একটা খবর দিলাম, এখন হেসে কথা বলুন। তারপর তিনি বললেন, রিপোর্টগুলো নিয়ে আমি নিজেই আসব আপনার বাসায় আমার অফিস বন্ধ হলে। আমাদের অফিস তো সন্ধ্যার পরও অনেকক্ষণ খোলা থাকে। কাজ শেষ হলে আমি আসব। নিজের হাতে রিপোর্টগুলো দেব। আমি খুব খুশি হয়েছি স্যার। 

আতাহার খান এলেন। হাতে ফুলে তোড়া। লাল, নীল, হলুদ। নানা রংয়ের ওপর ঘরের বাতির আলো পড়ে ঝলমল করে উঠল। তিনি দেখলেন ঘরের মধ্যে আকাশের রংধনু উঠেছে। আতাহার খান এসেই তার যে করমর্দন করলেন হাত ছাড়তেই চান না। বোঝা গেল তিনিও খুব রিলিভড ফিল করছেন। একটু যেন ইমোশনালও হয়ে গেছেন। সোফায় বসে ঘরের চারদিক দেখে তিনি অবাক হয়ে বললেন, একি আপনি দেখি রেডি হয়ে বসে আছেন? ব্যাগের ভেতর কাপড়-চোপড় রাখা। বাইরে যাওয়ার পোশাক পরে বসে আছেন। ব্যাপার কি স্যার? কোথাও যাচ্ছেন নাকি?

তিনি হেসে বললেন, যাচ্ছিলাম। এখন মনে হচ্ছে যেতে হবে না। তারপর আস্তে আস্তে বললেন হাসপাতালে। 

আতাহার খান অবাক হয়ে বললেন, হাসপাতালে? কেন? 

তিনি বললেন, আমার তো সেখানেই যাওয়ার কথা ছিল। দিন দেখি রিপোর্ট দুটি। রিপোর্ট হাতে নিয়ে বললেন, কি খাবেন? চা না কফি?

আতাহার খান বললেন, একটা হলেই হলো। এই মুহূর্তটা যে কোনো ভাবেই সেলিব্রেট করা যায়। এক গ্লাস পানি খেয়েও।

তিনি সখিনার মাকে ডেকে বললেন, দু’কাপ কফি দাও আর বাটার বিস্কিট। এখানে এসেই দিয়ে যাও। টেবিলে রাখতে হবে না। তবে মুখে কাপড়টা রেখ। অভ্যাসটা থাক। একটু পর সাবানের পানি দিয়ে হাত ধোবে। মনে আছে তো। 

শুনে আতাহার খান হাসলেন। বললেন, দেখতে পাচ্ছি আপনি বাসায় কোয়ারেন্টাইন করে রেখেছেন।

তিনি বললেন, আই ওয়াজ রেডি ফর দি ওয়ার্স্ট। আমি তো ধরেই নিয়েছি ওই অসুখটাই হয়েছে আমার । তাই সবকিছু গুছিয়ে নিয়েছিলাম। 

আতাহার খান কফি খেয়ে চলে গেলেন। তিনি সোফায় বসে বসে রিপোর্ট দুটি কয়েকবার পড়লেন। টেকনিক্যাল কথা-বার্তা লেখা আছে, শুধু নেগেটিভ কথাটা পরিষ্কার পড়তে পারা যায়। পড়তে পড়তে তার মুখে হাসি ফুটে উঠল। তিনি রিপোর্ট দুটি হাতে নিয়ে উঠে ডাইনিং টেবিলের কাছে গেলেন। সেখানে রিপোর্ট দুটি রেখে বই চাপা দিয়ে রাখা চিঠি তিনটি হাতে তুলে নিলেন। তারপর ঘরের জানালার কাছে গিয়ে চিঠিগুলো একটা একটা করে টুকরো করে ছিঁড়ে বাইরে ছড়িয়ে দিলেন। তিনি জানালা দিয়ে বাইরে কিছু ফেলেন না; কিন্তু আজ ফেললেন। 

রাত ৯ টায় আতাহার খান ফোন করলেন। তাকে উদ্বিগ্ন শোনাল। তিনি বললেন, কি হলো আবার, এইমাত্র তো গেলেন? ফোন কেন? 

আতাহার খান বললেন, ঘাবড়াবেন না। ব্যাড নিউজ। ল্যাব আপনাকে যে দুটি রিপোর্ট দিয়েছে সেগুলো সোয়াব টেস্টের। 

তিনি বললেন, হ্যাঁ তাইতো লেখা আছে। নেগেটিভ লিখা আছে দুটিতেই। 

আতাহার খান বললেন, আপনার ব্ল্যাড রিপোর্ট নিয়ে এসেছে আমার অ্যাসিস্ট্যান্ট। সেখানে লেখা...।

কি লেখা? তিনি বেশ স্বাভাবিক স্বরে জিজ্ঞাসা করলেন।

আতাহার খান একটু থেমে থেমে বললেন, সেখানে লেখা, আপনার শরীরে কোভিডের কিছু সিম্পটম রয়েছে। শুনে তিনি কিছুক্ষণ চুপ করে থাকলেন। তারপর বললেন, তাহলে সোয়াব রিপোর্ট দুটিতে নেগেটিভ রেজাল্ট কীভাবে এলো? একটা হলে না হয় বোঝা যেত ভুল হয়েছে; কিন্তু দুটি রিপোর্টই নেগেটিভ। 

আতাহার খান বললেন, জ্বি। ঠিক তাই; কিন্তু ব্ল্যাড রিপোর্ট বলছে অন্য কথা। মাইল্ড ফর্মে হলেও আপনার ভেতরে কোভিডের ভাইরাস রয়ে গেছে। আপনাকে আজ রাতেই হাসপাতালে যেতে হবে। আমি কিছুক্ষণের মধ্যেই অ্যাম্বুলেন্স পাঠাচ্ছি। আপনি বললে আমি নিজেও আসতে পারি। 

তিনি দৃঢ় কণ্ঠে বললেন, থ্যাঙ্ক ইউ। আতাহার খান সাহেব আমি গত চব্বিশ ঘণ্টা হাসপাতালে যাবার জন্য প্রস্তুত ছিলাম। আপনি তো এসে নিজের চোখেই দেখেছেন। ব্যাগে কাপড়-চোপড় গোছানো। আমি নিজেও কাপড় পরে তৈরি; কিন্তু যখন বললেন, দুটো রিপোর্টই নেগেটিভ তারপর আমার রিপ্লেক্স চেইঞ্জ হয়ে গেছে। আমি নিজেকে এখন কোভিড রোগী ভাবতে পারছি না। এই মুহূর্তে, আজ রাতে হাসপাতালে যাবার জন্য আমি একেবারেই প্রস্তুত না। বুঝতে পারছেন আতাহার সাহেব।

আতাহার খান বললেন, কিন্তু ব্ল্যাড রিপোর্ট ইজ মোর রিলায়াবেল দ্যান সোয়াব রিপোর্ট। ডাক্তার তাই বলছেন। নেগেটিভ রিপোর্টের ওপর নির্ভর করে আপনি সিদ্ধান্ত নিতে যাবেন না।

তিনি আগের মতোই দৃঢ় কণ্ঠে বললেন, হতে পারে মোর রিলায়াবেল; কিন্তু আমি আজ রাতে হাসপাতালে যেতে পারব না। আমি প্রস্তুত নই। বুঝতে পারছেন আতাহার সাহেব। আমার রিফ্লেক্স চেইঞ্জ হয়ে গেছে। এটা সাইকোলজিক্যাল ব্যাপার হবে হয়তো। যাই হোক, আমি এখুনি নিজের মন অন্যভাবে প্রস্তুত করতে পারব না। 

আতাহার খান বললেন, তাহলে কী করবেন? 

তিনি আস্তে আস্তে বললেন, আই উইল ওয়েট। আমি অপেক্ষা করব। আজ রাতটা দেখব। সকাল বেলা দেখব। দুপুরও হতে পারে। চব্বিশ ঘণ্টা পর আমি বুঝতে পারব আমার কি করা উচিত। আমার শরীর, আমার মন দুটিই আমাকে বলে দেবে কি করতে হবে। 

সাম্প্রতিক দেশকাল ইউটিউব চ্যানেল সাবস্ক্রাইব করুন

মন্তব্য করুন

Epaper

সাপ্তাহিক সাম্প্রতিক দেশকাল ই-পেপার পড়তে ক্লিক করুন

Logo

ঠিকানা: ১০/২২ ইকবাল রোড, ব্লক এ, মোহাম্মদপুর, ঢাকা-১২০৭

© 2024 Shampratik Deshkal All Rights Reserved. Design & Developed By Root Soft Bangladesh

// //