জানালায় রোদ্দুর

মন ও মেজাজ দুটিই প্রচণ্ড খারাপ। মন খারাপ কারণ আমার কোভিড টেস্টের রিপোর্ট পজিটিভ এসেছে। আগে ছোটবেলায় পড়াশোনায় রেজাল্ট এ প্লাস পেলে যেমন খুশি হওয়ার ব্যাপার ছিল, করোনা টেস্টে পজিটিভ আসা মানে ততটাই দুঃখজনক।

যাই হোক, মেজাজ খারাপের কারণ হলো, আগামী তিন সপ্তাহ আমাকে একটা রুমবন্দি আইসোলেশনে থাকতে হবে। খাঁচায় বন্দি পাখি যেমন ছটফট করে তেমনি কয়েক দিন ছটফট করতে হবে আমারও। এটা ভেবেই মেজাজ সপ্তমে চড়ে যাচ্ছে। নিজেই নিজের চুল ছিঁড়তে মন চাইছে, কী দরকার ছিল এরকম একটি অনিশ্চিত সময়ে ঢ্যাং ঢ্যাং করে বন্ধুদের সঙ্গে আশুলিয়ায় ঘুরতে যাওয়ার! এখন বোঝ ঠ্যালা। এই অদৃশ্য ভাইরাস কার মাধ্যমে কখন, কোথায় ছড়াচ্ছে কেউ জানে না। তবুও আমরা একটু ভয় পাই না। বেপরোয়া ছুটে চলি অসুখকে আলিঙ্গন করতে। আমাদের ১২শ’ স্কয়ার ফিট ঘরের একদম দক্ষিণ দিকের একটা রুম দেওয়া হলো আমাকে আইসোলেশনের জন্য। রুমটা অতিথিদের জন্য, তাই এদিকে কখনো থাকা হয়নি। বেশ ছোট রুমটা। আট ফিট বাই দশ ফিট হবে বড়জোড়। একটা জানালা আছে শুধু রুমের দক্ষিণ পার্শ্বে। আর একটা লাগোয়া বাথরুম। আমি এই কয় দিনেই হাঁপিয়ে উঠেছি, এত লম্বা সময় এই একটা রুমে কীভাবে আইসোলেশনে থাকব সেটাই বুঝতে পারছি না। জানালার পর্দাটা সরিয়ে দিলাম। আমার এই জানালা বরাবর মুখোমুখি পাশের বিল্ডিংয়ের বারান্দাটা। ছয় ফিটের মতো দূরত্ব হবে হয়তো মাঝামাঝি দুটি বিল্ডিংয়ের। ছোট্ট বারান্দা। ঢাকা শহরের বিল্ডিংগুলো কেমন যেন একে অপরের গায়ে গা লাগিয়ে বানানো, মনে হয় যেন পরমাত্মীয় অথচ প্রতিটা ঘরের বাসিন্দা একে অপরের কাছে অচেনা, অপরিচিতই থেকে যায় অনেকাংশেই। কারও সঙ্গে কোনো সৌহার্দ্যপূর্ণ সম্পর্ক তো দূরে থাক, প্রতিটি ঘরের বাসিন্দা যেন আলাদা একেক খাঁচার বাসিন্দা। আমার এই জানালা মুখোমুখি এই বারান্দাওলা ফ্ল্যাটে একজন বৃদ্ধ দম্পতি থাকতেন শুনেছি। আগে দেখেছি খুব সুন্দর ঝুল বাগানও করেছিলেন এই ছোট্ট বারান্দায়; কিন্তু গত মাসে বৃদ্ধা মহিলা হঠাৎ করোনা আক্রান্ত হয়ে মারা যাওয়াতে বৃদ্ধ তার বড় সন্তানের কাছে চলে গেছেন। এতদিন জানতাম ফ্ল্যাটটা ফাঁকা পড়ে আছে, তবে আজকে এই বারান্দা দেখে মনে হচ্ছে নতুন কোনো ভাড়াটিয়া এসেছে। বারান্দায় কয়েকটা অর্কিডের টব ঝুলানো আর একটা উউন্ডচাইম ঝুলানো।

বারান্দা থেকে চোখ সরিয়ে নিজের ভাবনায় ফিরলাম। আমি রায়না চৌধুরী। পড়াশোনা করছি বিবিএ, একটা প্রাইভেট ইউনিভার্সিটিতে। টুকটাক অভিনয়ও করছি টেলিভিশনে। আমার নাটকগুলোর আজকাল বেশ দর্শকও বাড়ছে। রাস্তাঘাটে লোকজন একবার দেখেই আমাকে চিনে ফেলছে সেটাও বেশ মজার। এখন করোনা বাঁধিয়ে গৃহবন্দি, কীভাবে এই দীর্ঘ গৃহবন্দি সময় পার করব ভাবছি। মনে মনে কিছু প্ল্যান বানিয়ে ফেললাম। নেটফ্লিক্সে কিছু নতুন মুভি দেখে ফেলব, এবারের বইমেলায় কেনা বইগুলোও পড়ে ফেলব আশা করি। সেই তালিকায় অনেক প্রিয় লেখকের বইয়ের তালিকাও আছে। হারুকি মুরাকামি, সুনীল, শীর্ষেন্দু, বিভূতিভূষণ, হুমায়ূন আহমেদের বইও আছে তালিকায়। যাই হোক, করোনাবন্দি লকডাউন সময়টা হয়তো খুব বেশি খারাপ যাবে না। বাসায় ষাটোর্ধ্ব বাবা ও মায়ের শরীরের স্বাস্থ্য সুরক্ষার জন্য হলেও এটুকু নিয়মের কষ্ট মেনে নিতেই হবে। যদিও আমার মধ্যে করোনা উপসর্গগুলো খুব বেশি জোরালো নয়, তবুও গতকাল রাতে একটু জ্বর আসাতে সন্দিহান হয়ে নিজেই নিজেকে নিশ্ছিদ্রি কক্ষবন্দি করলাম। সাবধানের মার নেই। গুনগুন করে একটা ঝুমুর গান গাইছিলাম আপন মনে- ‘কালো জলে কুচলা তলে/ডুবল সনাতন/আইজ সারা না, কাইল সারা না/পাই যে দরসন।’

জানালা দিয়ে হঠাৎ হাততালি বেজে উঠল মনে হলো। উঁকি দিলাম জানালা দিয়ে। দেখি ওপাশের বারান্দায় উশকোখুশকো লম্বা চুলের এক সুদর্শন যুবক বসে আছে। আমি জানালায় উঁকি দিতেই হাসি মুখে সম্ভাষণ জানিয়ে যুবকটি বলল- ‘বাহ্ বেশ ভালোই সুর আছে গলায়। শিখছেন কোথাও?’

আমি মাথা নেড়ে না বোধক উত্তর দিয়ে বললাম- ‘না এমনি বাথরুম সিঙ্গার।’

যুবকটি চোখ বড় করে তাকিয়ে কৌতুক করে বলল- ‘এহ্ যা। আমি তো বারান্দায় দাঁড়িয়ে শুনে ফেললাম বাথরুম সিঙ্গারের গান!’

আমি অজান্তে হো হো করে জোরে হেসে ফেললাম। পরক্ষণেই লজ্জা পেয়ে হাসি থামাতেই যুবকটি বলে উঠল- ‘গানের সুরের মতো আপনার হাসিও সুরেলা।’

আমি আরও লজ্জা পেয়ে জানালার পর্দাটা টেনে দিলাম। যুবকটি কি মনে করল কে জানে! নিজের ভিতর অপরাধবোধের পোকাটা কিলবিল করে নড়তে শুরু করল। কেন এমন হুট করে কিছু না বলে মুখের ওপর পর্দা টেনে দিলাম, ঠিক হলো না! সন্ধ্যা পর্যন্ত অপেক্ষায় রইলাম। যুবকটি ঠিক সন্ধ্যা নামার আগে আগুনরঙা আকাশের আলো নিয়ে যেন বারান্দায় এলো। যুবকটিকে আরও সতেজ, সপ্রতিভ লাগছে। গায়ে একটা হাল্কা নীলরঙা শার্ট।

আমি টুক করে জানালার পর্দাটা সরিয়ে একটু উঁচু স্বরেই বললাম যাতে শুনতে পায়- ‘আই অ্যাম সরি।’

যুবকটি তার হাতের গিটারটা মুছতে মুছতে আমার দিকে না তাকিয়েই বলল- ‘ফর হোয়াট?’

আমি কাঁচুমাচু স্বরে বললাম- ‘ওই যে সকালে আপনার মুখের ওপর পর্দা টেনে দিয়েছিলাম।’

যুবকটি যেন ঝনঝন করে হেসে উঠল তার হাতের গিটারের মত, ‘আরে ধূর, এটা কোন ব্যাপার হলো! তা আর কতদিন থাকতে হবে আইসোলেশনে?’

আমার চোখজোড়া ক্রমেই বিস্ফোরিত হতে নিতেই, যুবকটি মৃদু হেসে বলল- ‘করোনাকাল চলছে। সবাই আক্রান্ত কমবেশি। এই ভবিষ্যদ্বাণী তেমন কঠিন কিছু না। আমি নিজেও এই অদৃশ্য জীবাণুর সঙ্গে যুদ্ধ করছি কদিন হলো।’ কথাগুলো নির্বিকার বলেই ফস করে একটা সিগারেট ধরাল যুবকটি।

‘কিন্তু...আপনি সিগারেট ধরালেন যে...‘বলতে নিতেই দেখলাম যুবকটি ভিতরে চলে গেল, বলতে আর পারলাম না। যুবকটি নিশ্চয়ই আমাকে এক ঝলক দেখায় চিনতে পারেনি। হয়তো খুব একটা আজকালকার বাংলা নাটক দেখে না, এ জন্য চিনেনি। মনে মনে কিছুটা হাঁফ ছেড়ে বাঁচলাম। সারাক্ষণ পরিচিত মানুষের ভিড়ে মিথ্যে রঙিন মুখোশ পরে থাকতে ভালো লাগে না।

কংক্রিটের জানালার গ্রিলের ফাঁক দিয়ে আকাশটাকে এক বিন্দু দেখার চেষ্টা করছি তাও হচ্ছে না। এই জানালা দিয়ে আকাশ একদমই দেখা যায় না। পাশাপাশি বিল্ডিংগুলো গায়ে গা এলিয়ে দাঁড়ানো। আগুনরঙা সন্ধ্যাটা শুধু আভা দেখিয়েই বিদায় নিল অন্ধকার রাতের বুকে। জানালার থাই গ্লাস বন্ধ করে এসে বিছানায় শুয়ে রইলাম। আগামী কয়েকটা দিন নিজের কাছে পড়ে থাকতে হবে। কেউ আসবে না কাছে। অদ্ভুত অদৃশ্য এই জীবাণুর শক্তি, প্রিয় মানুষকেও দূরে ঠেলে দেয় এক নিমিষে। তবে নিজের কাছে পড়ে থাকার একটা সুবিধা আছে, নিজেকে জানা যায় নতুন করে। সিলিংয়ে ফ্যানটার দিকে এক দৃষ্টে তাকিয়ে আছি। প্রতিদিন কত মৃত্যুর খবর আসছে। কত পরিবার এই করোনায় প্রিয়জন হারিয়েছে। পৃথিবী থমকে আছে, সময় থমকে আছে এই চার দেয়ালের ভেতর।

হঠাৎ জানালার গ্লাসে একটা ইট পড়ল বুঝি, শব্দের চমকে ফ্যানের দিকে তাকিয়ে থাকা ঘোর ভাঙল।

জানালার থাই গ্লাস খুলে পর্দা সরিয়ে দেখি যুবকটি বারান্দায়। আমাকে দেখে মুচকি হেসে বলল- ‘একা বোর লাগছিল, তাই একটা পাটকেল ছুঁড়লাম তোমার জানালায়। বিষয়টা বেশ মজার!’

‘কেমন?’- আমি প্রশ্ন নিয়ে তাকালাম।

‘এই যে, তোমার সঙ্গে আমার পরিচয় নেই। জানাশোনা নেই, করোনা আমাদের একাকীত্বকে এক করে দিল, ইন্টারেস্টিং না? আমি পাটকেল ছুড়লাম, তুমি চাইলে ঢিলও মারতে পারো।’ বলেই যুবকটি জোরে হাসতে লাগল। অদ্ভুত একটা মায়া সে হাসির মধ্যে। লম্বা চুল আর রাতের আলো-আঁধারির মায়ায় বেশ আকর্ষণীয় লাগছিল মানুষটিকে।

‘হুম।’ আমিও মাথা নেড়ে সায় দিয়ে জিজ্ঞেস করলাম,

 ‘কদিন হলো এসেছেন এই বাসায়?’

যুবকটি হঠাৎ মাথা চুলকে উত্তর দিল- ‘গত কয়েক দিন হবে হয়তো।’

আমি একটু দুষ্টুমির সুরে গলার স্বর নামিয়ে বললাম- ‘নেশাটেশা করেন নাকি? কদিন হল এসেছেন, ভুলে গেলেন? নাকি করোনা ভুলিয়ে দিল?’

কোনো উত্তর এলো না মানুষটার কাছ থেকে। পাল্টা প্রশ্ন ছুড়লাম,‘কি নাম আপনার, কি করেন?’

‘অংক। জীবনের অংক করি।’

‘যাহ, দুষ্টুমি করছেন।’

‘বাবা অংকের টিচার ছিল, তাই অংক নাম রেখেছে। এখন জন্ম হলে হয়ত কোভিড রাখত!’

হো হো করে হেসে উঠলাম।

‘আপনার সেন্স অব হিউমার ভালো। আমার পছন্দ হল। আসলেই আপনার নাম কী? বলুন না।’

‘নাম দিয়ে কি মানুষ যাচাই করা যায়?’ খুব তীক্ষ্ণ শোনাল কথাটা।

আমি চুপ করে গেলাম। এই কথার কোন উত্তর আমার জানা নেই। মানুষটা একটু ভিন্ন। নিশ্চয়ই সোশ্যাল মিডিয়ায়ও ব্যবহার করেন না। ফেসবুক, ইনস্টাগ্রাম থাকলে অন্তত আমার মত কিঞ্চিৎ বিখ্যাত এ সময়ের অভিনেত্রীকে এক দেখাতে চিনে নিত, কিংবা অটোগ্রাফ বা ফটোগ্রাফ নেয়ার জন্য ব্যতিব্যস্ত হয়ে পড়ত গ্রিলের ওই পাশ থেকেই। মানুষটা সেটা করেননি। অথবা মানুষ পরিচয়ই হয়তো বড় এই মানুষটার কাছে। নাম, যশ, খ্যাতি কিছুই হয়ত তার কাছে প্রধান নয়। মনে মনে বেশ আশ্বস্ত হলাম, মানুষটা আমার মিথ্যে রঙিন মানুষটাকে চিনেনি।

‘এই ধরো তোমার নাম আমি জানি না, কিন্তু গতকাল থেকে তুমি আমার কাছে চন্দ্রমানবী।’

‘কেন?’-খুব অবাক হয়ে প্রশ্ন করলাম।

‘জানি না। তোমাকে দেখে মনে হল তুমি চাঁদের মতো সুন্দর তাই তুমি চন্দ্রমানবী। পৃথিবীতে এমন অনেক কিছুই ঘটে যার কোনো ব্যাখ্যা নেই। যেমন এই যে একটু আগে তোমার জানালায় পাটকেলটি ছুড়ে মারলাম, সেটারো কোনো কারণ নেই।’

‘আপনি অদ্ভুত!’

‘হা হা। চল তাহলে অদ্ভুত শুভরাত্রি বলে বিদায় নেই।’ বলেই মানুষটা তার রুমে চলে গেল। বাতাসের হাল্কা দোলায় বারান্দার উইন্ডচাইমটা টুংটাং বেজে উঠল। বাতাসে মানুষটার গন্ধও যেন মিলিয়ে গেল।

পরের দিন সকালে ঘুম ভাঙতেই জানালা খুলে দেখি যুবকটি এক কাপ ধোঁয়া ওঠা চা হাতে দাঁড়িয়ে সিগারেট ফুঁকছে। আমি জানি উনার নাম অংক নয়, ইচ্ছে করে বলছেন না। গলা খাকারি দিয়ে জানান দিলাম আমার উপস্থিতি। বললাম- ‘এ কয়টা দিন করোনার ভয়ে ধূমপানে বিরতি দিলে হয় না বুঝি?’

নির্বিকার সিগারেট টেনেই চলেছে মানুষটি। আমার কথায় কোনো রা নেই যেন। সিগারেটটা নিভিয়ে ফেলে দিয়ে আমার দিকে তাকিয়ে হঠাৎ বলে উঠল- ‘জীবনের কোনো গ্যারান্টি আছে? কাল আছি কি নেই! আমি আজকের মুহূর্ত একদম মিস করতে রাজি না!’

‘কিন্তু একটু সচেতনতা আগামির দিনকে একটু নিশ্চয়তা দিত তা নয় কি!’ আমার কথাটা বেশ ভারিক্কীই শোনাল।

‘বইয়ের কথা আমার একদম পছন্দ না। আমি জীবনের কথা শুনি। আমার কথা শুনতে নিরস লাগতে পারে, কিন্তু আমি এমনই। তোমার কোভিড অবস্থা কি এখন?’ হাতের কাপের চায়ে চুমুক দিয়ে বলল কথাটা যুবক।

‘বিভিন্ন টেস্ট করিয়েছি। রিপোর্ট ঠিকঠাক আছে। এখন শুধু অপেক্ষা। খুব একটা দুর্বলতা নেই তবে ঘ্রাণ নেই একদম। কি যে বিচ্ছিরি অভিজ্ঞতা! ঘ্রাণ ছাড়া পুরো দুনিয়াটাই অসাড়, নির্জীব লাগে।’

‘হুম। ঘ্রাণ ছাড়া ভালোবাসাও নিষ্প্রাণ, নির্জীব।’

লাইনটা বলেই যেন যুবক থ মেরে তাকিয়ে রইল উইন্ডচাইমের দিকে।

কিছুটা অপ্রস্তুত হলাম। মানুষটার দিকে মনোযোগ ফিরাতেই দেখি গিটার হাতে বারান্দার এক কোণায় বসে পড়েছে। গিটারের কর্ডে একটা সুর বাজছে। এলভিস প্রিসলির বিখ্যাত গান, ফর আই ক্যান্ট হেল্প ফলিং ইন লাভ উইদ ইউ।

গানের সুরের মূর্ছনা থামাতে ইচ্ছে করল না। তাই চুপচাপ বিদায় নিলাম। গান চলছে। আমি আমার জানালার পাশে চুপটি করে শুয়ে গিটারের মূর্ছনা শুনেই চলেছি। পুরো দুনিয়া দরজার বাইরে। আমার দুনিয়া এখন শুধু এই জানালার পাশেই জমাটবদ্ধ। ভালোই লাগছে এই পূর্ণ একাকীত্বে কারও নিঃশব্দ অবস্থান।

কদিন এভাবেই দুজনার নিঃশব্দ বন্ধুত্বের আনাগোনা চলল। বিকেল হলে আমি অপেক্ষা করি, আমার ধারণা মানুষটিও আমার জন্য অপেক্ষা করে। করোনার নেগেটিভ রিপোর্ট না আসাঅবধি এই যে নিশ্ছিদ্রি কক্ষবন্দি দীর্ঘ অপেক্ষার পালা, এই অপেক্ষার মুহূর্ত গুলোকে প্রাঞ্জল ও চঞ্চল করে দিয়েছে বিপরীত বারান্দার অচেনা মানুষটি। আমি খুব গোপনে তার নাম দিয়েছি ‘আকাশ’। আমি এই বন্দি সময়ে আকাশ দেখতে পাইনি। মানুষটিই আমার একদিনের খোলা আকাশ।

আজ বিকেলে একটা অদ্ভুত ঘটনা ঘটল। আমার লকডাউনের গৃহবন্দি সময়সীমা প্রায় শেষ হয়ে এসেছে। সেই খুশিতে নীল রঙের একটা শাড়ি পড়েছি, চোখে কাজল দিয়েছি, একটা ছোট্ট কালো টিপও পরেছি। বার বার জানালা দিয়ে উঁকি মেরে লক্ষ করছিলাম আমার আকাশটা বারান্দায় এল কি না!

হঠাৎ টুপ করে আমার রুমের মেঝেতে ঝনঝন করে পড়ল কী যেন। খুলে দেখি একটা কাগজের ঠোঙ্গার ভিতর একটা রুপার পায়েল, শুধু এক পায়ের। আমি ঠিক বুঝতে পারছি, বারান্দা বরাবরই কেউ নূপুরটি ছুঁড়ে মেরেছে তারমানে আকাশই ছুঁড়ে মেরেছে। খুশিতে কেমন যেন গদগদ হয়ে গেলাম। হঠাৎ তীব্র কাশির শব্দ শুনে জানালা বরাবর তাকিয়ে দেখি মানুষটা বিধ্বস্ত চেহারা নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। চেহারাটা দেখেই ধক করে উঠল বুকের ভেতরটা। মানুষটা এ কয়েকটা দিনেই আত্মার কেমন আপন হয়ে উঠেছে। কিছু সম্পর্কের মায়া ব্যাখ্যার উর্ধ্বে থাকে, মানুষটার জন্য এক পলকের প্রতিদিনকার প্রতীক্ষা বুকের ভিতর জায়গা করে নিয়েছে, এটা অনস্বীকার্য।

‘এত কাশি কেন হলো আপনার? এত যে বলি সিগারেটটা খাইয়েন না কিছু দিন, শুনেন তো না।’ গরগর করে এক নিমিষে রাগের বহিঃপ্রকাশ করলাম।

মানুষটা শুধু মুচকি হাসল; কিন্তু কিছু বলল না। কিছুক্ষণ পর আমার দিকে ভালোমতন লক্ষ্য করে বলল- ‘বাহ্, নীল শাড়িতে তোমাকে খুব সুন্দর লাগছে তো। আজকেই তোমার জন্য একটা কবিতা লেখা উচিত, নয়তো তোমার প্রতি অন্যায় হয়ে যাবে।’

আমি অবাক হয়ে প্রশ্ন করলাম-‘কেন?’

মুচকি হেসে মানুষটা শুধু বলল-

“শুধুমাত্র কবি জানে-

অপরূপ কবিতার মানে

কবিতা কাছে দিলে ধরা

আগলে নিতে হয় প্রাণে।”

আমি ঠাট্টা করে বললাম- ‘আপনি কি কবি?’

সে শুধু মৃদু হেসে উত্তর দিল- ‘জীবনটাই একটা কবিতা। যে জীবন বয়ে যায় নিরবধি, সে তো অগোচরেই এক কবি।’

মাথামুণ্ডু কিছুই বুঝিনি, কিন্তু প্রচন্ড ভালোলাগার এক জোরালো দমকা বাতাস যেন আমার মনের উপর দিয়ে বয়ে গিয়েছিল। টের পেয়েছি। প্রেম কড়া নাড়লে, টের পায় মন। প্রেম হারিয়ে গেলেও, শূন্যতা বোঝে মন।

সন্ধ্যায় জানালা খোলাই রেখেছিলাম যাতে মানুষটার নিঃশব্দ অবস্থানের অনুভব যেন আমার পাশেই থাকে। হঠাৎ টুপ করে আরেকটা চিরকুট এসে পড়ল পায়ে। মানুষটাই ছুড়ে মেরেছে। চিরকুটটা খুললাম। চিরকুটে লেখা-

‘‘বিকেলের নূপুরটা পারলে পরবে পায়ে। যদিও ওটা তোমার জন্য কিনিনি। সত্যিটা বললে কষ্ট পেয়ো না, সত্য সবসময় ক্ষুরধার, আমি তবু সত্যিটাই বলব। কেন জানি মনে হচ্ছে, আমার হাতে আর সময় নেই। নিঃশ্বাস বন্ধ হয়ে আসছে যেন। কাল থেকে অক্সিজেন লেভেল নিচে নেমে যাচ্ছে। আমার নিঃশ্বাস মনে হয় না কেউ ফিরিয়ে দিতে পারবে। এই নূপুরটা আমার প্রেমিকার জন্য কিনেছিলাম। লকডাউনে আটকা পড়ে আর দেখা হয়নি। শেষ দেখাটাও না। করোনা কিন্তু খুব নিষ্ঠুর। ভালোবাসাও কেড়ে নেয়, ভালোবাসার নিঃশ্বাসও। নীরাকে আর দেখিনি, তাকেও করোনা কেড়ে নিয়েছে। তার জন্য কিনে ছিলাম নূপুরটা, দেয়া হয়নি আর; কিন্তু কদিন ধরে তোমাকে নূপুরটা দিতে খুব ইচ্ছে করছে। বাঁচি মরি তার কোনো ঠিক নেই। নূপুরটা তোমার পায়েই থাক। ইচ্ছেটুকু অন্তত বেঁচে থাক।

একটা স্মৃতি অন্তত থাক। করোনা সব কেড়ে না নিক।”

ইতি

তোমার অপরিচিত বারান্দার প্রতিবেশী

ধক করে উঠল বুকে। জানালায় তাকিয়ে খুঁজলাম বেশ অনেকক্ষণ মানুষটাকে। পেলাম না। মানুষটা রাতেও এলো না বারান্দায়।

পরদিন ঘুম ভেঙে জানালার পাশে বসেই রইলাম। বারান্দাটা খালি। কয়েকবার কাগজের ঢিল বানিয়ে বারান্দায় ছুড়েও মারলাম। কারও কোনো সাড়া শব্দ নেই। মনের মধ্যে কেমন যেন আশঙ্কার দামামা বাজতে শুরু করেছে, তবে কী মানুষটা হারিয়ে গেল! সারা রাত ঘুমাতে পারলাম না। আজ আমার কোভিড লকডাউনের ২১তম দিন। রিপোর্টও নেগেটিভ এসেছে, অথচ আমার ভেতরে মুক্তির আনন্দ নেই, অজানা আশঙ্কার উইন্ডচাইমটা দুলছে।

রুম থেকে বের হয়েই দারোয়ানকে দিয়ে পাশের বিল্ডিংয়ের ৪র্থ তলার বাসিন্দাদের খোঁজ নিতে পাঠালাম, করোনা রোগী কেউ কি হাসপাতালে আছেন কি না।

দারোয়ান খুব নির্বিকার এসে জানাল- ‘আপা, আপনাদের জানালা বরাবর যেই লোকটা থাকত উনি গতকালকে হাসপাতালে করোনায় মারা গেছে। হেরা এই মাসেই এই বিল্ডিংয়ে উঠছিল।’

আমি কিছুই বলতে পারছি না। নিঃশব্দ কান্না গলা চেপে ধরেছে। ধীর পায়ে আমার রুমে ফিরে এলাম। জানালার পর্দা টেনে খুলে দিলাম যাতে স্পষ্ট দেখা যায় বারান্দাটা। টেবিলের ওপর রাখা ছিল নূপুরটা। বাম পায়ে পরলাম। টুপ করে এক ফোঁটা অশ্রু পায়ের ওপর পড়ল।

করোনা সত্যি নিষ্ঠুর, খুব নিষ্ঠুর।

সাম্প্রতিক দেশকাল ইউটিউব চ্যানেল সাবস্ক্রাইব করুন

মন্তব্য করুন

Epaper

সাপ্তাহিক সাম্প্রতিক দেশকাল ই-পেপার পড়তে ক্লিক করুন

Logo

ঠিকানা: ১০/২২ ইকবাল রোড, ব্লক এ, মোহাম্মদপুর, ঢাকা-১২০৭

© 2024 Shampratik Deshkal All Rights Reserved. Design & Developed By Root Soft Bangladesh

// //