বিষ বায়ু

আবহাওয়া অফিস যে বছর বেশি বেশি ঝড়ের সতর্ক বার্তা দেয়, সে বছর নাকি ঝড় হয় না। কথাটা বলেছিল সেদিন তাদের ইউনিয়ন পরিষদের মেম্বার কুতুবুদ্দীন। পান চাবাতে চাবাতে পিচ করে পিক ফেলল খানিক, তারপর হাতের চেটোয় দাড়িটাড়ি সমেত মুখ মুছতে মুছতে বলল, ‘কত দ্যাখলাম, এ দ্যাশের আবহাওয়া অফিসের কতা অত বিশ্বেস করার কিছু নেইরে ওলিউল্লা। তা যাইস কানে, যহন ঝড় আসপিনে তার আগে আগে সাইক্লোন শেল্টারে গিয়ে উটিস ক্যানে। তোরা বাড়ি বইসে মইরে পড়লি তো আবার আমাগের বিপদ!’ 

কুতুবুদ্দিনের এই গা জ্বালানো কথা শোনার মানুষ না ওলি, কিন্তু তাও এখন মাথা হেলিয়ে বসে শুনে যেতে হচ্ছে দুটি ত্রাণের আশায়। নইলে তো ত্রাণ পাবে না, রিলিফের কার্ড হবে না। এমনিতেও করোনার জন্য আসা রিলিফ নাকি সব চেয়ারম্যান, মেম্বার আর দলদারি করা লোকজন মিলে হাফিস করে দিচ্ছে। তায় আবার মড়ার ওপর খাঁড়ার ঘা এক ঝড় আসার খবর। ওলি কিছু বুঝে উঠতে পারে না, সব কিছু এমন একের পর এক এসে পড়তেছে, ‘এই কয় সবার থেকে তফাৎ থাকো, এই কয় শেল্টারে যাও!’ ওলিউল্লা দিনভর মনে মনে জপ করতে থাকে, ‘ঝড়ডা যেন না আসে খোদা’! 

২.

কিন্তু ওলিউল্লার এমনি কপাল, এ বছর অফিসের কথাও সত্য হয়ে গেল। অসময়ে টানা তিন দিন বৃষ্টির পর এলো সেই ঘূর্ণিঝড়। ওলিউল্লাহ খেদের মাথায় বলে, ‘ডাকিনী-যোগিনীগেরও আজকাইল কী সুন্দর সুন্দর নাম রাখা হতিচ্ছে। আরে কয়মাস আগে দুইনে ছিবড়ে কইরে দেলো যে ঝড়, তার নাম নাকি ছেলো বুলবুল। এখন আবার ডাক দিচ্ছে আমফান! কথায় আছে বুলবুলিতে ধান খেয়ে যায়, আর বুলবুল এসে তার জান খেয়ে গেল। ওই বছর তো এমন হতিই হবে। সে বছর যে এনজিওগুলোর থেকে ঋণ নিয়ে কাঠা তিনেক জায়গায় শীতের সবজি বুনেছিল সে। ওই বছরে আর বৃষ্টি কাদা না হয়ে যায় কই! ঝড়ের রাত্তিরে হুহু কইরে পানি উঠে গেল কোমর পর্যন্ত সঙ্গে ঘরের চালটাও উড়ে গেল। শীতের সবজি তো সবজি বর্গা জমিতে আমন ধান বুনেছিল তাও সব ধুয়ে মুছে শেষ। তারপর ফের বোরো ধান উঠতি না উঠতি আবার ঝড়। তার ওপরে মহামারি। 

একের পর এক তাণ্ডবে ওলিউল্লার সারাশরীর যেন ধীরে ধীরে অবস হয়ে আসতে থাকে। মাঝে মাঝে ওলি নিজের শরীরে চিমটি কেটে দেখে রক্ত আবার সব জমাট বেন্ধে গেল নাকি! এই যে চোখের সামনে এক বছরের টিকে থাকার রসদ, ঋণের টাকা শোধ দেওয়ার শেষ ভরসা সব এক নিমেষে শেষ হয়ে গেল! এই শোকই তো তার শরীর অসাড় হয়ে যাওয়ার জন্য যথেষ্ট, রক্ত চলা না চলার কি দোষ! ঘরে মণ খানিক ইরি ধান ছাড়া আর কিছু অবশিষ্ট নেই। টিকে থাকার জন্য খুব অসময় এই কয়টা মাস। এই সময়টা তো মাছেরও সিজন না। বাগদা চিংড়ি ধরার গোনের সময় হলে তা-ও খটিতে কাজ করে, চিংড়ির মাথা খুলে একবেলা খাবার জোটানো যেত কিন্তু এখন! ঘরে পাঁচটা পেট। সেই পেটগুলোতে একবেলা হলেও তো খাওয়ার জোটাতে হবে। ঝড়ে মাছের ঘেরগুলোর কিছু বেড়িবাঁধ ভেঙে গেছে। সেগুলো মেরামতের জন্য যদি মাটি কাটার ডাক পড়ে সেই অপেক্ষায় বসে থাকতে হবে। ওলি একসময় ছিল সুন্দবনের বাওয়াল। তার সে কাজ বন দস্যুদের তাড়নায় কবে সিকেয় উঠেছে! তারপর এই কাজ, সেই কাজ, বর্গা নিয়ে খেত খামার, ধান-পান সব ছাড়িয়ে শেষ পর্যন্ত গিয়ে ঠেকল মাটি কাটার ব্যালদারে! 

ওলিউল্লা আপন মনে ক্ষতির হিসেব কষে যায়, ‘গত বছর বৈশাখ মাসে যহন ধান উঠল, ধানের দাম গেল পইড়ে। ও বছর পানির দামে ধান বেচতি হলো তারে। খোরাকির ধান তাও রাখতে পারে নাই সে। ধান রাখতে গেলে যে সদায় পাতি জোটানো ভার। তেল-নুন-মাছ, গোস্তের যে দাম, ছোঁয়া যায় না। ইলিশ মাছ যে কোন জনমে খেয়েছিল মনেও পড়ে না। কোরবানির সময় ছাড়া তো গরুর মাংসেরও দেখা মেলে না। গরিবের জন্য গোস্ত বলতি আছে এক বয়লার মুরগি। তাও তো মাসে ছ’মাসে একবার অতিথি মেহমান আসলি কেনা হয়। তার বৌ কুট্টি কয়টা মুরগি পোষে বটে, তা ওই ছানা পোনার মুখে একটু ডিম তুলে দেয়ার ভরসায়। পিঁয়েজের দামওতো আকাশে উঠিল। গরিব-গুর্বো একটু ভাতের সঙ্গে নুন পিঁয়েজ দিয়ে পেট ভরাবে সে উপায়ও রাখি নেই! দেখতি দেখতি ইলিশ মাছ, গরুর গোস্ত, পিঁয়েজ-রশুন-আদা সব কেমন গরির মানষির কেসমত ছাইড়ে দূর-সুদূরের জিনিস হইয়ে গেল। একসময় হয়তো সবই যাবে। আল্লারও কি বিচার! আবারও তিন দিন ধইরে শুধু বৃষ্টি আর বৃষ্টি। বিশ্বাসই হয় না যে, জষ্টি মাস আইসে গেইছে। আগে কার্তিক মাসে শীত পড়ত, এখন পড়ে পৌষের শেষে। বাকি সব গরম আর বর্ষাকাল।’ 

সারা গায়ে কাদা-পানি মেখে সন্ধ্যা অবধি বাড়ি ফিরল ওলি। নেশা-ভাং কিছু করে নাই তারপরও পা-দুটো টলছে তার। কোথাও কোনো কাজ জোটাতে পারেনি সারাদিনে। শরীর যেন আর বয় না। বুকজুড়ে সারা দুনিয়ার হতাশা ভর করে তার! ‘ছেলে-মেয়ে তিনটেরে নাহয় কুট্টি দুটো ভাত ফুটিয়ে দেবে কিন্তু কিস্তির টাকা! সময় হলি হপ্তা শেষে যমদূতের মতো এসে দাঁড়াবে কিস্তির টাকা নিতি। খিস্তি খেউর, ঘরের জিনিস পত্তর নিয়ে টানাটানি চলবে। ফসল গেল কি ঘর গেল, তাতে ওদের কিছু যায় আসে না। কিস্তি দিতি না পারলি কেননা খাওয়ার ধান কয়টাও নিয়ে যায় শালারা! থু করে এক দলা থুতু ফেলে ওলি। বিড়ির নেশা জেগেছে। একটা বিড়ি কেনারও পয়সা নেই শালা! শহরে, শহরেই যাতি হবে তারে। শহরে অন্তত খাওয়ার অভাব হবে না।’ 

৩.

শহরে যাওয়ার কথা সে ভাবছে বটে কিন্তু সেই ভাবনার ভেতরে একটা বড় সংশয় ঝুলে আছে। তার বৌ কুট্টি কিছুতেই শহরে যেতে চায় না। শহরের নাম শুনলেই সে পানি না দেওয়া চারা গাছের মতো প্রাণহীন হয়ে পড়ে। ওলি তার ভেতরের বিরক্তি থুতুর ভেতর দিয়ে বের করে দিতে দিতে বলে, ‘মাইয়ে মানষির কি বুদ্ধি! তার বাপের দেওয়া ওই কাঠা দশেক জায়গা নাকি তারে বাঁচায়ে রাখপে। দুইনে যে বদলি যাচ্ছে, এই মেয়েছেলে তার কোনো খোঁজই রাখতে চায় না। আরে বেটি, তুই এই জমিতে কয়দিন টিকতি পারবি? তোরে টিকতি দেবে ওরা?’ 

এই রামপাল-মোংলা গোটা অঞ্চলের জমির দাম হুহু কইরে বেড়ে গেছে গত কয়েক বছরে। চারদিকে শুধু গজিয়ে উঠছে ইন্ডাস্ট্রি। কুট্টিকে ওলি কথাটা কিছুতেই বুঝাতে পারে না। কথা পাড়ামাত্র সে বটি নিয়ে তেড়ে আসে। কথা পড়ার সঙ্গে সঙ্গেই যা নয় তাই বলে ওঠে। 

ওলি টের পায়, খটিতে আর আগের মতো মাছের আনাগোনা নাই। তবে কিসের যেন এক দাপাদাপি আছে। নগরের মতো এক ছোটাছুটি টের পায় ওলি চারদিকে। এই বনে, জলে, জঙ্গলে বড় বড় কারখানা গড়ে ওঠার বিকট বীভৎস আওয়াজ শোনা যায়।

ওলির কাছে ঘন ঘন আসে লোকগুলো। সিঅ্যান্ডবি রাস্তার অদূরে কুট্টির জমিনটা চাই তাদের। জমির নাকি দাম বেড়ে গেছে অনেক। ‘এই জমিন ছেড়ে দাও ওলিউল্লা। যে পরিমাণ টাকা পাবা সেই টাকায় অন্য জায়গায় জমি কিনে থাকতি পারবা। এর চেয়ে বেশি জমিনও পাইয়ে যাতি পরো।’ দাঁত কেলিয়ে বলে জমির দালাল রজব আলি।

‘দেখো তোমার বাড়ির আশপাশের সব জমি ইন্ডাস্ট্রির লোকেরা কিনে নিছে। ওই জমি তুমি এমনিতেও রাখতি পারবা না। শক্তি আর ক্ষমতার কাছে তোমরা তো নস্যি, বোঝোনা ওলি ভাই’!

কিন্তু কুট্টি মানে না সে কথা। সে আরও বেশি করে মন দেয় তার কৃষিকাজে। সে যেন ওলিকে প্রমাণ করে দিতে চায়, এই জমিনের আয়ের টাকায়ও বেঁচে থাকা যায়!’ কিন্তু প্রকৃতি যে সায় দেয় না কুট্টিকে। 

এইবার হয়ত কুট্টি রাজি হবে। এমন আকালেও সে রাজি না হয়ে পারবে না। একটা টিপসই। একটা মাত্র টিপসই আপাতত সব দুর্দিন ঠ্যাক দিতে পারবে। এরপর যদি সেই সুযোগও না থাকে! রাত্রির আঁধারে পালাতে হয় সব ছেড়ে! 

জমির দালাল রজব আলী তো সেদিন সে কথাই বলল। ‘ভালোয় ভালোয় জমিটা বেচে দেও ওলি ভাই। ওই যে দেখো ট্রেন লাইন যাচ্ছে। গরমেন্ট তোমার জমিটা একোয়ার করার আগেই ছাড়ো। নইলে তো আমও যাবে ছালাও।’

কুট্টির বসত ভিটেটা আরও কয়েকটা জমির মধ্যিখানে। তারপরও আশেপাশের জমিন বিক্রি হয়ে গেলে এ জমিন তো আর রাখা যাবে না! 

এ এক আশ্চর্য নিয়ম। যতক্ষণ মানুষ বেঁচে থাকবে ততক্ষণ জমিন নিয়ে কাড়াকাড়ি করবে। এই যে দুনিয়ার তিনভাগ জল আর একভাগ জমিন। সেই জমিন নিয়ে চলে অবিরাম কাড়াকাড়ি। ছলে বলে কৌশলে।

কুট্টির হাতেই এখন সব। তার বুড়ো আঙু লের একটা টিপসই! কিন্তু কুট্টি যেন ঘা খাওয়া সাপের মতো ফুসছে। সে তার জমিন ছাড়বে না কিছুতেই। কথাটা আবারো পাড়তেই স্বামীকে সে সাপের মতো হিসহিসিয়ে বলল, ‘ওরে মুখপোড়া, তোর তো তিনকূলে কেউ নেই, কিছু নেই। আমার এই ছাওয়াল-পাওয়ালগুলোরেও ভিটেছাড়া করতি চাস? ওই জমিন খেকোগের ওপর বনদেবীর অভিশাপ পড়বে দেইখো। এই অনাচার বনদেবী সহ্য করবে না। তোগের এত খাই! কলকারখানা বানাতি এহন বন-জঙ্গলে চইলে আসলি!’

ওলিউল্লাহ একটা ভাঙ্গাচোরা মাটির পুতুলের মতো ফিরে যেতে থাকে বাড়ির দিকে। সন্ধ্যা ঘনিয়ে এসেছে। এখনো না ফিরে আর উপায় নেই। 

৪.

কুট্টি সারাদিন উড়ে যাওয়া ঘরের চাল মেরামতের চেষ্টা করে করে ক্লান্ত অবসন্ন। ঝড়ের তোড়ে উঠোনে যে পানি উঠে এসেছিল তা আজ কদিনেও নামার নাম নেই। হাঁস-মুরগি আর মানুষে একসঙ্গে বসবাস। দীর্ঘশ্বাস গিলে ফেলে কুট্টি ছোটে চুলা ধরাতে। ছেলে-মেয়েগুলো দিনভর বলতে গেলে না-খাওয়া তার। সন্ধ্যাবধি কটা চাল ভেজে নিয়ে ছেলে-মেয়েদেরকে খেতে দিয়ে দেয় দাওয়ায়, সেও বসে এক কোণে; তার দৃষ্টি পথের দিকে। 

পাশের জমিতে দানবের মতো গর্জাতে থাকা মাটি কাটার ড্রেজারটা এই মাত্র তার হুঙ্কার থামাল। তার মানে কারখানা দালানের লেয়ার কাটার কাজকর্ম আজকের মতো খান্ত। সারাদিন শব্দে শব্দে তার কান ঝালাপালা। এরই মাঝে ট্যা-ট্যা রবে একঝাক টিয়া পাখি উড়ে যাওয়ার শব্দ কানে ভেসে এলো কুট্টির। আপছে একটা দীর্ঘশ্বাস বেরিয়ে আসে তার ভেতর থেকে। ‘হায়রে! গাছ গাছালির পাখ-পাখালির কত নিজস্ব সাড়া শব্দ ছিল এতদিন, সব কোথায় উবে গেল দেখতি দেখতি! সইন্ধ্যে বেলা রসুন্দি গাছটায় এখন আর জোনাকির মেলা বসে না। কোথায় পালায়ে গেল তারা’! 

ক্ষণিকের নীরবতা আবার ভেঙে যায় কারখানার নির্মাণ শ্রমিকদের হৈ হৈ করে নদীতে হাত-পা ধোয়ার শব্দে। সে সময়ে মনে মনে একটু অস্থির হয়ে ওঠে কুট্টি। ‘কি হলো মানুষটার? সন্ধ্যা ঘনায়ে গেল এখনো এলো না যে! সেই ভোরবেলা বের হইছে, এত দেরির কারণ কি?’ 

ফুরিয়ে আসা চালভাজা নিয়ে ঝগড়া বেঁধে যায় ছেলেমেয়েদের মধ্যে। মেঝটার বাড়ন্ত শরীর। সব সময় তার খিদে লেগে থাকে। সে-ই দুম করে এক কিল বসিয়েছে বড়টার পিঠে। ‘তুই সব নিয়ে নিলি যে বুবু! কতা ছেলো শেষটুক আমি খাবো!’ 

বড় মেয়েটা একটু রোগাসোকা সে কিছু বুঝে উঠতে না পেরে, হতের চেটোয় চোখের পানি মুছতে মুছতে বলল, ‘তুই আবার কহন কলি? অভিমানে বাটিটা সে বোনের দিকে ঠেলে না দিয়ে দিল ছোট ভাইটার দিকে। বলল, নে তুইও পাবি নে, আমিও পাবো না, হিসেব সমান’। 

মেঝটা ঝট করে বাটিটা নিজের হাতে তুলে নিয়ে বলল, ‘জোর যার মুল্লুক তার, বুঝলি’? 

বড়টাও ছাড়বে না সহজে, সে গায়ের জোরে না পারলেও মুখের জোরে ছাড়বে না। সে মুখ খিচিয়ে বলল, ‘খা, তুই আগান বাগান সব খেয়ে খেয়ে একটা কারখানা হয়ে যা’। 

অন্যদিন হলে কুট্টি মারামারি সামাল দেওয়ার চেষ্টা করত। খাওয়া নিয়ে কাড়াকাড়ি সে একদম দেখতে পারে না। যতসব অলক্ষুণে কাণ্ড! বকতো ওদের খুব করে; কিন্তু এখন তার সব কিছু থেকে মন উঠে গেছে। করুক নিজেরা নিজেরা মারামারি খামছা খামছি। এ দুনিয়ায় টেকার জোগ্যি হয়ে উঠুক। তা বলে এতখানি স্বার্থপর হবে কেন তারা! বাপটা যে ফিরছে না, তা নিয়ে কোনো চিন্তা নেই!

৫.

খানিক বাদে দূর থেকে ওলিউল্লাকে আসতে দেখে চমকে ওঠে কুট্টি। এতদিনের সংসারে মানুষটাকে এমন ভাঙ্গাচোরা অবস্থায় দেখে নাই কখনো। মানুষটা এমনিতে সবকূল হারানো; কিন্তু সেই ছাপ তার আচরণে ছিল না। সে শুধু গড়ার চেষ্টা করে গেছে; কিন্তু এবার মানুষটা একেবারেই ধ্বসে গেছে। সেই যে জঙ্গলে বাওয়ালের কাজ করত। গোলপাতা কেটে নিয়ে যেত ব্যাপারীর কাছে। মাঝে মাঝে মৌচাকও ভাঙত। বাগদার পোনা ধরা। সব কাজে সে ছিল এক নম্বরে। তারই ডাক পড়ত সবার আগে; কিন্তু ধীরে ধীরে বন কেমন বদলে গেল। বন ঘিরে সব কাজবাজও চলে গেল অন্যের দখলে। সেই দখলের দলাদলিতে পড়ে গেল ওলিউল্লা। যে ওলিউল্লা বন অন্ত প্রাণ। কুমিরের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে সাঁতার কাটে, শুশুকের সঙ্গে ডুবোডুবি করে, নাও নিয়ে গভীর সমুদ্রে চলে যায় মাছ ধরতে। সেই ওলি আর বনে থাকার যোগ্য থাকে না। বন তার দখল করে নেয় এবার সত্যিকারের বন দস্যুরা। এই দস্যুরা বনটা আর বন রাখতে চায় না। কারখানা চায় কারখানা। ক্ষুদ্র ওলির না চাওয়ায় কি আসে যায়! তাইতো তার ওপর যখন খড়গ নেমে আসে। একদিন এক রাত্তিরে কুট্টি স্বামীকে নিয়ে সব ছেড়ে চলে আসে তার বাপের ভিটেয়। মরার কালে তার বাপ তাকে সব দিয়ে গেছিল বলে। নইলে তার স্বামী এতদিন দুই দলের কাইজ্জায় মারা পড়ত। এমন এটা ষড়যন্ত্র সে টের পাচ্ছিল ভেতরে ভেতরে। বলতে গেলে নিমেষের মধ্যে পালায়ে এসে উঠল সে বাপের কাছে। সেই থেকে ওলিউল্লার বদলে যাওয়া শুরু। কুট্টির বাপজান তারে কৃষিকাজ বলতে গেলে হাতে ধরে শিখাল; কিন্তু সে কি আর জাত কৃষক হয়ে উঠতে পারল! এ ছাড়া আর তো তার গতিও ছিল না কিছু। বনদস্যু, বনরাক্ষসরা ছেয়ে গেছে চারদিকে। 

কুট্টিও ঘরের কাজ ছাড়াও এটা ওটা করে সুযোগ পেলে। গত বছর বোশেখ মাসে ওঠা ধানের ক্ষতি সামাল দিতে চিংড়ির খটিতে কাজ করতে গেছিল কুট্টি। বর্ষায় খটিগুলোতে ধুমছে চলে চিংড়ির মাথা খোলার কাজ। দুই হাতে দুটো পলিথিনের ব্যাগ পেঁচিয়ে নিয়ে চলে বাগদা চিংড়ির মাথা খোলা। তারপরও চিংড়ির কাঁটার খোঁচায় ক্ষত বিক্ষত হয় তার হাত। তখন আবার কাজ বাদ দিতে হয়। আর সব সময় তো একাজ থাকেও না। শুধু গোনে গোনে মাসে দুবার হপ্তা দুয়েকের কাজ। তাও সেবার যে হাতে ঘা হলো। ভালো হতে সময় নিয়েছিল অনেক। এখনো মাঝে মাঝে ফেটে যাওয়া ঘা থেকে কষ বেয়ে পড়ে। ওষুধ দিয়েছিল সরকারি হাসপাতাল থেকে; কিন্তু সারাদিনের ঘর গেরস্থালির কাজের মধ্যে সে ওষুধ আর কাজ করবে কখন! অবসর নেই ফুরসত নেই, শুধু কতগুলো পেট চালানোর চিন্তায় দিনরাত খেটে যায় দুজনে। 

কুট্টি যেন হাঁপিয়ে ওঠে ইদানিং। ছেলে-মেয়েগুলো দুদিন ধরে বায়না ধরেছে। শুধু জাউ ভাত আর পুকুর ধারে আপছে জন্মানো কলমি শাক সেদ্ধ তারা আর খেতে চায় না। তবে কি স্বামীর কথা মেনে নেবে সে! জমি বেচে শহরে পাড়ি জমাবে! কথায় আছে না! যদি হয় কহর, না ছাড়িও শহর! সত্যিই কি শহর তাদের খাওয়া পরা দেবে! কুট্টির নিঃস্বাস ক্ষণিকের জন্য বন্ধ হয়ে আসতে চায়, ‘এই গ্রাম, এই বন-জঙ্গল ছাড়া সে বাঁইচে থাকপে কি কইরে! শহরের ওই ধোয়া ধুলো বিষ বাতাস কি সে সইতে পারবে! শহর তার অচেনা। আবার তার চিরচেনা গ্রাম, তার জল জঙ্গল, সেও অচেনা হয়ে উঠতিছে ক্রমশ। বিষ বাতাস তার বিষের ছোবল মারতিছে সবখানে’। 

৬.

প্রায় ভাঙ্গাচোরা ওলিউল্লার পরাজিত হেঁটে আসা দেখতে দেখতে কুট্টির দু’চোখ জলে ঝাপসা হয়ে আসে। আর সেই জল ঝাপসা চোখে সে এক আলোর ঝলকানি দেখতে পায় যেন। ‘ওই তো, তার স্বামীর ঠিক পেছনে- কতদিন, আইজ কতদিন পর রসুন্দি গাছটাতে জোনাকিরা বিয়ের আসর বসায়েছে। হঠাৎ যেন এক জয়ের আভাস দেখতে পায় কুট্টি। উঠোন ছাড়ায়ে ডোয়ায় ওঠা নোনা জল ঝটিতে ভাটির টানে বিলীন হলো যেন। সারাবছরের মরা নদীটায় জোয়ারের পানি যেন উতলে উঠিছে। নোনা জলে খলবলানো মাছের ঝাঁক। সুতোর মতো বাগদার পোনা ফাৎনার মতো ভাইসে উঠতিছে। গাছে গাছে মৌয়ের চাক। নদীর চরে গোল পাতার ঝির ঝিরে হাওয়া। বদলে যাতি পারে! কুট্টির মন বার বার বলতিছে, এই ঘোর লাগা সইন্ধের মতো বদলি যাতি পারে না সব কিছু’!  

সাম্প্রতিক দেশকাল ইউটিউব চ্যানেল সাবস্ক্রাইব করুন

মন্তব্য করুন

Epaper

সাপ্তাহিক সাম্প্রতিক দেশকাল ই-পেপার পড়তে ক্লিক করুন

Logo

ঠিকানা: ১০/২২ ইকবাল রোড, ব্লক এ, মোহাম্মদপুর, ঢাকা-১২০৭

© 2024 Shampratik Deshkal All Rights Reserved. Design & Developed By Root Soft Bangladesh

// //