ছয় মাস পর কনফার্মেশন

ঠিক ৮টা বেজে ৫৫ মিনিটে বায়োমেট্রিকে ফিঙ্গার প্রিন্ট দিয়ে টেবিলে বসতেই তাসমিমা স্যারের ইন্টারকম ডাক। পুরো অফিসে তখন হাসপাতালের আইসিইউর মতো গম্ভীর নীরবতা, মৃত্যুর আশঙ্কা কিংবা জীবিকা হারানো অনিশ্চিত জীবনের দিকে এগিয়ে যাওয়ার মাঝে খুব একটা পার্থক্য নেই।

এ সময় এই ডাকের অর্থ সবার জানা। একটা অনুল্লেখ, অনস্বীকার্য সম্ভাবনা নিয়েই অফিস করছে সবাই। তাসমিমা স্যার কখন ডাকেন! গোল্ডেন এসেট নামক কোম্পানিটির এম ডি। ‘ম্যাডাম’ ডাকা একদম পছন্দ করেন না, অফিসে চাকরির ইন্টারভিউ দিতে আসা, করতে আসা, ছেড়ে চলে যাওয়া সবাই জানে এই অলিখিত নিয়মটা। 

স্যারের ঘরে একটা ফুরফুরে স্বর্গীয় গন্ধ, অচেনা আতঙ্কের মতো, অস্তিত্বের ভিত্তিমূল কাঁপিয়ে দেওয়া। গন্ধটা নাকি তার ব্যবহৃত পারফিউমের। কী পারফিউম ব্যবহার করেন তিনি? আদার ব্যাপারির জাহাজের খবর নেয়ার দরকার নেই অবশ্য! বাইরে বের হওয়ার সময় গায়ে একটু পাউডার বুলানোও যার কাছে বিলাসিতা, তার আবার পারফিউম এর ব্রান্ডের খবর নেওয়া!

তাসমিমা স্যার যখন তখন যে কাউকে ডাকেন না। তাসমিমা স্যার ডাকা মানেই চোরাবালিতে পা আটকে যাওয়া, উত্তাল সমুদ্রে অতঃপর লাশ হয়ে ভেসে ওঠা।

যতদিন, যতবার স্যারের ডাকে এই স্বপ্নের মতো সুসজ্জিত কক্ষটিতে ঢুকেছে তুহিন, ততবারই মনে হয়েছে এই গন্ধটি সে হারিয়ে ফেলবে। যতোবার তার কক্ষে ঢুকেছে, প্রাণভরে গন্ধটা ভেতরে নিয়ে নেওয়ার চেষ্টা করেছে, যেন কোনোভাবেই হারিয়ে না যেতে পারে। যেন গন্ধটা ঢুকে যায় ফুসফুসের অলিন্দে অলিন্দে। আইসিইউ রোগীর মতো এই গন্ধটা দীর্ঘ নিঃশ্বাসে নিতে পারে, আবার প্রশ্বাসে ছাড়তেও পারে। 

কিন্তু কক্ষ থেকে বেরিয়ে প্রতিবারই টের পেয়েছে গন্ধটি আর তার সঙ্গে নেই। আজও ভুল করেনি বুক ভরে শ্বাস নিতে, কিন্তু আজ তাসমিমা স্যার তুহিনের হাতে যে খামটি ধরিয়ে দিলেন, তাতে গন্ধ শুষে নেওয়ার শেষ বার্তা চাকরির ছাড়পত্র।

মূলত এই মহামারিকালে একের পর এক শিপমেন্ট বাতিল হচ্ছে, এক্সপোর্ট বলতে গেলে বন্ধ। কোম্পানি লকআপের মুখোমুখি। এই অবস্থায় এমপ্লয়ি পোষা কঠিন বটে। শুধু তুহিনকে নয়, অনেককেই। প্রতিদিন একজন দুজন করে চিঠি পাচ্ছেন। তুহিনও মানসিকভাবে তৈরি ছিল। 

চিঠিটি স্যার মেইলে দিলেই পারতেন, তা না দিয়ে হাতে হাতে দিলেন। মূলত সঙ্গে আনুষঙ্গিক সান্তনা কিংবা অনিবার্য অপারগতামূলক কথাগুলো বলার জন্য। দু-দুটি শিপমেন্ট অর্ডার ঝুলে আছে। পজেটিভ ডিসিশান এলে আবার তাকেই সবার আগে ডাকা হবে, এই সান্তনাটুকুই বা কম কি এই উষড় সময়ে? চিঠিটি হাতে হাতে নেয়ার সময় তিনি মুচকি হেসে যা বলেছেন, বলা যায় না, দু-একদিনের মধ্যেই হয়তো আবার ডাক পেতে পারেন। তুহিনের কাছে এ কেবল সান্ত্‌বনা মনে হয় না, বিশ্বাস্য আশ্বাসই বোধ হয়।

এর একটা গ্রহণযোগ্য কারণ রয়েছে অবশ্য। তাসমিমা স্যারের অফিসে তার চাকরিটা হয়েছিল বিশেষ তদবিরে। সে অন্য ইতিহাস। তানিয়ার প্রতি আকর্ষণ ছিল তাসমিমা স্যারের। একটা প্রজেক্টে কাজ করতে গিয়ে কলকাতার হোটেল রুমে তাসমিমা স্যার রুমে ডেকে নিয়ে তানিয়ার গায়ে হাত দিয়েছিলেন। ফেসবুকে নারীর অধিকার নিয়ে তুড়ি ছুটানো তানিয়া অবশ্য এই আকর্ষণকে দোষের মনে করেনি; কিন্তু বিনা অনুমতিতে গায়ে হাত দেয়াতে ক্ষেপে গিয়েছিল ভীষণ। তাসমিমা স্যারের বিদেশ ফেরত ডিগ্রি, কোম্পানির গুড উইল সব পচা শামুকে পা কাটার মতো প্রশ্নবিদ্ধ হয়ে যাবে চোখের নিমিষে। আর এই ফেসবুক ভাইরালের হুজুগে যুগে তানিয়ার মতো মেয়ে যদি ফেসবুকে কিছু লিখে তো, কান নিয়েছে চিলের মতো দেশে বিদেশে ছড়িয়ে যাবে ঘটনাটা।

যা হোক পরে তাসমিমা স্যারের উদ্যোগেই একটা গ্রহণযোগ্য নেগোসিয়েশন হয়েছিল দু’জনের আর একটা ওপর দেখানো বন্ধুত্ব। যার অদূরপ্রসারী লাভ এই চাকরি। তাসমিমা স্যার অবশ্য জানেন না তানিয়ার সঙ্গে তুহিনের সম্পর্কটা কী বা কতখানি! তানিয়ারও বিশেষ ইচ্ছা ছিল না এই কোম্পানিতে তুহিন চাকরি করুক। আসলে তুহিনের চাকরিটা অনেক হিসাব-নিকাশের ফসল। তাসমিমা স্যার ভেবেছে তানিয়ার অনুরোধে একটা চাকরি দিয়ে তানিয়াকে কিছু দায়বদ্ধ করে রাখা যায়, যাতে তার মুখ খোলা নিয়ে অযথা টেনশন নিয়ে আর টেনশন থাকে না, আর তানিয়াও তুহিনের চাপাচাপিতে শেষমেশ ভেবেছে, ক্ষতি কী! যথেষ্ট যোগ্যতা নিয়েই তো তুহিন চাকরিতে যাচ্ছে। যেনতেন কাউকে তো জোর করে ঢুকাচ্ছে না। আদতে তুহিনের পারিবারিক পরিস্থিতি তখন একেবারে খাদে পড়া গাড়ির মতো উপায়হীন। মাথার ওপর রোজগার করা বড় ভাইটা হঠাৎ রোড এক্সিডেন্টে মারা গেলে সমস্যাটা সত্যি অপারেশান থিয়েটারে মারা যাওয়া রোগীর খবর নিয়ে বাইরে আসা ডাক্তারের মতো অসহায় হয়ে সামনে দাঁড়ায়। ভাইয়ের বউ বাচ্চা।

হার্টের রোগী বাবার পেনশনের টাকাটা যাও ছিল মাসিক বেনিফিট আসতো, বাবার হার্টে রিং বসাতে সবটুকু ভাঙতে হলো, বাবাও বাঁচলো না। মায়ের চোখের নির্বিকার হতাশা কতটা চল্লিশ বছর সংসার করা জীবনসঙ্গীর জন্য কতোটা ফুরিয়ে যাওয়া টাকাগুলোর জন্য তুহিন তৎক্ষণাৎ ঠিকঠাক বুঝে উঠতে পারেনি, মা মুখ না খুলার ফলে। পরবর্তীতে মাকে অবশ্য মাঝে মাঝেই একগাদা মেডিকাল টেস্ট কিংবা রব্বানির সেশন ফির বড় সড় এমাউন্টের প্রয়োজন পড়লেই পেনশনের টাকাগুলোর জন্য হা হুতাশ করতে শোনা যেতো, যদিও সঙ্গে ‘তবু মানুষটা বাঁচলেও বুঝতাম’ বলে টাকার গুরুত্বটা ওজনহীন করতে চাইতেন। তুহিন অন্তর্নিহিত কারণটা অনুচ্চারিত নগ্ন সত্যের মতো টের পেতো। সংসারে প্রয়োজন ফুরিয়ে গেলে বাঁচা মানে প্রয়োজনীয় সকলের অহেতুক বোঝা হয়ে থাকা। না ফেলা যায়, না রাখা যায় এমন পুরনো আসবাব। সারাজীবন পরিবার পেলে পুষে, শেষ বয়সে বাবার মৃত্যুর জন্য আফসোসের চেয়ে টাকার আফসোসটাই সংসারে বড় হয়ে দেখা দিয়েছে।

তুহিনের যখন মাস্টার্স শেষ হলো তখন কোথাও মহামারির কারণে চাকরি-বাকরির ক্ষীণ আলোক রেখাটারও সন্ধান নেই। ঘরে নিত্য হা হুতাশ, দীর্ঘশ্বাসের মাঝে খুঁজে পেতে পাওয়া গেলো, একমাত্র তাসমিমা স্যারের এই খোলা জানালাটাই। মধ্যবিত্তের ভাবধরা মুখোশের অন্তরালের অভাবটা ঠিক খুলে দেখানো যায় না যেখানে সেখানে, নিম্নবিত্ত যেভাবে পারে সাহায্যের জন্য যে কোন তালিকায় নামটা লিখিয়ে নিতে। মহামারীর জন্য নানা দিক থেকেই আয়োজন চলছিল তখন সাহায্য সহযোগিতার। না কোথাও লাইন ধরা যায়, না ঘরের এই নিত্য হা হুতাশ গায়ে সয়। এমন করুণ অবস্থায় পৌঁছেছিল, তুহিনই ওকে চাপাচাপি করছিল তাসমিমা স্যারের অফিসে তার চাকরিটার জন্য তদবির করতে।

ছাড়পত্রটি হাতে নিয়ে নিজের মানসিক প্রস্তুতি থাকার কারণে তুহিন তেমন না ঘাবড়ালেও বেরিয়ে অন্যান্য সবার বিষন্ন মুখে ঝুলে থাকা অব্যক্ত সান্ত্‌বনা আর আতঙ্ক পেরিয়ে নিজের টেবিলে এসে বসল সে।

প্রথমেই ফোন দিলো তানিয়াকে। তানিয়াকেই সবার আগে ফোনটা দেয়া দরকার। তানিয়া ফোন ধরলো না। তানিয়ার আজ বাবার পছন্দ করা পাত্রের সাথে বিয়ে পাকা হওয়ার কথা। তানিয়া দৃঢ় প্রতিজ্ঞ বিয়ে করবে না। বাপের পছন্দের পাত্রকে বিয়ে করার জন্য এতো বড় বড় নারী অধিকারের বুলি আওড়ে গেল এতকাল? অন্তত কাল পর্যন্ত তাই মত ছিল তানিয়ার। তুহিনকে ছাড়া জীবন সে ভাবতেই পারে না; কিন্তু এখন তানিয়া ফোন ধরছে না। 

বাইরে তখন ঠিক দুপুর। বৈশাখের তপ্ত দহনটা হঠাৎ টুক করে গিলে নিয়েছে কাল বৈশাখীর কালো মেঘ। নিমিষে, জানালা দিয়ে আকাশের দিকে তাকাতে তাকাতেই একটা বজ্র জানালার কাঁচ কাঁপিয়ে দিলো ঝনঝনিয়ে।

আর দেখতে দেখতেই ঝুম বৃষ্টি। সামনের কম্পিউটারে এক গাদা পেন্ডিং মেইল। দ্রুত শেষ করে, বুঝিয়ে দিয়ে যেতে হবে। বারবার জানালা গলিয়ে দৃষ্টি বাইরে চলে যায় তুহিনের। সে দৃষ্টিতে হতাশা আছে, স্বপ্নভঙ্গের যন্ত্রণা আছে, সবকিছু ছাপিয়ে আছে অসহায়ত্ব। অথচ যা থাকার কথা ছিল, তাই নেই। রোমান্টিকতা। টুপ টাপ বর্ষা পানি, পানিনে আগ লাগায়া...হুট করে গানটা এসে ঠোঁটে বসে গুনগুনিয়ে উঠে আপনা-আপনি। হাসি পায় তুহিনের। গুনগুনিয়ে উঠা আওয়াজটা তিতা ট্যাবলেটের মতো গিলে ফেলে ভাবে, যার ড্রয়ারে স্যাক হয়ে যাওয়ার চিঠি, কাল থেকে যার চাকরি নাই, ঘরে যার চার চারটি মুখ হা করে তার দিকে তাকিয়ে আছে সে বৃষ্টি দেখে গান গায়? 

মোবাইল স্ক্রিনে ১১টা মিসড কল। ফোনটা সাইলেন্ট ছিল। তানিয়া ব্যাক করেছিল। শুনতে পায়নি সে। 

 তানিয়া নিচে বৃষ্টি ভিজছে, বাসা থেকে বেরিয়ে এসেছে। দ্রত লিফটে নিচে নামে তুহিন। তানিয়ার ঠাণ্ডা এলার্জি আছে। ঠাণ্ডা থেকে শ্বাসকষ্ট, ইনহেলার। বেচারি। নিজেকেও বলতে ছাড়েনা বেচারা! আহা! বেচারা! বেচারা তুহিন। কী করে তানিয়াকে জানাবে আজই তানিয়ার তদবিরে হওয়া তার চাকরিটা চলে গেছে! 

এই বৃষ্টির দুপুরের সাথে নাকি খিচুড়ির সম্পর্ক আছে। ইলিশ ভাজা। নাটক সিনেমার মতো এই দুপুরে তানিয়াকে সাথে নিয়ে খিচুড়ি খাওয়া উচিত। বাস্তবে আজ দুপুরে তুহিন খাবে না। বৃষ্টি ভিজে আধামাইল দূরে পরোটা ভাজির দোকানটাতে যাওয়া হবে না। খাওয়াও হবে না। খিদে লাগবে, সহ্য করে নিলে চল্লিশ টাকা বেঁচে যাবে। এই মূহুর্তে চল্লিশ টাকা বাঁচানো খুব জরুরি নয়। আবার বেঁচে গেলেও মন্দ নয়। 

চাকরিটা আমি পেয়ে গেছি বেলা শুনছো, চাকরি পাবার চার মাস পর আজ মনে হচ্ছে চাকরি পাবার কথাটা বাসার কাউকে না বললেও চলতো। সবার প্রত্যাশা এভাবে লাগামহীন হয়ে উঠতো না। যেখানে সে নিজেও জানতো ছয়মাস প্রভিশনাল পিরিয়ড। ছয় মাস পার হলেই তবে চাকরি স্থায়ী।

প্রভিশনাল পিরিয়ড পার হবার আগেই চাকরি নাই। কোম্পানির দোষ দিয়ে লাভ কী? প্যানডমিকের আঘাত সেরে উঠে কয়েকটা অর্ডার আসার সাথে সাথেই দ্বিতীয় ঢেউয়ের ধাক্কা, অর্ডার বাতিল এসব তো কিছুই মিথ্যা নয়। প্রথম লকডাউনের ধাক্কা সামলে গোছগাছ করে শুরু করেই মাস চারেকের বেতন টেনেছে কোম্পানি। পাঁচ মাসের মাথায় জবাব দিয়ে দেয়া ছাড়া আর কোন উপায় যে কোম্পানির ছিল না তাতো সে নিজেও বুঝে। 

প্রথম চাকরি পাবার একটা আলাদারকম আনন্দ আছে। আর তা যদি হয় একেবারেই আয় রোজগারহীন মধ্য মেঘনায় ডুবে যাওয়া নৌকার যাত্রীর মতো হতাশায় ডুবে থাকা কোন পরিবারের, জীবনের হাঁফ ছাড়াতে এরচেয়ে বড় দাওয়াই নেই। চাকরির কথাটা বলে বলতে গেলে সে হামজার মতো উদ্ধারকারী জাহাজ নিয়ে হাজির হয়েছে পরিবারের সামনে। মুক্তি দিতে চেয়েছে পুরো পরিবারকে দমবন্ধ ডুবে মরার অসহায় অবস্থা থেকে। সিনেমার নায়কের মতো নিয়োগপত্র দৌড়াতে দৌড়াতে মায়ের কাছে নিয়ে যাওয়া, মা আমার চাকরি হয়েছে...মা আমার চাকরি হয়েছে। ব্যাপারটা আসলে তেমন পাণ্ডুলিপির মতো তো আর ছিল না। তুহিনের পরিবারের জন্য বরং অকল্পনীয় আশার ব্যাপারই ছিল। 

তানিয়াকে কোনরকমে বুঝিয়ে বাড়ি পাঠাতে পেরেছিল তুহিন। তানিয়া প্রথমে কিচ্ছু শুনতে রাজি ছিল না, কোন অজুহাত, কোন যুক্তিগ্রাহ্য কারণ। চাকরিটা আজ চলে যাবে বেলা শুনছো, তুহিনের কণ্ঠে যথেষ্ট কৌতুকের সুরে তানিয়া দৃঢ় কণ্ঠে বললো, আমি খুব ভালো একটা চাকরি করি তুমি জানো তুহিন। আর পুরুষ চাকরি করবে, আর ঘরের বউ বসে বসে খাবে এ নারীতো আমি নই তুমি ভালো করেই জানো।

ফেসবুকে নারী অধিকার নিয়ে তুমুল স্ট্যাটাস লেখা তানিয়া হ্যান্ডসাম বেতন পায় আমি জানি। তানিয়াকে অবশ্য বলা হয়নি ততক্ষণে চাকরিটা চলে গেছে! সন্ধ্যায় ওকে বাড়ি থেকে নিয়ে আসবো, এই শর্তে নিশ্চিত হয়ে তানিয়া বৃষ্টি ভিজে আবার ফিরে যায়, রিক্সার হুডে সব অভিযোগ ঢেকে। অদ্ভুত মেয়ে তানিয়া, এই ঠিক দুপুরে তুহিন ওকে না খাইয়ে বিদায় দিচ্ছে ওর কোনো অভিযোগ নেই, অভিযোগ করা যায় এটাই ভাবতে পারে না। 

মাসের বেতনের খামটা ড্রয়ার খুলে হাতে নিয়ে তুহিন বাসায় ঢোকে। অন্ধকার ঘরে ভাবি এসে টেবিলে চা রাখে। কপালে হাত রাখে। শরীর জাগাতে চায়। তুহিন ভাবিকে বলতে চায়, ভাবি আমার চাকরিটা আজ চলে গেছে। ভাবি খুব বুদ্ধিমতী। ভাইয়ার মৃত্যুর পর বুদ্ধির জোরেই টিকে থাকতে পেরেছে এ বাড়িতে। অভ্যাসের মতোই শাড়ির আঁচল খসিয়ে লোভাতুর করে তুহিনকে। কোনোভাবেই টলাতে না পেরে অবশেষে বলে, বাবুর প্রাইভেট টিউটরের বেতন দিতে হবে কাল। আলো জ্বালিয়ে টাকাটা গুণে দেয়। 

তানিয়া অপেক্ষা করছে। মাকে চাকরি চলে যাওয়ার খবরটা জানাতে চায়। জানাতে চায় তানিয়াকে নিয়ে আসার ব্যাপারটাও। মা আঁটি না বাঁধা আম কাটছেন উঁচু পিঁড়িতে বসে, আচার দেবেন। চাকরি যাওয়ার খবরটা দেয়ার ধারেকাছে যাবার মতো পরিস্থিতি তৈরি হয় না, এই কাঁচা আম কাটা ঘ্রাণের মসৃণ সাংসারিক আয়োজনে। মা প্রয়োজনের দৃষ্টিতে তাকিয়ে জানান, ঘরের বাজার প্রায় তলানিতে। 

মাহীনের ঘরটা পার হবার সময় মাহীন হাতের স্মার্টফোন টেবিলে রেখে সামান্য মনোযোগ এদিকে ঘুরিয়ে জানান দেয়, ভাইয়া সেকেন্ড সেমিস্টারের টাকাটা না সেকেন্ড উইকেই দিতে হবে। স্মার্টফোনের উজ্জ্বল আলোতে মাহীনের চোখদুটি আরো বুদ্ধিদীপ্ততায় চকচক করে, মা যেমন বলে, তার ছেলেদের মধ্যে মাহীন সবচেয়ে বুদ্ধিমান। নিজের প্যান্ট শার্ট, স্মার্টফোন সব সে নিজে রোজগার করে কেনে। পরিবারের কাছে চায়না। যে পরিবারের নিত্যদিনের ভদ্রস্থ আবশ্যিক খরচগুলো আটকে থাকে, সে পরিবারের ছেলের এই দামি শার্ট প্যান্ট, স্মার্টফোন না কিনলে চলে কিনা প্রসঙ্গগুলো অবশ্য উহ্যই থেকে যায়। মাহীনকে বলতে চায়, মাহীন আমার চাকরিটা চলে গেছে। মাহীনও সেই সুযোগ সৃষ্টি করে না বরং নিজের বিরক্তিটাই প্রকাশ করে, কে জানে এবারও হয়তো অনলাইনেই পরীক্ষা নেবে, কিন্তু সেশন ফিতো দিতেই হবে। 

তানিয়া আমার জন্য অপেক্ষা করছে। দুপুরে ফিরে যাবার পর থেকে তানিয়া অবশ্য আর ফোন দেয়নি। ওর বাসার দিকে রওয়ানা হয় তুহিন। তানিয়া অপেক্ষা করছে। তানিয়াদের বিল্ডিংটার সামনে স্বপ্নের বিরাট শো রুম, গলিতে ঢুকতেই বিশাল সাইনবোর্ড চোখে পড়ে, সাইনবোর্ডের পেছনে তানিয়াদের বাড়িতে ঝলমল লাল-সবুজ-নীল আলো ঝলমল করছে...। ছাদ থেকে নিচতলা পর্যন্ত। তানিয়ারা যেন ক তলায় থাকে?

এখানে দাঁড়িয়ে আগে একটা ফোন দেওয়া যাক। 

সাম্প্রতিক দেশকাল ইউটিউব চ্যানেল সাবস্ক্রাইব করুন

মন্তব্য করুন

Epaper

সাপ্তাহিক সাম্প্রতিক দেশকাল ই-পেপার পড়তে ক্লিক করুন

Logo

ঠিকানা: ১০/২২ ইকবাল রোড, ব্লক এ, মোহাম্মদপুর, ঢাকা-১২০৭

© 2024 Shampratik Deshkal All Rights Reserved. Design & Developed By Root Soft Bangladesh

// //