ফেরা (গল্প)

রাত গভীর হলেই সংলাপগুলো মূর্ত হয়ে ওঠে। 

বিছানায় মরার মতো ঘাপটি মেরে থেকেও নির্ঘুম রাতের দহনকে আর এড়ানো যায় না। কোনো কোনো রাতে তাই বাড়িতে ফিরতে চায় না তারেক। এলোমেলো ভাবনা মাথায় করে উদ্দেশ্যহীন বেরিয়ে পড়ে; কিন্তু সে না ফিরলে মা কিছুতেই ঘুমোবে না, সারাদিনের পরিশ্রান্ত দেহ নিয়ে ঘুমকাতর চোখে না খেয়ে অপেক্ষা করবে; এসব মনে হলে বাড়ি না ফিরে উপায় থাকে না।

বিকেল থেকেই মাথাটা ব্যথা করছিল তারেকের। পড়ার টেবিলে মনোযোগ স্থির করতে পারেনি। কিছুদিন পরেই তার মাস্টার্স ফাইনাল পরীক্ষা। রাতে সামান্য মাথাব্যথাকে আমলে না এনে বই নিয়ে বসেছিল। এমন সময় বাবা ফিরলেন। খাবার নিয়ে মা যখন সামনে এলেন, বাবা জানালেন, তিনি খাবেন না। বাইরে থেকে খেয়ে এসেছেন। হাতমুখ ধুয়ে বাবা বিছানায় গেলেন। বড় ছেলে এবং খোকা ফিরেছে কিনা, মুরগি-ছাগল ঠিকমতো তোলা হয়েছে তো, জানলেন। মা কোনো রকমে উত্তর দিয়ে শোবার আয়োজন করলেন। 

মা বললেন, কোথায় গিয়েছিলেন? ফিরতে এত রাত করলেন যে?

বাবা কিছুক্ষণ নীরব থেকে একটা দীর্ঘশ্বাস আড়াল করে বললেন, আচ্ছা মমতা, একটা কাজ করলে কেমন হয়?

কী কাজ?

বাবা এবার দীর্ঘশ্বাসকে আড়াল করতে পারেন না-সংসার যে আর চালাতে পারছি না মমতা। এভাবে কতদিন, বলো? দেয়ালে আমার পিঠ ঠেকে গেছে। ভাবছি, বরিশালের দিকে গিয়ে ফেরি করে কোনো ব্যবসা করব। ওদিকে আমাকে কেউ চিনবে না। লোকে জানবে, কোথাও চাকরি করি। সংসারটা কোনোরকম ঠেলে ঠুলে চলে যায়, কিন্তু খোকা ও ছোটমেয়ের পড়ার খরচ-বেতন কুলিয়ে উঠতে পারছি না। এছাড়া তো কোনো উপায় দেখি না। 

ঘুমান তো। অনেক রাত হয়েছে। আল্লাহই আমাদের চালিয়ে নিবে।

গুরুত্বপূর্ণ একটা অধ্যায় পড়ছিল তারেক। বাবার শেষ কথাগুলো কানে যেতেই সে বইটা বন্ধ করে। কিছুক্ষণ থম ধরে বসে থাকার পর, চেয়ার ছেড়ে উঠে পড়ে। সাবধানে দরজা খুলে রাস্তায় বেরিয়ে আসে। 

তারাভরা আকাশ। চারদিকে জোছনার নরম আলো থৈ থৈ করছে। নীরব রহস্যময় রাত। ধীরপায়ে তারেক গফুর মোল্লার দোকানের বেঞ্চিতে এসে বসে। রাতেরও যে আলাদা সৌন্দর্য আছে, তেমন করে সে কখনো ভাবেনি। কী স্নিগ্ধ ও প্রশান্ত রাত। প্রকৃতি অকৃপণ হাতে ঢেলে দিয়েছে তার সৌন্দর্য।

‘সংসার যে আর চালাতে পারছি না মমতা’; বাবার কথাগুলো প্রতিধ্বনির মতো কানে বাজে তারেকের। হৃদয়ের সমস্ত অনুভূতি দিয়ে বাবার কথাগুলো সে উপলব্ধি করে। লড়াকু বাবাটা জীবনের শেষবেলায় এসে হতাশ হয়ে পড়েছেন। তাঁকে কত না নৈরাশ্য জেঁকে ধরেছে! ইদানিং প্রায়ই বাবা তাঁর পরিকল্পনার অধ্যায় গভীর রাতে মেলে ধরেন। মনোযোগ না থাকলেও সেসব কানে আসে তারেকের। কিছুতেই সে নিজেকে স্বাভাবিক রাখতে পারে না। নির্ঘুমে রাত কাটে। বিছানায় এপাশ-ওপাশ করে পিঠব্যথা হয়ে যায়। দু’চোখের পাতা কিছুতেই এক করতে পারে না।

সকালে যখন তারেকের ঘুম ভাঙলো, বেলা আটটা পেরিয়ে গেছে। ছোটবানের ঘ্যানঘ্যান ও আবদার কানে আসে। সে দিনাজপুরের স্বপ্নপুরী বেড়াতে যাবে। মায়ের কাছে কিছুক্ষণ ঘ্যান ঘ্যান করেছে। মা বলেছে, তার কাছে টাকার গাছ নেই; বলে জোরে এক ধমক লাগিয়েছে। এখন সে মন খারাপ করে টিউবওয়েলের পাশে ফুলের গাছের সামনে দাঁড়িয়ে আছে। ফুলের বাগানটা তারই গড়া। তারেক থার্মোমিটারের মতো ব্রাশটা মুখে পুরে কলপাড়ে এসে দেখল, বোনটা বিষণ্ণ মুখে স্ট্যাচুর মতো দাঁড়িয়ে আছে। তারেক খুব অবাক হলো। নিজ হাতে তৈরি বাগানের সামনে অদিতিকে সে কখনো মন খারাপ করে দাঁড়াতে দেখেনি। চোখেমুখে উষ্ণ জলের ঝাপটা দিতেই ঘুমের ক্লান্তি দূর হয়ে গেল। গামছায় মুখ মুছে সে অদিতির কাছে যায়-কী হয়েছে রে? মন খারাপ? অদিতি কিছু বলে না, অন্যদিকে চোখ ফেরায়।

তারেক আন্তরিক গলায় বলে, কী হয়েছে? আমাকে বল। নুডুলস খাবি বলে মা বকেছে?

তোমাকে বললে কাজ হবে না। তুমি যাও।

তারেক সিরিয়াস ভঙ্গিতে বলে, বল না দেখি, তোর ইচ্ছেটা পূরণ করতে পারি কিনা?

অদিতি আদুরে গলায় বলল, বড় ভাইয়ার স্কুল থেকে ছেলেমেয়েরা শিক্ষা সফরে যাচ্ছে। আমার খুব শখ...

বেশ তো, ভাইয়াকে বল, নিয়ে যাবে।

প্রত্যেকের কাছে দুশ’ টাকা চাঁদা ধরা হয়েছে। টাকা দিলে ভাইয়া নিয়ে যাবে বলেছে।

তারেকের কপালে একটা ভাঁজ পড়ে, ছোটবোনের কাছে চাঁদার কথা বলতে পারল? 

মন খারাপ করিস না। ওরা কবে যাবে?

আগামী সোমবার সকালে।

তুই অবশ্যই যাবি। আমি কথা দিলাম। এখন লক্ষ্মী মেয়ের মতো নাস্তা করে স্কুলে যা।

অদিতির চোখে খুশির আভা ফুটে ওঠে। সে হাসিমুখে বাড়ির ভেতরে চলে যায়।

একটা প্লেটে নাস্তা সাজিয়ে মা প্রায় দৌড়ে বড় ছেলের ঘরে গেলেন। তার অফিসের সময় হয়ে যাচ্ছে। 

বাবার ঘরে একবার উঁকি দেয় তারেক। বাবার কাছে কিছু পেলে বাঁকিটা সে নিজেই দেবে; কিন্তু শূন্য বিছানা দেখে সে ফিরে আসে। অদিতি বলল, নাজনীনকে বাবা স্কুলে দিতে গেছে। ভাবির পায়ে ব্যথা, শুয়ে আছে।

ভাবিরা বড় বোন বা মায়ের মতো হয়; কিন্তু বড়ভাইয়ের স্ত্রীকে তারেক কখনো ভাবি বলেনি। অন্য কিছুও ডাকেনি। একই ছাদের নিচে বাস করেও সম্পর্কে দূরত্বের সীমানা দীর্ঘ হয়েছে।

সোয়া নয়টায় একটা টিউটোরিয়াল আছে। নাস্তার জন্য কিছুক্ষণ অপেক্ষা করে তারেক। মা কিংবা ছোটবোন কেউ তার ঘরে এলো না। সাইকেল নিয়ে সে বেরিয়ে পড়ে।

সাড়ে তিন কিলোমিটার পথ সাইকেলে চেপে কলেজে যেতে হয়। মাঝে মাঝে বিরক্তি এসে যায়। বিরক্তির শেষ প্রান্তে পৌঁছে মনে হয়, জীবনে কিছু অপূর্ণতা থাকাই ভালো। হঠাৎ প্রাপ্তির আনন্দটা তাতে তীব্রতর হয়ে উঠবে কোনো একদিন। কবে দেখা মিলবে সেই দিনের?

পরীক্ষা শেষ হলো এগারোটায়। তারেক কলেজের করিডোর ধরে হাঁটছে, এমন সময় মিথিলা পেছন থেকে ডাকল- পরীক্ষা কেমন দিলে?

এই তো। তুমি ভালো?

মিথিলা হাসল। কী করবে এখন? চলো, চা খাই। তোমার মুখটা ভার ভার লাগছে যে?

কই, না তো। ভাবছি একটু সেমিনারে বসব।

আমারও নাস্তা করা হয়নি, চলো কিছু খাই।

তারেক নীরবে মিথিলাকে অনুসরণ করে।

তারপর, তোমার খবর কী? বাড়ির পরিবেশ এখন কেমন? এতো ভেবো না তো, সব ঠিক হয়ে যাবে।

মিথিলা সচ্ছল পরিবারের মেয়ে। তারেক যে পরিবেশে দিনযাপন করে, তার দেখা সে কখনো পায়নি। একদিন বেখেয়ালে তারেক কিছু ক্ষোভ ও হতাশার কথা বলে ফেলেছিল। তারপর থেকে মিথিলা আন্তরিকতা নিয়ে ওকে কাছে টানে। স্বপ্ন ও সম্ভাবনার কথা বলে।

তারেক, খাও তো। তুমি বিষণ্ণ থাকলে আমার ভালোলাগে না। পড়ালেখায় তুমি বরাবরই ভালো। পাস করলেই কিছু একটা গতি হবে।

সত্যি কি গতি হবে? পাস করেও তো অনেকে বেকার ঘুরছে।

সুখী হতে বেশি কিছু লাগে না তারেক। সুখী হতে জানতে হয়। প্রচুর টাকা-পয়সায় সুখ পাওয়া যায় না।

সুখ? জীবনে সব মানুষই কি সুখের নাগাল পায়, মিথিলা?

কী জানি বাবা। শোনো, শিক্ষা সফরে যাচ্ছ তো? 

তারেক ভুলেই গিয়েছিল, ডিপার্টমেন্ট থেকে শিক্ষা সফরে কক্সবাজার যাওয়ার কথা। সে যাবে কিনা, এখনো সিদ্ধান্ত নেয়নি। বলল, দেখি।

দেখি বললে হবে না। তুমি না গেলে কিন্তু আমিও যাব না।

তারেক মিথিলার চোখে তাকিয়ে মৃদু হাসল। 

দুপুরের পর কলেজ থেকে ফিরল তারেক। জামা-প্যান্ট খুলে আলনায় রাখতে রাখতেই টের পায়, বাড়িতে কোনো আয়োজন চলছে।

নাজনীন এসে তারেকের হাত ধরে; চাচ্চু, তুমি কোথায় গিয়েছিলে বলো তো? আমি কখন থেকে তোমাকে খুঁজছি। 

কেন খুঁজছিলে, মামণি?

বাড়িতে মেহমান এসেছে। আম্মু মজার মজার রান্না করছে। আমি তোমার কাছে গল্প শুনব, খেলব।

আজ কারা এসেছে?

আম্মুর বান্ধবী আর দুটি বাবু।

আজ খাবার পেতে দেরি হবে। মেহমান এলেই এমন হয়। 

হাতমুখ ধুয়ে তারেক আবার শার্ট-প্যান্ট পরল। সাইকেল নিয়ে বেরোনোর সময় মা একবার দেখল, কিন্তু কিছু বলল না।

কাঁচা রাস্তার দেড় মাইল পথ হেঁটে তারেক যখন ফুফুর বাড়ির উঠানে এসে দাঁড়ায়, বেলা তিনটি পেরিয়েছে। ফুফুটা বড় ভালো। তারেককে খুব স্নেহ করে। দেখা হলেই বাপ বলে সম্বোধন করে। বুকে জড়িয়ে ধরে। বাড়ির কুশলাদি বিনিময়ের পর ফুফু যখন খেতে আহ্বান করে, সে না করে না। পাটিতে বসে পড়ে।

ফুফাত ভাই হলেও শাকিল বন্ধুর মতো। সময় না কাটলেই তারেক এখানে চলে আসে। শাকিল গরু নিয়ে মাঠে গেছে। তার অপেক্ষায় থাকতে থাকতে সে ঘুমিয়ে পড়ল।

সন্ধ্যায় বাড়ি ফিরতেই তারেক দেখে, ছোটবোন নীলার ছেলে তুহিন নাজনীনের সঙ্গে খেলছে। কাছে আসতেই তারেককে মামা মামা বলে জড়িয়ে ধরে।

কখন এলে মামুজান? 

বিকেলে।

নীলাকে দেখে তারেক বলল, কেমন আছিস?

ভালো। কোথায় গিয়েছিলি?

ফুফুর বাড়ি গিয়েছিলাম। তুই এসেছিস, ভালোই হলো। 

কেন রে?

­­পরে বলি। আমি একটু মোড়ের দিকে গেলাম।

বাবা-মায়ের কাছে সব সন্তানই হয়তো সমান। কাউকে দূরে সরিয়ে রাখতে পারেন না। নিজেদের সমস্ত সুখ-ভোগ বিসর্জন দিয়ে সন্তান মানুষ করে যান। ছেলেমেয়েরা প্রতিষ্ঠিত হলে বাবা-মার প্রত্যাশা থাকতেই পারে, সন্তানের একটু সেবা-সহযোগিতা পাওয়ার; কিন্তু বেশিরভাগ ক্ষেত্রে সেবা-সুযোগের বদলে অবহেলাই জোটে। তবু সন্তানকে আমৃত্যু আগলে রাখেন। 

তারেকের বাবার অবস্থা ভালোই ছিল। নীলার বিয়ে, বড় ছেলের চাকরি, সংসার-সবকিছুর ব্যবস্থা করতে গিয়ে তিনি সর্বস্বান্ত। বড় ছেলে ভালো চাকরি করে। একসঙ্গেই থাকে সবাই। সংসার চালানোর সামর্থ্য এখন বাবার নেই, এটা না বোঝার কথা নয়। তবু সংসারে সে এক পয়সা দেয় না। বউ-বাচ্চা, বন্ধু-আত্মীয় নিয়ে ব্যস্ত থাকে। বউয়ের নতুন নতুন শাড়ি-গয়না, ছেলের দামি খেলনা, মেহমানদারিতে সমৃদ্ধ আয়োজন নিত্য ঘটে; কেবল বাবার ছেঁড়া লুঙ্গি, পুরাতন শার্ট কেটে মায়ের ব্লাউজ বানানো-এসব তার চোখে পড়ে না। 

তারেক ভেবে পায় না, বড়ভাই এখন প্রতিষ্ঠিত; তবু বাবার ঘাড়ে বসে খেতে হয় কেন? কী অদ্ভুত এই জীবন। রহস্যময় এই জীবনের অলিগলি। 

তারেক পড়ার ঘরে ঢুকতেই নীলা এগিয়ে আসে-ছোট ভাই, একটু বাজারে যাবি?

এখনই তো এলাম।

কিছু টাকা হাতে দিয়ে নীলা বলে, বাবার খুব মিষ্টি খেতে ইচ্ছে করেছে, যা না। 

বৃষ্টিধোয়া স্নিগ্ধ সকাল। বেশ সাজুগুজু করে ভাই-ভাবি ও নাজনীন কোথাও বেরুচ্ছে। তারেক গাড়ির সামনে গিয়ে দাঁড়ায়-ভাইয়া, আজ তো ছুটির দিন। কোথায় বেরুলে?

শাহেদ কিছু বলে না। নাজনীন এগিয়ে আসে-চাচ্চু, আমরা রফিক আঙ্কেলের বাড়ি যাচ্ছি। আজ নিঝুমের জন্মদিন। সারাদিন খুব মজা হবে। 

নিঝুম নামটা ছেলের নাকি মেয়ের, তা নিয়ে মাথা ঘামায় না তারেক। সে একধাপ এগিয়ে যায়-ভাইয়া, সরকার তোমাকে যে বেতন দেয়, তাতে কি বউ-বাচ্চাসহ স্বাচ্ছন্দ্যে চলা সম্ভব?

তা সম্ভব। হঠাৎ এ প্রশ্ন?

না, তুমি সরকারি জব কর। স্যালারির বাইরেও ইনকাম আছে।

কী বলতে চাস তুই?

এখন তুমি প্রতিষ্ঠিত। তবু বাবার ওপর নির্ভর করতে চাও কেন? দোকানে কত টাকা বাকি জান?

এই সময় তারেকের ভাবি বড় একটা গিফটবক্স হাতে নিয়ে সামনে আসে। তাচ্ছিল্যের স্বরে তারেকের দিকে তাকায়-সকালবেলা কিসের হাঙ্গামা জুড়েছিস? সরতো।

তারেকের কপাল কুঞ্চিত হয়। চোখ ছোট হয়ে আসে। তবু সংযতভাবেই বলে, ভাবি, তুমি এখন যাও। তোমাকে কিছু বলা হয়নি। এর মধ্যে তুমি একটা কথাও বলবে না।

একটু বিরতি দিয়ে তারেক বলে, তোমার মান্থলি ইনকাম পঞ্চাশ হাজারের ওপরে। তুমি সেই টাকা কোথায় কীভাবে খরচ করো, কেউ খোঁজ রাখে না। আমিও না। প্রয়োজনও নেই; কিন্তু তুমি অন্তত নিজের খরচটা সংসারে দিতে পারো। বন্ধু-আত্মীয়ের পেছনে ঠিকই খরচ করছ, অথচ সংসারে কোনো পয়সা দাও না। তোমার এই মানসিকতায় সংসারের নাভিশ্বাস উঠেছে, খোঁজ রাখ কি?

শাহেদ ক্ষুব্ধ হয়ে তারেককে থাপ্পড় দিতে যায়-ইডিয়েট! 

নীলা এসে দু’জনের মাঝখানে দাঁড়ায়। দুই ভাইকে থামিয়ে দেয়।

তারেকের গলা এবার জোরালো হয়-তুইতো একটা চামার। এলাকায় তোর বউ রাণীর মতো চলে। দুইবেলা নতুন শাড়ি-ম্যাক্সি পরে। তোর বাবার শরীর খারাপ, ভালো কাপড় নেই, দুর্ভাবনায় রাতে ঘুমায় না; মা পুরোন শার্ট কেটে জামা বানায়, এগুলো তোর চোখে পড়ে না? 

শাহেদ রাগে ফুঁসতে থাকে।

সংসার কীভাবে চলে জানিস? কীভাবে জানবি? তুই তো বউয়ের কথায় ওঠবস করিস। লজ্জা করে না, বুড়ো বাবার ঘাড়ে বসে খেতে?

তারেকের কথার শব্দে মা বেরিয়ে আসেন। তারেককে সরাতে চেষ্টা করেন-তুই থামতো। 

ভাবির ফাটা গলা তুঙ্গে ওঠে-হিংসায় জ্বলে পুড়ে পাগল হয়ে গেছে...

তারেক বলে, তোর বউ লোককে টাকার গরম দেখায়। রঙিন টিভি কিনবে, ফ্রিজ আনবে। অথচ দুপুরবেলা পাতলা ডাল দিয়ে ভাত খেতে হয়। এগুলো তোর চোখে পড়ে না? ছোটবোনকে দুশ টাকার জন্য লাথি মারিস। ননসেন্স! পরের হক মেরে খেয়ে আবার মারতে আসিস? স্টুপিড!

ভাবি এসে স্বামীকে ধাক্কা দেয়-চলো। এই নরকে আর থাকতে চাই না। শাহেদ গাড়িতে স্টার্ট দিয়ে দ্রুত আড়ালে চলে যায়।

বিকেলে বাবার জ্ঞান ফিরল। রাত থেকে ভীষণ জ্বর। ভুল বকছিলেন। সকালে যখন বাড়িতে হৈ-হল্লা চলছিল, বাবা তখন প্রায় অচেতন। বিছানা ছেড়ে উঠতে পারলেন না। সদর থেকে ভালো ডাক্তার এসে দেখে গেছেন। এখন কিছুটা সুস্থ। সন্ধ্যায় নাকি শুয়ে থাকতে নেই; মাদুর পেতে আঙিনায় বসে কথা বলছিলেন।

পরিবারের সবাইকে নিয়ে এমন করে অনেকদিন বসা হয় না। কী এক ভালোলাগায় মনটা ভরে ওঠে। তারেককে কাছে ডেকে মাথায় হাত রাখেন বাবা-ওরা আলাদা না হলে কীভাবে সে কথা বলি, বাবা! কষ্ট করে পড়া-লেখাটা শেষ কর। আমি সব বুঝিরে বাপ। 

সন্ধ্যাটা ক্রমশ গাঢ় হয়ে ওঠে। গোধূলির এই মুহূর্তে তারেকের খুব একা আর অসহায় লাগে। বাড়ির আঙ্গিনা ছেড়ে সে নিঃশব্দে রাস্তায় চলে আসে। মাথাটা ভীষণ ফাঁকা ফাঁকা লাগে তার। কোথাও একটা স্থবিরতা ভর করেছে। একসঙ্গে দুটি পাখি উড়ে যায় মাথার ওপর দিয়ে। হঠাৎ মিথিলার কথা ভাবনায় চলে আসে। তার মতো আন্তরিক মনের একটা বন্ধু আছে তারেকের, এই অনুভূতি তাকে ভালোলাগায় আপ্লুত করে; কিন্তু পারিবারিক দৈন্য বেশিরভাগ সময়ই সেই অনুভূতিকে স্তিমিত করে দেয়।

ভোরবেলায় বিছানা ছাড়ে তারেক। এত সকালেও মা রুটি সবজি ও ডিমের ওমলেট করেছেন। নাস্তা সেরে সে বেরিয়ে যায়। সকাল ৮টায় ট্রেন। স্টেশনে পা রাখতেই শরীর-মনে দারুণ শিহরণ হয়। মোবাইল বের করে সময় দেখে, সাতটা পঞ্চাশ। 

হাতে কিছু জমানো ছিল। দুটি টিউশনি থেকে বেতনের টাকা পেয়ে পকেট পরিতৃপ্ত। পরে আর অমত করতে পারেনি তারেক। সে দেখল, দলের সবাই লাগেজ নিয়ে ট্রেনে উঠছে। ট্রেনের হাতল ধরে কম্পার্টমেন্টে ঢুকতেই মিথিলা হাসিমুখে হাত নাড়ে। পিঠের ব্যাগটা না খুলেই বসে পড়ে মিথিলার মুখোমুখি সিটে। ট্রেন হুইসেল বাজায়। খানিক পরেই ছেড়ে যাবে। 

কী যেন একটা গুরুত্বপূর্ণ কাজ ফেলে এসেছে প্ল্যাটফরমে, এমন ভঙ্গিতে ‘আসছি’ বলেই তারেক দরজার দিকে এগিয়ে যায়। ট্রেন থেকে নামে। বন্ধুরা ডাকে, এখন আর নামিস না। ট্রেন ছেড়ে দেবে। তারেক দ্রুত ঘাড় ফিরিয়ে বলে, এক মিনিট। 

ট্রেন থেকে নেমে তারেক আর একবার ঘড়ি দেখে; সাতটা আটান্ন। সে প্ল্যাটফরম ধরে হাঁটতে হাঁটতে একটা থামের আড়ালে দাঁড়ায়। ট্রেন দুলে ওঠে। ধীরলয়ে ট্রেন চলতে শুরু করে। বন্ধুদের কেউ কেউ জানালা দিয়ে মুখ বের করে ওর নাম ধরে ডাকে। তারেক চোখ বন্ধ করে মূর্তির মতো দাঁড়িয়ে থাকে। একসময় প্ল্যাটফরম থেকে ট্রেনটা আর দেখা যায় না। 

থামের আড়াল থেকে বেরিয়ে এসে তারেক বুকভরে নিঃশ্বাস নেয়। তার মুখ শুকিয়ে আসে, তৃষ্ণা পায়; কিন্তু মনের কোথাও সে পুলক অনুভব করে।

মৃদুপায়ে হেঁটে স্টেশনের বাইরে আসে তারেক। হাঁটতে থাকে। মিনিট পঁচিশ হেঁটে সে বড়বাজারে এসে ঢোকে। মনে মনে একটা তালিকা মিলিয়ে নেয়। একে একে কিনতে শুরু করে বড় দুটি রুই মাছ, মাংশ, পোলাওয়ের চাল, বাদাম-কিসমিস, সেমাই ও দুধ, মুগডাল, মশলা, আদা-রসুন-পেঁয়াজ, ভালো দই ও মিষ্টি; মা ও বাবার শাড়ি ও লুঙ্গি এবং বাড়ির প্রত্যেকের জন্য জামাকাপড়। কেনাকাটা শেষ করে যখন সে বাড়ির পথ ধরে, জিনিসপত্রের ভারে তার দুই হাত ছিড়ে যেতে চায়; কিন্তু তার মনের কোথাও একটা আলোর ফুল কুঁড়ি মেলতে থাকে। 

বাড়িতে ফিরে আসার পর, তাকে কেউ চেনে না, কোনোদিন দেখেনি; এমনই বিস্ময় ও হতবাক ভঙ্গি সবার চোখেমুখে দেখতে পায় তারেক। কিছুক্ষণ কেউই কোনো কথা বলতে পারে না; কিন্তু ভোরের সূর্যের কমলারঙের আলোর রেখার মতো আনন্দরেণু বাড়িময় ঝলমলিয়ে ওঠে।

সাম্প্রতিক দেশকাল ইউটিউব চ্যানেল সাবস্ক্রাইব করুন

মন্তব্য করুন

Epaper

সাপ্তাহিক সাম্প্রতিক দেশকাল ই-পেপার পড়তে ক্লিক করুন

Logo

ঠিকানা: ১০/২২ ইকবাল রোড, ব্লক এ, মোহাম্মদপুর, ঢাকা-১২০৭

© 2024 Shampratik Deshkal All Rights Reserved. Design & Developed By Root Soft Bangladesh

// //