জেলে একা ডা. আফ্রিনা আখতার

হৃদরোগ বিশেষজ্ঞ প্রফেসর আফ্রিনা আখতার একটি টিভি-চ্যানেলের কৃতী নারীবিষয়ক অনুষ্ঠানে যেদিন সাক্ষাৎকার দেয়, কৈশোরের স্বপ্ন প্রসঙ্গে সিনেমার নায়িকা হওয়ার ইচ্ছেটির কথা বলার সময় প্রকৃত নায়িকাসুলভ মোহন হাসিও ফুটেছিল মুখে। কারণ ওই টিভি অনুষ্ঠানের বছর বিশেক আগে, কলেজে পড়ার সময়েও আয়নায় মুখোমুখি সাজুগুজু করতে বসে নিজেকে নায়িকা ভাবলেও মনে পুলক জাগত। সামনে ক্যামেরাম্যান কল্পনা করে নানা ভঙ্গির পোজ দিয়েও আয়নায় নিজেকে উল্টেপাল্টে দেখেছে কত! নির্জন ঘরে নাচ ও মিষ্টি হাসির প্র্যাকটিসটাই করত বেশি। মায়ের মাধ্যমে বাবাও একদিন মেয়ের অ্যাম্বিশনের কথা জেনে কঠোরভাবে শাসন করেছে, ‘ভালো রেজাল্ট করে হায়ার এডুকেশন আগে শেষ কর। আমার ডাক্তার মেয়ের বাপ হওয়ার স্বপ্নটি পূরণ করে যা খুশি হও কিংবা যা খুশি কর, আমি বাধা দেবো না।’

‘কৃতী নারী’ অনুষ্ঠানে সাক্ষাৎকার দেওয়ার সময় বাবার স্বপ্ন পূরণের গর্বে এবং অনুষ্ঠানে সক্রিয় ক্যামেরার অপলক দৃষ্টিতে তাকানো দেখেও হয়তো-বা, সত্যি নায়িকার মতো বিশ বছর আগের প্র্যাকটিস করা হাসিটা ফুটেছিল মুখে, হাসিতে সাফল্যের গর্ব ও আত্মবিশ্বাস মিশে ছিল অবশ্যই। টিভির প্রযোজক অনুষ্ঠানের ভিডিও ক্লিপ ছেড়েছিল ফেসবুকে। যারা টিভিতে ও ফেসবুকে কৃতী নারী ডা. আফ্রিনাকে দেখেছে, তাদের অনেকেই ফোনে ও ফেসবুকেও খুশি হওয়ার মতো প্রতিক্রিয়া ও মন্তব্য করেছে। ফেসবুকে লিখেছিল একজন, ‘আপনি সত্যিই নায়িকার মতো সুন্দর ম্যাডাম। এখনো নামতে পারেন চলচ্চিত্রে।’ বেশ কিছু হৃদরোগীও তার চিকিৎসা নেওয়ার আগ্রহ প্রকাশ করেছিল ওই সাক্ষাৎকারের প্রভাবে। তবে সবচেয়ে বেশি প্রভাবিত হয়েছিল প্রেমিক জহির। টিভি পর্দাতেও মুম্বাইয়ের যে কোনো গ্লামারাস নায়িকার চেয়েও বেশি আকর্ষণীয় মনে হয়েছিল তার আফ্রিনাকে। ভালো লাগার আবেগে সেদিনই প্রথম নিজের ব্যবসায়িক উদ্যোগে শরিক করার জন্য আফ্রিনাকে সরাসরি প্রস্তাব দিয়েছিল সে। ‘সিনেমার সেক্সি নায়িকা নয়, বাস্তবের একজন বিশেষজ্ঞ ডাক্তার হিসেবেই তোমাকে আরও কৃতী ও সফল নায়িকা বানাব আমি। ফিল্মি নায়িকাদের চেয়েও খ্যাতি, আয়-উন্নতি ও সামাজিক মর্যাদা বেশি হবে তোমার।’ 

এ শুধু স্বপ্নের উচ্ছ্বাস নয়, স্বপ্ন বাস্তবায়নের জন্য শিগগির একটা প্রাইভেট হাসপাতাল প্রতিষ্ঠার উদ্যোগ নেবে জহির। সেই হাসপাতালের শেয়ার হোল্ডার হিসেবে পরিচালনা কমিটির চেয়ারম্যান হবে ডা. আফ্রিনা। এখন সরকারি হৃদরোগ হাসপাতালের প্রফেসর হিসেবে চাকরি করে এবং অন্য এক প্রাইভেট হাসপাতালে সার্জারি করে যা রোজগার করে আফ্রিনা, তার চেয়েও শতগুণ বেশি আয় করবে। সরকারি চাকরিতে আছে বলে সরকারের স্বাস্থ্য বিভাগের কর্তাদের মন জুগিয়ে চলতে হয়, কিন্তু নিজের হাসপাতালটি প্রতিষ্ঠা পেলে বহু ডাক্তার-প্রফেসরকে চাকরি দেবে আফ্রিনা আখতার।

পরিচিত সহকর্মী-স্বজনদের কেউ এরকম স্বপ্ন দেখালে দ্বিধা-সন্দেহ জাগত; কিন্তু জহির জাত ব্যবসায়ী পরিবারের ছেলে। অল্প বয়সে নিজেও সফল ব্যবসায়ী হিসেবে প্রতিষ্ঠিত। তার জুতা ও চামড়া রফতানির ব্যবসায়ের বিশদ না জানলেও জহিরের নিজস্ব গাড়ি, অফিস ও ভিআইপিদের সঙ্গে ওঠাবসার বহু পার্টিতে শরিক হয়ে দেখেছে আফ্রিনা। তার চেয়েও বড় কথা, ডিভোর্সের পর ওই সময়ে জহিরই হয়ে উঠেছিল তার সবচেয়ে নির্ভরযোগ্য বন্ধু। আফ্রিনার জন্য পানাহারে টাকা খরচ করতেও ছিল উদারহস্ত। জহিরের প্রস্তাবে মনে খুশির পুলক জেগেছিল তাই। 

মাত্র বছর খানেকের মধ্যে আফ্রিনা-জহির সংক্ষেপে এজেড হেলথ কেয়ার হাসপাতাল প্রতিষ্ঠা এবং শুভযাত্রায় কাগজপত্রে আফ্রিনাকে ম্যানেজিং কমিটির চেয়ারম্যান বানিয়ে নিজের যোগ্যতার প্রমাণ রেখেছিল জহির। মোটা অংকের প্রত্যাশিত ব্যাংকঋণ পায়নি বলে শুরুতে বড় হাসপাতালগুলোর যোগ্য প্রতিদ্বন্দ্বী হয়ে উঠতে পারেনি; কিন্তু তার স্বপ্ন ও ভালবাসায় আস্থা জেগেছিল আফ্রিনার, সব দ্বিধা-দ্বন্দ্ব ঝেড়ে বিয়েতেও মত দিয়েছিল। 

কৃতী নারীবিষয়ক অনুষ্ঠানটিতে সে অবশ্য সরকারি চাকরির বাইরে তার পেশাগত স্বপ্ন, এজেড হাসপাতাল কিংবা ব্যবসায়ী স্বামীর সঙ্গে সম্পর্কের বিষয়ে কিছুই বলেনি। কারণ পেশাগত জগতে তখনো আফ্রিনাকে প্রথম বিয়ের ডাক্তার স্বামীর সঙ্গে সম্পর্কিত জানত অনেকেই। জহিরকে চিনিয়ে আপন পেশা ও ব্যবসায়ের বিজ্ঞাপন-মডেল হতে চায়নি সে। সাক্ষাৎকার গ্রহণকারীর প্রশ্নের জবাবে ব্যক্তিগত ও পারিবারিক কিছু প্রসঙ্গে জবাব দিলেও, প্রেম ও বৈবাহিক সংক্রান্ত প্রশ্ন মিষ্টি হাসি দিয়েই চাপা দিয়েছিল। স্বাধীনচেতা সে অবশ্যই। তাই বলে একাধিক বিয়ে, প্রেমের সম্পর্ক কিংবা উদার লাইফস্টাইলের কথা বলে সংরক্ষণশীল এ সমাজে বিদ্রোহী, ফেমিনিস্ট অথবা কলঙ্কিনি নারী হিসেবে বদনাম কুড়াতে চায়নি কখনো। মধ্যবিত্ত পরিবারের মেয়ে। বাবা-মায়ের মতামতকেও গুরুত্ব দিয়ে চলেছে বরাবর; কিন্তু কৃতী নারীর ওই টিভি সাক্ষাৎকার প্রচারের মাত্র বছর চারেক পরে কয়েক ডজন টিভি চ্যানেলের সাংবাদিক-ক্যামেরা তার ব্যক্তিগত জীবন, বিশেষ করে জহিরের সঙ্গে সম্পর্কের মধু আহরণে মৌমাছির মতো ছেকে ধরবে, স্বপ্নেও ভাবেনি আফ্রিনা। চারপাশে ক্যামেরা-সাংবাদিকদের ভিড় দেখে নিজের টিভি-অভিজ্ঞতা ও জহিরের প্রতিক্রিয়া মনে পড়েছিল। সেইসঙ্গে চকিতে অকালপ্রয়াত ব্রিটিশ রাজবধূ ডায়নার ট্রাজিক মৃত্যুর কথাও মনে পড়েছিল কেন? ডায়ানার দুর্ঘটনার সঙ্গে তার গোপন অভিসারের খবর জানতে সাংবাদিক-ক্যামেরাম্যানদের অস্বাভাবিক কৌতূহল ও ভিড়ের সম্পর্ক থাকার কারণেই সম্ভবত। ক্যামেরার ভিড় দেখে বিখ্যাত নায়িকা হওয়ার স্বপ্নটির কথা মনে পড়েছিল ঠিকই, কিন্তু কৃতী নারীর অনুষ্ঠানসুলভ মিষ্টি হাসি ফোটেনি মুখে। তার বদলে ক্যামেরা দেখে চিনচিনে কষ্ট ও ভয়ের অনুভূতি মুখে বিষণ্ণ ছায়া ফেলেছিল। সাংবাদিকদের কোনো প্রশ্নের জবাবে একবারও মুখ খোলেনি ডা. আফ্রিনা আখতার। থানায়, কোর্টে কিংবা রাস্তায় সাংবাদিক-জনতার কৌতূহলী ভিড়ের আক্রমণাত্মক প্রশ্ন চোখেমুখে যে প্রতিক্রিয়া এনেছিল, তা আড়াল করার জন্য চোখে সানগ্লাস এবং মুখে করোনা ঠেকানো মাস্ক ছিল বলে কিছুটা আত্মরক্ষা হয়েছে। বাকি সুরক্ষা দিয়েছে পুলিশ। পুলিশ প্রোটেকশন দিয়ে নিজেদের গাড়িতে থানা-হাজত ও আদালতে আনা-নেওয়ার দায়িত্বে ছিল বলেই অবাঞ্ছিত সাংবাদিক ও কৌতূহলী জনতার হুল ফোটানো প্রশ্নবাণ থেকে মুক্তি পেয়েছিল ড. আফ্রিনা। তবে সব প্রশ্নের জবাব সাংবাদিকদের মুখের ওপর ছুড়ে দেওয়ার জন্য একটা পাল্টা প্রশ্ন তার মুখোশ ফুড়ে বেরিয়ে যাওয়ার উপক্রম হয়েছিল বারংবার। নিঃশব্দ চিৎকারে নিজেকে তা অনেকবার শুনিয়েছে আফ্রিনা, আমি একা কেন? ডা. আফ্রিনার স্বাভাবিক এ জিজ্ঞাসাটাও কারও মনে জাগেনি। অবশেষে পুলিশ প্রোটেকশন থেকে মুক্ত হয়ে ডা. আফ্রিনা এখন জেলহাজতে। মুখোশ ও চশমা খুলে আয়না ছাড়া একা নিজের মুখোমুখি হলে অনুচ্চারিত প্রশ্নটি আবারও মনে সোচ্চার হয়, আমি একা কেন? 

একা অবশ্য নয়, এজেড হেলথ কেয়ারের প্রতিষ্ঠাতা এমডি জহির ও ম্যানেজারকেও পুলিশ আগে অ্যারেস্ট করেছে। সিলগালা করা দেওয়া হয়েছে হাসপাতালটি। থানা-পুলিশ ও রিমান্ড শেষে কোর্টের নির্দেশে জহির জেলে আছে দশদিন ধরে। পুলিশ এখনো আনুষ্ঠানিক চার্জশিট দেয়নি, কিন্তু সংবাদপত্রে এজেড হাসপাতাল ও হাসপাতালের চেয়াম্যান-এমডি সম্পর্কে কেচ্ছাকাহিনি লেখা হচ্ছে রঙ মিশিয়ে। বিশ্বময় করোনা মোকাবেলা প্রতিটি দেশে সরকারের সর্বোচ্চ গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব হয়ে উঠেছে। করোনা রোগী সামলানো শুধু সরকারি হাসপাতালের পক্ষে সম্ভব নয় বলেই কর্মতৎপর হয়েছে বহু বেসরকারি হাসপাতাল। সম্মুখসারির যোদ্ধা হিসেবে ডাক্তার-নার্সদের করতালি বাজিয়ে অভিনন্দন জানাচ্ছে বিশ্ববাসী। এ পরিস্থিতিতে এজেড হাসপাতালের করোনা দুর্নীতির খবরটি লুফে নিয়েছে মিডিয়া জগৎ। যোগ্যতা না থাকা সত্ত্বেও সরকারের কাছে এজেড করোনা পরীক্ষার লাইসেন্স পেয়েই ভুয়া টেস্ট আর ভুয়া সর্টিফিকেট বেচে লাখ লাখ টাকা রোজগার করেছে; কিন্তু করোনা পজিটিভকে নেগেটিভ ও নেগেটিভকে পজিটিভ বানাবার ব্যবসায় ধরা খেতেও সময় লাগেনি। ভুক্তভোগী রোগীরা প্রমাণ দিলে জনস্বার্থে নিউজ ও সোস্যাল মিডিয়া বাংলাদেশের চিকিৎসা ব্যবস্থার দুর্নীতি নিয়ে শোরগোল তোলে। আন্তর্জাতিক মিডিয়াতেও বাংলাদেশের করোনা-পরিস্থিতি প্রসঙ্গে দুর্নীতি ও এজেড হেলথ কেয়ারের নাম আসে। সরকারের আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর তৎপরতায় এজেডের প্রতিষ্ঠাতা এমডি ধরা না পড়ে যাবে কোথায়? বিদেশে পালানোরও সুযোগ পায়নি সে। সরকারি অনুমোদনের যথাযথ কাগজপত্র না পেয়ে র‌্যাব হাসপাতালটি সিলগালা করে দেয়। ম্যানেজারকেও অ্যারেস্ট করে। এ পর্যন্ত সবই ঠিক ছিল। জহিরের বিবাহিত স্ত্রী হিসেবে ডা. আফ্রিনা আতঙ্কিত ও অস্বস্তি বোধ করলেও আপত্তির কিছু ছিল না।

কিন্তু জহিরকে জেলে ঢোকানোর পরও সরকারি হাসপাতালের কার্ডিওলজির মহিলা সার্জন প্রফেসর আফ্রিনাকে তার ব্যবসায়িক দুর্নীতির সঙ্গে জড়িত করাটাকে মোটেও স্বাভাবিক এবং যৌক্তিক পদক্ষেপ ভাবতে পারে না সে। জহির ধরা পড়ার পর থেকেই আফ্রিনাকেও তার অনুগামী করার জন্য একটি মহল অবশ্য তৎপর হয়ে উঠেছিল। হিংসুটেদের চক্রান্ত ঠেকাতে আফ্রিনাও এক নাগাড়ে সবাইকে, বিশেষ করে নিজেকে পাল্টা যুক্তি-প্রমাণ দিয়েছে। নির্দোষ সে। আসলেই নিজেকে শতভাগ নির্দোষ ভাবে সে। অন্তত এই কেসে জেলে ঢোকার মতো জামিন অযোগ্য অপরাধ করেনি আফ্রিনা।

জহিরের কোনো ব্যবসায়েরই শেয়ারহোল্ডার বা পার্টনার হিসেবে কাগজপত্রে তার নাম নেই। হ্যাঁ, এজেড হেলথ কেয়ার হাসপাতালের পরিচালনা বোর্ডে সে নামে মাত্র চেয়ারম্যান; কিন্তু এটা অনারারি পদ ছাড়া কিছু নয়। সরকারি হাসপাতাল ছাড়া প্রফেসর আফ্রিনাকে অন্য কোনো হাসপাতালের বেতনভুক ডাক্তার প্রমাণ করতে পারবে না কেউ। হ্যাঁ, প্রতিষ্ঠালগ্ন থেকে এজেড হাসপাতালটি দাঁড় করানোর ক্ষেত্রে তার একটা ভূমিকা ছিল অবশ্যই; কিন্তু দেশের কোন বিশেষজ্ঞ প্রফেসর-ডাক্তারটি সরকারি হাসপাতাল-কলেজে চাকরি করেও বিভিন্ন প্রাইভেট হাসপাতাল ও ক্লিনিকের সঙ্গে জড়িত থেকে এবং প্রাইভেট রোগী দেখে লাখ লাখ টাকা রোজগার করছে না? অন্যদের আয়ের তুলনায় ডা. আফ্রিনার প্রাইভেট আয়-উন্নতি বরং সামান্যই। মূল অপরাধটি আসলে তার কৃতী নারীর স্বপ্ন-সাফল্যের মধ্যেই নিহিত। চারপাশে এত ভক্ত প্রেমিক থাকতেও সে ব্যবসায়ী জহিরকে বিয়ে করতে গেল কেন? অল্প বয়সে প্রফেসর হয়েছে সে। মহিলা ডাক্তারদের মধ্যে আফ্রিনাই প্রথম কার্ডিওলজি সার্জেন্ট। বিশেষায়িত সরকারি হাসপাতালে ভালো পোস্টিংও পেয়েছে। তারচেয়েও বড় অপরাধ, মেধাবী ডাক্তার হয়েও নায়িকা হওয়ার মতো ধারালো আকর্ষণীয় চেহারা কেন তার? এবং এরচেয়েও বড় অপরাধ সম্ভবত, এই বয়সেও শরীরে যার এত রূপযৌবন, করোনাকালের অখণ্ড অবসরে সে জহিরের মতো ব্যবসায়ী স্বামী ও আফ্রিনার সঙ্গ-প্রত্যাশী বহু ক্ষমতাবান প্রভাবশালী পুরুষদের পাত্তা না দিয়ে সঙ্গরোধক বর্ম পরে একা এবং স্বাধীনভাবে আছে কেন?

দেশে করোনা আসার আগে থেকে প্রথম স্বামীর মতো দ্বিতীয় স্বামীর সঙ্গেও তার আশু বিচ্ছেদের অবস্থা জানত অনেকেই। বিশেষ করে আফ্রিনার ঘনিষ্ঠ স্বজনরা। কারণ স্বামীর সংসারে নয়, নিজ ফ্ল্যাটের পুরনো সংসারে একা থাকত আফ্রিনা। একা ঠিক নয়, সমাজের আর দশটা চাকরিজীবী মধ্যবিত্ত মেয়ের মতো পারিবারিক দায়িত্ব ছিল তারও। দশ বছরের সন্তানকে মানুষ করার দায় ছাড়াও রিটায়ার্ড বাবা ও বিশ্ববিদ্যালয় পড়ুয়া ছোটবোনকেও রেখেছে নিজের বাসায়। নিজে পরিজনকে সময় দিতে পারত না বলে সার্বক্ষণিক কাজের লোকজন ও আত্মীয়-স্বজনদের উপস্থিতিতে আফ্রিনার একক পরিবারে অভাব ছিল না কোনো। করোনা আসার অন্তত দু’মাস আগে থেকেই কেউ দ্বিতীয় স্বামী জহিরের সঙ্গে সম্পর্কের স্মৃতিছায়া দেখেনি তার বাসায়। সবাই জানত, দ্বিতীয় সংসারও টিকবে না তার। আনুষ্ঠানিক ডিভোর্সটাই বাকি ছিল শুধু। আর করোনা আসার পর শুধু জহিরকে নয়, সঙ্গরোধক বর্ম পরে রোগী, ভক্ত প্রেমিক, বন্ধুসহ গোটা সমাজকে দুরে সরিয়ে রাখাই হয়ে উঠেছিল আত্মরক্ষার একমাত্র পথ; কিন্তু একা হয়েও শেষ পর্যন্ত নিরাপদ থাকতে পারল না আফ্রিনা! সমাজশত্রুর আক্রমণে লণ্ডভণ্ড হয়ে গেল তার একা থাকার স্বাধীনতা ও নিজের আয়ে গড়ে তোলা সংসার।

করোনা আতঙ্কে মানুষের সামাজিক মেলামেশা ও ভিড় ঠেকাতে দেশব্যাপী লকডাউন শুরু হলে সন্তান ও পরিবারকে দেওয়ার জন্য অঢেল সময় পেয়েছিল আফ্রিনাও। সংক্রমণের ভয়ে রোগী দেখা বন্ধ করে দিয়েছিল প্রায় সকল বিশেষজ্ঞ ডাক্তার। মিডিয়ায় চব্বিশ ঘণ্টাই বিশ্বময় করোনার আতঙ্ক জাগানিয়া প্রচার। যেন কোভিড- ১৯-এর মতো বিশ্বে আর কোনো মারাত্মক মহামারি আসেনি আগে। সরকারি লকডাউনে প্রথমদিকে অধিকাংশ হাসপাতাল-ক্লিনিকের স্বাভাবিক কর্মপরিবেশ ছিল না। করোনার আগেই স্বাভাবিক সময়ে এজেড হাসপাতালের সঙ্গে সম্পর্ক প্রায় ছিন্ন করেছিল আফ্রিনা। সরকারি হাসপাতালে নিজের চাকরি বজায় রাখতে যেটুকু সময় ও রোগীসেবা দিতে হতো, করোনাকালে তা থেকেও অব্যাহতি পেয়েছিল। অফিস-চেম্বার ও নানারকম পার্টি-দাওয়াতে যাতায়াত একদম বন্ধ হয়ে গিয়েছিল বলে নিজের ড্রাইভারকেও কিছুদিনের জন্য ছুটি দিয়েছিল। দীর্ঘকাল পর বাসায় সন্তান ও স্বজনদের সান্নিধ্যে থাকার অবসর পেয়ে স্কুল-কলেজ জীবনের নায়িকা হওয়ার স্বপ্নের দিনগুলো যেন ফিরে এসেছিল আফ্রিনার। সাংসারিক কাজে তেমন হাত লাগাতে হতো না বলে শরীর ও রূপচর্চায় সময় দিত অনেকটা। বাইরে বেরিয়ে নিজেকে দেখানোর উপায় ছিল না। ড্রেসিং টেবিলে বসে নিজেই নিজেকে দেখত অনেক সময়। একদিন মাথায় লুকিয়ে থাকা একটি শাদা শত্রুকে খোঁজার সময় ছোট বোন আইরিন ঈর্ষান্বিত ভঙ্গিতে বলেছিল, ‘বিয়ের জন্য বরপক্ষ বাসায় আমাকে দেখতে এলে আমার বদলে তোকে দেখেই পছন্দ করত আপু। ভাগ্যিস কানাডায় নিজের বর ঠিক করে রেখেছি।’

আইরিনের সরল হিংসাটুকু উপভোগ করে অনাবিল হাসিতে খুশি হয়ে জবাব দিয়েছিল আফ্রিনা, ‘দুই স্বামী হজম করে তোর বরকেও কেড়ে তিন নম্বর স্বামী বানাবার কোনো ইচ্ছে নাই আমার। একাই বেশ আছি। আয়নার সামনে বসলে আমার আসলে সিনেমার নায়িকা হওয়ার স্বপ্নটির কথা মনে পড়ে রে। আমার মতো বয়স পর্যন্ত চিত্রনায়িকারা শরীর ঠিক রেখে হাজার হাজার প্রেমিক-ভক্ত সৃষ্টি করছে, কিন্তু নিজেরা বিয়ে না করেও একা বেশ আছে ওরা।’

‘একা আছে ওরা? বিয়ে যারা দেরিতে করছে, গোপন পার্টি-বেলাল্লাপনা আর বয়ফ্রেন্ডের ছড়াছড়ি তাদের। মাসে মাসে বয়ফ্রেন্ড পাল্টায়। পত্রপত্রিকায় কতরকম স্ক্যান্ডাল হয় তাদের নিয়ে। তবে হ্যাঁ, পত্রিকায় দেখলাম, এই করোনা মহামারি মুম্বাই-হলিউডের নায়িকাদেরও ঘরে একা করেছে। দিনে দিনে যে অবস্থা হচ্ছে আপা! দুনিয়াজুড়ে লকডাউন, জীবনে আমার আর কানাডা যাওয়া হবে কী না কে জানে!’

আতঙ্কময় অনিশ্চিত অবস্থা তৈরি হয়েছে বলেই বোধহয় আইরিন কানাডায় তার হবু-স্বামীর সঙ্গে প্রতিদিন ইন্টারনেটে স্মার্টফোনে অনেকটা সময় কাটায়। রাতে নিজের ঘরে একা থাকে বলে আফ্রিনাও পুরনো বন্ধু-ভক্তদের ফোনে অনেককেই সময় ও ভার্চুয়াল সঙ্গ দিয়েছে; কিন্তু এ সময়ে জহিরের সঙ্গে তার দাম্পত্য সম্পর্কের কোনো দাগ খুঁজে পাবে না কেউ আফ্রিনার ফোন বা সোস্যাল মিডিয়া ঘেটে। টানা প্রায় মাস দুয়েক গৃহবন্দি একঘেয়ে অবসর যখন ক্লান্ত করে তুলেছিল, একটি সুখবর জানাতে সহসা জহিরই আবার ফোন করেছিল একদিন। ধরি না ধরি করে ধরেছিল আফ্রিনা। করোনার মধ্যে ব্যবসা-হাসপাতাল যখন অচল, জহির তার আটকে থাকা আড়াই কোটি টাকার ব্যাংকলোনটা ছাড় করাতে পেরেছে অবশেষে। খুশিটা আফ্রিনার সঙ্গে শেয়ার করতে চায় সে।

জহিরের সঙ্গে আলাদা হওয়ার পেছনেও বড় কারণ ছিল টাকা-পয়সা ও নিজের স্বাধীনতা। এজেড হাসপাতাল প্রতিষ্ঠা ও চালু করার পেছনে আফ্রিনা যে অবদান রেখেছে, তার বিনিময়ে জহির প্রাপ্য সম্মানী দিতে পারেনি। কথা ছিল আফ্রিনার সন্তান ও বাবা-বোনসহ পরিবারের দায়িত্ব সেই সামলাবে। কথা রাখেনি বলে নিজের সংসারে একা এবং সরকারি বেতনের ওপর সীমিত হয়ে টানাপোড়েনের মধ্য দিয়েই চলছিল আফ্রিনা। এ সময়ে ফোনে তার ব্যাংকলোন প্রাপ্তির খুশি শেয়ার করতে চাইলে খুশি হয়েছিল আফ্রিনাও। জবাব দিয়েছিল, ‘বেশ তো আমাকে যা দেওয়ার, আমার ব্যাংক অ্যাকাউন্টে ট্রান্সফার করে দাও।’

কিন্তু জহির জেদ ধরেছিল, ডা. আফ্রিনার প্রাপ্য শেয়ারের চেকটা সে আফ্রিনার হাতেই তুলে দিতে চায়। তাছাড়া করোনায় লন্ডভণ্ড- দুনিয়ায় নতুন করে একটা ব্যবসায়িক উদ্যোগ নেয়ার কথা ভাবছে সে। বিষয়টা নিয়ে আফ্রিনার সঙ্গে আলোচনা করা জরুরি। তাছাড়া আফ্রিনার বাবা ও সন্তানের সঙ্গে দেখা করাটা ও কথা বলাটাও দায়িত্ব ভাবছে সে। এসব কারণে হয় আফ্রিনা যাক তার বাসায়, জহিরও আসতে পারে আফ্রিনার ফ্ল্যাটে, অথবা লক ডাউনের মধ্যেও গাড়িতে করে হিলট্রাক্ট বা কক্সবাজারে বেড়াতে গেলেও সব বিষয়েই বোঝাপড়া হতে পারে দু’জনের মধ্যে ।

শেষ পর্যন্ত দ্বিধা নিয়ে জহিরকে নিজের ফ্ল্যাটেই ডেকেছিল আফ্রিনা। আসার সময় ডিপার্টমেন্টাল স্টোর থেকে গাড়ি ভরে প্রচুর বাজার, সৎ ছেলের জন্য চকলেট-কান্ডি ও ডায়াবেটিক শ্বশুরের উপযোগী খাদ্যসামগ্রী কিনে এনেছিল। তারপরও দ্বিধা-সন্দেহ মুক্ত হতে পারেনি আফ্রিনা। এমন নয় তো, করোনা আক্রান্ত হয়েছে জহির, আফ্রিনাকেও সংক্রমিত করার হিংস্র চক্রান্ত নিয়েই বাসায় এসেছে সে? আসার কারণ যাই দেখাক, আফ্রিনার সঙ্গে রাত কাটানোর উত্তেজক মতলবটাও কথার সুরে মিশে ছিল। নিজে দরজা খুলে দিয়ে কিছুটা সন্দেহমুক্ত হয়েছিল আফ্রিনা। মাস্ক ও হাতে গ্লাভস ছিল জহিরের। জিনিসপত্র হাতে ড্রাইভারও ছিল নিরাপদ দূরত্বে। তারপরও জহিরের আনা জিনিসপত্রে হাত দেওয়ার আগে এবং তাকে বসতে বলার আগে আদেশ করেছিল, ‘আগে বেসিনে যাও। ভালো করে সাবান দিয়ে হাতমুখ ধুয়ে আসো।’

জহির তার পকেট থেকে সেপনিলের শিশি বের করে নিজের সতর্কতা প্রকাশ করতে বলেছিল, ‘লকডাউনের পর একমাত্র ব্যাংকের কাজে বেরুনো ছাড়া ঘরেই গৃহবন্দি ছিল এতদিন। কাজের লোকজন ও ড্রাইভারকেও কাছে ঘেষতে দেয়নি।’ তারপরও আফ্রিনার আদেশ মতো জহির বাথরুমে ঢুকেছে আগে।

ডাক্তারি চোখের পরীক্ষায় জহিরের শরীরে করোনার লক্ষণ খুঁজে না পেয়ে আশ্বস্ত হয়েছিল আফ্রিনা। আর দূরত্ব ও অভিমান কমাতে জহির আলাপের শুরুতেই আফ্রিনার নামে পাঁচ লাখ টাকার চেকখানা দিয়ে বলেছিল, ‘এই দুঃসময়ে এতগুলো টাকা হাতে পেয়ে শুধু খুশি হইনি আনা, এটাকে আল্লার অশেষ রহমত মনে হচ্ছে।’

‘এখন ঘরে বসে নিশ্চিন্তে পানাহার করতে পারবে। এ জন্য এত খুশি? আমার অবশ্য সংসার চালাতে চেকটা কাজে লাগবে। সরকারি বেতনটুকু ছাড়া ডাক্তারদের এখন তো সব রকম রুজি-রোজগার বন্ধ।’

‘শোনো, করোনার ভয়ে হাসপাতাল-ক্লিনিক বন্ধ করে ডাক্তার-নার্সদের চুপচাপ ঘরে বসে থাকাটা বেশিদিন চলতে পারে না। এই মহামারি মোকাবেলা যে একা সরকারি হাসপাতাল আর কিছু বিশেষজ্ঞ ডাক্তারদের দ্বারা সম্ভব নয়, দেরিতে হলেও সরকার সেটা বুঝতে পারছে। তাছাড়া করোনা এসেছে বলে তো অন্য অসুখ-বিসুখ থেমে নেই। তবে এই ভাইরাস গোটা ওয়ার্ল্ডে মানুষের স্বাস্থ্যসেবাকে এক নম্বর মানবতা করে তুলেছে। এখন মানবতার সেবা বলো, নিজেদের বাঁচা আর ব্যবসা বলো- এজেড হাসপাতালকে দিয়েই আমাদের করতে হবে।’

‘তার মানে তোমার অচল হাসপাতালকে চালু করতে আমাকে আবার অ্যাক্টিভ করে করোনায় মারতে চাও! এর মধ্যে দেশে কজন ডাক্তার-নার্স করোনায় মারা গেছে জানো সে খবর?’

‘তুমি মরবে কেন আনা? ডাক্তার-নার্সরা যাতে না মরে, এ জন্য বিদেশ থেকে আমি ভালো পিপিই-মাস্ক আমদানির উদ্যোগ নিয়েছি। দেশেও এসব তৈরির ব্যপারে গার্মেন্টস ইন্ডাস্ট্রির এক বন্ধুর সঙ্গে শেয়ারে ব্যবসা করব। কথাবার্তা অনেকদূর এগিয়েছে। এই মহামারি মোকাবিলায় তৎপর হয়ে আমরা মানবতার যেমন সেবা করব, এজেড হাসপাতালকেও এবার এক নম্বরে লাইমলাইটে আনব।’

অতঃপর জহির তার স্বপ্ন-পরিকল্পনার কথা শুধু আফ্রিনাকে নয়, খেতে বসে আফ্রিনার বাবা ও বোনকেও সবিস্তার বলেছিল। মহামারি মোকাবেলায় সরকারি স্বাস্থ্য-বিভাগের সীমাবদ্ধতা প্রকট হয়ে উঠছে বলে করোনা পরীক্ষা ও চিকিৎসার দায়িত্ব বেসরকারি হাসপাতালগুলোকেও দেওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছে সরকার। প্রথম দিকে দশটা হাসপাতালকে সুযোগ দেবে। এই দশটার মধ্যে এজেড ঠাঁই পেলে জহির তার সব ব্যবসা বাদ দিয়ে মহামারিতে মানুষের স্বাস্থ্যসেবা নিয়ে উঠে পড়ে লাগবে। কারণ লকডাউনে ঘরে চুপচাপ বসে থাকলে নিজের, দেশের কিংবা মানবজাতির কোনো লাভ হবে না।

সরকারের স্বাস্থ্যসেবা খাতের নীতি ও দুর্নীতির খবর জহিরের চেয়ে ডা. আফ্রিনা অনেক বেশি ভালো জানে। মূলত স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় থেকে শুরু করে সরকারি দপ্তর-অধিদপ্তরের কর্তাব্যক্তিদের অনেকের সঙ্গেই ডা. আফ্রিনার সুসম্পর্ক পুঁজি করেই জহির এজেড হাসপাতালটি সহজে দাঁড় করাতে পেরেছে। আবারও আফ্রিনাকে ব্যবহার করে নিজের ব্যবসাকে চাঙ্গা করার মতলব আগাম প্রতিরোধ করতে জবাব দিয়েছিল, ‘সরকার করোনা টেস্ট ও চিকিৎসার লাইসেন্স প্রাইভেট হাসপাতালকে দিলেও তোমাকে দেবে না। কয়েকটা হাসপাতালের মালিক সরকারি দল করে, সংসদেও আছে কয়েকজন। সরকারের একদম উচ্চপর্যায়ে তাদের ওঠাবসা। স্বাভাবিকভাবে সরকারি সুযোগ-সুবিধা ওরাই আগে পাবে। তোমার তো করোনা টেস্টের ল্যাব, উপযুক্ত আইসিইউ, যন্ত্রপাতি কিছুই নেই।’

‘নেই, এবার সব হবে। চায়না থেকে সবকিছু ইম্পোর্ট করব আমি। প্রয়োজনীয় সব ইক্যুইপমেন্ট দিয়ে হাসপাতালকে এবার আধুনিক করে ফেলব। করোনা চিকিৎসার জন্য ডাক্তার-টেকনিশিয়ানদের ডাবল বেতন দেব। পুঁজির কোনো সমস্যা হবে না । তুমি শুধু পাশে থাকো, করোনাকালেই আমরা মানুষের সেবায় অগ্রণী ভূমিকা রেখে এজেডকে সচল করব, নিজেরাও ভালো থাকব ইনশাল্লাহ।’

অনিশ্চিতকাল গৃহবন্দি ও নিষ্ক্রিয় অচলাবস্থার ভারে মরার চেয়ে, এরকম কিছু উদ্যোগকেই প্রয়োজনীয় মনে হয়েছিল। মাত্র বছর তিনেক একত্রে থেকে যে বিরোধ ও কাঁটাগুলো তাদের স্বামী-স্ত্রী সম্পর্কের মাঝে দূরত্ব সৃষ্টি করছিল, সেগুলো ছাপিয়ে আবার জহিরের কাছে প্রাপ্তি ও সম্ভাবনার দিকটাই বড় হয়ে উঠেছিল সেদিন। নগদ পাঁচ লাখ মূল্যের চেকখানার প্রভাব তো ছিলই, তার উপর ঘরেই দুজনের নিভৃত পার্টি জমিয়ে তোলার জন্য ব্যাগে আফ্রিনার প্রিয় ব্রান্ড বোতলও এনেছিল জহির। এজেডকে সক্রিয় ও সচল করে তোলার জন্য রাতেই সরকারের সংশ্লিষ্ট কর্তাব্যক্তিদের সঙ্গে ফোনে যোগাযোগ শুরু করেছিল ডা. আফ্রিনা। 

স্বাভাবিক সময়ে যাদের কাছে কাজ আদায় করতে অ্যাপয়েন্টপমেন্ট-ইনভাইটেশন এবং অফিস-বাসা-পার্টিতেও ধর্না দিতে হতো, করোনার লকডাউনে ভার্চুয়াল যোগাযোগেই অনেকটা কাজ সেরেছে আফ্রিনা। ফোনে কি ভিডিওকলে। একজন চিকিৎসক হিসেবে মহামারির বিরুদ্ধে সমুখ সমরে শামিল হওয়ার সদিচ্ছা এবং আতঙ্কিত-বিপন্ন মানুষের সেবা করার দায়টাকে বড় করে দেখেছে ডা. আফ্রিনা; কিন্তু কেউ যদি তার নারীশরীর তথা নায়িকা ইমেজ দ্বারা প্রভাবিত হয়ে থাকে, নগদ আর্থিক লাভটা বড় করে দেখে, তার জন্য একা ডা. আফ্রিনা দায়ী হবে কেন? পেনডেমিকের সঙ্গরোধক কোয়ারেন্টিন কালেও নিজের গৃহবন্দি একাকিত্ব দুঃসহ ছিল। ফলে ভার্চুয়ালি কোনো ক্ষমতাবান আফ্রিনার সঙ্গ-পিপাসায় কাতরতা প্রকাশ করলে আফ্রিনা বড়জোর সহানুভূতি দেখিয়েছে। ফিজিকাল যোগাযোগ, নগদে কিংবা চেকে লেনদেন যেখানে যেমন দরকার, জহিরই ছোটাছুটি করে সেরেছে সব। 

সরকারি লাইসেন্স পাওয়ার পর এজেডকে নিয়ে উঠে পড়ে লেগেছিল জহির। বরাবরই সামর্থ্যরে চেয়ে স্বপ্ন তার অনেক বড়। করোনাকালেও এজেডকে নিয়ে জোর প্রচারণা শুরু করেছিল টিভিতে ও পত্রপত্রিকায়। অনলাইনে চিকিৎসাসেবা দেওয়া, হাসপাতালে এমার্জেন্সি ও বিশেষজ্ঞ চিকিৎসা-সেবার সুযোগ সৃষ্টি, এবং সরকারি হাসপাতালের ভিড় এড়িয়ে সরকার নির্ধারিত রেটেই স্বল্পতম সময়ে করোনা টেস্টের ব্যবস্থা। প্রচারণার জোরে এজেড হাসপাতালের নামখ্যাতিও দ্রুত বাড়ছিল সন্দেহ নেই। একমাত্র এজেড হেলথ কেয়ারই আপাদমস্তক পিপিই পরিহিত টেকনিশিয়ানদের বাড়িতে পাঠিয়েও করোনা পরীক্ষার ব্যবস্থা করেছিল। প্রতিদ্বন্দ্বী বড় হাসপাতালগুলোর এতটা সহ্য না হওয়াই স্বাভাবিক। অন্যদিকে মিডিয়ার মালিক-সাংবাদিক চক্র চিকিৎসা-বাণিজ্যের রাঘব বোয়ালদের ঠোকর বসাতে না পেরে স্বপ্নবাজ জহিরকে ধরেছিল সহজেই। তার সঙ্গে একদার স্বপ্ন-নায়িকা ও বর্তমানের সরকারি ডাক্তার প্রফেসর আফ্রিনাকে আবিষ্কার করে উৎসাহের অন্ত ছিল না মিডিয়া-ফটোগ্রাফারদের। আর চিকিৎসা জগতে করোনা-কালেও এজেড হেলথ কেয়ারের উত্থান, বিশেষ করে এজেড জুটির রমরমা ব্যবসায় দেখে মনোকষ্ট পাওয়ার মতো প্রতিদ্বন্দ্বী তো ছিলই। রূপের ও মেধার কারণে সেই ছাত্রজীবন থেকে সহপাঠি এবং পেশাগত জীবনে সহকর্মীদের কাছ থেকে আফ্রিনা কম ঈর্ষা পায়নি। এদেরই কেউ কেউ এজেডের সীমাবদ্ধতা ও দুর্বলতার দিকগুলো মিডিয়ার ফোকাসে এনেই ক্ষান্ত হয়নি, ভুক্তভোগী রোগীদের দিয়ে মামলাও করিয়েছে থানায়। 

জহিরের সহযোগী হিসেবে মিডিয়ায় নাম আসায় সরকারি কর্তৃপক্ষ যেদিন প্রফেসর আফ্রিনাকে সাসপেন্ড করার সিদ্ধান্ত নেয়, পরিচালকের পরামর্শে সরকারের পরিচিত বড় কর্তাব্যক্তিকে ফোন করেছিল সে। কর্তার মুখ সামনে না থাকায় মুখোমুখি প্রতিবাদটাও ঝাঁঝালো হয়েছিল সেদিন। 

‘স্যার, এজেডকে তো আমি লাইসেন্স দিইনি, আপনারা দিয়েছেন। প্রাইভেট হাসপাতালে চিকিৎসা দেওয়া সরকারি প্রফেসর দেশে আমি একা নই। শত শত আছে। তা হলে একা আমি সাসপেন্ড হবো কেন?’

‘সরকারি ডাক্তার হয়েও তুমি প্রাইভেট এজেড-এর বৈধ পার্টনার, মিডিয়া এটাই হাইলাইট করছে।’

‘কাগজপত্রে আমি এই হাসপাতালের মালিক বা অথরিটি কোনোটাই নই।’

‘কিন্তু তুমি মালিক এমডি জহিরের বিবাহিত স্ত্রী! এটা তো আর মিথ্যে নয়।’

‘জহিরের সঙ্গে ব্যক্তিগত সম্পর্ক ছিল, এখন নেই। আপনিও জানেন, আমি এখন আলাদা, নিজের ফ্ল্যাটে একা আছি। জহির ছাড়াও আরও অনেকের সঙ্গে আমার ব্যক্তিগত সম্পর্ক, বন্ধুত্ব ও ভালো সম্পর্ক থাকতে পারে। আছেও। এই অপরাধে আমার চাকরি যাবে কেন?’

ডা. আফ্রিনার ধারালো যুক্তি ক্ষমতাধর কর্তাব্যক্তি বুঝেছিল ঠিকই, সান্ত্‌বনা ও পরামর্শ দিয়েছিল, ‘দেখো আনা, জহিরের সঙ্গে তোমার বৈধ সম্পর্ক সত্ত্বেও মিডিয়াগুলি তোমাকে নিয়ে উঠে পড়ে লেগেছে। পিএম সচিবালয়েরও নজরে এসেছো তুমি। এর সঙ্গে যদি মিডিয়া তোমার অতীতের বা বর্তমানের ব্যক্তিগত অবৈধ সম্পর্কের গন্ধ পায়, তা নিয়েও আরও লেখালেখি হবে। তোমার পক্ষে যাবে না কোনোটাই। কারণ সরকারের সব মন্ত্রণালয়ে দুর্নীতি হচ্ছে; কিন্তু মিডিয়ার চোখ এখন আমার মন্ত্রণালয়ে। এই অবস্থায় আমার পরামর্শ হলো, আপাতত মুখে কুলুপ এঁটে চুপচাপ থাকো। বাধ্য হয়ে সরকার কিছু আইনগত পদক্ষেপ নিলে আইনগতভাবেই তা মোকাবেলা কর। সময়ে স্বাভাবিক হবে সবকিছুই।’

নির্ভরযোগ্য ক্ষমতাকেন্দ্র থেকে এরকম গায়েবি আওয়াজ শোনার পর, একা কেন - প্রশ্নের যন্ত্রণা নিয়ে মুখে কুলুপ এঁটে একাই ছিল আফ্রিনা। জহিরের অনুগামী করার জন্য পুলিশ তাকে কোর্টে তুললে জামিনের জন্য চেষ্টা করেছিল জহিরের নিয়োগকরা আইনজীবী। জামিন না হওয়ায় উকিল সান্ত্‌বনা দিয়েছিল আফ্রিনাকে, ‘কী করবেন ম্যাডাম, পরিস্থিতি খারাপ। সরকার, আদালত সবাই এখন পাবলিক সেন্টিমেন্টকে গুরুত্ব দিয়ে চলছে। আপাতত কিছুদিন জেলে গিয়ে কোয়ারেন্টিনে থাকেন। মিডিয়ার ফোকাসটা অন্যদিকে ঘুরুক, শিঘ্রই হাইকোর্টে অবশ্যই আপনাদের জামিন আদায় করে ছাড়ব।’

আফ্রিনাকে পুলিশ অ্যারেস্ট করার আগের দিন রাতে অচেনা এক নাম্বার থেকে জেল থেকে ফোন করেছিল জহির। চেনা কণ্ঠ শুনেও প্রথমে বিশ্বাস হতে চায়নি। জেল থেকেও জহিরের গায়েবি কণ্ঠ সাহস জুগিয়েছে আফ্রিনাকে, ‘আমার পর একজন সরকারি ডাক্তারকেও জেলে ঢুকিয়ে ওরা সাধু সাজতে চায় বুঝলে! তুমি ভয় পাবে না আনা। আমার উকিলের সঙ্গে কথা বলো। জেলের কোয়ারেন্টিন শেষ হলে আমিও সব শালাদের মুখোশ খুলে দেব।’ 

আফ্রিনার স্বজন-শুভার্থীর বদ্ধমূল ধারণা, জহিরের সঙ্গে সম্পর্কের কারণেই আজ তাকে জেলের ভাত খেতে হচ্ছে। বাবা তো একাধিকবার বলেছে তার আপ্তবাক্য, অসৎ সঙ্গে সর্বনাশ। আসলে প্রথম বিয়ে ভাঙা এবং জহিরের সঙ্গে দ্বিতীয় বিয়ে সহজভাবে মানতে পারেনি বাবা। আফ্রিনাকে না পেয়ে বাবার প্রতিক্রিয়া জানতে চেয়েছিল একজন সাংবাদিক। তাকেও একই জবাব দিয়েছে বাবা, ‘দুর্নীতিগ্রস্ত ব্যবসায়ী ও স্বাস্থ্যবিভাগের সঙ্গে সম্পর্ক থাকাটাই আমার মেধাবী ডাক্তার মেয়ের একমাত্র অপরাধ।’

জহিরের ওপর স্বজনদের ক্ষোভ যতই থাক, জামিন না পেয়ে জেলে আসার পর জহিরের কথা মনে করে তাকে আর একটুও দায়ী মনে হয় না আফ্রিনার। বরং জেলে এসেই যদি তার সঙ্গে দেখা হতো, অন্তত ফোনে আলাপ করার সুযোগ পেত, তা হলে একাকিত্বের যন্ত্রণা লাঘব হতো খানিকটা; কিন্তু মেয়েদের জন্য নির্ধারিত ফটক থেকে পুরুষ কয়েদির সঙ্গে যোগাযোগের কোনো উপায় সে জানে না। বাইরের পুরুষশাসিত সমাজে পছন্দের পুরুষদের সঙ্গে মেলামেশা এবং পুরুষদের ডিঙিয়েও সামনে এগিয়ে যাওয়ার যে স্বাধীনতা ছিল, সেই সুখ থেকে বঞ্চিত করার জন্যই তো তাকে জেলে ঢোকানো। কতদিন এখানে একা কাটাতে হবে জানে না সে। একা ঠিক নয়, এই ওয়ার্ডের প্রহরী ও নানা কিসিমের কয়েদি সবাই নারী। দেখেশুনে জেনানা ফটকের সাজাপ্রাপ্ত নারীদের কাউকেই নিজের মতো বিশিষ্ট ও মর্যাদাবান মনে হয় না ডা. আফ্রিনার। এই ধারণা তার একাকিত্ব বোধকে আরও ধারালো করে। উকিল ও জহিরের ফোন পেয়ে ভেবেছিল, জেলে ঢুকে আফ্রিনাকে একা একটি ঘরে কোয়ারেন্টিনে থাকতে হবে কিছুদিন; কিন্তু সরকারি হাসপাতালের সাধারণ মহিলা গাইনি ওয়ার্ডের চেয়েও এখানে বিশ্রী পরিবেশ। ঘেঁষাঘেষি করে থাকতে হবে ক্রিমিনাল মেয়েদের সঙ্গে। নিম্নমানের একই খাবার খেতে হবে, ওয়াশরুম ব্যবহার করতে হবে লাইন ধরে। কোনো কারণে একজনের শরীরে যদি করোনাভাইরাস ঢুকে যায়, বাকিরা কেউ রক্ষা পাবে? 

আফ্রিনা চোখ বুজে আপন মনে একা হয়ে স্বাভাবিক হওয়ার চেষ্টা করে। কোর্ট থেকে বেরিয়ে পুলিশভ্যানে ওঠার সময় ভিড়ের কণ্ঠে শোনা মন্তব্যটি মনে পড়ে, ‘আল্লার মাইর দুনিয়ার বাইর! প্রকৃতির প্রতিশোধ বইলা কথা আছে। নিজের করোনা ধরলে এইবার ঠিকই টের পাইব।’ পাল্টা সান্ত্‌বনাবাণীও শুনেছিল আর একজনের কণ্ঠে, ‘জেলে গিয়াও করোনা রোগী সাইজা রাণীর হালেই থাকবে ম্যাডাম।’

সাবেক মন্ত্রী-নেতাদের মতো ডা. আফ্রিনাও যদি রাজবন্দির মর্যাদা পেত, তাহলে জেলেও আলাদা সেল ও সুযোগ-সুবিধাও বেশি পেত নিশ্চয়। করোনার মতো সংক্রামক রোগ থেকেও সহজে সুরক্ষা এবং অসুখ-বিসুখ হলেও হাসাপাতালের কেবিনে ভিআইপির মর্যাদায় চিকিৎসা পেত। জহিরও কি সেরকম সুবিধাভোগীর সুযোগ পেয়েই ফোন করতে পেরেছিল? কিন্তু ডা. সাব্রিনাকে জেলে ঢুকিয়ে ক্রিমিনাল কয়েদির সঙ্গে একাকার করে দেখা হচ্ছে কেন? থানার হাজতে পুলিশ অফিসার-কনস্টেবলরা আফ্রিনাকে সমীহের চোখে দেখেছে। তার ফোন কেড়ে নিলেও ফোন করার জন্য নিজের ফোন এগিয়ে দিয়েছিল একজন। এক অফিসার পকেটের টাকা বের করে কনস্টেবলকে আদেশ দিয়েছিল, ডাক্তার ম্যাডামকে ভালো খাবার এনে খাওয়াতে। সরকারি জেলের নারী কেয়ারটেকার ও প্রহরীদের যেন সেরকম গরজ নেই।

চোখ বুজে ড. সাব্রিনা ফেলে আসা মুক্ত পৃথিবীর মধ্যে প্রথমে নিজের পরিবার - সন্তান শুভ, বাবা-বোন ও নিজের শোয়ার ঘরটিকে দেখে। মুক্ত পৃথিবীতে যাপিত জীবনের স্মৃতি এখন মধুর স্বপ্নের মতো মিথ্যে যেন। আর জেলবাসের এই বর্তমান একাকিত্ব অকল্পনীয় এক দুঃস্বপ্ন কি? চোখ বুজে আফ্রিনা যখন নিজের অতীত ও বর্তমানকে স্বপ্ন ও দুস্বপ্নের মতো ভাবে, ভবিষ্যৎ তখন বড় প্রশ্নের খাড়ার মতো দোলে। করোনাক্রান্ত বিশ্ব ধ্বংস হয়ে যাবে বলেই কি একদার স্বপ্নকন্যা ডা. আফ্রিনা আজ জেলবাসের মতো দুঃস্বপ্নের ঘোরে বন্দি? নাকি কলেরা মহামারির মতো কোভিড-১৯ টিকা আবিষ্কারে পৃথিবী করোনামুক্ত এবং আবার স্বাভাবিক হয়ে উঠবে শিগগির? কিন্তু দুর্নীতির দায়ে ডা. আফ্রিনা জেলে ঢুকেছে বলে আগামীতে দেশ কি দুর্নীতমুক্ত হয়ে যাবে?

আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর হাতে ধরা পড়ার পরও ভিড়ের সাংবাদিকদের কেউ তাকে এরকম প্রশ্ন করেছিল কিনা মনে পড়ে না। মুক্ত দুনিয়ায় মুখোশ আটা মুখে সারাক্ষণ নীরব ছিল বলেই জেলে বসেও মিডিয়ার উদ্দেশে এরকম প্রশ্ন ডা. আফ্রিনার অন্তরে স্বতঃস্ফুর্ত জেগে উঠছে এখন। মিডিয়ার অপপ্রচার ঠেকাতে প্রভাবশালী পরিচিত কোনো সাংবাদিক সে খুঁজে পায়নি। কীর্তি নারীর প্রযোজকটির কথা মনে পড়ে তার। মিডিয়ায় কাজ করলেও টিভি সাংবাদিক ছেলেটি কবিতাও লেখে। হাসপাতালে তার মায়ের বাইপাস সার্জারিও করেছিল ডা. আফ্রিনা। কৃতজ্ঞতা প্রকাশের জন্য কবিতার বই উপহার দিয়েছিল একটা। বইটা পড়া হয়নি বলে নামটাও মনে নেই; কিন্তু তার কথাটি জেলেখানায় এসেও মনে পড়ে, ‘ডা. ম্যাডাম, আমরা হৃদয় খুড়ে বেদনা জাগাই, আর আপনি হৃদযন্ত্র কেটেছিড়ে মানুষের আয়ু বাড়ান। আপনার এই সাফল্য ও আনন্দ নিয়ে একটা আত্মজীবনী লেখেন - নায়িকার বদলে কেন ডাক্তার হলাম। এরকম শিরোনামে বেশ চলবে আপানার আত্মজীবনী।’

বন্দিজীবনের এই পরিবেশে লেখার জন্য ডা. আফ্রিনা কোথায় পাবে তার ল্যাপটপ কিংবা স্মার্টফোন? স্বপ্নেরও অতীত জেলখানায় ঢুকে যখন শিশুর মতো অসহায় চারদিকে তাকায়, জেলের কয়েদীর পোশাকে মধ্যবয়সী স্থূলকায় এক নারী প্রথম এগিয়ে আসে। আফ্রিনার ঘনিষ্ঠ হওয়ার চেষ্টা করে, হাসিমুখে স্বাগত জানিয়ে জানতে চায়, ‘এই সুন্দরী মাগী হাজতি না কয়েদি? কয় বছরের লাইগা হুজরাখানায় হান্দায় দিছে তোমারে?’

ডা. আফ্রিনা মুখ ফিরিয়ে নেয়। একা হয়ে নিজস্ব আস্তানায় থাকার অভ্যাসে মাস্কটা খুলে হাতে নিয়েছিল, দ্রুত আবার মুখে বাঁধে। 

মহিলা এবার ঘাড়ে ধাক্কা দিয়ে নিজেকে চেনায়, ‘এই যে, নিজেই জজ-ব্যরিস্টার হইয়া স্বামীরে ফাঁসিতে ঝোলায় দিয়া নিজেরে যাবজ্জীবন দিছি। সরকারি হুজরাখানায় আরামে থাকতে চাইলে আমারে মান্যগণ্য কইরা চলবা। টাকা কে দিব কও, সব ব্যবস্থা কইরা দিমু।’

ডা. আফ্রিনা ভয়ে ভয়ে তাকায় মহিলার দিকে। মহিলা খুনি-ক্রিমিনাল, পাগল, নাকি জেল-কর্তৃপক্ষের কেউ? জহির কি এরকম কাউকে ধরেই জেলে এসেও আফ্রিনার সঙ্গে ফোন করার সুযোগ পেয়েছিল? তার মানে দুর্নীতির দায়ে জেলে ঢুকে দুর্নীতি করেই তাকে ভালো থাকার চেষ্টা করতে হবে জেলখানাতেও?

‘সুন্দরী মাগী দেখি কথা কয় না! তা কেসটা কী তোমার? এমন খুবসুরত চেহারা লইয়া সরকারের কী খ্যাতা পুড়ছো? নাকি কোন বেটার বিচি চাইপা দিছিলা?’

ডা. আফ্রিনা সাংবাদিকদের নানা প্রশ্নের মুখে যেমন মুখে কুলুপ এঁটে ছিল, জেলাখানার অচেনা মাস্তান মহিলার কৌতূহলের মুখেও ভয়ে মুখ ঘুরিয়ে রাখে। মাস্কের আড়ালে দাঁতে দাঁত চেপে ঠোঁট বন্ধ রাখে। তারপরও কী বেদনায় কে জানে, হৃদরোগ বিশেষজ্ঞ প্রফেসর আফ্রিনার হৃদয় ও মুখোশ চিরে দু’চোখেও টলমল অশ্রু গড়ায়! 

সাম্প্রতিক দেশকাল ইউটিউব চ্যানেল সাবস্ক্রাইব করুন

মন্তব্য করুন

Epaper

সাপ্তাহিক সাম্প্রতিক দেশকাল ই-পেপার পড়তে ক্লিক করুন

Logo

ঠিকানা: ১০/২২ ইকবাল রোড, ব্লক এ, মোহাম্মদপুর, ঢাকা-১২০৭

© 2024 Shampratik Deshkal All Rights Reserved. Design & Developed By Root Soft Bangladesh

// //