মরীচিকা

অচেনা অদেখা অজানার প্রতি মানুষের আগ্রহ রক্তজাত আদিম অনন্য, সেখানে যুক্তির বাড়াবাড়ি নগণ্য। শাকেরী অজ গ্রাম দেশের মেয়ে। তার শহরে যাওয়ার প্রবল আকুতি। সামান্য জীবনে অনেক দেশি-বিদেশি শহরের নাম শুনেছে। শুনেছে শহরে অনেক সুখ আছে। শহরের বাহ্যিক জৌলুস-চাকচিক্য, অহমীয় আভিজাত্য সবই তার মনের গভীরে ভবিষ্যৎ রেখা লেপন করে রেখেছে। কল্পনায় সে নিজেকে মিলিয়ে নেয় কোনো অতি মহানগরীর অত্যাধুনিক নাগরিক হিসেবে। 

শহরফেরত কোনো মানুষের কাছে শহরের বর্ণনা শুনে তার মনের মধ্যে অদম্য ইচ্ছাশক্তির উদয় হয়, কবে সে শহরে যেতে পারবে। সে শুনেছে শহরে অনেকভাবে যাওয়া যায়। বাস-ট্রেন কিংবা আরও অনেক বাহনে। তবে শাকেরী যে গ্রামে থাকে, সেখান থেকে শহরে যাওয়ার সবচেয়ে উপযুক্ত মাধ্যম তার জানা নেই। তার শান্ত মন অশান্ত হয়ে ওঠে। শাকেরী একদিন তার মায়ের কাছে জানতে চাইল- মা, শহর কত দূর? 

মা বলল, আমি সঠিক জানি না। শিশুকালে একবার মাত্র বাবার সঙ্গে শহরে গিয়েছিলাম। সেই স্মৃতি ভালো করে মনে নেই। শুধু বলতে পারি সেখানে মানুষ থইথই করে। অনেক দালান আছে। মানুষ দেখলে মনে হয় কেউ কাউকে সময় দিতে পারে না। সবাই ছুটছে পাহাড় থেকে বেয়ে আসা জলের মতো। শাকেরী একবার তার শিক্ষককে জিজ্ঞেস করেছিল-চলতে গিয়ে মানুষ কি কোনো অদৃশ্য শক্তির বাধা পায়, মানুষ কেন নিজেকে থামাতে পারে না? তার প্রশ্ন শুনে সহপাঠীরা হো হো শব্দ করে হেসেছিল। তার সহজভাবে বলা কঠিন প্রশ্ন কেউই সেদিন ভালোভাবে বুঝে উঠতে পারেনি। শিক্ষক তাকে বলেছিল, তুই এসব পাগল প্রশ্ন কোথায় পাস? রাতে আলোহীন ঘরে শুয়ে আছে শাকেরী, ঘরের পাশে তেমন কোনো গাছপালা নেই। ফাঁকা প্রান্তর। জানালা দিয়ে বাইরে তাকিয়ে কিছু দেখার চেষ্টা করছে। অন্ধকারে কিছু দেখা যাচ্ছে না। অথচ তার বোধে আবিষ্কার হয়েছে আঁধারেও কিছু দেখা যায়। সেই দেখার জন্য অন্তর চোখ আলাদা। সে সেই অন্তর চোখ দিয়ে আঁধারি বনে আলো খুঁজছে। 

অন্ধকারে আলো খুঁজতে গিয়ে সমস্ত রাত অতিক্রান্ত, তবু ঘুম তার কাছে ঘেঁষতে পারল না। শাকেরী ভাবে, অন্ধকারের মধ্যে নিশ্চয়ই একদিন সে কিছু পাবে। ঘরহীন হয়ে সে চলল বাড়ির সামনের রাস্তায়। হঠাৎ দেখা দুই অন্ধ ফকিরের সঙ্গে। তারা ভিক্ষা করছে। দুই ফকির একাত্মভাবে এগিয়ে যাচ্ছে। শাকেরী তাদের চোখের দিকে খেয়াল করল, দু’জনের চোখই জন্মগতভাবে চামড়ায় ঢাকা। এই গ্রহের আলো তাদের চোখে প্রতিফলিত হচ্ছে না তাও সত্য। তারা আমাদের মতো দেখতে পাচ্ছে না তাও সত্য। তবে তারা কীভাবে চলছে? নিশ্চয় তারা কিছু দেখছে। তাহলে সেই দেখাটা সত্য। তবে তা কী দেখা, কীভাবে দেখা? 

শাকেরীর মনে শুধু এমনই প্রশ্নের উদয় হয়। সে যেখানে যায় প্রশ্ন তার পিছু পিছু যায়। নতুন প্রশ্ন আবিষ্কার করার জন্য মানুষ তার ওপর বিরক্ত হয়। সে তার বাবাকে বলে, বাবা- তোমাকে বাবা বলতে হয় কেন? বাবা শব্দটি কীভাবে এলো? কে কাকে কীভাবে প্রথম বাবা ডেকেছিল? শাকেরীর বাবা সহজ মানুষ। সে প্রশ্ন শুনে শিশুর মতো হাসে। ভাবে, শাকেরী ছোট মানুষ, তাই এমন সহজ-সরল প্রশ্ন করে।

শাকেরী তার বাবার কাছে প্রশ্নের উত্তর না পেয়ে ছুটে যায় তার বাড়ির কিনার দিয়ে বয়ে যাওয়া নদীর কাছে। নদীকে বলে, তুমি কতকাল থেকে আমাদের পৃথিবীতে চলছো। তোমার জল কেন নিঃশেষ হতে দেখি না? নদীর শরীরে দাঁড়িয়ে সূর্যের দিকে তাকিয়ে বলে, হে সূর্য, তোমার আলো কেন শেষ হয় না? সূর্যের উত্তর না পেয়ে সে ছোটে বন্য ফুলের কাছে। বন্য ফুলকে বলে, তোমার ফোটার রহস্য কী? ফোটার পর আবার ঝরে যাও কেন? কতকাল আগে থেকে তুমি আমাদের গ্রহে বসবাস করছ? এ রকম অসংখ্য প্রশ্ন শাকেরীর মনে অবিরল উদয় হয়; কিন্তু কোনো প্রশ্নের সদুত্তর সে না পেয়ে শহরের পথে রওনা হয়। ভাবে, শহরে অনেক জ্ঞানী-গুণীর বাস, তারা হয়তো তার প্রশ্নের সদুত্তর দিতে পারবেন।

সে খুব সকালে বেরিয়ে পড়ে শহরের উদ্দেশ্যে। যে কোনো ভাবে সে শহরে পৌঁছুবে। প্রথমে হাঁটাপথ। সে হাঁটতে থাকে মাঠের পাশ বেয়ে। হাঁটার সময় তার চোখে পড়ছে অন্তহীন প্রান্তর জুড়ে ফসলের মাঠ। ফসলের মাঠে নারী-পুরুষ কাজ করে চলেছে। সে হাত দিয়ে নরম সবুজ হলুদ লাল রঙের ফসল ছুঁয়ে দেখে। ফসলকেও দু-একটা প্রশ্ন রাখে, কোনো উত্তর আসে না। 

সে মাঠ পেরিয়ে একটা খালের নিকটে পৌঁছায়। খালের কূল ঘেঁষে অনেক মানুষ দৌড়াচ্ছে। সে কয়েকজনকে বলছে-আপনারা দৌড়াচ্ছেন কেন? কেউ কোনো কথা বলছে না। শুধু দৌড় আর দৌড়। সবাইকে দৌড়াতে দেখে সে আর স্থির থাকতে পারল না। অস্থির হয়ে সেও দৌড়াতে থাকল। দৌড়াতে গিয়ে এক নারীকে সে বলছে- আপনি দৌড়াচ্ছেন কেন? 

অচেনা নারীটি বলল, আমি বাড়ি ফিরছিলাম। সবাইকে দৌড়াতে দেখে বাড়ি না ফিরে এদের পেছনে দৌড়াতে শুরু করি। সবাই দৌড়াচ্ছে তাই আমিও দৌড়াচ্ছি। তারা কেন দৌড়াচ্ছে আমি জানি না। 

শাকেরী দৌড়ে অনেক পথ অতিক্রম করল। সমতল-অসমতল পথ পাড়ি দিয়ে আর দৌড়াতে পারল না। শাকেরীকে থামতে দেখে অনেকে থেমেছে। শাকেরী তাদের জিজ্ঞেস করছে, আপনারা থামলেন কেন? কেউ কোনো কথা বলছে না। হাঁপাতে হাঁপাতে একজন বলল, আমরা জানি না, অনেককে থামতে দেখে আমরাও থামলাম। 

শাকেরী কিছুক্ষণ নিজেকে শান্ত করে হাঁটতে শুরু করল। সে যেভাবেই হোক শহরে পৌঁছুবে। এটা তার অদম্য ইচ্ছা। হাঁটতে হাঁটতে সে বনের কাছে পৌঁছুতে রাত নেমে এলো। ভাবল, রাত গভীর হওয়ার আগেই বন অতিক্রম করতে হবে। বনের ভেতর দিয়ে সে দ্রুত পায়ে চলছে। দীর্ঘ পথ শেষ হচ্ছে না। সে একা। কোনো মানুষ নেই তার সঙ্গে। ভয় ভয় লাগছে। অবশেষে ক্লান্ত হয়ে সে একটা গাছের নিচে শুয়ে পড়ল। গা ছমছম করছে। ঘুটঘুটে আঁধার। নিশাচর ডাকছে। চোখ বন্ধ করলেও ঘুম আসছে না। এপাশ-ওপাশ করে অবশেষে সে ঘুমিয়ে গেল।

ঘুম ছেড়ে দেখে সকাল। আবার সে শহরের দিকে চলতে থাকে। বনের ভেতর চলার সময় তেমন মানুষের সঙ্গে দেখা হচ্ছে না। বনের শেষ প্রান্তে এসে মৌয়ালের সঙ্গে দেখা। সে বলল, শহর অনেক দূরে। দূর শুনেও তার কাছে একটুও দূর ঠেকছে না। মনে হচ্ছে, সে কত চেনা পথে চলেছে। চেনা পথ দূর হলেও মনের নিকটে থাকে। চলতে ভালো লাগে। সে ভাবছে এইতো সামনে শহর। 

সে হেঁটে একটি বাজারে এসে থামল। বাজার তার কাছে খুবই অচেনা। মানুষের তেমন ভিড় নেই। সামান্য কিছু দোকান আছে। অনেকেই শহরে যাবে বলে যানের জন্য অপেক্ষা করছে। সেও তো শহরেই যাবে। যানের জন্য দেরি না করে শাকেরী অপেক্ষমান লাইনে দাঁড়িয়ে গেল। অনেকক্ষণ পর পুরাতন লক্কড়-ঝক্কড় বাস এসেছে। বাসটি ঠিক শহরেই যাবে, অন্য কোথাও যাবে না। দেরি না করে সবাই বাসে উঠল। বাস চলছে। রাস্তা ফাঁকা। কোনো যানবাহন নেই, মানুষ নেই। যাত্রীরা অবাক, একে অপরের কাছে জানতে চাইছে রাস্তা এমন নিশ্চুপ কোলাহলমুক্ত কেন? রাস্তার পাশে কখনো বাজার, কখনো বাড়ি; কিন্তু একজন মানুষও দেখা যাচ্ছে না। বাসটি ফাঁকা রাস্তা বেয়ে হু হু করে শহরের পথে চলেছে। শাকেরীর মনে আশা জাগছে, সে স্বপ্ন দেখছে অনেক প্রচেষ্টার পরে সে হয়তো শহরে পৌঁছতে যাচ্ছে। অন্য যাত্রীরা চিন্তিত হলেও বাসের গতিতে সে নির্ভার।

হঠাৎ শব্দ করে বাসটি থেমে গেল। চালক বলছে- বাস অসুস্থ। সবাই নামেন, মেরামত করতে হবে। 

যাত্রীরা একে একে নেমে পড়ল। শুরু হলো অসুস্থ বাসের চিকিৎসা। সারা দিন মেরামত শেষে গোধূলিতে বাস আবার চলতে শুরু করল। অনেকটা পথ পাড়ি দিয়ে বাস এসে পৌঁছল নদীর ধারে। শোনা গেল নদী পার হলে স্বপ্নের শহর বেশি দূরে নয়। নদীতে কোনো ব্রিজ নেই। ফেরি পার করবে বাসটিকে। ফেরির অপেক্ষায় সবাই। 

প্রহর গুনতে গুনতে রাত নেমে এলো। খবর এসে গেল। রাতের কারণে আজকে ফেরি আসবে না। সবাইকে বাসেই রাত কাটাতে হবে। শাকেরী বাসের পেছনে অতি পুরনো নগণ্য ছেঁড়া সিট পেয়েছে। সবাই বাসের সিটে রাত কাটাচ্ছে। আনুমানিক রাত বারোটার দিকে ঠান্ডা বাতাস শুরু। শাকেরী জানালা খুলে হু হু শব্দ শুনতে পাচ্ছে। কিছুক্ষণের মধ্যে ঝমঝম করে পড়তে থাকল বৃষ্টির বড় বড় ফোঁটা। কনকনে ঠাণ্ডা। প্রচণ্ড বাতাসের বেগে বাসটি দুলছে। কাচে ছাওয়া জানালাগুলো ঝনঝন করে ভেঙে যাচ্ছে। যাত্রীদের ভয়ার্ত চিৎকারে আকাশ-বাতাস প্রকম্পিত হচ্ছে। শীতে শাকেরীর শরীর আড়ষ্ঠ। বৃষ্টির জল দ্বিগুণ থেকে দ্বিগুণতর হচ্ছে। বাসের সকল যাত্রী মাছ ভেজার মতো ভিজে একাকার। ভোরের দিকে বৃষ্টি কমল; কিন্তু শাকেরীর কাঁপন থামছে না। সকালে শরীর গরম হয়ে বেগহীন জ্বর এসে গেলে তার হাঁটার শক্তি নেই। 

ওদিকে সকালের আলোয় শোনা গেল ঝড়ের কারণে ফেরি আসবে দুপুরে। দুপুর আসার আগেই শাকেরীর জ্বর আরও বেড়েছে। সে বেহুঁশ। তার মুমূর্ষুতা দেখে এক ঘাটবাসী তাকে বাড়িতে নিয়ে চিকিৎসা শুরু করেছে। ডাক্তার জানিয়েছে সুস্থ হতে আরও  এক সপ্তাহ সময় লাগবে। দুপুরে ফেরি এসে বাসটি পার করে শহরে চলে গেছে। 

শাকেরী এক সপ্তাহ পর সুস্থ হয়ে আবার শহরের পথে রওনা দিয়েছে। সে নদীর কূলে পারাপারের উদ্দেশ্যে। ঘাটে নৌকা নেই। শোনা গেল কয়েক দিন আগে ঝড়ের কারণে ফেরির চল বন্ধ হয়ে গেছে। সে নৌকার জন্য অপেক্ষা করতে থাকল। 

নদীটি অনেক গভীর ও খরস্রোতা হওয়ায় সব মাঝি সেই নদীতে নৌকা ধরতে ভয় পায়। শুধু অনেক সাহসী মাঝিরা নৌকায় পার করে। অপেক্ষা শেষে দীঘিরঘাটের বিখ্যাত কালুয়ান মাঝি নৌকা নিয়ে হাজির। কালুয়ান দেখতে কালো বর্ণের। তার শরীর আঁটা। বাহু দু’খানা ইস্পাতের মতো শক্ত। চোখ দুটি মধ্যাহ্নের সূর্যের মতো লাল টকটকে। তার কণ্ঠস্বর ভরাট পুরু মোটা। যে যে নদী পার হতে ইচ্ছুক তাদেরকে নিয়ে কালুয়ান রওনা হলো। 

নদীতে তুমুল হামাল। নৌকাটিকে বিশাল নদীতে শিশুদের খেলনার মতো লাগছে। মনে হচ্ছে, এই বুঝি ডুবল, আবার খাড়া ঢেউ ভেঙে ভুস করা শুশুকের মতো জেগে উঠছে। যাত্রীরা অনেকেই দোয়া-কালাম-শ্লোক পড়ছে। কারো মুখের দিকে তাকানো যাচ্ছে না। সবাই ভীত। সবার মনে যেন ভয়ের আগুন জ্বলছে। শাকেরীও ভীত। তবু তার মনের মধ্যে চিন্তা হচ্ছে কখন পৌঁছতে পারবে সাধের শহরে।

কালুয়ান উঁচু উঁচু ঢেউয়ের সঙ্গে যুদ্ধ করে নৌকাকে এগিয়ে নিচ্ছে। তার ভয়-ডর নেই। সে যেন নদীর নায়ক। সবার ভীতি দেখে সে ভরাট গলায় বলছে-ডর কর তো আইছো ক্যান মিয়া? 

কালুয়ানের এমন কথা শুনে সবাই অবাক। নৌকাটি এগিয়ে অনেক দূর গিয়ে পালের রশি ছিঁড়ে দিকভ্রান্ত হয়ে ভেসে চলল অজানায়। কালুয়ান কোনোভাবেই নৌকাকে কূলে ভেড়াতে পারল না। নামকরা শক্তিধর কালুয়ানও শেষ রক্ষা করতে পারল না। নৌকাটি ভাসতে ভাসতে দূর দেশে অনেক মাইল দূরে অচেনা নদীর খাড়া পাড়ির তলদেশে ভিড়ল। ততক্ষণে আরও  একটি বিমর্ষ বিকেল শেষে রাত শেষ করে সকাল হয়েছে। কালুয়ান সকালে বলল- কী করবা মিয়া, ভাগ্যে না থাকলি হয় না। 

শহুরে শিক্ষিত স্যুট পরা এক ভদ্র যাত্রী বলল, ধুর মিয়া, পারো নাই তাই কও। ভাগ্যের দোষ দাও কেন? 

কালুয়ান তার কথা শুনে পান খাওয়া দাঁত বের করে এক গাল হাসে আর বলে, শহর এখান থিকা দূর আছে। তুমরা এবার হাঁটি যাও। আমি ফিরমু সেই ফেরিঘাটে। 

শাকেরী নৌকা থেকে নেমে আবার শহরের উদ্দেশ্যে হাঁটা শুরু করেছে। তার সঙ্গের এক পথচারী বলছে, শহর তো সুদূর বহুদূর।

শাকেরী বলল, যত দূরই হোক আমাকে শহরে পৌঁছুতে হবে। আমি যাবই শহরে।

শাকেরী চলছে জীবনীশক্তি নিয়ে আত্মশক্তিতে। সে ভীত দুর্বল নয়। সে চ্যালেঞ্জ গ্রহণ করেছে একদিন সে শহরে পৌঁছুবে। 

অনেক দিন অনেকটা পথ চলার পর দেখছে সামনে একটা স্টেশন। স্টেশনটি বেশ ফাঁকা। মানুষজন নেই। বহু প্রাচীন ছাউনি। ছাউনির নিচে এক পাগল বসে মনের সুখে গান ধরেছে। স্টেশনের সাইনবোর্ডের লেখাগুলো ধুলাচ্ছন্ন হওয়ায় তা একেবারেই বোঝার উপায় নেই। চারপাশে শাকেরী ভালো করে দৃষ্টি দিয়ে দেখছে কোনো দালানকোঠা নেই। কিছুদূরে দেখা যাচ্ছে লম্বা একটি জলাধার এঁকেবেঁকে চলে গেছে মাঠের দিকে। বোঝা যাচ্ছে এটি শহরের কোনো স্টেশন নয়। এই ফাঁকা মাঠের মধ্যে কখন ট্রেন আসে আর কখন যায় কেউ সঠিক করে বলতে পারে না। 

শাকেরী একটি পাকা করা স্থায়ী চেয়ারে বসে আছে। অনেকক্ষণ পর দেখা গেল দু-একজন যাত্রী আসছে। শাকেরী তাদের জিজ্ঞেস করল- ট্রেনের সময় জানেন?

এক যাত্রী মৃদু হেসে বলল, শুনেছি সপ্তাহে দু-একবার ট্রেন আসে মালামাল বহনের জন্য। 

শুনে শাকেরী অবাক হয়ে ভাবছে, মালগাড়িতে যাত্রী হিসেবে নেবে কেন? তবু শাকেরী আশায় বুক বেঁধে বসে রইল। ভাবছে, যে কোনোভাবে তাকে শহরে পৌঁছুতে হবে।

বসে থেকে বিকেল গড়িয়ে সন্ধ্যা ছুঁই ছুঁই। সে দূরের ফাঁকায় তাকিয়ে দেখছে সন্ধ্যা পাখিরা ক্লান্ত ডানা ঝাঁকিয়ে নীড়ে ফিরছে। তাদের সংগ্রামী ফেরা দেখে শাকেরী আশান্বিত হয়ে ভাবে, দেরি হলেও সে একদিন পৌঁছুতে পারবে শহরে। 

স্টেশনে বেশ ঘুটঘুটে রাত নেমে এলো। কয়েকজন মানুষ ছাড়া সেখানে কেউ নেই। আসা মানুষগুলো টিফিন ক্যারিয়ারে করে রাতের খাবার এনেছে। তাদের খাবার শেষে শাকেরীকেও কিছু দিল। অনেক দিন পর শাকেরী তৃপ্তি করে চারটে খাবার খেল। রাত বাড়ছে। আনুমানিক একটার দিকে লণ্ঠন হাতে সাদা পোশাক পরা একজন স্টেশনের এ মাথা থেকে ও মাথা পর্যন্ত পায়চারি করছে। শাকেরী তাকে জিজ্ঞেস করল, ট্রেনের খবর জানেন?

লোকটি বলল, এখনো ট্রেনের খবর হয়নি। হলে জানাব।

তন্দ্রালু থেকে শাকেরী কখন ঘুমিয়েছে বুঝতে পারেনি। আচমকা স্টেশন থেকে দূরের মাঠে শোরগোলের আওয়াজ। সাদা পোশাক পরা লোকটি দৌড়ে এসে বলছে, গ্রামে ডাকাত পড়েছে। ডাকাতরা এখন এদিকেই আসতে পারে। আপনারা পালান। 

তার কথা শুনে ঘুমন্ত মানুষগুলো হতচকিত হয়ে উঠে জঙ্গলের দিকে পালাচ্ছে। শাকেরীও তাদের পিছু পিছু। বেশ খানিকটা দৌড়ে এসে কিছুদূরে এক ঘন ঝোপের আড়ালে সবাই লুকাল। পচা দুর্গন্ধযুক্ত ঝোপের ভেতর কী আছে তা কারো বোধগম্য নয়। সবাই প্রাণভয়ে কোনো রকমে নাক চেপে বসে আছে। একজন বলছে, কেউ শব্দ করবেন না। এরা খুবই ভয়ংকর হিংস্র ডাকাত। টের পেলে মেরে ফেলবে। 

শাকেরী তো ভয়ে ঠকঠক করে কাঁপছে। ভোরের দিকে মনে হলো ডাকাত দল তাদের কর্ম শেষ করে চলে গেছে। শাকেরীসহ পালানো লোকগুলো হাঁপ ছেড়ে বাঁচল। জঙ্গল থেকে তারা স্টেশনে উঠে দেখছে সাদা পোশাক পরা লোকটি লোহার খুঁটিতে বাঁধা। তার শরীর দিয়ে জলের স্রোতের মতো রক্ত ঝরছে। লোকটি বিকট আওয়াজ তুলে গলা ফাটাচ্ছে। শাকেরীর খুব মায়া হওয়ায় তার হাত-পায়ের বাঁধনগুলো খুলে দিয়ে বলল, আপনি ডাক্তারের কাছে যান।

লোকটি বলছে-এ মুল্লুকে ডাক্তার নাইরে বেটা। এই বলে সে প্রাচীন স্টেশনের ভাঙা বারান্দায় গড়াগড়ি যাচ্ছে।

একজন যাত্রী বলল, শহর ছাড়া ডাক্তার নেই। তাকে চিকিৎসা নিতে হলে শহরে যেতে হবে। শহরে পৌঁছার আগে সে দুনিয়ায় থাকবে কি না তা একমাত্র বিধাতা জানেন।

এসব দৃশ্য দেখে শাকেরী নির্বাক। তার মুখ থেকে কোনো কথা বাতাস ঠেলে বের হচ্ছে না। সে ভাবছে, যেভাবেই হোক তাকে শহরে পৌঁছুতে হবে।

সেদিনও সকাল থেকে বিকেল পর্যন্ত শাকেরী স্টেশনে ট্রেনের জন্য অপেক্ষা করল; কিন্তু কোনো ট্রেন এলো না। সাঁঝের আগেই শাকেরী অদূর থেকে শহর যাত্রার জন্য ঘোড়া ভাড়া পেল। শাকেরীর ঘোড়ার সঙ্গে ঘোড়ার মালিকও যাবে অন্য ঘোড়ায় চড়ে। ভাড়া করা ঘোড়ায় সমস্ত রাত ধরে সে ছুটে চলল। সকালে ঘোড়ার মালিক বলল, সমস্ত রাত ঘোড়া চলে খুব ক্লান্ত হয়ে উঠেছে। বিশ্রামের দরকার। 

দু’জনের ঘোড়া দুটিকে গাছের সঙ্গে বেঁধে খাওয়া ও বিশ্রামের ব্যবস্থা করা হলো। তারা আবার যাত্রার জন্য প্রস্তুত হতে লাগল। মালিকের ঘোড়া উঠে গা ঝাড়া দিয়ে তৈরি; কিন্তু শাকেরীর ঘোড়া উঠছে না। মালিক ঘোড়াকে পিটিয়ে লাল করে ফেলল, পুকুর থেকে জল এনে চোখে-মুখে ঢেলে দিল, কোনোভাবেই ঘোড়া উঠছে না। শেষে মালিক বলল, আমার ঘোড়া খুব অসুস্থ হয়ে পড়েছে। আপনি অন্যভাবে চলে যান। শাকেরীর শহর-যাত্রা ঘোড়ায় চড়েও হলো না। 

শহরে যাওয়ার জন্য প্রথমে সে হেঁটে দৌড়ে তারপর বাসে ট্রেনে কত রকমভাবে প্রচেষ্টা চালাচ্ছে; কিন্তু কোনো চেষ্টাই সফল হচ্ছে না। শাকেরী ঘোড়যাত্রার কষ্ট ভোলার জন্য আবারও হেঁটে শহরের দিকে এগিয়ে যাচ্ছে। সে হাঁটছে আর মনের গহীনে প্রতীজ্ঞা করছে, যত বাধাই আসুক, সে শহরে পৌঁছুবে। পথেই সে এক অচেনা মানুষকে জিজ্ঞেস করল, শহর কত দূর? 

লোকটি বলল, দূর আছে। হেঁটে গেলে হাজার হাজার ঘণ্টা খরচ হবে। বরং আপনি কোনো বাহনে যান।

শাকেরীও ভাবছে, জীবন ফুরোবার অনেক আগে শহরে পৌঁছুতে হবে। সেখানে তার কত কাজ। এটা করতে হবে। ওটা করতে হবে। জীবনকে সাজাতে হবে। ভোগবিলাসিতা করতে হবে, জৌলুস গড়তে হবে; কিন্তু পথেই যদি তার সময় শেষ হয়ে যায় তাহলে কবে সে পৌঁছুবে শহরে? তাই সে দ্রুত পৌঁছার চেষ্টা করছে।

চলতে চলতে হঠাৎ তার মাথায় হাত চলে গেল। হাতে উঠে এলো কাঁচাপাকা চুল। সে হতাশ। সে রওনা দিয়েছিল কাঁচা চুলে। অথচ এখন চুলে পাক ধরেছে। সে হাত-পা মুখের দিকে খেয়াল করে দেখছে চামড়া গুছিয়ে শক্তিহীন হয়ে ঝুলছে। সে উদ্বিগ্ন, চিন্তাশীল। ভাবছে শরীর শক্তিহীন হওয়ার আগে শহরে পৌঁছুতে পারবে কি না? তাই বিধাতার কাছে মহাশক্তির কাছে র্প্রাথনা শুরু করল-হে বিধাতা, আপনি আমাকে দয়া করেন, মায়া করেন, করুণা করেন। আপনি জানেন জীবনের সেই ভোরে শহর-যাত্রায় বের হয়েছি কত আশা কত বাসনা কত শত স্বপ্ন বুকে করে। আজ জীবন মধ্যাহ্ন পেরিয়ে অস্তগামী। আপনি সমস্ত জ্ঞাত, আপনার অজানার কিছু নেই। আপনি সমস্ত দেখছেন, হে বিধাতা পরম স্বামী মহালোকের মালিক। আমাকে দয়া ভিক্ষা করেন, মায়া দান করেন। আমি চিরকাঙাল, ঘরছাড়া ঘরহীন দেশে-বিদেশে। আমার জন্মমৃত্যুর মালিক আপনি। আমি জীবনে যা কিছু পেয়েছি তা আপনারই দান, যা পাইনি আমার আশীর্বাদ। পৃথিবীতে কত মানবের জীবনে কত কিছু দান করেছেন। আমার এই ছোট নগণ্য অতিকণার পরিমাণ চাওয়াতে আপনার কি-বা আসে-যায়। আপনিই তো কথা দিয়েছেন, আপনি ক্ষমাশীল, দানশীল, মায়াময়। এটা আমার জীবনে আপনার কাছে প্রথম ও শেষ চাওয়া। 

প্রার্থনা শেষে শাকেরী প্রার্থনা শক্তিতে নতুন বাসনা আশা-ভরসায় পথচলা শুরু করল। এবার তার আত্মবিশ্বাসী শক্তিতে নিজের কাছে মনে হচ্ছে পৌঁছে যাবে শহরে। আশায় আশা বাড়ে। নতুন আশায় বুক বেঁধে সে চলছে পথে পথে; কিন্তু সে জানে না শহরে কোনো দিন পৌঁছুতে পারবে কি না।

সাম্প্রতিক দেশকাল ইউটিউব চ্যানেল সাবস্ক্রাইব করুন

মন্তব্য করুন

Epaper

সাপ্তাহিক সাম্প্রতিক দেশকাল ই-পেপার পড়তে ক্লিক করুন

Logo

ঠিকানা: ১০/২২ ইকবাল রোড, ব্লক এ, মোহাম্মদপুর, ঢাকা-১২০৭

© 2024 Shampratik Deshkal All Rights Reserved. Design & Developed By Root Soft Bangladesh

// //