অপদখল

তিনু মিজির ঠ্যাটা ছেলে কোব্বাত আলী। বাপ-বংশের নাম ডুবিয়ে একদিন হঠাৎ গায়েব হয়ে গেল। সেদিনই গাঁয়ের লোকে তার অভাব বুঝতে পারলো। বাপ তো এক পাক্কা পয়গম্বর। সাংসারিক মোহ ছেড়ে এবাদত বন্দেগীতে মশগুল থাকেন দিনরাত। নরম গোছের নির্বিবাদী মানুষটি মরুভূমির কোনো এক দেশে যৌবন কাটিয়েছেন বহুদিন। খেজুরের বাগানে পানি ঢেলে আর উটের সেবা করে শেষ জীবনে দেশে ফিরে এসেছেন বেশভুষা পাল্টে। গায়ে সাদা আলখাল্লা, বুক পর্যন্ত কাঁচা-পাকা ফিনফিনে দাড়ি আর মাথায় সবুজ পাগড়িবাঁধা খাঁটি দেহাতি আদম এখন তিনি। 

মসজিদের খাদেম থেকে যেদিন ইমামতির দায়িত্ব নিলেন, সেদিন থেকেই তিনু মিজিরের এই লেবাস আরও স্থায়ী হলো। আর হবেই বা না কেন? মরুর দেশে মেহনতের তিল তিল জমানো পয়সা আর কিছু এদিক ওদিক থেকে ধার-দেনা করা টাকায় হজ সারলেন বছর দেড়েক আগে। হাজি হয়ে ফেরত আসার পরে গাঁয়ের সবাই মিলে বাজারের ছাপরা মসজিদে তার ইমামতির বিষয়টি পাকা সাব্যস্ত করল। তখনই তিনি বুঝলেন এ তার ওপরওয়ালার খাস ইশারা।

আর ওদিকে কোব্বাত আলী? চতুর লাফাঙ্গা একটা। গড়নে পাতলা ছিপছিপে হলে কী হবে, কথায় তুবড়ি ছোটা পালোয়ান। তখন মুরব্বি গণ্য-গণনা তার হিসাবের মধ্যে থাকে না। কোব্বাত আলী যেদিন গায়েব হয়ে গেল তিনু মিজি প্রথমে ব্যাপারটা আমলে নেননি। পরে একবার মনে হয়েছিল, যাক, বুক থেকে বোধহয় একটা কঠিন বোবা পাথর সরে গেল; কিন্তু অবুঝ বেগমের নীরব অশ্রুবর্ষণ ও অনবরত আহাজারি উপলব্ধি করে উল্টো মনে হলো, না; বুকে আরও ভারী পাথরই চেপে বসল যেন। কিছু কিছু অটল পাথর আসলে বুকে বহন করে চলতেই হয় আজীবন। টানা দু’দিন বেগম রয়মননেসা খাওয়া-খাদ্য কিছুই গ্রহণ করলেন না। এক ফোঁটা পানিও নয়। এভাবে দুইদিন গত হলে কপালের কালচিটে জায়গায় চিন্তার রেখা আরও গাঢ় হয় তার।

ভাটিয়ালপুর গ্রামটি এ অঞ্চলে বেশ বর্ধিষ্ণু। মরুর দেশ থেকে হঠাৎ কাঁচা পয়সার আমদানি বেড়েছে। তার ছিটেফোঁটা এখন লাগতে শুরু করেছে বসবাসের পুরনো দালানগুলোতে। মক্তব-মসজিদগুলোকেও সে সুযোগে রেয়াত দেওয়া হয়নি। বাড়ির বহিরঙ্গের সাবেকি কাছারি ঘরগুলো সেজে উঠছে নতুন মক্তব হিসেবে। ধর্মচর্চার প্রবল জোশ জেগে উঠছে সবখানে। কোথাওবা মক্তব ভেঙে গড়ে উঠছে নতুন মাদ্রাসা কিংবা আলিশান কোনো মসজিদ। চুন-বালির পুরাতন পলেস্তারা খসে গিয়ে লাগছে চকচকে নতুন রঙ, কোথাওবা ঝকঝকে টাইলসের বেহিসাব আচ্ছাদন। 

বিষয়টি তিনু মিজিকেও ভীষণ চিন্তিত করে। এভাবে কি খোদার ঘরের আবাদ হয়? খেজুর পাতার মসজিদে কি আল্লাহর পেয়ারে নবী ইমামতি করেননি? সাহাবী ও মুমিন বান্দাগণ তাঁর পেছনে দাঁড়িয়ে সেখানে নামাজ আদায় করেননি? আজকালকার এই হুজুগে লেবাসের মানে বোঝেন না তিনি। খোদার ঘরের দখল নিয়ে গাঁয়ে যে রাজনীতি হয়, সেটাও তাকে কম্পিত করে। 

আল্লাহর ঘর জেয়ারত করে আসার পর তিনু মিজি সবকিছু নতুন করে ভাবেন। সে পুণ্যভূমির হাওয়া তাকে সারাক্ষণ আচ্ছন্ন করে রাখে। মানুষ কেন যে বোঝে না ইসরাফিল শিঙায় ফুঁক দিলে সব নিরর্থক। খান খান হয়ে ভেঙে পড়বে চকচকে সব মহল, বেশুমার রঙিন দালানকোঠা। সে জন্যই গত দু’বছরে তার কলবের গতিবিধি পাল্টে গেল আমূলভাবে। হাদিসে তফসির আয়ত্ত করে তিনি বিষয়গুলো ভেবেছেনও নতুন করে।

মাগরিবের পর এশার জামাত শেষে একবারে বের হন তিনি। মাঝখানের সময়টিতে জিকিরে ডুবে থাকেন। ঘরে বিবির অবস্থা বেশি ভালো নয়। তাই তার মধ্যে চাপা অস্থিরতা ভর করেছে। মসজিদের কাছে তাকে দেখেই হোসেন মিয়া জোর পায়ে এগিয়ে আসে। 

কোব্বাতের কোনো খোঁজ পাইছেননি হুজুর। আহা ছেলেটা! হঠাৎ এমনে গায়েব হই গেল।

তিনু মিজির তসবিহ ধরা হাতের সরু আঙুলগুলো জোরে জোরে কাঁপতে থাকে। তসবিহ্র গোটাগুলো দ্রুত গুনতে গুনতে মুখের বিড়বিড়ানিও বেড়ে যায়। হোসেন মিয়ার দরদকণ্ঠ থামে না। শত হইলেও আলেমের ছেলে। আমাদের তো একটা দায়িত্ব আছে। ছেলেটা মানুষ হইলো না একদম। তবু ভালা করি খোঁজ লাগান ইমাম সাব। যাইব আর কই? আছে হয়তো আশেপাশে কোনোখানে। 

তিনু মিজি একটা কথাও উচ্চারণ করেন না। হোসেন মিয়ার কথায় কর্ণপাত না করে ভাটিয়াল খালের দিকে তর্জনী উঁচিয়ে বলেন, খালের পাশে এত হাঙ্গামা কীসের হোসেন মিয়া? 

গেরামের ছেলেপেলেরা কী নিয়া যেন হাঙ্গামা কইরতেছে ওইদিকে। আপনে যাইবেননি হুজুর?

চলেন, দেখি আসি।

মসজিদের সরু রাস্তা থেকে বড় রাস্তায় ওঠার ঢালে দাঁড়িয়ে কথা হচ্ছিল হোসেন মিয়া আর তিনু মিজির। মসজিদ চাতালের আলো-অন্ধকার থেকে একসঙ্গে দুই জোড়া চোখ বাজারের আলোর দিকে তাকায়। তারপর দুই জোড়া পা অশেষ কৌতূহল নিয়ে সেদিকে গমন করে। মুহূর্তে তাদের শরীর-মন ইচ্ছা বা অনিচ্ছা সত্ত্বেও দুনিয়ার কোন্দলে মিশে যাবার অনুমতিপ্রাপ্ত হয়। সেখান থেকে তারা দু’জন এগিয়ে যায় টিনের সাইনবোর্ড ঝুলানো একটা রাজনৈতিক দলের অফিসের দিকে। মঙ্গল সাধুর চায়ের টঙঘরে বসে ছিল লিয়াকত। সেও এসে যুক্ত হয় ইমাম সাহেবের সঙ্গে। ইমাম সাহেবের থমথমে গম্ভীর মুখ দেখে গাঁয়ের বাতাসে ওড়া কোব্বাত আলীর নিখোঁজ হওয়ার টাটকা খবরটা সে চেপে যায়। 

গাঁয়ের ছোট্ট বাজার। ভাটিয়াল খাল ধরে ফিতার মতো লম্বা এ বাজারের নাম চান্দ্রা। ভাটিয়ালপুর আর চান্দ্রা গ্রামে দিন দিন অবস্থাপন্ন বিত্তশালী প্রবাসী মানুষের সংখ্যা বাড়ছে। তাদের অর্থে-বিত্তে বিস্তৃত মাঠে-ময়দানে মাথা ফুঁড়ে উঠছে বসবাসের দালানগৃহ। অথচ সে তুলনায় বাজারটার তেমন উন্নতি হলো না। দু’পাশে খেয়াল খুশিমতো দোকানঘর উঠেছে, নিয়মনীতির তোয়াক্কা না করে। মঙ্গল সাধুর দোকানঘর, নন্দলালের ছোট্ট স্বর্ণের দোকান, আলেপের গ্রামীণ ভাতের হোটেল এ সবকিছুই গড়ে উঠেছে সরকারি খাল দখল করে- খালের ওপর বাঁশ-বেড়ার অস্থায়ী মাচান বেঁধে। অনেক আগে থেকেই খালের পানিপ্রবাহ বন্ধ করে দিয়েছে তারা। সরকারি জায়গার অন্যায় দখলে যেন সকলের হক আছে।

বাজারের হৈ-হাঙ্গামা উপেক্ষা করে তিনু মিজি তসবিহ হাতে চুপচাপ দাঁড়িয়ে থাকেন। সদ্য গজিয়ে ওঠা অফিসঘর দেখে একবার মনে হয়, আগে কীসের যেন অস্থায়ী টঙ ছিল ওখানে। একটা অসম্পূর্ণ ভিত আর ভাঙা স্তম্ভ এতকিছুর ফাঁকেও নজরে আসে তার। সবই দখল পাল্টা দখলের খেলা। ইমাম সাহেবকে দেখে কয়েকজন হৈচৈ থামিয়ে দেয়। কেউ তখনো আলাপ চালিয়ে যায় নিচু স্বরে। এদের মধ্যে কয়েকজন আবার কোব্বাতের সঙ্গেই ঘোরাঘুরি করতো গাঁয়ের মধ্যে। কয়েকদিন হলো ছেলেটার কোনো খোঁজ নেই- অথচ এদের মধ্যেও কোনো ভাবান্তর নেই। এসব দেখে তিনু মিজির বিরক্তি গাঢ়তর হলে আস্তে আস্তে বাড়ির পথ ধরেন তিনি।

দুই. 
বেগম রয়মননেসা বেশ কিছুদিন ধরে খাওয়া-খাদ্য-পানি কিছুই প্রায় স্পর্শ করলেন না। অবশেষে তিনি শয্যাগত হলেন। গাঁয়ের সম্ভাব্য সব জায়গায় কোব্বাতকে খোঁজা হয়েছে। খবরটা ঝিমিয়ে পড়েছে অন্যান্য নতুন খবরের চাপায়। বাজারের আনাচ-কানাচ কোথাও এখন আর তাকে নিয়ে তেমন আলোচনা হয় না। প্রথম দিন খবরটা শুনে চোখ কপালে ওঠা মানুষগুলোর মধ্যে যেমন হা হুতাশ শুরু হয়েছিল, খুব দ্রুতই সে আলোচনায় ভাটা পড়ে গেল। তিনু মিজির আক্ষেপ একটাই। তিন মেয়ের পর এই ছেলেটাই ছিল বংশের বাতি জ্বালানোর শেষ অবলম্বন। অথচ সে তার ধার দিয়েই গেল না। সেই কিনা... ভাবতে ভাবতে দরজায় কড়া নাড়ার শব্দ হয়। 

জোহরের নামাজের পর আহারাদি সেরে একটু গা এলিয়ে বিছানায় পড়ে থাকেন তিনু মিজি। কখনো আশপাশের গাঁয়ে সুন্নতে খৎনা বা আকিকা-মিলাদের দাওয়াত থাকলে সেই আরাম ভোগ করা হয় না। আয়ু ফুরিয়ে আসছে- জীবনটাইবা আর ক দিনের? এদিকে একদিন দু’দিন করে প্রায় দু’মাস হলো ছেলেটারও কোনো হদিস নেই। 

খাটের শিথানের কাছে আধশোয়া থেকে উঠে বসেন তিনি। পা হাতড়ে চটিজোড়া পায়ে গলিয়ে দরজার দিকে এগিয়ে যান। আলিম তার সামনে দাঁড়িয়ে। বাজারের পোস্ট অফিসে কাজ করে। এই গাঁয়েরই ছেলে। হাতে একটা চিঠি গুঁজে সালাম ঠুকেই চলে যায় সে। যাওয়ার আগে বলে, চাচাজান... আপনের চিঠি। বিদেশের...।

তিনু মিজি অবাক হয়ে ভাবে, তাকে আবার চিঠি লিখবে কে? তাও আবার বিদেশ থেকে! ছোট মেয়ের জামাই মালয়েশিয়া থাকে। তার পরিবারে সম্পত্তির ভাগ-বাটোয়ারা নিয়ে দারুণ অশান্তি চলছে। পারিবারিক বণ্টকনামায় আপত্তি তুলে একটা বাটোয়ারা মামলাও বোধহয় ঠুকেছে জামাই আবদুর রবের বড়টা। গত শীতেও এই নিয়ে মেয়ের শ্বশুরালয়ে সালিশ-দরবার বসেছিল। ছোট মেয়ে সাফিয়া জানিয়েছিল, তিনি যেন দ্রুত সেখানে যান। এটা নিয়েই বিদেশে থাকা আবদুর রবের সঙ্গে তিনু মিজির ফোনে দু একবার কথাও হয়েছিল; কিন্তু, এবার কোনো ফোন না করে একেবারে চিঠি? খাম খুলে দেখেন তার জল্পনাই ঠিক। আব্দুর রবের গোটা গোটা হাতে লেখা সংক্ষিপ্ত চিঠি। 

শ্রদ্ধেয় আব্বাজান, 

আমার সালাম নেবেন। আশা করি শ্রদ্ধেয়া আম্মাজানসহ আল্লাহর অশেষ কৃপায় আপনারা বেশ কুশলেই আছেন। আপনি কোনো চিন্তা করবেন না। কোব্বাত আলী আমার কাছে আছে। এখানে তার একটা ব্যবস্থাও হয়েছে। সে আপাতত মন দিয়ে কাজ করছে। সামনের মাস থেকে কিছু কিছু করে টাকা পাঠানোর চেষ্টা করবে সে। খুব নগন্য পরিমাণে। আপনি সে টাকা দয়া করে গ্রহণ করবেন। তার খাস নিয়ত গ্রামে একটা মসজিদের কাজে যেন এ টাকা ব্যয় হয়। আপনার কাছে এটাই তার সবিশেষ আরজি। 


ইতি

আপনার কৃপাপ্রার্থী

আবদুর রব

কোব্বাত আলীর গায়েব হওয়ার দিনে তিনু মিজি একটু অবাকই হয়েছিলেন; কিন্তু চিঠি পড়ে হুঁশ হারানোর অবস্থা। ছেলেটা তার উড়নচী। গাঁয়ের রাজনীতি নিয়ে সারাদিন টইটই করে ঘুরে বেড়ালেও রাতে অন্তত শোয়ার জন্যে বাড়ি ফিরতো। অবশ্য মাঝে মাঝে যে আড্ডার চক্করে পড়ে বাড়ির বাইরে থাকেনি তাও নয়। উঠতি বয়সের ছেলেছোকরাসহ স্থানীয় রাজনীতির ডামাডোলে পড়লে এমন হালচালই হয়। 

চিঠি পড়া শেষ হলে তিনু মিজির সুরমা লাগানো চোখ জ্বালা করতে থাকে ভীষণ। কীভাবে এর মধ্যে এত কিছু ঘটে গেল! সকলের অগোচরে কীভাবে সে মালয়েশিয়ায় পাড়ি জমালো? টাকাই বা দিলো কে? পেছন থেকে কলকাঠি নেড়ে কেইবা তাকে সাহায্য সহযোগিতা করলো? সারাদুপুর গড়িয়ে বিকেল পর্যন্ত এমন হাজারো চিন্তা ঘুরপাক করতে থাকল তার মাথার মধ্যে। আসরের ওয়াক্তে তিনি মসজিদেই গেলেন না। ঘর অন্ধকার করে শুয়ে রইলেন মাগরিব পর্যন্ত। শেষে কাজা আদায় করে একবারে গেলেন এশার নামাজের ওয়াক্তে। তার দেরি দেখে মুয়াজ্জিন হাতেম ইমামতির কাজ সারলেন। পুরোটা সময় তিনি গভীরভাবে ভাবলেন। ভাগ্যের ওপর দোষ না চাপিয়ে মনে মনে নিজেকে অপরাধী করে খোদার লানত বর্ষণ করতে লাগলেন ইচ্ছামতো।

ঘটনার পেছনে অবশ্য আরও কিছু পূর্বঘটনা আছে। কোব্বাত আলী উঠতি বয়সের তরুণদের নিয়ে একসময় ইউনিয়নের রাজনীতি করে বেড়াত। বড় নেতাদের কাছে ধর্ণা দিয়ে কীভাবে যেন ছোট-খাটো ঠিকাদারির কাজ বাগিয়ে নিয়েছিল সে। একরোখা জীবনে পিতাকে কোনো কিছুতেই পরোয়া করতো না। শেষবার ইউনিয়ন পরিষদের বিনা ভোটের যুদ্ধে কাজ করে রাজনীতির বৃহৎ মাঠে যাওয়া-আসা শুরু করেছিল সে। সেভাবেই হয়তো ধীরে ধীরে টাকার সংস্থান হয়েছিল তার। অগত্যা এসব ভেবে নিজেই নিজেকে সান্ত্বনা দেন তিনু মিজি। 

রাতের খাবারের সময় বিবি রয়মননেসাকে বলেন, বেগম... কোব্বাত মিয়া ভালোই আছে। আপনের চিন্তার কোনো কারণ নাই। এইবার একটু দানা-পানি খান। নাইলে তো কঠিন বিমারে পইরবেন। 

শয্যাগত বিবি ফ্যালফ্যাল চেয়ে একবার ফুঁপিয়ে ওঠেন শুধু। তিনু মিজির শান্ত স্বর তার বুকে তীরের মতো বিঁধে।

ভাটিয়ালপুর গাঁয়ে কয়েক মাস অতিবাহিত হয়ে যায় এভাবে। স্থানীয় পোস্ট অফিস থেকে খবর আসে একদিন। সত্যি সত্যি মানি অর্ডার এসেছে- তিনু মিজির নামে। মালয়েশিয়ার ঠিকানা। খামের গায়ে ছোট জামাই আবদুর রবের নাম লেখা। টাকা তুলতে গিয়ে তিনু মিজির মন দ্বিধান্বিত। মনে মনে ভাবে, ছয় মাস হয়ে গেল প্রায়। কই? কোব্বাত তো একদিনের জন্যেও তার বা বিবি রয়মননেসার সঙ্গে কথা বলেনি। সে কোথাও গা ঢাকা দিয়ে নেই তো? আজকাল কত সুযোগ। ইউনিয়ন অফিস, বাজারের দোকান সবখান থেকেই বিদেশের সঙ্গে সরাসরি কথা বলা যায়।

ইউনিয়নের পার্টি অফিসখানা সরকারি খাল দখল করে অনেক আগেই দাঁড়িয়ে গেছে। মাসখানেক ধরে তার সংলগ্ন একটা মসজিদের পাকা ভিত উঠছিল ঠেলেঠুলে। সেটাও ওই খালের জায়গায়। সরকারি জায়গা থেকে মাঝে মাঝে উচ্ছেদ চললেও ধর্মীয় প্রতিষ্ঠান দেখে ফিরে যায় দলবল। 

একদিন এশার জামাত শেষে মসজিদের ভেতর তবলিগের আসর বসেছিল। সেখানে সবাই মিলে পরামর্শ রাখে নির্মীয়মান মসজিদখানার আরও জৌলুস বাড়িয়ে বড় করে তারা তৈরি করতে চায়। শুধু তাই নয়, আরব দেশের আদবকেতা তিনু মিজির চেয়ে আর কেউ ভালো জানে না। তাই সকলেরই ইচ্ছা, ঐ নতুন মসজিদের চার দেয়াল আর ছাদ উঠে গেলে আপাতত সেখানেই যেন ইমামতি শুরু করেন তিনি। কাজ সুসম্পন্ন হলে প্রয়োজনে বাজারের ছাপরা মসজিদের পুরনো ঘর ভেঙে ফেলে কিছু একটা ব্যবস্থা করা যাবে। এতে মসজিদের দেকভালের কাজটিও সহজ হবে। 

হোসেন মিয়া, লিয়াকত, জুলু গাজী অনেকেই এমন প্রস্তাব তোলে। তাদের অন্তরের নিয়ত তিনু মিজির কাছে পরিষ্কার। মসজিদের উসিলায় অনেক কাঁচা পয়সার আমদানি হবে। ওদিকেই সবার নজর তা তিনি বোঝেন। তবে সবচেয়ে জুতসই প্রস্তাব করে হোসেন মিয়া। 

বুইঝলেননি ইমাম সাব; সইত্য মিথ্যা জানি না, শুইনলাম কোব্বাত আলী মালোশিয়া গ্যাছে। আল্লাহর রহমতে সে নাকি ভালোই কামাই-রোজগার কইরতেছে। অন্যায়-অশান্তি তো আর কম করে নাই গেরামে। ট্যাকা-পয়সা নতুন মসজিদের কাজের পিছনে দান কইরলে গুনাহ-খাতা কিছু মাফ হইতেও পারে।

বাকিরাও সরবে সমর্থন জানায়। প্রস্তাবটা নেহাত মন্দ না হলেও তিনু মিজির ভেতরটা জ্বলে যায়। তিনি সহজে সায় দেন না। বলেন, শোনেন মিয়ারা। খোদার ঘর হালাল পয়সায় আবাদ হওয়া দরকার। আমার কোব্বাত আলী একটা অমানুষ। স্বয়ং খোদাই জানেন সে আছে কোনখানে। কোন পথে তার এই আয়-রোজগার। বাপ হিসাবে কইবার পারি খোদা তারে হেফাজতে রাখুক আর ভালা চিন্তা করার তওফিক দিক। তার পাঠানো ট্যাকায় আমার কোনো বিশ্বাস নাই।

এইটা কেমন কথা কন ইমাম সাব? বটতলার নিচে বইসা রাস্তা দিয়া যাওনের সময় মানুষের থিকা মসজিদের উন্নয়নে যেই ট্যাকা তোলে কিংবা জুমাবার বা ওয়াক্তিয়া নামাজে যেই ট্যাকা দানবাক্সে জমা পড়ে সেইটায় কি কিছু লেখা থাকে? এইটা বিচার করাও তো মুশকিল। ট্যাকার গায়ে তো আর লেখা থাকে না, কোনটা হালাল, কোনটা হারাম?

আরে মিয়া, আপনেরা ঈমান আর কোরআনের রসম থিকা দূরে সইরা গেছেন। খোদাপাকের হিদায়াতে কোনো কাজ হইতেছে না। দুনিয়াবির জৌলুস আর চাকচিক্যে ডুইবা আছেন সকলে। আমি আমার সাফ মতামত জানাইলাম। কোব্বাতের ট্যাকায় আমার আপত্তি আছে। খোদার রাস্তায় সব কাম সহিহ হওয়া উচিত। বাকিসব আপনাগোর ইচ্ছা।

কথা আর বেশিদূর এগোয় না। লিয়াকত বলে, আমরাই না হয় কোব্বাতের লগে যোগাযোগ করুম। গেরামে একখান ভালা মসজিদ হোক আমরা সবতেই চাই। মসজিদের গায়ে পাথর বইসব, ভিতরে ঠান্ডার ব্যবস্থা হইব, দামি লাইট ঝলমল কইরব সবই চাই আমরা।

তিনু মিজি এইবার উত্তেজিত হন। আরে মিয়া খোদার নবী যেই গুহায় ধ্যান কইরতো ওইখানে কি ঠান্ডা হাওয়া ছিল? না সেই পাহাড়ে উঠার সিঁড়ি ছিল? ওইটা তো ছিল আবার মরুর দেশ। নিজের আরামের কথা অত চিন্তা না কইরা ঈমানের বান মজবুত করেন মিয়ারা। দুনিয়াবির বাজে চিন্তা বাদ দেন। আর মসজিদ না, ইমান আকিদা শক্ত করেন। আমার এইসবে মত নাই। আমি পরিষ্কার জানায়া দিলাম।

তিন. 
চান্দ্রা বাজারের কোল ঘেঁষে রাতারাতি সুরম্য অট্টালিকার মতো মসজিদ দাঁড়িয়ে যায়। মানুষের দান-খয়রাত আর দুই গ্রামের বিত্তবান মানুষের কাঁচা পয়সার কেরামতি সকলেই দেখে। এত টাকা কোত্থেকে এলো বা কে দান করল তার হিসাব কোথাও লেখা ছিল না। মসজিদ হয়েছে এটাই গাঁয়ের মানুষের মধ্যে স্বস্তির খবর। তবে সেদিনের আলোচনার পর তিনু মিজি তার ইমান-আকিদা নিয়েই ব্যস্ত হয়ে পড়েন নিবিষ্টভাবে। ছেলে কোব্বাতের সঙ্গে দু’একবার কথা হলেও মসজিদের বিষয়ে তিনি কোনো উচ্চবাচ্য করেননি। 

মসজিদ নির্মাণ শেষে এবার উদ্বোধনের পালা। বিশাল এক পাথুরে ফলক প্রস্তুত। জামে মসজিদের নামখানাও হয়েছে খাসা। বায়তুল মামুর জামে মসজিদ ও এতিমখানা। ফলক ঢেকে একহাতি রেশমি লাল কাপড় ঝুলছে পতপত করে। বাতাসের কারণে আতরলাগানো মুসল্লিদের গা থেকে খোশ গন্ধ লুটিয়ে পড়ছে বাজারের ভিড়ে। মসজিদের পাশেই গায়ে লাগানো ইউনিয়নের সেই পার্টি অফিস। জবরদখলের দু’জনেই সাক্ষী। জুমাবার হলেও আনন্দের আতিশয্যে উচ্চস্বরে গান বাজছে সেখান থেকে।

তিনু মিজি সহজেই বুঝতে পারেন এই আনন্দের কারণ কী? ছেলেটা তার বহু আগেই দখল হয়ে গেছে। নতুবা আলেমের ঘরে এমন জালেম তৈরি হয় নাকি? তিনি ভারাক্রান্ত মন নিয়ে তার ছোট্ট ছাপরা মসজিদের দিকে এগিয়ে যেতে থাকেন। কয়েকজন উটকো ছেলে তার পথরোধ করে দাঁড়ায়। চাচা, আইজ ওই নতুন মসজিদে আপনার ইমামতি করা লাইগব। নামাজের পরে মসজিদের উদ্বোধন শেষে দোয়া পাঠ আছে। আপনি চলেন আমাদের সঙ্গে।

প্রতি জুমাবারের মতো খুৎবা শুরু হয়। মাইকের আওয়াজে আকাশ বাতাস প্রকম্পিত করে ধর্মীয় গুরুগম্ভীর বয়ান। সে বয়ান চলে অনেকক্ষণ। সকলের জবরদস্তিতে শেষে সেখানেই ইমামতির জন্য প্রস্তুত হন ভাটিয়ালপুর গাঁয়ের আরব দেশফেরত আলহাজ্ব তিনু মিজি। তিনি তার বয়ান শুরু করেন ধীরে ধীরে।

শোনেন, মুসুল্লিয়ান ইকরাম; আল্লাহর রাস্তায় নিজেরে নিয়োজিত করা সকল মুসলমান ও মুমিনের জইন্য ফরজ। আপনারা ঠিক কামখানাই কইরছেন; কিন্তু, ইসলামে বাজার হইতেছে সবচেয়ে খারাপ জায়গা। অথচ সেই বাজারের ওপরেই খাল দখল কইরা আপনেরা খোদার ঘরের আবাদ কইরলেন। পাক-নাপাক নানান মানুষের জমায়েত হয় এই বাজারে। আমাদের নবীপাক খোদ হেরা গুহায় ধ্যান কইরতেন নিবিষ্ট মনে। অথচ এই বাজারের মইধ্যিখানে এমন হৈ হট্টগোলের ভিতরে আল্লাহর ধ্যানে কি মন বইসব মিয়ারা?

সকলেই মুখ চাওয়াচাওয়ি করতে থাকে। কাতারে ঠাসা মানুষের মধ্যে মৃদু গুঞ্জন শুরু হয়। হুজুরের কথা তো একেবারে মিথ্যা নয়। কেউ কেউ গুনগুন করে, শরীয়তের আসল বিধান জানা দরকার। তিনু মিজি তখনও বয়ান চালিয়ে যান।

আপনেরা আমার কথা মন দিয়া শোনেন। সূরা আল-ফজরের এগারো নম্বর আয়াতে খোদাপাক কী ফরমাইয়াছেন? আমাদের সব কাজ তিনি নেক নজর দিয়া দেইখতেছেন। তাই সীমা ছাড়াইয়েন না মিয়ারা। আমরা যে তার ঘর আবাদ করছি সরকারি জায়গা দখল কইরা এইখানে কি তাঁর সায় আছে? কী...কথা কন না ক্যান আপনেরা?

কোরআন-হাদিসের এমন বর্ণনা চলে অনেকক্ষণ। একসময় আরবি খুৎবা শুরু হয়। সেদিকে মনোযোগ রেখে কেউ কেউ গরমে হাঁসফাঁস করে ওঠে। ভিড়ের মধ্য থেকে কে যেন বলে, চৈত্র মাসের ছাতিফাটা গরম আইজ। এসিখানা চালাইয়া দেন হুজুর...

তিনু মিজি তার খুৎবা দিয়েই চলেন। এর মধ্যেই প্রচণ্ড ভিড়ের একটা দমক পেছনের কাতার ফুঁড়ে সামনের দিকে এগিয়ে আসে- ঠিক মিম্বারের কাছে, খুৎবা দেওয়ার জন্যে তিনি দাঁড়িয়ে ছিলেন যেখানে।

প্রধান অতিথি সদলবলে নতুন জামে মসজিদ উদ্বোধনের সমস্ত এন্তেজাম নিয়ে হাজির হয়ে গেছেন। নামাজের সময় হয়ে গেছে। মুয়াজ্জিন হাতেমকে ইকামাত দেওয়ার জন্যে কে যেন পেছন থেকে বারবার তাড়া দেয়। হাতে খুব সময় নেই। সকলে তাড়াতাড়ি উঠে দাঁড়ায়। তিনু মিজি পাগড়ি বেঁধে গম্ভীর স্বরে বলে ওঠেন, আপনেরা সবাই কাতার সোজা কইরা দাঁড়ান।

সাম্প্রতিক দেশকাল ইউটিউব চ্যানেল সাবস্ক্রাইব করুন

মন্তব্য করুন

Epaper

সাপ্তাহিক সাম্প্রতিক দেশকাল ই-পেপার পড়তে ক্লিক করুন

Logo

ঠিকানা: ১০/২২ ইকবাল রোড, ব্লক এ, মোহাম্মদপুর, ঢাকা-১২০৭

© 2024 Shampratik Deshkal All Rights Reserved. Design & Developed By Root Soft Bangladesh

// //