নয়নতারা

৪টা বেজে গেছে। আমি অফিসে। একা বসে আছি। সকলের ফেরার তোর-জোড়, জানালা দিয়ে নিচে তাকালে বৃহস্পতিবার বিকেলের চেহারা সুস্পষ্ট হয়। সকলেই কেমন উৎফুল্ল। অপেক্ষমান বাসগুলো ঘিরে হাসি-তামাশা চলছে। আমাদের এই অফিসের লোকজনের জীবনে অবশ্য বৃহস্পতিবার কখনোই ‘থার্সডে’ হয়ে দেখা দেয় না। আনন্দের কারণ এটুকুই যে, আগামী দু’দিন কাউকে আর অফিসে আসতে হচ্ছে না।

একজন নারী সহকর্মীর ফোন! রিনা আপা। কাজে কর্মে বিশেষ ভালো নন। তবে সেসব ঢেকে যায় তাঁর আন্তরিক ব্যবহারে। সহকর্মীদের প্রতি সহমর্মী। বিপদ-আপদে অত্যন্ত ক্রিয়াশীলভাবে খোঁজ-খবর নেন। ফোন করে জানান, কে যেন মহাপরিচালকের নিকট আমার নামে একটি নারীঘটিত বিষয়ে অভিযোগ করে গেছেন। ফোনে তিনি জানান, এই মুহূর্তে তাঁর সঙ্গে ইয়াসমিনও আছে। ইয়াসমিন আমার সমসাময়িক; চাকরিতে যেমন কয়েক দিনের ব্যবধানে একই পদে আমরা যোগদান করেছি-বিশ্ববিদ্যালয়ে তেমনি আমরা একই ব্যাচের। দু’জনই কলা ভবনের। সেই হিসেবে আমাদের যতখানি ওঠাবসা থাকা উচিত ততখানি নেই। কেন যে নেই, তা সুনির্দিষ্ট করে বলা যাবে না। কিছু দিন আগে অকাল গর্ভপাতজনিত কারণে ওকে একটা বড়সড়ো চিকিৎসার ভেতর দিয়ে ঘুরে আসতে হয়েছে। মধ্যরাতে আরেকজন সহকর্মীর মাধ্যমে খবরটি জেনে বেশ উদ্বিগ্ন হয়েছিলাম, এই যা! তারপর বেমালুম ভুলে গেছি। যেভাবে ভুলে যাই, অনেক কিছু, অনেক বিষয়। তবে এখন কোনো উত্তেজনা কিংবা উদ্বেগ কোনো কিছুই বোধ করছি না। আমি শান্ত-স্বাভাবিক কণ্ঠে আমার রুমে ওদের চা-খাওয়ার জন্য অনুরোধ করি। ওরা ‘আসছি’ বলে সম্মতি জানায়। আমি ফ্রেশরুমে যাই।

ফিরে এসে দেখি, আমার টেবিলের ডানপাশ আগলে বসে আছে শৈবাল। শুল্কবিভাগে ওর চাকরি। ‘থার্সডে’, তাই একটু তাড়াতাড়ি বেরিয়েছে। টেবিলের ডানপাশে কয়েক দিনে জমে ওঠা প্রয়োজনীয়-অপ্রয়োজনীয় বইগুলো উল্টেপাল্টে নিজের মতো আড়াল তৈরি করে নিয়েছে। হাতের নড়াচড়া-মুখের প্রসন্নতা দেখে বুঝতে পারি, গাঁজা বানাচ্ছে। ডানপাশে ঝুঁকে দেখি গাঁজার পরিমাণ অনেক। খুব বেশি সুখকর দৃশ্য নয়, শৈবালের সঙ্গে একজন অচেনা লোক। লোকটার গোফগুলো অদ্ভুতভাবে চিকন করে ছাঁটা, সুতোর মতো নাকের নিচ দিয়ে; দেখে মনে হয় নকল। বিসদৃশ! লোকটা শৈবালের সহকর্মী হতে পারে আবার নাও হতে পারে, বিচিত্র আর অচেনা লোক নিয়ে চলাফেরা শৈবালের সহজাত। এই ধরনের অদ্ভুত লোকদের সঙ্গে নিয়ে যে কোনো অনুষ্ঠানে, পার্টিতে কারও বাসায় বা অফিসে নির্দ্বিধায় যাতায়াত করে ও। কেউ বিষয়টা পছন্দ করছে কি করছে না, তা নিয়ে ভ্রুক্ষেপ নেই। আমি কাঁত হয়ে ওর ওখান থেকে খানিকটা গাঁজা নিয়ে কাগজে মুড়ে ড্রয়ারে রেখে দেই। কেন রাখি জানি না। আমি এখন আর গাঁজা খাই না। খেতেও পারি না, অসহ্য লাগে, হাঁসফাঁস-হতাশা সবই তৈরি হয়।

জানালা দিয়ে নিচে তাকিয়ে দেখি রিনা আপা এবং ইয়াসমিন অফিস চত্বরের বাঁকা রাস্তাটা ধরে গেটের দিকে চলে যাচ্ছে। নিচ দিয়ে জানালায় ঠেস দিয়ে বসে থাকা শৈবালকে ওরা দেখেছে সম্ভবত। সময় চলে যাচ্ছে, বাসায় ফেরার তাড়া আছে নিশ্চয়। অফিসের গাড়ি ফেল করলে বাসায় ফেরা কঠিন এক যুদ্ধে পরিণত হয়, উপরন্তু আজ বৃহস্পতিবার, তদুপরি ওরা মেয়ে। অতএব, ওরা চলে যাচ্ছে। রিনা আপা নিচ গিয়ে ইশারায় কিছু একটা বোঝাতে চান। সম্ভবত এর অর্থ, ‘বিষয়টি ফোনে আলাপ হবে’।

শৈবাল উঠে দাঁড়ায় এবং চলে যায়। সঙ্গে বেরিয়ে যায় সুতার মতো অদ্ভুত গোফওয়ালা লোকটাও। বেরোবার সময় আমাকে অবশ্য সঙ্গে যাবার অনুরোধ করে না। তাতে বরং আমি খুশি হই-বেঁচে যাই। ওদের সঙ্গে উঠলেই রাত ১০টা। বাসায় ফিরতে বাজবে ১১টা কি সাড়ে ১১টা।

এবার ওই নারী আসেন। সম্ভবত তাঁকে নিয়েই অভিযোগ। আর তিনি আসলেনও বড্ড অসময়ে যখন ঘরে ফেরার উত্তেজনায় মাঠভর্তি মানুষ। সকলেই আমার সহকর্মী। আগত নারী একজন অনিন্দ্য সুন্দরী। যেন অপ্সরা। টিভিতে এবং টিভির বাইরে তাঁর জুড়িমেলা ভার। সুতরাং তাঁর রূপের বর্ণনায় না যাওয়াই ভালো। একটা ঠুনকো লেখা সংগ্রহের জন্য এমন একজন নারীর বারবার আমার কাছে আসাটা বেমানান, অবিশ্বাস্য। তবু তিনি সেটাই করছেন, এটাই বাস্তব। আমি তাঁকে পূর্ব থেকেই চিনতাম বা চিনি; তবে ওই অতটুকুই। তাঁকে আমি চিনি কারণ তিনি বর্ণনাতীত রকমের সুন্দরী আবার তাঁকে আমি বরাবরই এড়িয়ে গেছি কারণ অতি সুন্দর আমার কাছে বরাবরই ভীতিকর। সৌন্দর্যের এই ভীতি না-কি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরেরও ছিল। একদা এক গবেষক বলেছিলেন, কোথাও এক বক্তৃতায়, কোথায় তা ভুলে গেছি, মনে আছে কেবল ওই বক্তৃতা অনুষ্ঠানে আমিও ছিলাম, বক্তা নয়-শ্রোতা হিসেবে। 

আমি তাঁকে ফোনে এবং সাক্ষাতে নানাভাবে বুঝিয়ে বলেছি। আর যেটুকু বলিনি, সেটুকু হলো, তাঁর মতো একজন নারীর এমন একটা মাঝারিমানের লাইফস্টাইল পত্রিকায় চাকরি করা মানায় না। এমনকি ওই পত্রিকার পুরোটা স্বত্ব তাঁর হলেও ঘাটতি রয়ে যায়।

আমার কাছে তাঁর চাহিদা হলো, গত পঞ্চাশ বছরে ঢাকার নারীদের পোশাকে যে বিবর্তনটা ঘটেছে তার ইতিবৃত্ত লিখে দেওয়া। তাঁর ভাষ্যমতে দেশ সেরা মডেলদের শরীরে বিভিন্ন দশকী পোশাক চাপিয়ে আসছে সংখ্যার প্রায় পুরোটাজুড়ে তাঁরা এই স্টোরিটা করতে চায়। আমি তাঁকে আমার অবস্থা-সীমাবদ্ধতা এবং অপারগতা জানিয়েছি। আমি একজন নিতান্ত সাধারণমানের কাহিনী লেখক, বলা উচিত ‘ছিলাম’। বর্তমানে অত্যন্ত দ্রুততায় পাল্টে যাওয়া ‘গল্পে’র গতি-প্রকৃতি আমি ধরতে পারিনি। তার ওপর সর্বগ্রাসী ওটিটি এবং ওখানে যা প্রদর্শিত হচ্ছে সেসবও আমার জানাশোনার বাইরে। ফলে ওসব বাদ দিয়ে বর্তমানে আমি কেবলই একজন চাকরিজীবী এবং সেখানেও মাঝারি। ঢাকার নারীদের পোশাক কবে কীভাবে বদলে গেল আমি জানি না। এমনকি নারীর পোশাকের বিবর্তন বা এর সমাজতত্ত্ব বুঝে উঠতে পারার মতো পর্যাপ্ত জ্ঞানও আমার নেই। এ বিষয়ে উত্তম বক্তব্য তৈরি করতে পারবেন কোনো নারীবাদী সমাজতাত্ত্বিক, যার মূল পেশা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক হওয়াটা বাঞ্ছনীয়। এ ছাড়া তত্ত্বীয় দিকটা এড়িয়ে গ্লামার ফোকাস কিছু চাইলে গুণী, অভিজ্ঞ এবং লিখতে সক্ষম কোনো ফ্যাশন ডিজাইনারকে দিয়ে লিখিয়ে নেওয়াই ভালো। এসব কথা আমি তাঁকে বলেছি। বলবার সময় গলার স্বর যতটা সম্ভব স্বাভাবিক রাখার চেষ্টাও করেছি। সমকালে এটাও আরেকটা সংকট হিসেবে দেখা দিয়েছে। কারও অনুরোধে না করতে গেলেই তিনি ধরে নেন আমি কোনো গভীর অভিমানে ভুগছি; কিন্তু ব্যাপারটা একদমই তা নয়, লিখতে পারছি না বা লিখছি না, এটাই দারুণ এক প্রশান্তির কারণ হয়ে দেখা দিয়েছে, আমি উপভোগ করছি।

আজ অবশ্য এসব বিষয়ে কোনো কথা হয় না। আমার চারপাশে অতি মনোরম ঘ্রাণ ছড়িয়ে তিনি একটু নড়েচড়ে বসেন। কিঞ্চিৎ হাসেন। হাতের কালো ব্যাগটা থেকে তাদের পত্রিকার একটা কপি বের করেন। হতে পারে এটাই চলতি সংখ্যা, হয়তো দু-এক দিনেই বেরিয়ে থাকবে। সঙ্গে একটা রিসিপ্ট; যাতে আমার সই নেন। পত্রিকার কোনো সৌজন্য সংখ্যা গ্রহণ করে এমন সই করার অভিজ্ঞতা আমার নেই।

অল্প সময়ের ভেতরেই আমি বেশ খানিকটা ভেবে নেই। ঘটনাটা আসলে কী এবং কতটা বুঝে উঠতে পারছিলাম না। এমনতর পরিস্থিতি নিয়ে আমার কোনো পূর্বাভিজ্ঞতা নেই সেটা বলাই-বাহুল্য। নারীঘটিত অভিযোগ যাদের বিরুদ্ধে উত্থাপিত হয়, তারা এগুলো কীভাবে সামাল দেন তা-ও জানি না। আমার নিকট বন্ধুবান্ধব কারও বিরুদ্ধে এমন কোনো অভিযোগ উঠেছে কি-না, মনে করার চেষ্টা করি। মাজহারকে স্মরণ করতে পারি, অ্যাসিসটেন্ট প্রফেসর, সহযোগী হওয়ার আগমুহূর্তে অভিযোগটা উঠেছিল ওর বিরুদ্ধে। ও অবশ্য আমাকে বলেছিল ওর প্রোমোশন আটকে দিতে বিরোধী গ্রুপের শিক্ষকরা অভিযোগটা বানিয়েছে, যে ছাত্রী অভিযোগ তুলেছে সেও নাকি ওদের লোক। বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদের নিয়ে এহেন অভিযোগ বেশ কয়েক বছর যাবৎ একটা মড়ক হিসেবে দেখা দিয়েছে।

যা হোক, নিরুদ্বিগ্ন আর আপাত নিরাসক্ত নাগরিক জীবনে একটা ছন্দপতন দেখা দিল হঠাৎ। যাকে ঘিরে এই কাণ্ড তিনি যদিও আমার সামনে বসে আছেন, কীসব বলছেন, আমিও জবাব দিয়ে যাচ্ছি মনোযোগহীনভাবে। আমার দু’জন নারী সহকর্মীই বিষয়টা জানিয়েছেন আমাকে, তার অর্থ হতে পারে আমাকে ঘিরে এসব কথা তাঁরা আমলে নিতে চান না। এমনই হবে; নয়তো তাঁরা আমাকে ফোন করতেন না, এড়িয়ে যেতেন কিংবা বিষয়টি জেনেই আমাকে ঘৃণা করা শুরু করতেন।

প্রসঙ্গটা তাঁকে বলা উচিত হবে কি-না, ভেবে পাচ্ছি না। আমতা-আমতা করে বললাম কিছু একটা, বলতেই তুড়ি বাজিয়ে উড়িয়ে দিলেন ভীষণ সুন্দরী। ‘মাথায় নিয়েন না! ওগুলো কিছু নয়’ বলে তিনি জানালেন, তাঁর এক ভাসুর। বিয়ের পর থেকেই লোকটার নজর খারাপ দেখে তিনি এড়িয়ে চলেন। সময়ে অসময়ে তাঁর স্বামীর অনুপস্থিতিতে লোকটা তার ঘরে চলে আসে, চা খেতে চায়। অশ্লীলভাবে চায়ে ‘দুধ-চিনি’ বাড়িয়ে দিতে বলে। তাঁর সম্ভ্রান্ত শ্বশুরকুলে এমন বিকারগ্রস্ত মানুষ কীভাবে রয়েছে, সেটাই তিনি ভেবে পান না। ভীষণ সুন্দরী নারী জানান, বিষয়টা তিনি তাঁর স্বামীর গোচরে এনেছেন। মূলত ছয় মাসের কিছু দিন বেশি হলো এই পত্রিকার কাজটি তিনি করছেন। আর এ সময়েই লোকটার উপদ্রব বেড়ে গিয়ে ভিন্ন মাত্রা পেয়েছে। তিনি এটাও বলেন, ‘ভাববেন না, ওসব আমি সামলে নেব।’ উদ্ভূত পরিস্থিতির ঠিক কোন অংশ তিনি সামলে নেবেন, সেটা ঠিক বুঝে উঠতে পারছি না।

আমার অফিসের সবচেয়ে বড় মিলনায়তন। নতুন পুরনো মিলিয়ে এরকম আরো কয়েকটি মিলনায়তন রয়েছে এখানে। সভা-সেমিনার আলোচনা ইত্যাদির জন্য তৈরি করা। তবে আজকের জন্য সর্বাপেক্ষা বড়টি বেছে নেওয়ার কারণ অজ্ঞাত। উপস্থিত বলতে তিনজন বিচারক, ঠিক বিচারকও নন, তদন্তকারী, তিনজনই পরিচালক। একজন সহকারী; প্রজেক্টরে কিছু একটা প্রদর্শনের আয়োজন চূড়ান্ত। আরও একজন সহকারী, যার কাজ মূলত মিলনায়তটি খোলা-বন্ধ করা এবং লাইটগুলো অন-অফ। আমি তদন্তকারী কর্মকর্তাদের বেশ পেছনে শরীর এলিয়ে, আধশোয়া। মিলনায়তনটি ঠান্ডা, আসনগুলো আরামাদায়ক, ইচ্ছে করছে চোখ বন্ধ করে বসে থাকতে। চোখ বন্ধ করি। গ্রিবাদেশীয় কশেরুকা নরম করে ঠেকিয়ে দিই চেয়ারের কাঁধে। মাথা সোজা, উপরে আলো জ্‌বলছে। আলোটা না থাকলেই ভালো হতো। আলোটা নিভে যায়। মঞ্চের পর্দায় ঘ্যাস-ঘ্যাস শব্দে কিছু একটা বেজে ওঠে। তিনজন পরিচালকের একজন অনুচ্চস্বরে আমার নাম ধরে ডেকে ওঠেন। প্রজেক্টরের বিরাট পর্দা থেকে ঠিকরে আসা আলো আর পরিচালকের নাম ধরে ডেকে ওঠায় চোখ মেলে নড়ে-চড়ে বসি। প্রজেক্টরে নয়নতারার ছবি ভেসে ওঠে। সুন্দর!

উনি সত্যিই ভীষণ সুন্দর; অক্ষরের বেড়াজালে অবোধ্য উনার হাসি। দরাজ কণ্ঠে কিছু একটা বর্ণনা করা হচ্ছে। নয়নতারা উনার নাম। পোশাকি নাম কি! জানি না। অনেক দিন হয় পরিচয়। অথচ তাঁর নাম মনে রাখিনি। নামটা কখনো শুনেছি কি-না খেয়াল করে উঠতে পারি না। মূলত দরাজ কণ্ঠ তাঁর পরিচয় বর্ণনা করছে। কণ্ঠটা পেশাদার। ভিউপাগল ইউটিবারদের মতো জঘন্য উচ্চারণ-বর্ণনা নয়, তবু আমি কিছু শুনছি না। নয়নতারার নানাভঙ্গিমায় তোলা ছবি দেখছি; দেখছি তাঁর হাসি, ক্লিভেজ। 

এবার আমার পালা। আমারও অনেক ছবি; একের পর এক প্রদর্শিত হতে থাকে। সবই কেমন যেন ঝাপসা। কোথাও আমার হাতে সিগারেট, ধোঁয়া উড়ছে। আবার আমার বন্ধুদের সঙ্গে তোলা নতুন পুরনো অনেক ছবি। একটা ভেসে যায়-তো আরেকটা ভেসে আসে। কোনোটা ভাঁজ হয়ে পর্দার বাঁ-দিকের কোণা দিয়ে মিলিয়ে যায়। ওটার মিলিয়ে যাওয়া দেখতে-দেখতে ভেসে ওঠে আরেকটা। মাঝারি মানের এক মঞ্চ থেকে প্রখ্যাত এবং পৌঢ় সাহিত্য-পুরোহিতের হাত থেকে আমি পুরস্কারের ক্রেস্ট গ্রহণ করছি। পাশে একজন মন্ত্রী, মন্ত্রীর মুখে হাসি। আরো কয়েকজন বড় এবং মাঝারি অধ্যাপক-বিচারক-সাহিত্যিক। ছবি প্রদর্শন শেষ। নিজেকে হঠাৎ আমার খানিকটা সেলিব্রেটি মনে হয়। বুকের ভেতর নুয়ে পড়া ভাবটা কেটে গিয়ে আমি হঠাৎ আত্মবিশ্বাসী আর সুখী বোধ করি। এবার কয়েকটি ভিডিও ক্লিপ। আমার বন্ধু, শুভাকাঙ্ক্ষী, সমবয়সী সাহিত্যিক ক্ষুদ্র-ক্ষুদ্র ক্লিপে আমার প্রশংসা করছেন; এমন একটি ভিডিও চিত্র নির্মিত হয়েছিল আমাকে নিয়ে; সাহিত্য পুরস্কারের মঞ্চে সেটা প্রদর্শিতও হয়েছিল। পরে আর দেখিনি, হয়তো আছে কোথাও, গুগলে, নেটে, ইউটিউবে, সব কিছু যেভাবে থাকে, সেভাবে। এবারে একটি পারিবারিক ছবি, ছবিতে আমার স্ত্রী-সন্তান এবং আমি, আমার মুখে হাসি। সবশেষে নয়নতারা এবং আমার একটি যুগল ছবি; ঝাপসা। আমরা মুখোমুখি বসে আছি, দূর থেকে তোলা। তবু এতক্ষণ পেশাদার নেপথ্য কণ্ঠের বিবরণে নয়নতারা এবং আমার যতগুলো ছবি প্রদর্শিত হলো তাতে ঠিকই চেনা যায় যে, প্রদর্শিত ছবিতে মুখোমুখি বসে আছি উনি এবং আমি।

ছবিটার কথা আমার মনে পড়ে না। তবে মনে পড়ে জায়গাটা কোথায়! এটা আমাদেরই অফিসের ক্যান্টিন। আমি দুপুরে বসে খাচ্ছিলাম। নয়নতারা আমার কাছে আসেননি, আমাকে চেনেন না, চিনি না আমিও তাঁকে। অন্য কারও কাছে এসেছিলেন, হয়তো লেখা, বিজ্ঞাপন কিংবা অন্য কোনো কাজে। যেহেতু দুপুরে এই ক্যান্টিনে অনেক লেখক-সাহিত্যিককে একসঙ্গে পাওয়া যায়। কেউ হয়তো আমাকে দেখিয়ে দেয় দূর থেকে, চিনিয়ে দেয়। খাওয়া শেষে আমি উঠি-উঠি করছি, তখন আমার চোখ যায় উনার ওপর। তৎক্ষণাৎ উনি উঠে আসেন আমার টেবিলে এবং তাঁর পত্রিকার জন্য একটা গল্প লেখার অনুরোধ করেন। সেই দিনের-সেই ক্ষণের, সেই যুগল ছবিটা। চলিষ্ণু ছবির কাহিনীচিত্র শেষের পথে। নেপথ্য কণ্ঠটা হঠাৎই আমার চেনা-চেনা লাগে। মনে হয় আমার অফিস থেকে গত বছর রিটায়ার করা ডেপুটি আনোয়ার সাহেবের কণ্ঠ। চিত্রকাহিনী শেষ, তদন্তকারীদের মন্ত্রমুগ্ধ দশা তখনো কাটেনি। 

হলের এসি বন্ধ হয়ে গেছে সম্ভবত। গরম বোধ করছি। তদন্তকারীদের মুগ্ধতায় ব্যঘাত না ঘটিয়ে পেছন দিয়ে বেরিয়ে আসি। বাহ্! দারুণ এক পশলা বৃষ্টি হয়ে গেছে। এখনি থামল হয়তো। না-কি রেশ রয়ে গেছে ইলশেগুঁড়িতে; বোঝা যাচ্ছে না। এখান থেকে নামলে বোঝা যাবে। সিগারেটের প্রচণ্ড তেষ্টা বোধ করি। ডানে-বাঁয়ে দু-একজন ঘোরাঘুরি করছে। তারা কেউ আমার দিকে তাকাচ্ছে না। আমার ইচ্ছে হচ্ছে না কারও সঙ্গে কথা বলতে।

চত্বরটা পাড়ি দিয়ে মূল ফটকে যেতে হবে আমাকে, একটা সিগারেট জ্‌বালাতে হবে। মূল ফটকে চলে আসি। দূর থেকে নয়নতারার ছায়া দেখতে পাই। কাছে আসতে আরও স্পষ্ট হয়। হ্যাঁ, তিনিই। মুখে হাসি, আসুন বলে আমার দিকে পা-বাড়ান। ভ্রুতে অলঙ্ঘনীয় ইশারা। সিগারেট ভুলে যাই। নয়নতারার সঙ্গে হেঁটে রাস্তা পার হই। ওপারে নগরীর প্রধান উদ্যান। সাজানো-গোছানোর কাজ চলছে। সমাগত স্বাধীনতা উৎসব পালনের প্রস্তুতি। নয়নতারার সমতলে হাঁটছি আমি। বৃষ্টিতে পাতায় জমা শীতল পানির একটা বড় ফোঁটা এসে পড়ে আমার মাথায়, সেখান থেকে অসংখ্য কণায় পরিণত হয়ে ছুটে যায় নয়নতারার চোখের পাপড়িতে, শব্দ করে হেসে ওঠেন তিনি। তাঁর ডান হাতে জড়ানো আমার বাঁম বাহু, পেশিসমেত হিউমেরাস। আমি উষ্ণতাবোধ করছি।

সাম্প্রতিক দেশকাল ইউটিউব চ্যানেল সাবস্ক্রাইব করুন

মন্তব্য করুন

Epaper

সাপ্তাহিক সাম্প্রতিক দেশকাল ই-পেপার পড়তে ক্লিক করুন

Logo

ঠিকানা: ১০/২২ ইকবাল রোড, ব্লক এ, মোহাম্মদপুর, ঢাকা-১২০৭

© 2024 Shampratik Deshkal All Rights Reserved. Design & Developed By Root Soft Bangladesh

// //