বস্তা

সাজু কায়েসের চোখ দুটি এমনিতেই বড়, মোটা কাচের চমশার ভেতর দিয়ে আরও বড় দেখা যায়, এই মুহূর্তে তার চেয়েও বড় হয়ে গেল সে দুটি। থমকে দাঁড়ালেন তিনি সঙ্গে সঙ্গে। যা ভেবেছেন, জিনিসটা সেটাই কিনা, তার জন্য ঝুঁকে দাঁড়ালেন একটু। তেমন কিছু বুঝতে পারলেন না প্রথমে। দু’পা এগিয়ে গেলেন, আরও একটু ঝুঁকলেন, ধূসর কিছু জঞ্জালের মাঝে আধো জেগে ওঠা জিনিসটা যে একটা বস্তাই, সবশেষে কোনো সন্দেহ রইল না তার।

দু’পা আরও এগিয়ে গেলেন সাজু কায়েস। ভালো করে তাকালেন। মুখ বাঁধা বস্তাটার। ফুলে উঠেছে সেটা; কিন্তু বস্তাটা কিসের এটা বুঝতে না বুঝতেই বোটকা একটা গন্ধ এসে লাগল নাকে। সাজু কায়েসের বুকের ভেতরটা ধুক করে উঠল ঠিক তখনই। ঝট করে সোজা হয়ে দাঁড়ালেন। খুব ধীরগতিতে ডান-বাঁয়ে দু’পাশ, তার চেয়েও ধীরে পেছনের দিকটা দেখে সামনের দিকে তাকালেন। কালচেটে পানির মাঝারি গোছের ডোবাটায় দৃশ্যমান বস্তাটা ছাড়া আপাতত নজর কাড়ার মতো কোনো কিছু নেই, নেই বোধহীন কোনো প্রাণীও।

নিঃশব্দে, অথচ স্বস্তির একটা নিঃশ্বাস ছেড়ে সাজু কায়েস যখন মূল রাস্তার দিকে যাচ্ছিলেন, পাশ দিয়ে রিকশায় যাওয়া ননী ভৌমিক নেমে পড়লেন রিকশা থেকে। রিকশা বিদায় করে দিয়ে সাজু কায়েসের কাছ ঘেঁষে দাঁড়ালেন তিনি। আশপাশ তাকিয়ে গোপন কথা বলার মতো নিচু স্বরে বললেন, ‘দাদা, ঘটনাটা শুনেছেন নাকি?’ 

নাকে নেমে আসা পুরো কাচের চশমাটা ঠেলে ওপরে তুললেন সাজু কায়েস। সেটা ভেদ করে অচেনা দৃষ্টিতে তাকালেন ননী ভৌমিকের দিকে। কিছু বললেন না, কেবল ছোট্ট করে নিঃশ্বাস ছাড়লেন আবার একটা। 

সাজু কায়েসের হাত খামচে ধরলেন ননী ভৌমিক, ‘ঘটনাটা সত্যি শোনেননি!’ মুখটা আরও সামনে ঠেললেন তিনি, ‘উত্তর পাড়ার রফিক শেখকে নাকি খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না।’

‘বলেন কি!’ বড় চোখ আরও বড় করে ফেলেন সাজু কায়েস, ‘কয়দিন হলো খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না?’

‘নয় দিন।’

‘নয় দিন!’ সাজু কায়েস আড়চোখে ডোবাটার দিকে তাকালেন। তারপর আবার সামনের দিকে তাকিয়ে বললেন, ‘এতদিন ধরে লোকটাকে পাওয়া যাচ্ছে না, ব্যাপারটা কেউ খেয়াল করল না!’

‘লোকটার তো একটা বাজে স্বভাব ছিল। কয়দিন পরপরই কাউকে কিছু না বলে বাড়ি থেকে কোথায় যেন যেতেন। দু’তিন দিন পর ফিরে আসতেন আবার। সবাই ভেবেছে এবারও সেরকম দু’তিন দিনের জন্য হাওয়া হয়ে গেছে। তাই তেমন কিছু গা করেনি কেউ।’

‘খুব সাহসীও কিন্তু মানুষটা।’

‘তা তো বটেই।’ ননী ভৌমিক আশপাশ তাকিয়ে সাবধানতা অবলম্বন করে বললেন, ‘তিনি তো প্রায়ই আমাদের এমপি সাহেবকে যা তা ভাষায় গালাগাল করেন। কোথাও কোনো অন্যায় দেখলে তার প্রতিবাদ করেন। আজকাল এসব কেউ করে না। সবাই বাল-বাচ্চা নিয়ে গর্তে বাস করা প্রাণীর মতো জীবনযাপন করছে।’ থুঃ করে থুথু ফেললেন ননী ভৌমিক, ‘ঘেন্না ধরে গেছে, দাদা। তিন কুড়ির কাছাকাছি বয়স হয়ে গেছে অনেক আগেই। আর কয় দিন! মানসম্মান নিয়ে এখন এ কয়টা দিন পার করলেই বাঁচি।’

সাজু কায়েস আলতো করে ননী ভৌমিকের হাড্ডিসর্বস্ব ডান হাতটা চেপে ধরলেন। ননী ভৌমিক টের পেলেন কিছু একটা। বললেন না কিছু। শুধু সাজু কায়েসের পরবর্তী পদক্ষেপের জন্য অপেক্ষা করতে লাগলেন। তার এই অপেক্ষায় উত্তেজনা আছে, অস্থিরতাও আছে, আপাত দৃষ্টিতে ননী ভৌমিকের দিকে তাকিয়ে সেটা টের পাওয়া না গেলেও একটা কাঁপুনি টের পেলেন সাজু কায়েস। কাঁপুনিটা মৃদু, তবে দীর্ঘস্থায়ী।

হাত ধরেই ডোবার দিকে এগিয়ে গেলেন সাজু কায়েস। পনেরো-বিশ ফুট দূরে নিজের দৃষ্টিটা মেলে দিয়ে ইশারা করলেন ননী ভৌমিককে। তাৎক্ষণিকভাবে কিছু টের পেলেন না তিনি। সামনের বড় কচুরিপানাটা সরে যেতেই চমকে উঠলেন সেই কাঁপুনি নিয়েই, ‘ওটা কি দাদা?’

‘আমি জানি না।’ শান্ত গলায় বললেন সাজু কায়েস।

‘মনে তো হচ্ছে একটা বস্তা।’

‘আমারও তাই মনে হচ্ছে।’

ডোবার দিকে একটু ঝুঁকে দাঁড়ালেন ননী ভৌমিক। বিড়বিড় করার মতো বললেন, ‘বস্তাই তো দাদা।’ ঝট করে সোজা হয়ে সাজু কায়েসের দিকে তাকালেন, ‘কিসের বস্তা দাদা?’

‘আমি জানি না।’ শান্ত স্বরে আগের উত্তরটাই দিলেন সাজু কায়েস। চশমটা আবার নাকের নিচে নেমে এসেছে তার।

‘বিপদের গন্ধ পাচ্ছি, দাদা।’

‘আমিও।’

‘এখানে আর দাঁড়িয়ে থাকা ঠিক হচ্ছে না।’ সামনের দিকে পা বাড়ালেন ননী ভৌমিক, ‘চলুন, কেউ এদিকে আসার আগেই কেটে পড়ি। পাছে কোন ঝামেলায় পড়তে হয়!’

মূল রাস্তায় উঠে আসতে পারলেন না তারা। টহল পুলিশের একটা গাড়ি এসে থামলেন তাদের ঠিক সামনেই; কিন্তু তারা যা ভেবেছিলেন, তা না। গাড়ি থেকে একজন পুলিশ অফিসার নামলেন। তাদের দিকে তাচ্ছিল্যেভরা এক পলক তাকিয়ে দু’হাত দিয়ে টেনে ধরলেন প্যান্টের কোমড়ের কাছটা। প্যান্টটা তেমন ওপরে উঠল না। যা-তাভাবে বেড়ে ওঠা ভুড়িটা বাধা হয়ে দাঁড়াল; কিন্তু ডোবার কিনারায় গিয়ে ঝট করে খুলে ফেললেন প্যান্টের সামনের দিকটা। ডোবার পানিতে ঝরঝর শব্দ হওয়ার কয়েক সেকেন্ডের মধ্যে থেমে গেল তা। প্যান্ট খোলা পুলিশটি ধীরগতিতে, সামনের দিকটা লাগাতে লাগাতে ঘুরে দাঁড়াচ্ছিলেন; কিন্তু সম্পূর্ণ ঘুরে দাঁড়ালেন না তিনি। আগের গতিতেই আবার আগের দিকে তাকালেন। নির্ভার চোখ দুটি নির্ভারই রইল, চেহারারও তেমন পরিবর্তন হলো না, কেবল নিচে নেমে যাওয়া প্যান্টটা ওপরে তোলার চেষ্টা করলেন আবার। উঠল না তা, ভুড়ি-বাধায় নেমে গেল আগের জায়গায়। সেই অবস্থাতেই তিনি মাথাটা কাত করলেন, ঝুঁকে দাঁড়ালেন, কয়েক সেকেন্ড দাঁড়িয়েও রইলেন সেভাবে, তারপর সেদিকে তাকিয়ে থেকেই বাম হাতটা পেছনে নিয়ে ইশারা করলেন গাড়িতে বসে থাকা সঙ্গীদের। 

গাড়ি থেকে নেমে এলেন সবাই। কিছুটা দৌড়ে ডোবার কিনারায় এসে দাঁড়ালেন। প্রথমজনের দৃষ্টি অনুসরণ করে সামনের দিকে তাকালেন তারা। কোণার চিকন স্বাস্থ্যের পুলিশটা প্রথমজনের দিকে এগিয়ে এসে বললেন, ‘স্যার, ঘটনা তো খারাপ মনে হইতাছে।’

‘খারাপ তো বটেই।’ টেনে টেনে কথাটা বলেই সামনের দিকে তাকালেন প্রথম পুলিশ, ‘জামসেদ, দ্রুত ওই লোক দুটিকে থামান। কাছে নিয়ে আসুন আমার।’ 

সাজু কায়েস আর ননী ভৌমিককে নিয়ে জামসেদ সাহেব সামনে আসতেই প্রথম পুলিশটি বললেন, ‘আপনারা দু’জনই আমার বুকের দিকে তাকান।’

কথাটা বুঝতে পারেননি, এমন ভাবে তারা তাকালেন পুলিশটির দিকে। মুখ বাঁকা করে হাসতে হাসতে তিনি নিজের বুকের ডানপাশে একটা আঙ্গুল রেখে বললেন, ‘এখানে কী লেখা আছে, তা পড়তে নিশ্চয় অসুবিধা হচ্ছে না আপনাদের-ছদরুল পাটোয়ারী। অনেকে লেখে স দিয়ে, আমারটা হচ্ছে ছ দিয়ে। বাপ-মা রেখেছে, আমার কোনো হাত ছিল না; কিন্তু প্রতিবার যখন নতুন জায়গায় পোস্টিং হয় আমার, সবাই নামটা ভুল লেখে। স দিয়ে লেখে তারা। আমি বলি ছ, ছাগলের ছ। আচ্ছা, ছ দিয়ে আর কোন কোন শব্দ জানা আছে আপনাদের?’

মাথা নিচু করে ফেললেন তারা দু’জনই। সঙ্গে সঙ্গে ছদরুল পাটোয়ারী বললেন, ‘আপনাদের দু’জনকেই তো আমি চিনি। সাজু সাহেব, আপনি হচ্ছেন মসজিদের ইমাম; ননী ভৌমিক, আপনি হচ্ছেন স্কুলের শিক্ষক। দু’জনই শিক্ষিত। মাথা নিচু করে ফেললে তো হবে না। ছ দিয়ে আরও কিছু শব্দ হচ্ছে ছিনাল, ছোটলোক, ছিঁচকা, ছন্নছাড়া, ছ্যাবলামি, ছেঁচর, ছুঁচো, ছিলিম-।’ ছদরুল পাটোয়ারী দু’জনের দিকে ভালো করে তাকালেন, ‘ছিলিম মানে কি জানেন তো?’ একটু থামেন তিনি, ‘ছিলিম মানে হচ্ছে গাঁজার কলকে।’

সাজু কায়েস অস্ফুট স্বরে বলেন, ‘জি।’

সমস্ত শরীরটা এক পাক ঘুরিয়ে ছদরুল পাটোয়ারী বললেন, ‘এই জায়গাটা বেশ চমৎকার। আপনারা কী বলেন?’

‘জি।’ আগের মতোই ছোট্ট করে উত্তর দিলেন সাজু কায়েস।

‘নির্জনও।’

‘জি।’ সাজু কায়েসই উত্তর দিলেন। 

‘বেশ ফুরফুরে বাতাস চারপাশে।’

সাজু কায়েস এবারও জি বলতে যাচ্ছিলেন, কিন্তু ছদরুল পাটোয়ারী হাত দিয়ে ইশারা করে থামিয়ে দিলেন তাকে। চোখ দুটি সামান্য সরু করে ননী ভৌমিকের দিকে তাকালেন। আলতো করে হাত রাখলেন তার কাঁধে, ‘মাস্টার মানুষ তো কথা বেশি বলে ননী সাহেব; কিন্তু আপনি তো দেখছি তার উল্টো। ভালো। কথা কম বলা বুদ্ধিমানের লক্ষণ। কথা যত কম বলা যায়, ঝামেলা থেকেও তত দূরে থাকা যায়; কিন্তু এখন যে আপনাকে কিছু কথা বলতে হবে।’ ডোবার দিকে ফিরলেন ছদরুল পাটোয়ারী, ‘আপনাকে প্রথম যে প্রশ্নটা করা উচিত-ডোবায় একটা বস্তা দেখা যাচ্ছে, যেটা বেশ ফুলে উঠেছে, বেশ গন্ধও বের হচ্ছে সেটা থেকে, বস্তাটা আপনি দেখেছেন কিনা? না, এ প্রশ্নটা আপনাকে করব না। কারণ বস্তাটা আপনি দেখেছেন, এবং-।’ সাজু কায়েসের দিকে তাকালেন ছদরুল পাটোয়ারী, ‘ইমাম সাহেব, আপনিও দেখেছেন।’ নিচে নেমে যাওয়া প্যান্টটা আবার ওপরে তোলার ব্যর্থ চেষ্টা করলেন তিনি, ‘আমার প্রশ্ন হচ্ছে-বস্তাটার ভেতর কী আছে বলে আপনাদের মনে হয়। না না, ইমাম সাহেব না, মাস্টার সাহেব উত্তর দিন।’

‘স্যার, আমি ঠিক বলতে পারব না।’

‘ছি-ছি, আপনি আমাকে স্যার বলছেন কেন? আমি তো আপনার ছেলের বয়সী। আমারই বরং আপনাকে স্যার বলা উচিত।’ ছদরুল পাটোয়ারী চেহারাটা কঠিন করে ফেললেন, ‘বস্তাটার ভেতর কী আছে, সেটা আপনি বলতে পারবেন না; কিন্তু একটা বস্তা যে ডোবায় ভেসে উঠেছে, সেটা তো আমাদের কাউকে বলতে পারতেন, জানাতে পারতেন। নাকি পারতেন না?’

‘জি, পারতাম।’ মাথা নিচু করে ফেললেন ননী ভৌমিক। 

‘গুরুতর একটা অপরাধ করেছেন আপনারা। ডিম থেরাপি কিংবা গরম পানিতে বিশেষ অঙ্গ চুবানোর মতো শাস্তি না হলেও একটা শাস্তি আপনাদের পাওনা হয়ে গেছে।’ সামনের উঁচু জায়গাটা দেখিয়ে ছদরুল পাটোয়ারী বললেন, ‘আপনারা আপাতত ওই জায়গাটায় গিয়ে বসুন।’ চিকন পুলিশ জামসেদের দিকে তাকালেন ছদরুল পাটোয়ারী, ‘ফায়ার সার্ভিসকে খবর দিন। বস্তাটা তুলতে হবে ডোবা থেকে।’ নিচে নেমে যাওয়া প্যান্টটা আবার ওপরে তোলার চেষ্টা করলেন ছদরুল পাটোয়ারী, এবারও পারলেন না। বোটকা গন্ধটা একটু পরপরই নাকে এসে লাগছে। থুঃ করে একদলা থুথু ফেললেন তিনি মাটিতে।

দুই

‘বাবা দেখেছো, কতগুলো গাড়ি এসেছে!’ বাবার হাত ধরে আছে পিপলু। হাতটা আরও জোরে চেপে ধরে বলল, ‘সব টিভির গাড়িই এসেছে।’

মুনতাসীর সাহেব ছেলের দিকে তাকালেন, কিছু বললেন না। গাড়িগুলোর পাশ দিয়ে হাঁটতে হাঁটতে সামনের দিকে যাচ্ছেন তিনি। বিশ-পঁচিশ মিনিট আগে এসেছেন এখানে। লোকে লোকারণ্য হয়ে গেছে চারপাশ। পা ফেলার জায়গা নেই কোথাও।

পিপলু হঠাৎ কিছুটা শব্দ করে বলল, ‘বাবা, আমাদের স্কুলের অঙ্ক স্যার বসে আছেন ওখানে।’ সামনের দিকে হাত বাড়াল পিপলু, ‘ওই যে!’

‘উনি ওখানে কেন!’

‘আমারও তো একই প্রশ্ন বাবা।’

‘তুমি কি ওনার সঙ্গে কথা বলতে চাও?’

‘বলতে ইচ্ছে করছে বাবা। দেখো না, কেমন ম্লান মুখে বসে আছেন তিনি। আরে-।’ পিপলু উদ্বিগ্ন স্বরে বলল, ‘আমাদের মসজিদের হুজুরকেও তো দেখছি। উনিও তো বসে আছেন!’ বাবার হাতটা টেনে ধরল পিপলু, ‘বাবা, দেখো দেখো-।’ আবার সামনের দিকে হাত বাড়ায় পিপলু, ‘টিনারাও এসেছে। ওদের বাবাকে তো অনেকদিন ধরে খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না। বাবা-।’ পিপলুর দুঃখী দুঃখী গলা, ‘টিনার মা কাঁদছেন।’

‘টিনা কি তোমাদের স্কুলে পড়ে?’

‘হ্যাঁ, আমার এক ক্লাস নিচে পড়ে, সিক্সে।’

টিভির সাংবাদিকরা মাউথপিস হাতে যার যার বক্তব্য বলে যাচ্ছেন ক্যামেরার সামনে। পত্রিকার সাংবাদিকরা একে ওকে বিভিন্ন প্রশ্ন করছেন। ফায়ার সার্ভিসের লোকজন ব্যস্ততা নিয়ে ছোটাছুটি করছেন এদিক-ওদিক। ছদরুল পাটোয়ারীর সামনে অনেক স্যুট-টাই পরা মানুষ দাঁড়িয়ে, ব্যস্ততা নিয়ে হাত নেড়ে নেড়ে কথা বলছেন। গুনগুন শব্দে ভরে গেছে চারদিক, মাঝে মাঝে উচ্চ স্বরে কথা বলছে কেউ। তারপর হঠাৎ পিনপতন নীরবতা। বিশেষ ধরনের পোশাক পড়ে দু’জন লোক ডোবাতে নামছেন, নাক ঢাকা তাদের। পানিতে পা রাখলেন তারা প্রায় একসঙ্গে। স্থির কালচেটে পানি কেঁপে কেঁপে সরে যাচ্ছে, কেঁপে উঠছে চারপাশে দাঁড়ানো মানুষের বুকের ভেতর, কেঁপে উঠছে চোখের পাতা, ঠোঁট, শরীর, পায়ের নিচের ঘাস। 

নাক ঢাকা লোক দু’জন বস্তাটার একেবারে কাছে গিয়ে থামলেন। কিছুটা ইতস্তত করে হাত রাখলেন একজন বস্তার ওপর। আলতো করে টান দিতেই সরে এলো বস্তাটা। এবং আরও একটু ভেসে থেকে ডুবে যেতে যাচ্ছিল সেটা। তার আগেই খপ করে টেনে ধরলেন একজন, পাশের জন টেনে ধরলেন আরেক পাশটা। ডাঙ্গায় দাঁড়ানো মানুষগুলো উদ্বিগ্ন, নিঃশ্বাস বন্ধ হয়ে গেছে কারো কারো, কেউ কেউ বড় বড় করে ফেলেছেন চোখ।

বস্তাটা ধরে আস্তে আস্তে ডোবার কিনারার দিকে আসছে লোক দু’জন। চারপাশের মানুষজন ঠেলে সামনের দিকে আসতে চাচ্ছে। পরস্পর হাত ধরে অনেকগুলো পুলিশ বাধা দিচ্ছে তাদের। টিভির ক্যামেরাগুলো প্রায় স্থির হয়ে আছে বস্তাটার দিকে। কেউ কেউ মাউথপিস হাতে কথা বলে যাচ্ছেন অনবরত।

ডোবার একেবারে কিনারায় চলে এসেছে বস্তাটা। স্যুট-টাই পরা কয়েকজন লোকের সঙ্গে সেদিকে এগিয়ে গেলেন ছদরুল পাটোয়ারী। প্রত্যেকের নাকে রুমাল চাপা দেওয়া। লোক দু’জন বস্তাসহ উপরে উঠে এসে তাদের দিকে তাকালেন। ফিসফিস করে পরস্পর কী যেন কথা বলে নিলেন তারা, তারপর ইশারা করলেন দু’জনকেই।

দ্রুত বস্তাটা খুলতে লাগলেন দু’জন। বেশ শক্ত করে বাধন দেওয়া হয়েছে বস্তাটার মুখে। কারও কারও কান্নার শব্দ পাওয়া যাচ্ছে আশপাশ থেকে। মানুষজন আবার ঠেলে সামনে আসার চেষ্টা করছে, পুলিশও বাধা দিচ্ছে সমান্তরালে। হঠাৎ চুপচাপ চারপাশ। 

খোলা হয়ে গেছে বস্তাটা। চোখ বড় বড় হয়ে গেছে বস্তার কাছে থাকা সবার। সবার চোখে অবিশ্বাস, কিংকর্তব্যবিমূঢ়তাও। 

বস্তার নিচের দিকটা ধরে ভেতরের জিনিসটা বের করে ফেললেন লোক দু’জন। ডোবার কিনারায় ঘাসের ওপর রাখা হলো জিনিসটা। সঙ্গে সঙ্গে হুমড়ি খেয়ে পরলেন আশপাশেই সবাই। কয়েক সেকেন্ড। তারপর সবার চোখে হতাশা, শরীরে হতাশা, মুখে হতাশা-ধ্যাত!

পিপলু বাবার হাতটা একটু টেনে ধরে বলল, ‘বাবা, এত একটা কুকুর! মরে একেবারে পচে গেছে!’

মুনতাসীর সাহেব ছেলের কথার কোনো জবাব দিলেন না। চোখ মেলে তিনি দেখতে লাগলেন চারপাশটা-আজকের বস্তায় কোনো মানুষের লাশ না থাকায়, প্রতিনিয়ত বস্তায় লাশ পাওয়ায় অভ্যস্ত মানুষগুলো প্রচণ্ড হতাশ, বিরক্ত, অনেকটা মর্মাহতও!

সাম্প্রতিক দেশকাল ইউটিউব চ্যানেল সাবস্ক্রাইব করুন

মন্তব্য করুন

Epaper

সাপ্তাহিক সাম্প্রতিক দেশকাল ই-পেপার পড়তে ক্লিক করুন

Logo

ঠিকানা: ১০/২২ ইকবাল রোড, ব্লক এ, মোহাম্মদপুর, ঢাকা-১২০৭

© 2024 Shampratik Deshkal All Rights Reserved. Design & Developed By Root Soft Bangladesh

// //