সন্ধ্যাবেলায় বিহান কথা

এক
মাঝে মাঝেই ছায়াটা শাহেদের ডানে-বাঁয়ে এক্কাদুক্কা খেলছে। এই আছে, আবার এই নাই। সিনা টানটান করে হাঁটছে শাহেদ; কিন্তু কলিজায় কাঁপন ঠিকই হচ্ছে।

শাওন মাসের বৃষ্টিধোয়া নির্মল আকাশ। তবে এখনো মেঘেদের আনাগোনা যথেষ্ট আছে। তাই ভরা জ্যোৎস্নার আলো যেমন ঠিকরে পড়ার কথা তেমন পড়ছে না। এই আলো-আঁধারিতেই পা চালিয়ে হাঁটছে শাহেদ! আজ বেশ দেরি হয়ে গেছে। ওসব কাজ ছেড়ে দেওয়ার পর খুব সাবধানে চলাফেরা করে। মানুষজন ছাড়া কোথাও পথ বয় না। যে কাজেই যায় দিনে দিনে বাড়িতে ফিরে আসে; কিন্তু আজ আর উপায় ছিল না। দুই পাল্লা কালিজিরা চাল নিয়া হাটে গেল। এত সুন্দর সাগু দানার মতো চাল, কিন্তু দাম ওঠে না। তাই শেষবেলা পর্যন্ত অপেক্ষা করতে হলো। শেষমেশ কপাল ধরা দিল। যা পেয়েছে তাতে সন্তুষ্ট শাহেদ। এরপর সদাইপাতি, এটা-সেটা করতে করতে মেলা-ই দেরি হয়ে গেল।

শুরুতে চেনা, অচেনা চার-পাঁচজন ছিল; কিন্তু এইপথ ওইপথে যেতে যেতে শাহেদ একা হয়ে গেল। এরপর থেকেই ছায়াটা মাঝে মাঝে দেখছে। কখনো কাছে আসে, আবার দূরে সরে যায়। কখনো মনে হয় দুটি ছায়া। অবশ্য মনের ভুলও হতে পারে। শাহেদ বলে- আল্লাহ, তুমিই ভরসা!

পিছনের দিনগুলোর অনুশোচনায় শাহেদ এখনো ভোগে। উপায়হীন হয়ে করেছে; কিন্তু ফিরে আসাটা যে এত কঠিন, প্রতি মুহূর্তের শঙ্কা, এটা আগে এতটা বুঝতে পারেনি।

শাহেদ মনে মনে বলে- মাবুদ, না বুইঝা খারাপ কামে জড়াইছি। শাস্তি তো কম হয় নাই। যখন যেখানে ছিলাম, সবই আমার কাছে জেলখানা ছিল। একটা দিনও শান্তিতে কাটাই নাই। এহন আমারে মাফ দেও, ক্ষমা দেও। আইজের দিনটাও বাঁচায়ে দেও। আল্লার কালাম পড়তে পড়তে শাহেদের গলা শুকায়ে কাঁটা কাঁটা লাগতেছে।

কেডা যাও গো, কেডা...! আমি কুড়ের পশ্চিম বাড়ির সুরুজ। বারে যাও!

ওহ্... ওই মিয়া, তোমার ঠ্যাং তো ম্যালা চলে। লাগুর পাই, আবার পাই না! আধা মাইল দৌড়াইয়া ধরলাম। এই ধরি ধরি, এই লাগুর পাই না। একমনে যাইতাছ, তো যাইতাছই!

শাহেদ বুকে থুথু দিয়া চাইপা ধরল! সুরুজ ভাই, কিছু মনে কইরেন না। বেশি দেরি হইলে বাচ্চা-কাচ্চাগুলান ঘুমাইয়া পড়বো। তাই তড়স্ত হাঁটতাছি। হাটবারে কয়ডা টেকার উলুফা কিনি। পোলাডা এইডা-ওইডা খাইতে চায়। আর দিন তো কিছু পায় না।

হ, কথা ঠিকই কইছো!

দুই
শাহেদের ঘাম দিয়া জ্বর ছাড়ল। মনে মনে আল্লার কাছে শুকরিয়া আদায় করল- মাবুদ তুমিই রক্ষার মালিক।

খুব ছটফট করে রাতটা কাটাল শাহেদ। ঘুম যেন তারে সিদ্ধান্ত নিয়েই আজাব দিচ্ছে। পথের ওই ভয় সারারাত তার মনকে টানাহেঁচড়া করল।- ওরা কি তাইলে এহনও আমার পিছে লোক লাগায়?

সক্কাল সক্কাল উঠে দানাপানি ছাড়াই ঘর থেকে বেরিয়ে পড়ল শাহেদ। ক্ষেত-খাল-মাঠ পেরিয়ে সে-ই বহেরাতলায়- গাঁয়ের লোক বলে বয়রাতলা! গায়েনের আস্তানায়! যখনই শাহেদের মন অশান্ত হয়, সে গায়েনের কাছে যায়। ওর গান শোনে, ওর জীবনের নানান অভিজ্ঞতা মন দিয়া শোনে। গায়েন বলে- একজন মানুষের চক্ষু নাই, সে আল্লাহর অপূর্ব নেয়ামত দেখতে পারে না, তার সবচেয়ে প্রাণের ধন মা-বাবা, তাদের একনজর দেখতে পারে না, কোনো আপনজনরে দেখতে পারে না, এরচেয়ে বড় আর কোনো কষ্ট আছে, ভাই? আপনার দুটি চক্ষু আছে, আপনজন পাশেই আছে! আপনার কিসের ভয়? দাবড়াইয়া বেড়াইবেন। আল্লাহ-ই ভরসা! মন শান্ত করেন! যান, বাড়িত যান!

আজ আর ক্ষেত-খলায় যেতে ইচ্ছে করছে না। শাহেদ বাড়ি ফিরে দরমার কোঠার ঝাপটা টেনে শুয়ে পড়ল। মন খারাপ থাকলে এই আলো- আঁধারি ঘরটাই ওর ঠিকানা হয়। কখনো টানা এক দু’দিন এখানেই শুয়ে বসে কাটিয়ে দেয়। শাহেদ ভাবনায় ডুবে গেল। অতীত তাকে ঘিরে ধরল!

বয়রাতলায় এই অন্ধ গায়েনের আস্তানা দুই যুগ ধরে। বলা যায় তারে ঘিরেই এখানে এই ছোট্ট হাটের সৃষ্টি! বয়রারহাট। এক সময় এই ভিটায় গায়েন একাই সুর তুলতো! টুংটাং করে একতারা বাজাতো! কেউ মাঝে-মধ্যে ইচ্ছে হলে বসতো, গান শুনতো, হাসি গপসপ করত! কেউ চারটা খাবার দিত। না দিলে সেদিন না খেয়েই থাকত।

এখন সেখানে চা, পুরি, ডাল, ভাতের জোগাড়ও আছে। আশপাশের লোক নিত্য নিজের গাছের লাউটা, বেলটা, ঝিঙ্গাটা এইখানেই বেচে কেনে। একটা দর্জিঘরও আছে। বেলাল কম্পাউন্ডারের ফার্মেসি কতজনের জান বাঁচায়! সঙ্গে গায়েনের মিঠাসুর তো আছেই!

তিন
শাহেদ লছনে- গড়নে ভালো। স্বভাব চরিত্রেও নম্বরের কাটাকাটি নাই; কিন্তু বিদ্যার বহরটা যে মাথাটায় কেন নাই খোদা-ই জানেন। বাবার খুব শখ ছিল চান্দের রঙের একমাত্র পোলারে কয়টা পাশ দিয়া সাহেব বানাইবো; কিন্তু গোপালের কপাল শেষমেশও ঠেকল না। স্কুলের গণ্ডিতেই পণ্ডিত বিদ্যাসাগরকে লজ্জা দিয়ে শেষতক পড়াশুনায় ক্ষেমা দিল।

তবে লেখাপড়ায় দুর্বল হলেও অন্যান্য অনেক বিষয়েই সে পটু। তার গানের গলা অতি চমৎকার! খেলাধুলায়ও বেশ ভালো। বিভিন্ন ইভেন্ট জিতে সে স্কুলের সুনাম বাড়িয়েছে। তাই শিক্ষকরা তাকে যথেষ্ট স্নেহ করত; কিন্তু স্কুল তো পড়াশোনার জায়গা। ওইসব গুণের তারিফ করে কতোদিন আর থাকা যায়? তাই বিদায় নেওয়া ছাড়া উপায় ছিল না!

এখন রোজ দিন বাবার সঙ্গে সূর্যের সীমানা ধরে ক্ষেতখলা করতে হয়। তবুও কোনো ঝুটঝামেলা ছাড়াই বাবার সঙ্গে চাষের কাজে মন দিয়েছে, এটাই শুকরিয়া! কারণ শাহেদ এতটা সংসারি না। সুর তার মধ্যে সব সময়ই টলমল করে। মা, বাবা, ৪ ভাই-বোনের সংসার। বাবার সঙ্গে থেকে থেকে বাজার-হাট, বেচাকেনা, পাইকারি, খুচরা, দালাল, আড়ত, মহাজন এসবও শিখে নিতে হচ্ছে! তাছাড়া বছরী শক্ত-পোক্ত হামেদ আলী তো আছেই অনেক বছর ধরে।

এভাবেই চলছে শাহেদের সময়। দিন কাটে ক্ষেত-খামারি করে আর নিশি কাটে গায়েনের সঙ্গে সুর তুলে। গায়েনের আস্তানা তার সুখপ্রাণ! বিদ্যার দেবী শাহেদের সহায় না হলেও গলায় সুর আছে। সেই সুর কারও বুকে আচানক মোচড়ও তোলে। শাহেদ আঁজলা ভরে তা গায়ে মাখায়! মালতি! শাহেদের সুরের সঙ্গে যার আশনাই! তার সুর মালতিরে নয়া পানির স্রোতের মতো টানে। মালতির আকুলি- বিকুলি আর বাঁশ বাগানের চিরটে চিরটে চান্দের বাতাসের রিনিঝিনি শাহেদ বুকের ভাঁজে ভাঁজে রাখে। যখন মন পোড়ায় একটু উঁকি দিয়া দেখে। আবারও যত্ন কইরা রাখে। শাহেদের মনে কয়, মালতির আশনাই যতক্ষণ বুকে বাজে, ততক্ষণ তার সুবাস পাওয়া যায়! সে ঘুমাতে পারে না। ওই মুখ তারে জাগায়ে রাখে। সে অধীর হয়!

কিন্তু গাঁয়ের লোকের তা বুঝে কাম কি। তারা শুধু বোঝে, কিভাবে কার টুঁটিটা ধরা যাবে! তিনটি কথা শুনানো যাবে! কদিনেই মালতিরে নিয়ে কম বেশি কানাঘুষা, দু’চারটা মন্দ বলাও শুরু হয়েছে। শাহেদের এসব নিয়ে তেমন মাথা ঘামানো নেই। তবে সে মাথা না ঘামালেও মালতির বাড়ির লোকজন শুধু ঘামানো নয় রীতিমতো মাথা ঠুকতে শুরু করেছে। কি অসম্ভব কথা! তাদের কলেজ পাশ করা বিদ্যাধর মেয়ের একি অধঃপতন! পোলার না আছে পড়ালেখা, না হইছে গিরস্ত। কেউ বলে, বাপের এক পোলা আদরে অকর্মাই হয়। তারা গায়েনরেই দায়ী করে। গায়েনের আসকারাতেই ওর গানের গরজ হইছে। যদিও গাঁয়ের লোক গায়েনরে অপছন্দ করে না; কিন্তু তাই বলে এত বাড়াবাড়ি?

গায়েন তাতে কিছু মনে করে না। সে শাহেদেরে বেজায় ভালোবাসে। বয়স ধরে, সামাজিক অনুপাতে শাহেদ তার সন্তানতুল্য! কিন্তু সে এইসব মানে না। সে তো জানে, মালতি শাহেদের অন্তরাত্মা! ওদের মিলনে হাশরের ময়দানে একটা ফুল ফুটবো!

চার
কিন্তু আলো-আঁধারি রেখা সদাই বোধকরি লগালগি চলে। শাহেদের বেলায়ও তাই ঘটল। ওর মাথার ওপরের শক্ত ছাউনি বাবা, হঠাৎ করেই কঠিন অসুখে পড়ল! সুতরাং সংসারের দায়িত্ব পালনের মানসিক প্রস্তুতি, সক্ষমতা না থাকলেও তা নিজে নিজেই মাবুদ ওর মাথায় চাপিয়ে দিলেন। সুরের মূর্ছনায় মন যার উথাল-পাতাল, তার কাঁধে উঠল লাঙল, জোয়াল, হাট- বাজার, হিসাব-নিকাশ, বোনের শ্বশুরবাড়ির তাঁবেদারি, ছোট বোনদের বিবাহ!

এভাবেই কঠিন সময় পাড়ি দিচ্ছে শাহেদ। গায়েনের আস্তানায় কখনো সখনো যায়, কিছুটা সুরের চর্চা চলে, তবে সেই সুরে প্রাণের হিল্লোল নাই। দোতারায় শাহেদের হাতটা পড়লেই বাঁশঝাড়ের কোণায় মালতির রশ্মি মিলতো। আইজ তার সাক্ষাৎ নাই। তবুও শাহেদ মালতির কলতান শুনতে পারে। মনে হয় বুকের গহীনে বসে মালতি তাকে বলছে- আহা; কি মিঠা তোমার গলা! ওর সঙ্গে দেখা নাই কতদিন! অনুভবেও যেন ঠাঁই দিতে পারছে না! না জানি বুকে কত ব্যথা জমেছে তার!

শাহেদ বাবারে নিয়া এই হাসপাতাল, ওই হাসপাতাল ঘুরছে; কিন্তু কেউ কোনো আশা দেয় না। টাকা স্রোতের মতো যাচ্ছে! অনেক জমি আধাআধি দামে ছেড়ে দিয়েছে। বাবার জানটা বেঁচে থাকলে জমি আবার হবে।

সেদিন চিন্তা- ভাবনা করে সে যে স্কুলে পড়ত সেখানকার শিক্ষক গনি হাওলাদারের কাছে গেল, তাঁর পরামর্শ অনুযায়ী এবং গনি স্যারে সহায়তায় বাবাকে ভালো একটা হাসপাতালে ভর্তি করাল। গনি স্যার বলল, এই অসুস্থ মানুষটারে রোজদিন শহরে টানাহেঁচড়া করে কষ্ট দেওয়ার কোনো মানে হয়? টাকা তো সবভাবেই যাচ্ছে। এভাবে তোমার বাবার কষ্টটা একটু কম হবে। শাহেদ তাই করল।

বেশ কিছুদিন হাসপাতালে থাকার পর কিছুটা ভালো অবস্থায় শাহেদ বাবারে নিয়ে বাড়িতে ফিরল। তবে এরই মধ্যে অনেক জমিজমা পানির দামে বিক্রি করে বাবার চিকিৎসা চালিয়েছে। বাকি জমির বেশিরভাগই পতিত। সুতরাং বছরটা চরম দুর্যোগে পার করতে হলো।

পাঁচ
বছরের হিসাব ধরে মালতি আরও ডাঙর-ডোঙর, আরও চক্ষুনন্দন হয়েছে। বাড়ির লোকরা ওর বিয়ে নিয়ে অস্থির হয়ে পড়েছে; কিন্তু শাহেদের ঘটনা পাড়ায় কিছুটা জানাজানি হওয়ার কারণে তারা আপাতত চুপ আছে! তবে মালতি একেবারে গৃহবন্দি অবস্থায় দিন কাটাচ্ছে। আইএ পাসের পর তার পরিবার তাকে আর ডিগ্রিতে ভর্তি করাল না। মালতিও নিজের ব্যাপারে কোনো মতামত রাখতে পারছে না। কারণ বাবার মৃত্যুর পর ৪ ভাই-ই ওর অভিভাবক সেজেছে।

এদিকে প্রচণ্ড অর্থকড়ির চাপ এবং সংসারের নানা ঝামেলায় মালতিকে নিয়ে সাহসী কোনো সিদ্ধান্ত নেওয়া শাহেদের জন্যও কঠিন হয়ে পড়েছে! গত কটা মাস তাকে অনেক পরিণত, অনেক বুঝনেদার বানিয়েছে। আগের শাহেদ থাকলে হয়তো মালতিকে নিয়ে যে কোনো সিদ্ধান্ত চট করে নিয়ে নিতো! কিন্তু এই পরিণত শাহেদ দিন- রাত নিজের সঙ্গে যুদ্ধ করেও কিনারা পাচ্ছে না! সে মায়ের সঙ্গে কথা বলল। মা বলল, তারা তো আপোষে রাজি না, বাপধন! তোমার সঙ্গে হাজাহাজি করতেছে। তুমি একলা, ওরা চার ভাই। ওরা তোমারে রেহাই দিব না! মনের কষ্ট মনেই বাইন্ধা রাখো বাজান!

মেলা দিন পর শহিদ গায়েনের আস্তানায় গেল। গায়েন চক্ষুহারা; কিন্তু অন্তরচক্ষু জ্বলে বাজপাখির মতো। দোতারাটা হাতে দিয়া বলল, গান ধর শাহেদ, মনরে উজাড় কইরা গাও! মন শান্ত হবে! বুকের চাপ কমবে! গাও! শাহেদের হাত কাঁপছে! তবুও দুই হাতে দোতারাটা নিয়া কপালে ঠেকাইল। মনে মনে বলল, পরমেশ্বর তোমার যা মনে চায় আমারে তাই কর!

দোতারা টুংটাং বেজে উঠল। শাহেদ গলা ছেড়ে গান ধরল। ইয়া মাবুদ, যেন চারপাশ থেকে সাগরের ফেনিল ঢেউ আসছে। গায়েন শাহেদের গলায় এমন সুরেলা আওয়াজ কখনো শোনেনি! সন্ধ্যায় বয়রার হাটে মেলা লোক থাকে, দোকানিসহ সবাই ছুটে আসল। মালতি শাসন-বারণ সব ভুলে দৌড়ে এলো! হাঁপাচ্ছে! ওর চোখে জল থইথই! বলল-আমার একটা কথা রাখবা? আমগর মিল হোক বা না হোক, সুর যেন কখনো তোমারে ছাইড়া না যায়! বলেই এক দৌড়ে মিলিয়ে গেল! পরদিন সূর্য ওঠার আগেই মালতি আর তার মা মামার বাড়ি রওয়ানা দিল।

ছয়
জানা গেল মামার বাড়িতে মালতির বিয়ে। যদিও নিয়তির এই নির্মমতা শাহেদের জানা ছিল। তবুও মানুষ দুরাশা পুষে রাখে! তবুও বান্ধের উজানে মাছের চাইরে আমনের শেষ গোছা নাগাদ তিরতির কইরা পানি বহে! শাহেদের আশার সলতেটাও তেমনি টিমটিম করে জ্বলছিল! ছেলের এই ব্যথায় মা-র বুকের জখমটা বিষে টুকটুকা। বাবাও বিছানায় শুয়ে থেকেই এদিক সেদিক পাত্রীর সন্ধান করছেন। এবং জিদ্দের ভাত কাড়া আর আকাড়া- এই দুঃসময়েও জমি বেচে, ধুমধাম করে ছেলের বিয়ে দিলেন!

শাহেদের জন্য এই মুহূর্তে এমন সিদ্ধান্ত আরও চরম সংকট তৈরি করল। সংসারের চাপে এমনিতেই সে দিশেহারা। তার ওপর নতুন বউ, নতুন কুটুম বাড়ি। অসুস্থ বাবা-মা, দুইটা বোন বিবাহযোগ্য। কি করবে সে? এত লোকের ভাতের যোগাড় অল্প চাষের জমি দিয়ে কীভাবে হবে? বছরের ৬/৭ মাসের খোরাকি হয়, তারপরই কিনা লাগে। তাছাড়া বাবার ঔষধ, পথ্য তো আছেই!

এসব চিন্তায় বাড়িতে থাকলেও ফাপর ফাপর লাগে। কষ্টের মুখগুলো আর দেখতে ভালোলাগে না। ক্ষেতের কাজকামেও মন নাই। বছরী হামেদ আলী যা পারে করছে। শাহেদ দিন কাটায় ইস্টিশানে, হারু ব্যপারীর দোকানের বেঞ্চিতে বসে। নানা কিসিমের মানুষের আনাগোনা। দু-এক কাপ চা, এক-দুইটা বিস্কুট কাস্টমাররে এটা সেটা একটুখানি আগাইয়া দিলে এমনিই জোটে। মানুষের আনিগুনি দেখে, কথাবার্তায় ঘর-দোরের কথা ভুলেই যায়।

হঠাৎ একদিন একজন গায়ে পড়ে অনেক কথা জানতে চাইল। হয়তোবা আগে থেকেই চোখ রাখছিল। একদিন! দুইদিন! চারদিন! আস্তে আস্তে লতায়পাতায় ইষ্টি বানিয়ে ফেলল। শাহেদের সংসারের হাল শুনে লোকটির সোনায় সোহাগা। এরপর থেকে একদম লেগেই আছে। খুব আদর, আহ্লাদ, আপ্যায়ন করছে। যেভাবে দুর্দিনে পাশে থেকে একজনের আপন হওয়া যায়, তা-ই করছে। ওরা জানে কীভাবে, কাকে কব্জায় নিতে হয়! ছেলেটার চেহারা-ছবি ভালো, কিছুটা পড়ালেখাও আছে। এমন লোক পেলে বস নিশ্চয়ই খুশি হবে!

লোকটা শাহেদকে বলল তাদের কোম্পানিতে চাকরির ব্যবস্থা করে দিবে।

শাহেদ বলল, এই পড়ালেখায় কী চাকরি?

কতরকম কামই তো আছে। তোমার লগে যেটা মিল পড়ে ওইটাই করবা। তবে এখনই কাউরে কিছু বলবার দরকার নাই।

অভাবের সংসারে এটা বিরাট ভরসা। অল্প জমি, হামেদ আলীই সামলাতে পারবে। শাহেদ রাজি হয়ে গেল।

ভালোই ঘায়েল করেছে। ওপর থেকে অনুমতিও পেয়েছে। বস ওকে কিছু দিন চোখে চোখে রাখতে বলল। এবং সময় সুযোগ বুঝে বসের দেওয়া ঠিকানায় নিয়ে যেতে বলেল।

সাত
মেজোকে দেখতে আসবে। কথাবার্তায় লয় পরলে কাবিন হয়ে থাকবে। পরে ওই বাড়ির সুবিধা মতো উঠায়ে নিবে। বোনটা শ্যামবর্ণের। তাই সব সম্বন্ধ ভেঙে যায়! মা বললেন- বাবা, এইবার কিছু দেওয়া-থোয়া কইরা হইলেও কাজটা শেষ করতে হইবো। ওর জন্য তো ছোটটাও আটকে আছে।

কিন্তু শাহেদ ভাবছে, দেওয়া-থোয়া তো পরের কথা। কইনা দেখার মানুষগুলানের শিরনী-পোলাও জোগাড় করা-ই তো তার জন্য কঠিন। ইস্টিশনে বসে যতই তামাশা দেখুক, মাথার মধ্যে সেই চিন্তাই ঘুরপাক খাচ্ছে! এমন সময়ই লোকটা এসে পাশে বসল। জানাল- তোমার ভাগ্য খুব ভালো! বস দু’একদিনের মধ্যেই যাইতে বলছে। তুমিই ঠিক করো কখন যাইবা? শাহেদের বলতে ইচ্ছে হলো, এখনই! কিন্তু অচেনা একজন মানুষ তার জন্য এত করছে এতেই সে কৃতজ্ঞ। শাহেদ তার ওপরই ছেড়ে দিল। অচেনা পর দিনই যাওয়া সাব্যস্ত করল।

এই প্রথম বস কোনো এসাইনমেন্ট ঠিকঠাক শেষ করার আগেই কারও সঙ্গে দেখা করল। শাহেদ থুম ধরে বসেই আছে। যা বলার অচেনাই বলছে। ওর বোনের বিয়ে, কিছু টাকা-পয়সা দরকার, বড় আশা কইরা আসছে- এইসব নানান কথা অচেনা নিজের ইচ্ছামতো বসকে বলছে। এসব শুনে অচেনার প্রতি শাহেদের কৃতজ্ঞতা আরও বেড়ে গেল। অচেনা যা করছে, নিজের জ্ঞাতিভাইও তা করে না। তার কথায় বস পঞ্চাশ হাজার টাকা এডভান্স দিতে রাজি হয়ে গেল। বলল, যাও ধুমধাম করে বোনের বিয়ে দাও। শাহেদ এত টাকা নিতে আপত্তি করে। বলে হাজার তিরিশেক হলেই হবে; কিন্তু লোকটা বলল- একবারে দিতে হবে না। মাসে মাসে কেটে নিবো। নিয়ে নাও। বেশি ছুটি পাবে না। খরচ হিসেবে বাবা-মার হাতে দিয়ে আসবে। একটা সাইনও নিয়ে রাখল। তবে কাগজে কি লেখা ছিল তা দেখার কোনো সময় সে পায়নি। তবুও কৃতজ্ঞ শাহেদ। তবে তার সরল দৃষ্টির পিছনে কি ঘটে গেল তা ঘুনাক্ষরেও টের পেল না! কিন্তু কি যেন খটকা আছে বলে মনে হলো। যাক বোনের বিয়েটা মিটুক, তারপর দেখা যাবে।

মেয়ে তুলে দেওয়ার পর পরই অচেনা হঠাৎ বাড়ি এসে উঠল। শাহেদ অবাক। বাড়ি চিনলেন কি করে? জবাব না দিয়েই বলল, বস জরুরি ডেকেছেন। এখনই চলো।

ছেলের ওপর মা ভীষণ খুশি। এই শ্যামবর্ণের মেয়েটাকে পার করতে মায়ের চিন্তার কূলকিনারা ছিল না; কিন্তু ছেলেটা বিয়ের রাতেই হঠাৎ চাকরিতে চলে গেল, এটা নিয়ে মা-র একটু কষ্ট হচ্ছে; কিন্তু বাবা খুব চিন্তিত। এত খরচ করে বিয়ে দিল, আবার তার হাতেও বেশকিছু টাকা দিল। কি চাকরি?

আট
অল্পসময়েই টের পেল কি দুঃসহ এক জীবন বেছে নিয়েছে সে। চিটিংবাজি নানারকম ব্যবসার কথা শুনেছে; কিন্তু এইরকম? শাহেদ ভাবতেই পারছে না। একটি পরিবার। একটি ছিমছাম সংসার। বাবা, মা, ভাই, বোন! শাহেদ এখন এই পরিবারের ছেলে। অথচ কেউ কাউকে জানে না। বাইরে আরও কয়েকটি গ্রুপ আছে। যার যার কাজ সে সে করছে। তাকেও একটা গ্রুপ ঠিক করেছে। অথচ সে কিচ্ছু বুঝতে পারেনি। সব মিলে একটি চক্র। অল্প শিক্ষিত পয়সাওয়ালা বাবার মেয়ে খুঁজে বের করে। কোনো খুঁত, বা সমস্যাসংকুল মেয়ে হলে আরও ভালো। এরপর চাকরিপ্রত্যাশী সেই ফান্দে ফেলা ছেলেটার, মোটা অংকের টাকা, স্বর্ণালংকারের বিনিময়ে বিয়ে হয়। যতদিন সম্ভব নানা কৌশলে টাকা-পয়সা নিতে থাকে। আর অভিনয় চলতে থাকে। এরপর হঠাৎ পুরো পরিবার হাওয়া! নিরুদ্দেশ! আবার অন্য কোথাও গিয়ে আবাস গড়ে। আবার কৌশল চলে।

শাহেদকে নিয়েও এমন চলতে থাকে। ওকে দিয়ে লক্ষ লক্ষ টাকা আয় করে কিন্তু অগ্রিম দেওয়া পঞ্চাশ হাজার টাকা আর শেষ হয় না। বছরে দু-একবার বাড়ি যে যায়নি তা নয়; কিন্তু পরিবারের ক্ষতির কথা চিন্তা করে পালিয়ে যায়নি, কাউকে কিছু বলেওনি; কিন্তু মনের সঙ্গে যুদ্ধ করে আর কুলাতে পারছে না। প্রচণ্ড অপরাধ বোধে ভুগছে। এর মধ্যে কেউ কেউ ধরাও পড়েছে। শাহেদকে ওপরওয়ালা কোনোরকম বাঁচিয়ে দিয়েছেন। এবার সে ঘুরে দাঁড়াতে চায়! প্রয়োজনে পুলিশের কাছে নিজেকে সোপর্দ করে সব বলে দিতে চায়; কিন্তু ওর সন্তানদের মুখখানি মনে করে তাও পারছে না! আর, কেনই বা সে ধরা দিয়ে নিজে জেল খাটবে? বস সাহেব তো দিব্বি আছে, থাকবে! আরেকটা ছেলেও জোগাড় করে ফেলবে! মাঝখান থেকে সে জেলে পচে মরবে। যেমন অন্যরা মরছে। তাদের জন্য কিচ্ছু করেনি। বরং দ্রুত সটকে পড়েছে।

শেষ পর্যন্ত একদিন সাবধানে বেরিয়ে এলো। এটাকে নির্দ্বিধায় পালিয়ে আসাও বলা যায়। শাহেদ শুধু ওই বাড়ি নয়, শহরের শেষ প্রান্ত অবধি চরম উৎকণ্ঠায় ছিল। এরপরও সে নিরাপদ নয়। তবুও যতটুকু নানা সময়ে শুনেছে বা জেনেছে সেই অনুযায়ী ওদের ব্যবহৃত পথগুলো এড়িয়ে বাড়ি পর্যন্ত পৌঁছাতে ওর দুই রাত তিন দিন চলে গেল। কারণ বেশিরভাগ সময় সে রাতে পথ চলেছে। আর দিনে খেয়ে না খেয়ে ঘাপটি মেরে কোথাও শুয়ে বসে থেকেছে।

নয়
শাহেদ বেশ রাতে বাড়ি পৌঁছাল! বাড়ি ফিরে যেন হাতে আসমান পাইল। বউরে বলল- সব পরে কমু, আমারে আগে খাওন দেও বউ! আর, দুইটা দিন আমারে লুকাইয়া রাখতে পারবা না? আমার ঘুম দরকার।

রাহেলা খুব তড়স্ত চাউলের মুটকি থেকে একটা ডিম নিয়ে বিরান করল, মাসকলাইয়ের ডাল আর ভাতের ছোট গামলা নিয়ে দৌড়ে আসল। কাছে বসে শাহেদের খাওয়া দেখল। আবার দৌড়ে গেল বিছানা করতে। নকশী দরমা দেওয়া লেপ-তোশকের বড় কাঠের সিন্দুকের ওপর বিছানা পাতল। পরিস্কার ফুল তোলা চাদর, নতুন বালিশের ওয়ার লাগানো ঝকঝকে বিছানা। দেখে শাহেদের প্রাণটা জুড়িয়ে গেল। রাহেলারে বুকে জড়িয়ে বলল- তোমার সঙ্গে আমি অনেক অন্যায় করছি, আমারে মাফ কইরা দিও বউ! আর এমন হইব না। কসম!

রাহেলা চুপচাপ সব অনুধাবন করছে। শাহেদ খুব ভালো। তবে আজ সে আরও মায়াদারি একজনকে দেখছে। বিয়ের পর থেকেই দেখেছে বিষন্ন এক শাহেদকে! ঠাণ্ডা, চুপচাপ! দশ চড়েও যার রা’ নেই। অনেকেই বলতো মালতিকে না পেয়ে শাহেদের এমন হাল; কিন্তু রাহেলার এসব নিয়ে কোনো মাথা ঘামানো নেই। অবশ্য কয়টা বছর তো বিদেশ- বিভুঁয়েই কাটল।

শাহেদ যেন প্রাণহীন অসাড় দেহ বিছিয়ে ঘুমাচ্ছে। দুপুর গড়িয়ে সাঁঝ নামছে। রাহেলা মাঝে মধ্যে এসে দেখে যায়, কিন্তু ডাকে না। ওর ঘুমন্ত মুখটা রাহেলার পোষা খরগোশ কিটির মতো মায়াময়! এই ছড়ানো মায়াটা কোনোভাবেই সে মিলাতে দিবে না। সিথানে বসে নানান কথা ভাবছে রাহেলা।- মানুষটা আছিল গান পাগল। তারে পাগল করতে গানই লাগবো! দশ গেরামের মানুষ তার গান শোনার জন্য বয়রারহাটে আসতো! শুনছি মালতিবুও তার গান শুইনা পাগল হইছিল! তার মুখের ঝলমলানি হাসি, এই মায়া, গান ছাড়া কেউ ফিরাইয়া দিতে পারবো না। সে যেমুন কসম কাটছে, আমিও কসম কাটলাম।

রাহেলা ক্ষণেক্ষণেই নতুন নতুন ভাবনায় পড়ে যাচ্ছে। মনে হলো শাহেদের কথা শাশুড়িকে জানানো দরকার। মা-ছেলে বলে কথা। পরে জেনে হয়তো কষ্ট পাবেন। খুব চুপিসারে শাশুড়িকে এনে দেখাল। বিকেলটায় ছেলেপেলেরা বাড়ির বাইরে খেলা নিয়ে ব্যস্ত থাকে। তাই একটু নিশ্চিন্ত। তাছাড়া সচরাচর এই কোঠায় কেউ খুব একটা যায় না। খিড়কির কপাট বন্ধ থাকলে দোজখের আন্ধার। খুব নিকট ম্যায়- মেহমান আসলে এইখানে থাকে।

এভাবেই শাহেদের চাকরি থেকে ফিরে আসার বিষয়টা সবার কাছে স্বাভাবিক হয়ে ওঠে; কিন্তু শাহেদ জানে কি সে পাড়ি দিয়ে এসেছে! এখনও প্রতিটা মুহূর্ত চরম অনিশ্চয়তা আর মৃত্যুভয় নিয়ে কাটাতে হচ্ছে!

স্বগতোক্তির মতো উচ্চারণ তার- যতো কঠিনই হোক, আর যামু না, হারামের পয়সা পোলামাইয়ারে আর খাওয়ামু না! গত রাতের ঘটনাটা মনের ভুলও হতে পারে।

হাটবারে ছেলেমেয়েগুলান ভালো মন্দ কিছু খাওয়ার জন্য অপেক্ষা করে। শাহেদ তার সাধ্য অনুযায়ী বাজার- সদাই করে আনে। ছোট ছেলেটা ভাতের চেয়ে উলুফাই বেশি চায়। বহুদিন পরে বাবার কাছে তাদের অনেক আবদার। বৌয়ের রুমাল তোলার সুতা আর বিলের বোয়াল মাছের একটা ভাগা পই পই কইরা দেইখা লইল। মধ্যের কাটা ওয়ালা টুকরা কয়টা আর কাটা ছাড়া কয়টা! মাছটা বাত্তি হইছে কিনা! মাছটা তেলাল কিনা! পোলাটা মাছের বিরান খাইতে খুব পছন্দ করে।

বৈকালে গায়েনের আস্তানায় গেল।

কই গায়েন...দোতারাটা দেও! মাবুদের নাম নিয়া শাহেদ দোতারা কপালে ঠেকাইল! চক্ষু খুলে দেখল, মালতি আর রাহেলা গলাগলি ধরে হেসে কুটিকুটি!

সাম্প্রতিক দেশকাল ইউটিউব চ্যানেল সাবস্ক্রাইব করুন

মন্তব্য করুন

Epaper

সাপ্তাহিক সাম্প্রতিক দেশকাল ই-পেপার পড়তে ক্লিক করুন

Logo

ঠিকানা: ১০/২২ ইকবাল রোড, ব্লক এ, মোহাম্মদপুর, ঢাকা-১২০৭

© 2024 Shampratik Deshkal All Rights Reserved. Design & Developed By Root Soft Bangladesh

// //