করোনার দিনকাল

হাওয়া বেগমের করোনা হয়েছে। 

হাওয়া বেগমের বয়স চল্লিশের মতো। পঁয়তাল্লিশও হতে পারে। সে মোমিন সাহেবের বাসায় কাজ করে। বিশ বছর ধরেই আছে ওই বাসায়। গত ঈদের ছুটিতে বাড়ি গিয়েছিল। যদিও মিসেস মোমিন মানে রাবেয়া নিষেধ করেছিলেন ‘এখন যেও না, করোনা হবে’ 

-না খালাম্মা, আমগো করোনা-মরোনা হইব না। এইডা গরিবগো ধরে না। বড়লোকের রোগ

শেষ পর্যন্ত সে বাড়ি গেলই এবং দিন দশেক থেকে ফিরে এলো করোনা নিয়ে। 

মোমিন সাহেব এবং তার স্ত্রী রাবেয়া দু’জনেই সিরিয়াস টাইপের মানুষ এবং ভালো মানুষ। মোমিন সাহেব সরকারি চাকরি করতেন, এখন রিটায়ার্ড। স্ত্রী রাবেয়া বেগম একটা স্কুলে ছিলেন এখন তিনিও রিটায়ার্ড। অনলাইনে ক্লাস নিতে আরাম পান না বলে চাকরি ছেড়ে দিয়েছেন। তাদের এক ছেলে এক মেয়ে; দু’জনেই বিদেশে। একজন বিয়ে করে ওখানেই সেটেল্ড, একজন পড়তে গেছে, ফিরে আসবে আশা করা যায়। 

তারা দু’জনেই যেহেতু সিরিয়াস টাইপ। তাই হাওয়া বেগম বাড়ি থেকে ফেরামাত্র তার করোনা টেস্ট করালেন। এবং তখনই ধরা পড়ল সে করোনা পজিটিভ। সঙ্গে সঙ্গে তাকে একটা ঘরে গৃহবন্দি করা হলো। সে অবশ্য চেঁচাতে লাগল-

- খালাম্মা আমি ভালো আছি, খালি একটু জ্‌বর আর কাশি হইছে... সাইরা যাইব

- একটা কথা বলবে না। এই ঘর থেকে বের হবে না। তোমার খাবার-দাবার আমি দেব। তোমার ঘরের বাইরে দরজার কাছে এই ছোট টেবিলটায় রেখে দিব, তুমি নিয়ে নেবে। মনে 

থাকবে?

- মনে থাকব কিন্তু ...

- কোনো কিন্তু না। যা বলছি অক্ষরে অক্ষরে পালন করবে, ঠিক আছে?

- আচ্ছা। বিরস মুখে বলে হাওয়া বেগম

 দু’দিন পর হাওয়া বেগম বলল ‘আম্মা মন টেকে না। টিবি দেখত মন চায়’ 

- উফ... আচ্ছা ব্যবস্থা করছি। রাবেয়া বেগম ড্রাইভারকে দিয়ে তার ঘরে ছোট একটা টিভি সেট করে দিলেন, মেয়ের ঘরে একটা টিভি ছিল, সেটা কাজে লাগল। ওখানে এখন সারাদিন বাংলা ছবি চলে। 

বিকেলে হাওয়া বেগম ফের ডাকাডাকি শুরু করল

- আম্মা আম্মা ...

- আবার কি হলো?

- আম্মা চা খাইতে মন চায়, চিনি কম দুধ বেশি

- আচ্ছা দিচ্ছি। চা বানিয়ে টেবিলে রাখলেন। দুটি টোস্ট বিস্কিটও দিলেন। 

পর দিন আবার হাওয়া বেগমের চিৎকার। 

 -আম্মা আম্মা ...

- আবার কি হলো?

- আম্মা বিরানির গন্ধ পাই, ঘরে কি বিরানি বানাইছেন আইজকা?

- উফ... না বিরানি রাঁধিনি। কেন? বিরানি খেতে ইচ্ছে হচ্ছে?

- জে আম্মা

- আচ্ছা বিরানি আনিয়ে দিচ্ছি; কিন্তু এটাই শেষ এরপর আর কে নো ইচ্ছে যেন না হয়

- আইচ্ছা আম্মা। 

ড্রাইভারকে দিয়ে বিরিয়ানি আনিয়ে দিলেন এক প্যাকেট। 

দু’দিন বাদে আবার ডাকাডাকি

- আম্মা আম্মা ...

- আবার কি হলো? 

- আম্মা আমি এখন সুস্থ আছি। রান্না ঘর থাইকা আমি একটা ডিম ভাইজা খাই? গোল মরিচ দিয়া...

- খবরদার ঘর থেকে বের হবে না। আমি ডিম ভেজে দিচ্ছি। উফ...

রাবেয়া বেগম যখন ডিম ভাজছিলেন তখন পিছে এসে মোমিন সাহেব দাঁড়ালেন, মুখটা হাসি হাসি তার

- কি হলো হাসো কেন? 

- তোমার কষ্ট দেখে। হাওয়া বেগমতো মনে হচ্ছে কোয়ারেন্টিনের ১৪ দিন আমাদের জীবন অস্থির করে তুলবে।

- তোমার জীবন না, বলো আমারটা

- ওই হলো আরকি, তুমি মানেইতো আমি

- থাক আর ন্যাকামি করতে হবে না। যাও ডিমটা ওর দরজার সামনের টেবিলে রেখে আস। 

- দাও। ডিম নিয়ে ছুটলেন মোমিন সাহেব।

মোমিন সাহেব টেবিলে ডিম রাখছেন দেখে হাওয়া বেগম জিভ কেটে ছি ছি করে উঠল ‘হায় হায় খালু আমার লাইগা ডিম আনছেন নিজের হাতে...’

- খাও ডিম খাও । ঘর থেকে বের হবে না। যা লাগে বলবে 

 আচ্ছা... ও খালু একটা কথা

- কি? মোমিন সাহেব খেয়াল করলেন হাওয়া বেগমের মুখে লাজুক হাসি 

- খালু ঐদিন শুক্কুরবারে আপনেরা খাইলেন যে গোল মতো বাক্সের মধ্যে তিন কোণা... আমারে খালাম্মা একটা দিছিলেন ওইটা একটা যদি খাইতে পারতাম

মোমিন সাহেব ফিরে এসে স্ত্রীকে বললেন

- একটা পিজ্জার অর্ডার দাও অনলাইনে

- মানে?

- তোমার হাওয়া বেগম পিজ্জা খেতে চাইছে 

- তোমাকে তাই বলল?

- হ্যাঁ, বলল ‘ওই দিন শুক্কুরবারে আপনেরা বাক্সের মধ্যে গোল মতো তিন কোণা খাইলেন, খালাম্মা দিছিলেন ...’

- উফ ... মাথায় হাত দিয়ে বিছানায় বসে পড়লেন রাবেয়া বেগম। তার মনে পড়েছে। গত শুক্রবারে আমেরিকা থেকে অনলাইনে অর্ডার করে পাঠিয়েছিল মেয়ে। একটা ফ্যামিলি সাইজ পিজ্জা; মেয়েটা প্রায়ই এটা সেটা ওখান থেকে অনলাইনে অর্ডার করে। 

- না বাবা, আমি এসব অনলাইনে অর্ডার করতে পারি না। তুমি কর

- আমিও পারি না। তাহলে মেয়েকে বলো, হাওয়া বেগম পিজ্জা খেতে চাইছে।

- আমি পারব না। 

তবে রাতে রাবেয়া বেগম মেসেঞ্জারে মেয়ের সঙ্গে কথা বললেন। ভিডিও কল

- মারে শুনেছিসতো হাওয়ার করোনা হয়েছে

- হ্যাঁ, এখন কেমন আছে?

- ভালোইতো মনে হয়। এখন পিজ্জা খেতে চাইছে

- হাঃ হাঃ তাই? আচ্ছা ফোনটা ওর দরজার সামনে টেবিলে রাখ কথা বলি

মেয়ে আরেক পাগল। রাবেয়া বেগম তাই করলেন। ‘হাওয়া নাও রুপুর সঙ্গে কথা বলো। ফোনে হাত দিও না।’ ফোনটা টেবিলের ওপর ফোন স্ট্যান্ডে রাখলেন।

-হাওয়া বু কেমন আছ?

-ভালো আছি, আমার করোনা হইছে তুমি কেমন আছ বইন?

-ভালো আছি। তোমার নাকি পিজ্জা খেতে ইচ্ছে হয়েছে? 

-হ চ্যাপ্ডা বাক্সের মধ্যে গোল... তিনকোণা কাডা... খালুরে কইছি

-হু হু বুঝেছি। কি খাবে চিকেন আলফ্রেডো? নাকি বিফ পেপারনি? 

-হ ওই যে চ্যাপ্ডা বাক্সের মধ্যে গোলমতো... তিন কোণা কইরা কাডা... লগে ছোড ছোড সাদা সসের ডিব্বা 

-আচ্ছা বুঝেছি... ঠিক আছে ঠিক আছে। সাবধানে থেক ঘর থেকে বের হবে না খবরদার। তোমার কারণে বাবা মার করোনা হলে কিন্তু সাড়ে সর্বনাশ। উনাদের বয়স হয়েছে। 

-আইচ্ছা

-তোমার পিজ্জা অর্ডার করছি। রাখলাম। ফোনে হাত দিও না

-আইচ্ছা

সেদিন সন্ধ্যায় পিজ্জা চলে এলো, চিকেন আলফ্রেডো। নিজেদের জন্য দুটি টুকরা রেখে পুরো বাক্সই হাওয়া বেগমকে দিয়ে দিলেন রাবেয়া। পিজ্জা মোমিন সাহেব বা রাবেয়া কারও খুব একটা ভালো লাগে না। বরং হাওয়া বেগমই খাক তার যখন শখ হয়েছে। 

হাওয়া বেগমের কোয়ারেন্টাইনের অষ্টম দিনে আবার চিৎকার ‘আম্মা আম্মা ...’ 

-আবার কি হলো তোমার?

-খালাম্মা বিষ্টি হইতাছে বাইরে... ঝুম বিষ্টি!

-তো?

-রান্না ঘরে গিয়া আপনেগো লাইগা খিচুড়ি চড়ায়া দেই? আর ডিম ভুনা! খালুর পছন্দ

-খবরদার তুমি ঘর থেকে বের হবি না। খালুর খিচুড়ি খেতে হবে না। তোমার ইচ্ছে হচ্ছে?

-জে

-উফ... রাবেয়া রান্না ঘরে গিয়ে খিচুড়ি চড়ালেন; পেছনে হাসি হাসি মুখে এসে দাঁড়ালেন কৃষি মন্ত্রণালয়ের রিটায়ার্ড অ্যাসিস্ট্যান্ট সেক্রেটারি মোমিন হোসেন। 

-কি ব্যাপার হাসছ কেন? 

-কি হাসতেও পারব না?

-না। কড়া গলায় বললেন; বলেই খিল খিল করে হেসে ফেললেন রাবেয়া। মোমিন সাহেব মুগ্ধ হয়ে গেলেন। বিশ্ববিদ্যালয় জীবনে এক বৃষ্টির দিনে এই হাসি দেখেই প্রথম মুগ্ধ হয়েছিলেন তিনি। এত বছর পরে আবার মুগ্ধ হলেন। হাওয়া বেগমের করোনার কারণেই আবার হয়তো এই হাসি দেখা সম্ভব হলো, কে জানে!  

সাম্প্রতিক দেশকাল ইউটিউব চ্যানেল সাবস্ক্রাইব করুন

মন্তব্য করুন

Epaper

সাপ্তাহিক সাম্প্রতিক দেশকাল ই-পেপার পড়তে ক্লিক করুন

Logo

ঠিকানা: ১০/২২ ইকবাল রোড, ব্লক এ, মোহাম্মদপুর, ঢাকা-১২০৭

© 2024 Shampratik Deshkal All Rights Reserved. Design & Developed By Root Soft Bangladesh

// //