লাল রেইনকোট পরা সেই মহিলা

কাহিনিটা সেই সময়ের যখন হিন্দু-মুসলমান সংঘর্ষে পূর্ব এবং পশ্চিম পাঞ্জাব রক্তের বন্যায় ভেসে যাচ্ছিল। বেশ কিছুদিন ধরে টানা বৃষ্টি হচ্ছিল এবং যে-হানাহানির আগুন মানুষ নেভাতে পারেনি তা এই প্রকৃতি কিছুটা নিজে থেকে যেন দমিয়ে এনেছিল। যদিও নিরীহ মানুষকে বিনা কারণে খুন করা, কিংবা প্রকাশ্য রাস্তায় মেয়েদের ইজ্জত লুট করা, অসহায় ভয়ার্ত মেয়েদের বাড়ি থেকে তুলে নিয়ে যাওয়ার কোনো খামতি ছিল না।

লুটতরাজ, খুনোখুনি ছিল যেন সেই সময়ের নিয়ম, যার গল্পের কথা বা বলতে যাচ্ছি, আমার বন্ধু ‘স’ ব্যাপারটাকে খুব সহজভাবে নিয়েছিল।

যাই হোক ওর গল্পটা শুরু করবার আগে ‘স’ সম্বন্ধে কয়েকটা জরুরি কথা বলে নিই। ওকে দেখতে খুব সাধারণ, আটপৌরে এবং আর পাঁচটা সাধারণ লোকের মতোই ‘কিছু-না’-এর মধ্যে থেকে ‘কিছু’-কে আবিষ্কার করার দিকে খুব ঝোঁক ছিল। স্বভাবের দিক থেকেও মোটেই নির্মম ছিল না; কিন্তু একটা আশ্চর্য ট্র্যাজেডির নায়ক এবং সাক্ষী হয়েছিল এমন এক ঘটনার, যা ঘটবার সময়ও বিন্দুমাত্র আঁচ পাওয়া যায়নি।

আমাদের স্কুলে ‘স’ ছিল একজন মাঝারি ছাত্র, খেলাধুলো ছিল ওর প্রাণ, আর কথায় কথায়, তর্কাতর্কি ভালো করে জমতে না জমতে, ও হুটপাট হাত চালিয়ে দিত।

ছবি আঁকার নেশা ছিল ওর; কিন্তু কলেজে এক বছর মাত্র পড়ার পরই ওকে পড়াশোনায় ইতি টানতে হয়। অনেক দিন পরে শুনেছিলাম ও একটা সাইকেলের দোকান খুলেছে শহরে।

যখন দাঙ্গা শুরু হলো, ওর দোকানটাই প্রথম গুঁড়িয়ে দেওয়া হয়েছিল। সেই মুহূর্তে হাতে আর কোনো কাজ না থাকায় ও লুটেরাদের দলে ভিড়ে গিয়েছিল, যতটা না জাতি হিংসা থেকে তার থেকেও বেশি মজা আর বৈচিত্র্যের সন্ধানে। সেই সময়টা ছিল সত্যিই ভারি অদ্ভুত। অন্ধকার রক্তাক্ত একটা যুগ, খুব অন্যরকম। এবার ওর গল্পটা ওর মুখেই শোনা যাক।

‘সেদিন প্রচণ্ড বৃষ্টি হচ্ছিল। মনে হচ্ছিল আকাশ বুঝি ফেটে চৌঁচির হয়ে যাবে আজ। সারাজীবনে আমি একসঙ্গে এত বৃষ্টি দেখিনি। আমি বাড়ির ব্যালকনিতে বসে বসে সিগারেট টানছিলাম। আমার পায়ের কাছে পড়ে ছিল একগাদা মালপত্র, যা আমি আমার দলের সঙ্গে বিভিন্ন দোকান ও বাড়ি থেকে লুট করে এনেছিলাম। তবে এগুলোতে আমার তেমন মন ছিল না। ওরা আমার দোকান পুড়িয়ে দিয়েছিল ঠিকই; কিন্তু দিব্যি কেটে বলছি, এত ছিনতাই রাহাজানি আর খুন-খারাবি আমি দেখেছিলাম জীবনে যে ওসব আমাকে তেমন আর একটা ভাবাত না। বৃষ্টির তুমূল আওয়াজের ভেতরেও কেমন একটা শুকনো অর্থহীন স্তব্ধতা আমার মনকে ছেয়ে রেখেছিল। হাওয়ায় একটা অদ্ভুত গন্ধ পাচ্ছিলাম আমি। ঠোঁটের সিগারেটটাও বিস্বাদ ঠেকছিল। কেমন একটা ঝিমুনির মধ্যে যেন চলে যাচ্ছিলাম আমি। হঠাৎ একটা শিহরণ খেলে গেল শিরদাঁড়া বেয়ে আর মনে হলো, একটা মেয়ে মানুষ এই মুহূর্তে আমার চাই-ই চাই। ঝমঝমিয়ে বৃষ্টি পড়ছিল। আমি উঠে পড়লাম। রেইনকোটটা চাপালাম গায়ে, একটি নতুন সিগারেটের প্যাকেট নিলাম লুট করা মালের ভেতর থেকে; তারপর বৃষ্টির মধ্যেই বেরিয়ে পড়লাম রাস্তায়।

‘রাস্তা সুনসান আর অন্ধকার। এমনকি সেনাবাহিনীর লোকজনরাও নেই। উদ্দেশ্যহীনভাবে ঘুরে বেড়াতে লাগলাম ঘণ্টার পর ঘণ্টা। রাস্তায় এখানে ওখানে মৃতদেহ ছড়িয়ে ছিটিয়ে ছিল; কিন্তু তাতে আমার কোনো হেলদোল ছিল না। কিছুক্ষণ বাদে আমি সিভিল লাইন অঞ্চলে এসে পড়লাম। রাস্তাঘাট প্রাণশূন্য, নিস্তব্ধ। একটা গাড়ির আওয়াজ আমার চটক ভেঙে দিল। দেখলাম একটা অস্টিন গাড়ি দুরন্ত গতিতে এগিয়ে আসছে। হঠাৎ মাথায় ভূত চেপে গেল আমার। আমি এক দৌড়ে মাঝ রাস্তায় চলে এলাম আর রুমাল নাড়িয়ে নাড়িয়ে ড্রাইভারকে ইশারা করতে লাগলাম থামবার জন্য, কিন্তু গাড়িটা থামল তো নাই, উল্টে আমার খুব কাছাকাছি এসে হঠাৎ বাধা পেয়ে প্রবল গতিতে বাঁদিকে বেঁকে গেল। আমি গাড়িটার পেছনে দৌড়াতে গিয়ে পড়ে গেলাম; কিন্তু তক্ষুণি আবার উঠে দাঁড়ালাম। দেখলাম চোট তেমন একটা লাগেনি। গাড়িটা হঠাৎ ভয়ংকর ব্রেক কষল, সামনের দুটি চাকা পিছলে গেল রাস্তা থেকে। তারপর একটা গাছের গায়ে ধাক্কা খেয়ে গাড়িটা শেষ পর্যন্ত থেমে গেল। আমি গাড়িটার দিকে এগিয়ে গেলাম। গাড়ির দরজা খুলে একজন মহিলা, গায়ে লাল রেইনকোট, প্রায় লাফ দিয়ে নামল রাস্তায়। অন্ধকারে তার মুখ দেখা যাচ্ছিল না; কিন্তু রেইনকোটটা যে উজ্জ্বল লাল, তা বোঝা যাচ্ছিল। আগুনের জিভ যেন ছুঁয়ে গেল আমার শরীর।

‘মহিলাটি আমাকে হন হন করে এগোতে দেখে হঠাৎ দৌড় লাগাল। আমিও দৌড়ে গিয়ে জড়িয়ে ধরলাম তাকে। ‘বাঁচাও বাঁচাও’, সে চিৎকার করতে লাগল।

‘তুমি কি ইংরেজ?’ আমি জিজ্ঞেস করলাম।

‘না না’ সে বলল।

‘ইংরেজদের আমি ঘেন্না করতাম। তাই বললাম, ‘ও তাহলে ঠিক আছে।’

‘এবার সে উর্দুতে চিৎকার করতে লাগল, ‘তুমি আমাকে খুন করবে, আমি জানি আমাকে মেরে ফেলবে তুমি।’

‘আমি টুঁ শব্দ করলাম না। শুধু অন্ধকারে ঠাহর করবার চেষ্টা করছিলাম মেয়েটির বয়স কত হতে পারে, আর তাকে দেখতেই বা কেমন। তার মুখ রেইনকোটে ঢাকা ছিল, আমি তা তুলে দেখতে গেলে সে প্রবলভাবে বাধা দিল। আমি আর জোরাজুরি করলাম না বরং আমি তার হাত ধরে গাড়ির দিকে এগিয়ে গেলাম। তাকে গাড়ির ভেতর একরকম ধাক্কা মেরে ঢুকিয়ে দিয়ে নিজে ড্রাইভারের আসনে বসলাম। তারপর গাড়ি স্টার্ট দিলাম। পিছল রাস্তায় খুব সাবধানে চালিয়ে গাড়িটা নিজের বাড়ির সামনে এসে দাঁড় করালাম।

‘ইঞ্জিন বন্ধ করে প্রথমে ভাবলাম মহিলাটিকে ব্যালকনিতে তুলে নিয়ে যাই। তারপর ভাবলাম হয়তো সিঁড়ি ভেঙে উঠতে রাজি হবে না। তাই বাড়ির কাজের ছেলেটিকে চিৎকার করে বললাম, ‘নিচের ড্রইংরুমটা খুলে দে।’ তারপর ড্রইংরুমে মহিলাকে প্রায় ঠেলে ঢুকিয়ে সোফায় এলিয়ে দিলাম।

‘আমাকে মেরো না। আমাকে মেরো না, প্লিজ,’- সে চিৎকার করতে লাগল। 

‘আমি ইচ্ছে করে একটু নাটকীয় ভঙ্গিতে বললাম, ‘না আমি তোমাকে মারব না, প্রিয়তমা।’

‘মেয়েটি কান্নায় ভেঙে পড়ল। আমি কাজের ছেলেটিকে বললাম বাড়ির বাইরে যেতে। একটা দেশলাই বাক্স বের করলাম; কিন্তু বৃষ্টিতে কাঠিগুলো ভিজে স্যাঁতসেঁতে হয়ে গিয়েছিল। কয়েক সপ্তাহ ধরে বাড়িতে বিদ্যুৎ ছিল না। ওপরের ঘরে একটা টর্চ ছিল; কিন্তু ওটা আনার প্রয়োজন বোধ করলাম না আমি। আমি তো আর ফটো তুলব না যে আলোর দরকার, মনে মনে ভাবলাম। নিজের রেইনকোটটা খুলে ছুড়ে ফেলে দিলাম মাটিতে। তারপর মহিলাকে বললাম, ‘তোমারটা খুলে দিই।’

‘সোফার কাছে গিয়ে বুঝতে পারলাম মেয়েটি সোফায় নেই। কোথায় আর যাবে, ভাবলাম আমি, তারপর অন্ধকার হাতড়ে হাতড়ে খুঁজতে গিয়ে প্রায় মুখোমুখি ধাক্কা খেয়ে গেলাম দু’জন। ধাক্কা খেয়ে পড়ে গেলাম মেঝেতে। সম্পূর্ণ কাকতালীয়ভাবে আমার আঙুল এসে পড়ল তার গলায়। মেয়েটি চিৎকার করে উঠল, ‘থামো, থামো, কী করছ?’

‘আরে আরে ভয় পেও না, মারব না তোমায়।’ আমি বললাম।

‘মেয়েটি কেঁদেই চলল। আমি ওর পিছল প্লাস্টিকের লাল রেইনকোটটার বোতামগুলো খুলতে লাগলাম। খোলা হলে দেখলাম যে মেয়েটি শাড়ি পরে আছে। আমি ওর ঊরুতে হাত ছোঁয়ালাম। একটা বিদ্যুতের শিখা দৌড়ে গেল আমার শিরা বেয়ে; কিন্তু আমি মনে মনে বললাম, ধীরে, বন্ধু, ধীরে।

‘আমি তাকে শান্ত করতে লাগলাম। বললাম, ‘আমি তোমাকে খুন করতে এখানে আনিনি। বরং বাইরের থেকে এখানে তুমি অনেক বেশি নিরাপদ। যদি তুমি বেরিয়ে যেতে চাও যেতে পার; কিন্তু আমার মনে হয় কি জানো যতদিন এইসব দাঙ্গা না থামে, আমার এখানেই থাক। তুমি শিক্ষিত ভদ্র মেয়ে, বাইরে লোকজন এখন পশু হয়ে গেছে। আমি চাই না যে তুমি এই জানোয়ারদের হাতে পড়।’

মেয়েটি কাঁদতে কাঁদতে বলল, ‘তুমি আমাকে মারবে না তো?’

‘না, স্যর।’ আমি বললাম।

‘স্যর শব্দটা শুনে মেয়েটি হো হো করে হেসে উঠল।

‘আমি বললাম ‘আসলে আমি ইংরেজিতে খুব কাঁচা।’

‘সে অনেকক্ষণ কোনো কথা বলল না। তারপর খুব করুণ গলায় প্রশ্ন করল, ‘মারবেই না যদি, তবে এখানে আনলে কেন?’

একটা অদ্ভুত প্রশ্ন। আমি এর কোনো উত্তর খুঁজে পেলাম না। হঠাৎ কে যেন আমার ভেতর থেকেই বলে উঠল, ‘আমি তোমায় খুন করব না এই কারণেই যে আমি অযথা মানুষ মারতে ভালোবাসি না; কিন্তু তোমাকে আমি এখানে এনেছি কেন? তাই জিজ্ঞেস করলে, না? হয়তো... হয়তো এই কারণে যে আমি খুব একা...।’

‘কিন্তু তোমার তো সর্বক্ষণের কাজের ছেলে রয়েছে।’

‘ও তো কাজের-ই লোক মাত্র।’

‘মেয়েটি চুপ করে গেল। আমার কেমন একটু অপরাধবোধ জাগল মনে। আমি উঠে দাঁড়ালাম। বললাম, ‘যাকগে ওসব কথা থাক। তুমি যদি চলে যেতে চাও আমি তোমায় আটকাব না।’

‘আমি তার হাত ধরলাম। আমার মনে পড়ল তার ঊরুর কথা। হঠাৎ ভয়ংকরভাবে আমি তাকে বুকে চেপে ধরলাম। আমার চিবুকের ঠিক নিচে তার নিঃশ্বাসের গরম আমি টের পেলাম। আমি তার ঠোঁটে ঠোঁট চেপে ধরলাম। সে কাঁপতে শুরু করল। আমি ফিসফিস করে বললাম, ‘ভয় নেই, সোনা, আমি তোমায় মারব না।’

‘মেয়েটি কাঁপা কাঁপা গলায় বলল, ‘যেতে দাও আমায়, প্লিজ।’

আমি খুব নম্রভাবে ওর শরীর থেকে হাত সরিয়ে নিলাম। তারপর হঠাৎ কী প্রবৃত্তির খেয়ালে তাকে এক ঝটকায় তুলে নিলাম মেঝে থেকে আর শুইয়ে দিলাম সোফায়, দেখলাম যে মেয়েটির সঙ্গে একটা ছোট হাতব্যাগ রয়েছে। আমি হাতব্যাগটা সরিয়ে রেখে দিলাম। মেয়েটিকে আশ্বস্ত করে বললাম, ‘যদি এর মধ্যে মূল্যবানও কিছু থেকে থাকে তবু চিন্তার কিছু নেই। আমি বরং উল্টে তোমায় অনেক কিছু দিতে পারি।’

‘আমার কিছু চাই না।’ সেই ঘুরঘুট্টি অন্ধকারে মেয়েটি ফিসফিস করে বলল।

‘কিন্তু আমার যে চাই।’ আমি বললাম।

‘কী?’

‘তোমাকে।’

‘সে কিছু বলল না। আমি তার কাঁধে হাত রাখলাম। সে বাধা দিল না। আমি ভাবলাম মেয়েটি হয়তো ভাবছে আমি ওর অসহায়তার সুযোগ নিচ্ছি, তাই বললাম, ‘আমি জোর করব না। তুমি চলে যেতে চাইলে যেতে পার।’

‘আমি উঠে দাঁড়ালাম। মেয়েটি আমার ডান হাতটা চেপে ধরে ওর বুকের ওপর রাখল। টের পেলাম ওর হৃদস্পন্দনের গতি খুব দ্রুত। হঠাৎ খুব উত্তেজিত হয়ে ওকে জড়িয়ে ধরলাম।

‘তারপর দু’জনে চুম্বনের আদিম খেলায় মেতে উঠলাম। সেই তুমুল আলোড়নের মধ্যে কে কাকে কী বলছি খেয়াল থাকল না। ‘জামা কাপড়গুলো খোল’, আমি বললাম।

‘ নিজে খুলে দিতে পার না?’, সে বাসনামিশ্রিত গলায় বলল।

‘আমি তাকে আদর করতে লাগলাম। সে বলল, ‘তুমি কে?’

‘যেই হই আপাতত আমি তোমার।’ আমি বললাম।

‘দুষ্টু লোক।’ সে আমার আরও কাছে ঘেঁষে এসে বসল।

‘কিন্তু যেই তার জামার বোতামে হাত রাখতে গেলাম সে বলল, ‘প্লিজ না।’

‘ কেন এখন তো অন্ধকার।’

‘তাতে কী। আমার লজ্জা করে।’

‘ ঠিক আছে, ঠিক আছে।’ আমি বলে উঠলাম।

‘সে কিছুক্ষণ চুপ করে থাকল। তারপর বলল, ‘তুমি রেগে গেছ, না?’

‘আমি বললাম, ‘না না রেগে টেগে যাবার ব্যাপার না... আসলে... আসলে কিছু তো একটা হবে... তাহলে শাড়িটা...’

‘আমার খুব ভয় করছে।’ মেয়েটি বলল।

‘কীসের ভয়? আচ্ছা তবে থাক’, আমি বললাম, ‘দু-চারদিন এ বাড়িতে থাক। একটু সয়ে যাক। তারপরে দেখা যাবে।’

‘না না সে কথা না’, সে বলল আর তার মাথাটা এলিয়ে দিল আমার কোলের ওপর। আমি তার চুলে বিলি কেটে দিতে লাগলাম। আস্তে আস্তে সে শান্ত হয়ে এল। তারপর উঠে এক ঝটকায় আমাকে টেনে নিল তার দিকে। সে ভয়ংকর কাঁপছিল।

হঠাৎ দরজায় কড়া নাড়ার শব্দে সম্বিৎ ফিরে পেলাম। বাইরে থেকে সরু আলোর রেখা এসে পড়ল ঘরের ভেতর।

‘লণ্ঠনটা এনেছিলাম। যদি আপনাদের লাগে।’

‘কাজের ছেলেটির গলা পেলাম।

‘ঠিক আছে, আনো,’ আমি বললাম।

‘না, না, না’, মেয়েটি যেন রুখে দাঁড়াল।

‘কেন অসুবিধে কী আছে। সলতেটা একটু কমিয়ে ঘরের এক কোণে নামিয়ে রাখব।’

‘আমি দরজায় কাছে গিয়ে লণ্ঠনটা নিয়ে এসে এক কোণে নামিয়ে রাখলাম। আলোটা চোখে সইয়ে নিতে কিছুক্ষণ সময় লাগল। এর ফাঁকে, দেখলাম, মেয়েটি ঘরের এক প্রত্যন্ত কোণায় গিয়ে ভয়ে জড়সড় হয়ে বসে রয়েছে।

‘এবার এসো, এই আলোয় একটু গল্প করা যাক’, আমি বললাম, ‘পরে লণ্ঠনটা নিভিয়ে দেব।’

‘লণ্ঠনটা তুলে নিয়ে আমি তার দিকে কয়েক পা এগিয়ে যেতেই সে শাড়ির আঁচল দিয়ে তার মুখ ঢেকে দিল।

‘অদ্ভুত মেয়ে সত্যি তুমি।’ আমি একটু বিরক্ত হয়ে বলে উঠলাম।

‘ঠিক এই সময় বাইরে একটা ভয়ংকর বিস্ফোরণের আওয়াজ হলো। ভয়ে দিশেহারার মতো মেয়েটি দৌড়ে এসে আমাকে জাপটে ধরল।

‘ও তো বোম পড়ার শব্দ। ও কিছু না। ও তো আকছারই হচ্ছে।’ আমি বললাম।

‘এই প্রথম লণ্ঠনের মৃদু আলোয় ওর মুখ আবছা দেখতে পেলাম। মনে হলো যেন চেনা চেনা কিন্তু পরিষ্কারভাবে কিছু ঠাহর হচ্ছে না।

‘আমি তার দুই কাঁধ ধরে তাকে কাছে টেনে আনলাম। ওঃ ভগবান, কেউ বিশ্বাস করবে না সেই মুহূর্তে কী দেখলাম আমি। আমার অবিশ্বাসী চোখের পর্দায় ভেসে উঠল এক বৃদ্ধার লোলচর্ম মুখ। রঙচঙ করা, তাতে অজস্র ফাটলের চিহ্ন। বৃষ্টির জলে তার মেকআপ প্যাঁচপ্যাঁচে হয়ে গেছে। তার চুল রঙ-করা। গোড়াগুলোয় সাদা জেগে রয়েছে। তার খোঁপায় গোঁজা প্লাস্টিকের কয়েকটা রঙিন ফুল।

‘হতভম্বের মতো আমি লণ্ঠনটা নামিয়ে রাখলাম মাটিতে। বললাম, ‘তুমি এখন যেতে পার।’

‘সে কিছু একটা বলতে গেল। আমি তার রেইনকোট আর হাত ব্যাগ তার দিকে এগিয়ে দিলাম। সে আর কিছু বলল না।

‘তার দিকে না তাকিয়েই আমি তার জিনিসপত্র তাকে ফিরিয়ে দিলাম। সে কিছুক্ষণ চুপচাপ দাঁড়িয়ে রইল মাথা নিচু করে। তারপর দরজাটা খুলে বৃষ্টির মধ্যেই বেরিয়ে গেল।’


এখানেই আমার বন্ধু ‘স’-এর গল্পটা শেষ হলো। শেষ হলে, আমি তাকে জিজ্ঞেস করলাম, ‘জানো ওই মহিলা আসলে কে ছিলেন?’

‘না।’ বন্ধু বলল।

‘বিখ্যাত আর্টিস্ট মিস্ ম।’

‘মিস্ ‘ম’?’ বন্ধু চিৎকার করে উঠল, ‘স্কুলের দিনগুলোতে যার আঁকা আমরা নকল করবার চেষ্টা করতাম!’

‘হ্যাঁ, ঠিক তাই। উনি ছিলেন আর্ট কলেজের অধ্যক্ষ। উনি ওনার ছাত্রীদের স্টিল লাইফ আঁকা শেখাতেন। পুরুষদের উনি ঘৃণা করতেন।’ আমি বললাম।

‘এখন তবে তিনি কোথায়।’ আমার বন্ধু হঠাৎ জিজ্ঞেস করল।

‘স্বর্গে।’

‘মানে, কী বলছ তুমি?’ ‘স’ চিৎকার করে উঠল।

আমি বললাম, ‘যে রাত্রে তুমি ওঁকে বাড়ি থেকে বার করে দিয়েছিলে সেই রাত্রেই উনি গাড়ি অ্যাকসিডেন্টে মারা যান। সেই অর্থে তুমি ওঁর খুনি। আসলে, তুমি দু’জন মহিলাকে হত্যা করেছিলে সেদিন। একজন মিস্ ‘ম’ নামজাদা আর্টিস্ট আর আরেকজন যিনি তার শরীর থেকে কিছু সময়ের জন্য জন্ম নিয়েছিলেন সেই বর্ষার রাতে তোমার ড্রইংরুমের আধো-অন্ধকারে, আর যাকে তুমি একাই দেখেছ।’

আমার বন্ধু এ কথার কোনো উত্তর দিল না।

সহায় ‘এমন বলো না যে এক লাখ হিন্দু আর এক লাখ মুসলমান মারা গেছে... বলো, দু’লাখ মানুষ মারা গেছে... দু’লাখ মানুষের মৃত্যুর চেয়েও আসল ট্র্যাজেডি হলো, যারা মরেছে, তারা কোনো হিসেবের খাতাতেই ঢোকেনি... এক লাখ হিন্দু মেরে মুসলমানরা ভেবেছে, হিন্দুত্ব নিকেশ হয়ে গেছে; কিন্তু তা বেঁচে আছে আর বেঁচে থাকবেও... একই ভাবে এক লাখ মুসলমানকে কোতল করে হিন্দুরাও নিশ্চয়ই বগল বাজিয়ে বলেছে, ইসলাম খতম হয়ে গেছে... কিন্তু তোমরা তো সবাই জানো, ইসলামের গায়ে একটা আঁচড়ও পড়েনি... বেকুবরাই ভাবতে পারে বন্দুক দিয়ে ধর্মকে শিকার করা যায়... ধর্ম, দীন, ইমান, বিশ্বাস- এসব তো আমাদের শরীরে থাকে না, থাকে আত্মায়। ছুরি, তলোয়ার, বন্দুক দিয়ে ওদের হত্যা করা যায় না।’ মমতাজ সেদিন আশ্চর্য রকম উত্তেজিত ছিল।

আমরা তিনজন ওকে জাহাজে বিদায় জানাতে গিয়েছিলাম। ও আমাদের ছেড়ে চলে যাচ্ছিল- কত দিনের জন্য কেউই জানতাম না- গন্তব্য পাকিস্তান, এমন এক দেশ, যার সম্পর্কে আমরা কিছুই জানতাম না।

আমরা তিনজন হিন্দু। পশ্চিম পাঞ্জাবে আমাদের আত্মীয়দের জীবন ও সম্পত্তির অনেক ক্ষতি হয়েছিল। সম্ভবত সেজন্যই মমতাজ আমাদের ছেড়ে চলে যাচ্ছিল। লাহোর থেকে আসা চিঠিতে যুগল জানতে পেরেছিল, দাঙ্গায় ওর কাকা মারা গেছেন। খবরটা ওকে ধসিয়ে দিয়েছিল। একদিন এলোমেলো কথার মাঝে যুগল মমতাজকে বলেছিল, ‘আমাদের মহল্লায় দাঙ্গা বাঁধলে, আমি কী করব, তাই ভাবছিলাম।’

মমতাজ জিজ্ঞাসা করেছিল, ‘কী করবে?’

যুগল গম্ভীর হয়ে উত্তর দিয়েছিল, ‘ভাবছিলাম... আমি তোমাকে খুন করে ফেলব।’

মমতাজ কথাটা শুনে একেবারে চুপ করে গিয়েছিল; আট দিন নীরবতায় ডুবে থাকার পর সে আমাদের জানিয়েছিল, পৌনে চারটের জাহাজে ও করাচি চলে যাচ্ছে। ওর হঠাৎ চলে যাওয়ার কারণ আমরা তিনজনের কেউই খুঁজিনি। যুগল জানত, ওর কথাটাই- ‘ভাবছিলাম... আমি তোমাকে খুন করে ফেলব’- সম্ভবত চলে যাওয়ার কারণ। আর সেজন্যই হয়তো ও ছিল সবচেয়ে চুপচাপ। আশ্চর্যের ব্যাপার, চলে যাওয়ার কয়েক ঘণ্টা আগে মমতাজ ওর স্বভাবের বিপরীতে গিয়ে অনর্গল কথা বলে যাচ্ছিল।

সকাল থেকে ও মদ্যপান করে যাচ্ছিল। খোশমেজাজে জিনিসপত্র গোছাচ্ছিল, যেন সে কোথাও বেড়াতে যাচ্ছে, না থেমে কথা বলে যাচ্ছিল, নিজের বলা ঠাট্টায় নিজেই হাসছিল। ওই অবস্থায় তাকে দেখলে কারুর মনে হতে পারত, বম্বে ছেড়ে যেতে পারার জন্য সে খুব উল্লসিত; কিন্তু আমরা তিনজনেই জানতাম, নিজের অনুভূতিকে গোপন করে ও আমাদের আর নিজেকে বোকা বানাচ্ছে।

আমি অনেকবার ওকে জিজ্ঞেস করার চেষ্টা করেছিলাম, হঠাৎ এমন সিদ্ধান্ত সে কেন নিল। যুগলকেও ইশারাতে বলেছি, প্রশ্নটা তোলার জন্য; কিন্তু মমতাজ আমাদের সামান্য সুযোগটুকুও দেয়নি।

যুগল তিন-চার পেগ খেয়ে আরও চুপচাপ হয়ে গিয়েছিল, তারপর পাশের ঘরে গিয়ে শুয়ে পড়েছিল। ব্রিজমোহন আর আমি মমতাজের সঙ্গে ছিলাম। ডাক্তারের বিল মেটানো, ধোপাখানা থেকে জামাকাপড় নিয়ে আসার সময় ও শুধু কথা বলে যাচ্ছিল আর হাসছিল। মোড়ের গোবিন্দর দোকান থেকে পান কেনার সময় তার চোখ জলে ভরে উঠল। ব্রিজমোহনের কাঁধে হাত রেখে মুখ ঘুরিয়ে বলেছিল, ‘মনে আছে ব্রিজ, দশ বছর আগে আমাদের অবস্থা যখন খারাপ ছিল, গোবিন্দ আমাদের এক টাকা ধার দিয়েছিল?’

সারা পথ মমতাজ চুপ করে ছিল; কিন্তু ঘরে ফিরে আবার সে কথা শুরু করেছিল- একটা কথার সঙ্গে আরেকটা কথার কোনো সম্পর্ক নেই- কিন্তু এমন সব মজাদার কথা যে আমি আর ব্রিজমোহনও যোগ দিয়েছিলাম। তার যাওয়ার সময় এগিয়ে এল, যুগলও আমাদের সঙ্গে এসে ভিড়ল। ট্যাক্সিতে ডকইয়ার্ডে যাওয়ার সময় আমরা কেউই কথা বলতে পারছিলাম না।

বন্দরে ট্যাক্সি ঢোকার আগে পর্যন্ত মমতাজের দৃষ্টি বম্বের ছড়িয়ে থাকা বাজারগুলোকে বিদায় জানাচ্ছিল। বন্দর ভিড়ে ভিড়াক্কার। হাজার হাজার উদ্বাস্তু, কিছু বড়লোক, বেশিরভাগই হতদরিদ্র- দেশ ছেড়ে চলে যাচ্ছে। মনে হচ্ছিল, মমতাজ একাই চলে যাচ্ছে, আমাদের ফেলে রেখে এমন এক জায়গায় যা আগে সে দেখেনি, আর শত চেষ্টা সত্ত্বেও সে ওখানে অপরিচিতই থেকে যাবে। এমনটাই আমি ভাবছিলাম। মমতাজের মনের ভিতরে কী চলছিল, তা আমি জানি না।

 কেবিনে তার ব্যাগপত্তর ঢোকার পর সে আমাদের নিয়ে ডেকে এসে দাঁড়াল। আকাশ ও সমুদ্র যেখানে মিশেছে, সেদিকে দীর্ঘসময় তাকিয়ে থাকলে। তারপর যুগলের হাত নিজের হাতে নিয়ে বলল, ‘কী প্রতারক দেখো, অকাশ আর সমুদ্রের মিলন, অথচ কী আনন্দময়।’

যুগল চুপ করে ছিল। হয়তো তার ওই কথা-‘আমি তোমাকে খুন করে ফেলব’-তখনো তার ভিতরে খোঁচা দিয়ে যাচ্ছিল।

জাহাজের পানশালা থেকে মমতাজ ব্র্যান্ডির অর্ডার দিল। সকাল থেকে সে ব্র্যান্ডিই খেয়ে যাচ্ছিল। গ্লাস হাতে আমরা রেলিংয়ের পাশে দাঁড়িয়েছিলাম। জাহাজে যতই উদ্বাস্তুরা উঠছিল, ততই চিৎকার- চেঁচামেচি, ঠেলাঠেলি বাড়ছিল। আপাত শান্ত জলের ওপর সমুদ্রপাখিরা উড়ে বেড়াচ্ছে।

হঠাৎ যুগল একবারে গ্লাস শেষ এর বিকৃত স্বরে বলে উঠল, ‘আমাকে ক্ষমা কর মমতাজ। ওইদিন তোমাকে খুব কষ্ট দিয়েছি।’

মমতাজ একটু থেমে থেকে জিজ্ঞেস করল, ‘কথাগুলো যখন বলেছিলে, আমি তোমাকে খুন করে ফেলব, ওই কথাগুলোই কি তখন তুমি ভাবছিলে? ঠান্ডা মাথায় কি তুমি সিদ্ধান্তে পৌঁছেছিলে?

যুগল মাথা নেড়ে বলেছিল, ‘আমি-আমি দুঃখিত।’

মমতাজ ঘোরের ভিতর থেকে বলে, ‘আমাকে সত্যিই খুন করলে, তুমি আরও খারাপ বোধ করতে; কিন্তু একবার যদি ভাবতে, তুমি মমতাজকে, একজন মুসলমানকে, বন্ধুকে মারোনি, মেরেছ একজন মানুষকে। সে যদি খারাপ মানুষ হতো, মনে রেখো, তুমি তার খারাপটাকে মারোনি, মেরেছো মানুষটাকে, সে মুসলমান হলে, তার মুসলমানিকে মারতে পারোনি, মেরেছো তার অস্তিত্বকে। মুসলমানরা তার মৃতদেহ পেলে আর একটা কবরের সংখ্যা বাড়ত; কিন্তু দুনিয়ায় একজন মানুষ কম পড়ে যেত।’

ভাবার সময় নিয়ে সে একটু চুপ করে থাকলে, তারপর আবার বলতে লাগল, ‘আমার ধর্মের মানুষরা আমাকে হয়তো শহীদ ঘোষণা করত; কিন্তু সত্যি বলছি, কবরে আমি ছটফট করতাম, চিৎকার করে বলতাম, ওই তকমা আমি চাই না। পরীক্ষা না দিয়ে আমি এই ডিপ্লোমা চাই না। লাহোরে কিছু মুসলমান তোমার কাকাকে মেরেছিল, বম্বেতে বসে তুমি সেই খবর পেয়ে আমাকে খুন করলে। এর জন্য কী পুরস্কার আমরা পেতে পারি, বল আমাকে? লাহোরে তোমার কাকা আর তার হত্যাকারীই বা কী সম্মান পেতে পারে? হ্যাঁ, যারা মরেছে, তারা কুকুরের মতো মরেছে আর হত্যাকারীর হাত রক্তাক্ত হয়েছে, প্রয়োজন ছাড়া- কোনো প্রয়োজনই ছিল না।’

কথা বলতে বলতে মমতাজ বড় আবেগী হয়ে পড়েছিল, কিন্তু ওর উত্তেজনার মধ্যেও ছিল ভালোবাসার স্পর্শ। সেই মুহূর্তে আমারও মনে হচ্ছিল, ধর্ম, দীন, ইমান, বিশ্বাস আমাদের শরীরে থাকে না, থাকে আত্মায়। ছুরি, তলোয়ার, বন্দুক দিয়ে তাদের হত্যা করা যায় না। আমি ওকে আবেগতাড়িত হয়ে বলেছিলাম, ‘তুমি ঠিক কথা বলেছ।’

আবারও কিছুক্ষণ ভাবল মমতাজ। তারপর অস্বস্তির সঙ্গে বলতে লাগল, ‘না, আমি ঠিক বলছি না। আমি যা সত্যিই বলতে চাই, তা স্পষ্ট করে বলতে পারিনি। ধর্ম বলতে আমি এমন কিছুকে বোঝাচ্ছি না যাতে আমরা নিরানব্বই শতাংশ মানুষ বন্দি হয়ে আছি। ধর্ম বা বিশ্বাস বলতে আমি সেই গুণকেই বুঝি যা আমাকে পাশের মানুষের থেকে উন্নত করে, এমন এক অলৌকিক আভা দেয় যাতে আমরা সত্যিই মানুষ হয়ে উঠি; কিন্তু সেই আভাটা কী? আমি তো তোমাদের হাতে করে দেখাতে পারব না।’ তার চোখে আশ্চর্য এক আলো দেখা গেল আর সে নিজেকেই প্রশ্ন করতে শুরু করল, ‘সেই লোকটার মধ্যে বিশেষ কী ছিল? ও একটা কট্টর হিন্দু ছিল, একটা নোংরা পেশায় জড়িয়ে থাকা মানুষ অথচ তার আত্মা কী উজ্জ্বল।’

‘কার?’ আমি জিজ্ঞেস করেছিলাম।

‘একটা বেশ্যার দালালের।’

আমরা তিনজনেই চমকে উঠেছিলাম। তার উচ্চারণে বিন্দুমাত্র মিথ্যে শালীনতা ছিল না। আমি আন্তরিক ভাবে জিজ্ঞেস করেছিলাম, ‘বেশ্যার দালালের?’

মমতাজ মাথা নেড়েছিল, ‘আমি অবাক হয়ে ভাবি, ও তো একটা সাধারণ মানুষ। তার চেয়েও বিস্ময়ের, বেশিরভাগ লোকের কাছে সে বেশ্যার দালাল মাত্র, অথচ তার আত্মা কী পবিত্র।’

মমতাজ কিছুক্ষণ চুপ করে থাকল, যেন সে মনের ভিতরে পুরনো ঘটনাগুলোকে নতুন করে দেখতে পাচ্ছে। তারপর বলতে শুরু করেছিল, ‘তার পুরো নাম মনে নেই... সহায় বা ওইরকম কিছু একটা হবে। বাড়ি ছিল বেনারসে। খুব পরিচ্ছন্নতা ভালোবাসত... যে ছোট্ট ঘরটায় থাকত, তাকে সবসময় সাজিয়ে-গুছিয়ে রাখত... পর্দা দিয়ে আড়াল তৈরি করেছিল... চারপাই ছিল না, তবে খদ্দেরদের জন্য মাদুর-বালিশের ব্যবস্থা ছিল... চাদর, বালিশের খোল সব সময় পরিষ্কার... একটা কাজের লোক ছিল কিন্তু সে নিজে হাতেই সব পরিষ্কার করত... সত্যি বলতে কি, নিজেই সব কাজ করত... কখনো মিথ্যে কথা বলেনি, কাউকে ঠকায়নি... বেশি রাত বলে যদি মদ না পাওয়া যেত তবে সে খদ্দেরদের বলে দিত, জল মেশানো সস্তা মদে টাকা খরচ না করাই ভালো... কোনো মেয়ের ব্যাপারে সন্দেহ হলে স্পষ্ট জানিয়ে দিত... একবার সে আমাকে বলেছিল, শেষ তিন বছরে ও কুড়ি হাজার টাকা রোজগার করেছে... মেয়েদের আনা প্রতি দশ টাকায় তার কমিশন ছিল আড়াই টাকা... তার ইচ্ছে আরও দশ হাজার রোজগার করবে... জানি না, কেন দশ হাজার, কেনইবা বেশি নয়। আমাকে বলেছিল, পুরো ত্রিশ হাজার রোজগার করতে পারলে সে বেনারসে ফিরে গিয়ে কাপড়ের দোকান খুলবে। কেন কাপড়ের দোকান, কেন অন্য ব্যবসা না, তাও আমি জানি না।’

আমি নিজেকে সামলাতে না জোর বলে উঠলাম, ‘আশ্চর্য মানুষ তো!’

মমতাজ বলে যেতে লাগল, ‘আমি ভাবতাম, লোকটা একেবারে বোগাস, পা থেকে মাথা অবধি জোচ্চোর। যে মেয়েদের দিয়ে ব্যবসা চালায়, তাদের সে নিজের কন্যাসম মনে করে এ কথা বিশ্বাস করবে? একদিন জেনে অবাক হলাম, সে পোস্ট অফিসে প্রত্যেকটা মেয়ের জন্য সেভিংস অ্যাকাউন্ট খুলে দিয়েছে, প্রতি মাসে তাদের আয় সে অ্যাকাউন্টে জমা করে দেয়। আরও অবাক ব্যাপার, দশ থেকে বারোটা মেয়ের থাকা-খাওয়ার খরচ সে নিজে দিত। ভাবতাম, ওর সব কথা আর কাজই বানানো চাতুরি।

‘একদিন ওর ডেরায় যেতে বলল, ‘আমিনা আর সখিনার আজ ছুটি। আমি ওদের সপ্তাহে একদিন ছুটি দিই যাতে বাইরের গিয়ে আমিষ খাবার খেতে পারে। এখানে, আপনি তো জানেন, শুদ্ধ নিরামিষাশী।’ আমাকে বোকা বানানোর চেষ্টা করছে ভেবে মুচকি হাসলাম। আরেক দিন আমাকে বলল, আহমেদাবাদের হিন্দুমেয়েটিকে নাকি এক মুসলমান খদ্দেরের সঙ্গে বিয়ে দিয়েছে। মেয়েটি এখন লাহোরে থাকে আর চিঠি লিখে জানিয়েছে দাতা সাহেবের মাজারে সে মানত করেছিল, তার ফলও মিলেছে। এবার নাকি মেয়েটি সহায়ের জন্য মানত করছে, যাতে ত্রিশ হাজার টাকা জমিয়ে দেশে গিয়ে কাপড়ের দোকান খুলতে পারে। শুনে আমি হাসিতে ফেটে পড়লাম। ভেবেছিলাম, আমি মুসলমান বলেই লোকটা আমাকে খুশি করার জন্য এইসব বলছে।’

মমতাজকে জিজ্ঞেস করলাম, ‘তোমার ভাবনা ভুল ছিল?’

এক্কেবারে; তার কথার আর কাজে কোনো ফারাক ছিল না। ওর হয়তো কিছু দোষ ছিল, সন্দেহ নেই। হয়তো অনেক ভুল করেছিল, যা আমরা সকলেই করি; কিন্তু, আমি বলছি, ও এক অপূর্ব মানুষ, আমার জানাশোনার মধ্যে সবচেয়ে ভালো।’

যুগল জিজ্ঞেস করেছিল, ‘কীভাবে জানতে পারলে?’

‘ওর মৃত্যুর মুখোমুখি দাঁড়িয়ে।’ কথাটা বলেই মমতাজ চুপ করে গিয়েছিল। আকাশ ও সমুদ্র যেখানে অস্পষ্টভাবে মিশেছে, সেই দিগন্তের দিকে সে তাকিয়ে থাকল। দীর্ঘ নীরবতার পর বলতে শুরু করেছিল, ‘দাঙ্গা তখন শুরু হয়ে গেছে। একদিন খুব সকালে আমি ভিণ্ডি বাজারের মধ্য দিয়ে যাচ্ছিলাম। কারফিউ চলছিল, লোকজন রাস্তায় খুবই কম। ট্রাম চলছিল না। ট্যাক্সির খোঁজে জে জে হাসপাতালের কাছে পৌঁছে দেখি, ফুটপাথে একটা লোক পড়ে আছে, তার পাশে একটা বেতের ঝুড়ি। ভাবলাম, রাস্তার কোনো লোক ফুটপাথে ঘুমোচ্ছে; কিন্তু রাস্তার ওপর জমাট রক্ত দেখে দাঁড়িয়ে পড়লাম। তার মানে, ব্যাপারটা খুন। চলে যাওয়ার সময় লক্ষ করলাম, শরীরটা একটু নড়ছে। চারপাশে তাকালাম। রাস্তায় কেউ নেই। লোকটাকে কাছ থেকে দেখার জন্য ঝুঁকে পড়লাম। সহায়ের পরিচিত মুখ, রক্ত আর নোংরায় মাখামাখি। ফুটপাথে ওর পাশেই বসে পড়লাম, খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে ওকে দেখছিলাম। ওর ধবধবে সাদা জামা রক্তে ভিজে গেছে। তার মানে বুকেই আঘাত করা হয়েছে। খুব আস্তে গোঙাচ্ছিল, আমি কাঁধ ধরে ঠেলতে লাগলাম। ওর অর্ধেক নামটুকু ধরেই ডাকতে লাগলাম। যখন চলে যাওয়ার জন্য উঠে পড়ছি, ও চোখ খুলে তাকাল। আধ-খোলা চোখে, পলকহীন সে আমার দিকে অনেকক্ষণ তাকিয়ে থাকল। তারপর হঠাৎই ওর শরীরে কাঁপুনির স্রোত বয়ে গেল, আমাকে চিনতে পেরে বলে উঠল ‘আপনি... আপনি!’

‘আমি সঙ্গে সঙ্গে প্রশ্নের পর প্রশ্ন করে যাচ্ছিলাম। তুমি এখানে কীভাবে এলে? কীভাবে আহত হলে? ফুটপাথে কতক্ষণ পড়ে আছ? কাছের হাসপাতালে খবর দেব?

‘উত্তর দেওয়ার ক্ষমতা ছিল না ওর। আমার সব প্রশ্ন শেষ হয়ে যাওয়ার পর ও শুধু বলতে পারল, ‘আমার সময় এসে গেছে- ভগবানের ইচ্ছা।’

‘ভগবানের ইচ্ছা কী আমি জানি না; কিন্তু আমি যা জানতাম, তা মেনে নিতে পারিনি : মুসলমান-অধ্যুষিত এলাকায় দাঁড়িয়ে আমি একজনকে মরে যেতে দেখছি- মানুষটা হিন্দু- আর আমি ভালো করেই জানি, যে ওকে আক্রমণ করেছে, সে মুসলমান আর মৃত্যুর দরজায় শুয়ে থাকা মানুষটার সামনে দাঁড়িয়ে আমিও একজন মুসলমান, আমি ভীতু নই; কিন্তু সেই মুহূর্তে অনেক ভীতুর চেয়ে আমি ভীতু। মৃত্যুপথযাত্রী একজন মানুষের সঙ্গে আমাকে ধরা হবে ভেবে আতঙ্কিত হয়েছিলাম, অভিযুক্ত যদি নাও হই, আমাকে তো গ্রেফতার করা হবে, জিজ্ঞাসাবাদ করা হবে। ওকে হাসপাতালে নিয়ে যাওয়ার কথা ভাবতে ভাবতেও ইতস্তত করছিলাম : ওকে যে এমন মারাত্মকভাবে আঘাত করেছে, তার ওপর শোধ তুলতে যদি আমাকে ফাঁসিয়ে দেয়? সহায় জানত, ও মরছে ; তার হারানোর আর কী আছে? আমি চলে যাচ্ছিলাম- বলতে পারো পালিয়ে যাচ্ছিলাম- সহায় আমার নাম ধরে ডাকল। আমি থেমে গেলাম, থাকতে চাইনি, তবু দাঁড়িয়ে পড়তে হল। ওর দিকে তাকিয়ে যেন বলছিলাম : তাড়াতাড়ি মরো, আমাকে যেতে হবে।

‘যন্ত্রণায় দুমড়ে-মুচড়ে ও রক্তমাখা জামার বোতাম খুলে ভেতরে হাত ঢোকাল। শত চেষ্টাতেও ও কিছু করতে পারল না, আরও নেতিয়ে পড়ল। তারপর আমাকে বলল, ‘আমার ফতুয়ার ভেতরটা একটু দেখুন। কিছু গয়না আর বারশো টাকা পাবেন... ওগুলো সুলতানার... নিরাপদে রাখার জন্য এক বন্ধুর কাছে দিয়েছিলাম... ওগুলো ফিরিয়ে আনতে গিয়েছিলাম... সুলতানাকে পাঠাতে চেয়েছিলাম, কারণ... আপনি তো জানেন... দিন দিন পরিস্থিতি খুব খারাপ হচ্ছে... ওগুলো নিন... সুলতানকে দেবেন... ওকে বলবেন, চলে যেতে... এক্ষুণি... আপনি... আপনি নিজের দিকে খেয়াল রাখবেন।’

গল্প শেষ করে মমতাজ নীরবতায় ডুবে গিয়েছিল। আমি ভাবছিলাম, ওর আর সহায়ের কণ্ঠস্বর- জে জে হাসপাতালের পাশের ফুটপাথে যা শেষবার শোনা গিয়েছিল- এক হয়ে যাচ্ছে, যেমন দূর দিগন্তের অস্পষ্টতায় সমুদ্র ও আকাশ এক হয়ে গেছে।

জাহাজের ভোঁ বেজে উঠলে মমতাজ বলেছিল, ‘আমি সুলতানার কাছে গিয়ে ওকে টাকা আর গয়না দিয়ে এসেছিলাম। ওর দুই চোখ জলে ভরে উঠেছিল।’

বিদায় জানিয়ে আমরা জাহাজ থেকে নেমে পড়েছিলাম। মমতাজ ডেকে দাঁড়িয়ে ডান হাত নাড়ছিল। যুগলকে বললাম, ‘মনে হয় না, মমতাজ সহায়ের আত্মাকে ওর সঙ্গে যাওয়ার জন্য ডাকছে?

যুগল বলেছিল, ‘ইচ্ছে হয়, আমিই সহায়ের আত্মা হয়ে যাই।’ 

ভাষান্তর : রজতশুভ্র রায় চৌধুরী

সাম্প্রতিক দেশকাল ইউটিউব চ্যানেল সাবস্ক্রাইব করুন

মন্তব্য করুন

Epaper

সাপ্তাহিক সাম্প্রতিক দেশকাল ই-পেপার পড়তে ক্লিক করুন

Logo

ঠিকানা: ১০/২২ ইকবাল রোড, ব্লক এ, মোহাম্মদপুর, ঢাকা-১২০৭

© 2024 Shampratik Deshkal All Rights Reserved. Design & Developed By Root Soft Bangladesh

// //