মহাজীবন

এতদিন যাবৎ সংসারটা হয় দৈর্ঘ্য, অথবা প্রস্থে, কিংবা একই আকার ধারণ করা সত্ত্বেও স্তরে স্তরে অর্থাৎ আভ্যন্তরীণ ভরাট কিংবা ঘনত্বের কারণে কেবল প্রসারিত হয়েই চলছিল; কিন্তু হঠাৎ করেই একদিন, তা সংকুচিত হতে শুরু করে।

আমি অবাক হই না। মাঝে মাঝে জীবনের প্রয়োজনেই জীবন ছোট হয়ে আসে, অথবা তাকে কেটে ছেঁটে ছোট করে নিতে হয়, কিছুটা বাহুল্যবর্জিত শীতকালের শুকনো ন্যাড়া গাছগুলোর মতো। সকল শুষ্ক পাতা আর বাড়তি শাখাগুলোকে কেটে ফেলে দেবার মাস কয়েক পরেই বসন্তের সূচনায় নতুন কচি শাখা-প্রশাখা, পাতা, কুঁড়ি, এমনকি নতুন নতুন অজস্র ফুলের সমারোহ দেখা দেয় কুঞ্জে-কাননে।

কিন্তু প্রচণ্ড শীতের দুঃসময়ে এত ডালপালা, পাতা, ফুল কুঁড়ি নিয়ে বেঁচে থাকা খুব কঠিনই হয়ে পড়ে গাছগুলোর জন্য। তাই তারা বাঁচে বাহুল্যবর্জিত হয়ে, শীর্ণকায় কাণ্ডটিকে শিরদাঁড়ার মতো কোনোমতে সোজা খাড়া করে দাঁড়িয়ে রেখে।

মরোক্কোর এক বেকার বংশীবাদক ছেলের হাত ধরে যখন অ্যান্থ্রপলজিতে পিএইচডি করা আমাদের একমাত্র কন্যা ঘর ছেড়ে চলে গেল, আর বছর না ঘুরতেই কনিষ্ঠ সন্তান মানে আমাদের পুত্রও হাই স্কুল পাস করে অন্য শহরে গিয়ে কলেজে ভর্তি হলো, আমরা দু’জন তখন স্বভাবত-ই একটু একা হয়ে পড়লাম।

ততদিনে আমিও যতটা সম্ভব প্র্যাক্টিস গুটিয়ে এনেছি। দুটি কি তিনটিই তো জীবন, একটি সংসার চালাবার জন্য আর কত টাকা লাগে! মোটামুটি প্রতিষ্ঠিত প্র্যাক্টিস ছেড়ে দিয়ে তাই আরো তিনজন পিডিয়াট্রিসিয়ানের সঙ্গে গ্রুপ প্র্যাক্টিসে যোগ দেই অতঃপর। গ্রুপ প্র্যাক্টিসের মজা তো এটাই, নিজের জন্য খানিকটা বাড়তি সময় পাওয়া যায়। এ ছাড়াও অনেক রকম চয়েস থাকে। ফ্লেক্সিবিলিটি থাকে। আমার সহকর্মীরা অবশ্য উল্টোটাই বলে। গ্রুপে তারা কাজ করে ঠিকই; কিন্তু একক প্র্যাক্টিসের জন্য হা-হুতাশ লেগেই থাকে তাদের কথাবার্তায়; চাল চলনে। তবে আমি কিন্তু একক প্র্যাক্টিস ছেড়ে দিয়ে একটুও অনুশোচনা করি না। প্রাত্যহিক দায়দায়িত্ব-ও অপেক্ষাকৃত কম মনে হয় এখন। আর সেই মহা ভয়ংকর ম্যাল প্র্যাক্টিস ইন্স্যুরেন্সের ভয়াবহ প্রিমিয়াম? ওটা কমে অনেক সহনীয় পর্যায়ে চলে এসেছে এখন। সন্ধ্যায় ঘরে ফিরে এসে ডিনার খাবার পর সপ্তাহে এক-দুটি হলিউডের পুরনো দিনের পছন্দের মুভি পর্যন্ত দেখার সময় হয় আজকাল। নিজের একলা প্র্যাক্টিসের সময় সেসব সৌখিনতার সুযোগ ছিল না।

শহরের প্র্যাক্টিস কমিয়ে দিয়ে প্রতি শনি-রবিবারগুলোতে শহর থেকে নব্বই মাইল ড্রাইভ করে উত্তর-পশ্চিমের পাহাড়ি অঞ্চলের এক ছোট ক্লিনিকে নিয়মিত যাই। এই ক্লিনিকে রোগী যারা আসে তাদের প্রায় এক-চতুর্থাংশ-ই এদেশের নেটিভ ইন্ডিয়ান। নিকটবর্তী শহর বা গ্রাম থেকে বহু দূরে তাদের নিজস্ব লোকালয়ে- ঠিক তাঁবুতে নয়, তবে বিশেষভাবে নির্মিত তাদের ব্যতিক্রমী নকশার বাড়ি ঘরে বাস করে তারা। অধিকাংশই ক্লিনিকে আসে পায়ে হেঁটে। একান্ত বাধ্য না হলে তারা অবশ্য ডাক্তার দেখাতে আসে না। নিজেদের দীর্ঘদিনের অভিজ্ঞতা অনুযায়ী টোটকা জাতীয় কোনো বস্তু দিয়ে প্রথমে চিকিৎসা করায়। যখন ডাক্তারের কাছে আসতেই হয়, আসার সময় কখনো হাতে করে নিয়ে আসে কয় গোছা পরিণত ভুট্টার ছড়া, এক কাদি কলা বা কয়েকটি লাল টুকটুকে মরিচ, টমেটো অথবা গাঢ় কমলা রঙের মিষ্টি আলু। কখনো এক থলে শুকনো ব্ল্যাক বীন্স। একবার এক মধ্যবয়সী নারী-নিজের হতে বানানো বিভিন্ন কম ছোটবড় পাথর বসানো একটি রুপোর আংটি দিয়েছিল আমাকে, তার অসুস্থ পুত্রকে সম্পূর্ণ বিনা খরচে সুস্থ করে তোলবার জন্য। আরেকবার অন্য একজন ইন্ডিয়ান নারী এনেছিল হাতে বোনা ভেড়ার লোমে তৈরি এক ভারী সোয়েটার। এক দিনের জন্য হলেও তাকে আবার সেটা পরে দেখাতে হয়েছিল আমাকে। দেখে খুশি হয়েছিল খুব। মুখ ফুটে তা বলতে বাঁধেনি, স্পষ্ট ইংরেজিতে বলেছিল সে, ‘ও, মাই গড! ইউ লুক সো লাভলী।’

সপ্তাহের পাঁচটি দিন শহরে থাকি, থাকতে হয়। সেখানেও কিছু রোজগার দরকার। স্ত্রীর জন্য, বিশেষ করে তার চিকিৎসার জন্য, পুত্রের কলেজ টিউশনের জন্য, বাড়ির মর্গেজ দেবার জন্য, কাঁচা বাজারের জন্য, নানারকম সামাজিক দায়বদ্ধতার জন্য; কিন্তু শনিবার এলেই মুক্তির ডানা মেলে ভেসে বেড়ায় আমার স্বাধীন ময়ূরী মন। আমি হাঁফ ছেড়ে বাঁচার জন্য, এই কোলাহলপূর্ণ বড় শহরের নষ্ট বায়ু ছেড়ে নির্মলবাতাস বুক ভরে টেনে নেবার জন্য ছুটে যাই উত্তরের সেই পাহাড়ি অঞ্চলে। 

দীর্ঘজীবন- হ্রদে বিভিন্নরকম অভিজ্ঞতার ভেতর দিয়ে সাঁতরে যেতে যেতে আস্তে আস্তেতলানিতে যে ক্লেদ, গ্লানি, বিতৃষ্ণা, ক্লান্তি, আর হতাশা জমা হয়েছিল, বহুদিন ধরে, সেই বদ্ধ জলাশয়ের তলা থেকে সেসব ময়লারা এখন ধীরে ধীরে ওপরে ভেসে উঠেছে। জাহাজ থেকে সাগরে পড়া পোড়া তেলের মতো হৃদয়ের ওপরের স্তরে থিক থিক করে ভাসছে তারা অনবরত। সাতান্ন বছর বয়সী শিশুরোগ বিশেষজ্ঞ আমি যখনই রাজধানী ছেড়ে ওই ছোট্ট গ্রামীণ শহরটাতে যাই, প্রতিবারই নতুন করে অনুভব করি, এখনো বেঁচে আছি। জীবন স্রোতে পোড়া তেল নয়, স্বচ্ছ, সুশীতল ও সুনীল জলপ্রবাহের আনাগোনা টের পাই। শব্দ শুনি। সেখানে বসে প্রতি মুহূর্তে বোধ করি, সুন্দর, নির্মল হালকা, ফুরফুরে এক ভালোলাগা। মনে হয়, আনন্দ বলে এখনো কিছু অবশিষ্ট রয়েছে জীবনে। সপ্তাহান্তে দু’দিনের এই নির্জন-বাস, নিরিবিলি নৈঃশব্দ্য, শান্ত নিরুপদ্রব পরিবেশ, এর চেয়ে উত্তম, এর চেয়ে শ্রেয়তর, অপার স্নিগ্ধতার আর বুঝি কিছু নেই। হতে পারে না। এখানে এলেই মনে হয়, জীবন থেকে ভালোলাগা বস্তুগুলোর পুরোপুরি নির্বাসন ঘটেনি।

শুধু তাদের সন্ধান জানতাম না এতদিন। আর তাই শনিবারে সূর্য ওঠার আগেই রওনা হয়ে ছুটে আসি এখানে। শুধু সহজ সরল পাহাড়বাসী রোগীদের জন্যই নয়, গ্রামীণ হাইওয়ের ওপর দিয়ে একা একা মুক্তমনে গাড়ি চালাতে চালাতে দু’পাশে অবারিত ঘনসবুজে আচ্ছাদিত বন্য লতাপাতা আর শস্যক্ষেত, সেইসঙ্গে দূরে দূরে একেকটা খামারবাড়ি পেরিয়ে দ্রুত সামনের দিকে ছুটে আসতেও ভারি মজা লাগে।

স্ত্রীকে সঙ্গে নিয়ে আসার কথা মনে হয় না আমার। সারাদিন তো ক্লিনিকেই থাকি, সঙ্গে এলে সপ্তাহান্তের এই দীর্ঘ সময় হোটেল রুমে একা একা করার কী-ই বা থাকতো তার! সে নিজেও অবশ্য আসার জন্য ইচ্ছা প্রকাশ করেনি কখনো। তাছাড়া আমি মনে করি, প্রতিটি মানুষেরই কিছুটা নিজস্ব সময় থাকা দরকার - একা নিজের মতো করে কিছু সময় কাটানো প্রয়োজন। এই স্পেসটুকু না থাকলে, না পেলে আমরা হাঁপিয়ে উঠি। নিদারুণ সংসার, রুটিন দায়িত্ব-কর্তব্য, ও অতিপরিচিত ভুবন ফেলে তাই কেউ কেউ পালিয়ে আসে, হারিয়ে যেতে চায়, হোক তা তিন সপ্তাহ, দুই দিন বা তিন ঘণ্টা- হোক তা ত্রিশ মিনিটের জন্য। নিজেকে সতেজ ও সবুজ করে তুলতে এটুকু ছাড় দিতে হবেই নিজেকে, চুপি চুপি মনকে বোঝাই আমি।

পাহাড়ের কোলে ছোট্ট এই জায়গাটিতে সপ্তাহের ওই ছত্রিশ ঘণ্টার প্রতিটি মুহূর্তে টের পাই, আমি বেঁচে আছি। একেবারে শেষ হয়ে যাইনি। আর তখন-ই আমি স্পষ্ট বুঝি, একটি মারাত্মক একঘেয়ে, নিরানন্দ জীবন টেনে বেড়ানোর কোনো অর্থ হয় না। কারো জন্যই না। আমার আরো অনেক আগেই বেরিয়ে পড়া উচিত ছিল।

সেই সন্ধ্যায় বাড়ি থেকে নিয়ে আসা স্ত্রীর রেঁধে দেওয়া খাবারের সঙ্গে ওই ক্লিনিকের রেজিস্টার্ড নার্স মনিকার ঘর থেকে রেঁধে আনা খাবার একত্র করে দু’জনে মিলে ডিনার খাচ্ছিলাম। আমার জন্য বরাদ্দ করা সপ্তাহান্তের নির্ধারিত হোটেল রুমে বসেই খাচ্ছিলাম আমরা। এই রুমটা একখানা ফার্নিশ্ড এফিসিয়েন্সি এপার্টমেন্টের মতো। আজকের এই সান্ধ্য-আহারই এখানে বসে মনিকার সঙ্গে একত্রে প্রথম খাদ্যগ্রহণ নয়। প্রায় উইকেন্ডেই শনিবার আমরা একসঙ্গে খেয়ে থাকি।

আজো কথা বলতে বলতে ধীরে ধীরে আমরা খাচ্ছি। এক সময় অপ্রাসঙ্গিক কী জানি কী বলে একচোট হাসাল আমাকে মনিকা। কী বলেছিল ঠিক মনে নেই। কথা হচ্ছিল আমাদের ক্লিনিকের এক আধ-পাগল রাঁধুনী সম্পর্কে যাকে আমরা দু’জনেই খুব পছন্দ করি; কিন্তু মনিকার বলার ভঙ্গিটি ছিল ভীষণ মজার। নেপথ্যে তখন মৃদু আওয়াজে বহু দিনের পুরনো পপ ব্যান্ড গ্ল্যাডিস নাইটস অ্যান্ড দ্য পিপ্সের এক কন্সার্টের রেকর্ড বাজছিল হোটেলের স্টেরিওতে। সিকস্টিজের একঝাঁক প্রতিভাময় শিল্পীর গাওয়া অনেক জনপ্রিয় গানই শোনা যায় এই স্টেশনে। যেমন গাইছে গ্ল্যাডিস এখন, এক পাশে ছোট ভাই, অন্য পাশে কাজিন নিয়ে তাদের সবচেয়ে জনপ্রিয়, সবচেয়ে সেরা গানটি, ‘মিড নাইট ট্রেইন টু জর্জিয়া।’ দূরের কোনো এফএম রেডিও স্টেশন থেকে নিশ্চয়। কাছাকাছি এফএম রেডিওতে ওসব গান আর কেউ বাজায় না এখন। খাওয়া শেষে গ্লাস প্লেটগুলো ডিশওয়াশারে দিয়ে লিভিং রুমে ফিরে আসি আমরা। সোফায় এসে বসে মনিকা। সামনের অটোমনে পা দুটি একটার ওপরে আরেকটা আলতো করে ভাঁজ করে রাখা। অতি আয়েশে।

মনিকাকে দেখলে মনে হয় ওর মধ্যে যেন কখনো কোনো টেনশন নেই, সর্বদা কেমন এক প্রশান্তির ছায়া সমস্ত অবয়ব জুড়ে। বন্ধ টেলিভিশনের সামনে বসে বসে আনমনে বাঁ কপালের ওপরের ছোট চুলগুলো ডানহাতের তর্জনীতে একবার পেঁচাচ্ছে, একবার খুলছে সে। ছত্রিশ বছরের মনিকার ছিপছিপে অ্যাথলেটিক স্বাস্থ্য ও পূর্ণ যৌবন তার খাটো স্কার্ট আর সিল্কের ব্লাউজে উদ্ভাসিত হলেও বসার ধরনে তা যথেষ্ট সংযত-অবগুণ্ঠিত। মিউজিকের তালে তালে মৃদু পা নাড়াচ্ছে মনিকা। আমার হঠাৎ মনে হলো, যে যাপিত জীবনের অধিকারী আমি, তেমন জীবন হবার কথা ছিল না আমার। টের পাই, মানুষের জীবন অতি সংক্ষিপ্ত ও অনিশ্চিত। তাকে অবহেলা করা, অগ্রাহ্য করা ঠিক নয়। মনে হলো, আমার যে জীবন, যা আমি যাপন করি, তা যেন আমার নিজস্ব জীবন নয়, অন্যের গড়ে দেয়া, বা অপরকে খুশি করার জন্য করণীয় বেঁধে দেওয়া একটা নির্দিষ্ট সময় পার করার ব্যবস্থা মাত্র। অর্থাৎ নিজের নয়, অন্য কারো জীবনকে যেন বয়ে বেড়াতে হচ্ছে আমাকে। অথচ আজীবন আমি ব্যক্তি স্বাধীনতার পূজারি।

সেই সন্ধ্যায় বা বিকেলে কোনো মদ্যপান করিনি আমরা। আমি সম্পূর্ণ সজাগ, সম্পূর্ণ স্বাভাবিক; কিন্তু অতি আকস্মিকভাবেই আমি স্থির করে ফেলি, পরিপূর্ণ একা একাই সিদ্ধান্ত নেই, এই পাহাড়ি ঝর্ণাস্নাত ছোট্ট উপশহরেই বাকি জীবন কাটিয়ে দেবো। এই মাসের শেষ সপ্তাহে যখন আসবো এখানে, আর কোনো দিন ওই মহানগরে, পরিচিত বাড়ি, বা গ্রুপ প্র্যাক্টিসে ফিরে যাবো না। শহরের বাড়িঘর, গাড়ি, ব্যাঙ্কে যত টাকা সব ভাগ করে দিয়ে দেবো স্ত্রী-পুত্র-কন্যাকে। 

আমি জানতাম মনিকা লাফিয়ে উঠতো কথাটা শুনলে; কিন্তু আমার এই পরিকল্পনা আজ কারো কাছে প্রকাশ করার ইচ্ছে হলো না। এমন কি মনিকার কাছেও নয়। আমি নিশ্চিত যা করতে যাচ্ছি, সেটা প্রধানত নিজের কথা ভেবেই। সব জেনে বুঝে কেউ যদি পাশাপাশি চলতে চায়, বিশেষ করে মনিকার মতো উচ্ছল ও জীবন সম্পর্কে অত্যন্ত আশাবাদী এক নারী, যদি এই ব্যতিক্রমী যাত্রার সাথী হতে চায়, বাধা দেই কী করে? কিন্তু এই যে মুক্তির স্বপ্ন দেখছি আমি, তা কেবল মনিকার জন্য নয়। আমার জীবনে মনিকা উদিত হবার অনেক আগে থেকেই আমি মোটামুটি জীবনের একটা ছক এঁকে ফেলেছিলাম। মনিকা এসে যুক্ত হয়ে তাকে পূর্ণতা দিতে চলেছে মাত্র। যদিও অন্যরা তা মানবে না কিছুতেই। তাতে কিছু আসে যায় না।

সেই ছোটবেলা থেকে, পড়াশোনা শেষ করার অনেক আগে থেকেই, মা, ছোট ভাইবোনদের দেখাশোনার দায়িত্ব নিয়েছি। কারণ অসময়ে পিতৃহারা হয়েছিলাম আমরা। আজো সংসারের একটানা-একঘেয়ে ঘানি টেনে বেড়াচ্ছি। অথচ এত করেও নিজের অক্ষমতার কথাই কেবল স্মরণ করিয়ে দিচ্ছে বর্তমান জীবনের ধরন। প্রাত্যহিক দিনের চেহারা-এখনকার বেঁচে থাকা। একটা অতৃপ্তি, একটা আশা ভঙ্গ, একটা প্রাপ্তির অপূর্ণতা যেন থেকেই যাচ্ছে কোথাও না কোথাও। আমি ভেবে দেখি, আমার গোটা জীবনের প্রায় সবটাই উৎসর্গ করে দিয়েছি আমি অন্যদের জন্যই। নিজের ইচ্ছা, আনন্দ, সখের জন্য কিছুই করিনি। অন্যরাও এই ব্যাপারে বেশ উদাসীন। ধরেই নিয়েছে, আমার মতো মানুষের প্রায় কিছুই লাগে না। তাই ঠিক করেছি, আর যে কদিন বাঁচব, নিজের মতো করে বাঁচার চেষ্টা করব। নিজের জন্য বাঁচব। আবারো বলছি, মনিকা এই জীবনের একটা উল্লেখযোগ্য অংশ হলেও সব নয়। শুধু তার জন্যই আমি ঘর ছাড়ছি, এটা সত্য নয়। তবে আমার নবজীবনে সে একজন বিশেষ সংযোজন হবে, সন্দেহ নেই।

সিদ্ধান্তটা নিয়ে কিছুটা উৎফুল্ল ও হালকা মনে ঘরে ফিরি পরদিন। মনিকাকে বিদায় দেবার আগে তাকে গভীর চুম্বনে কাছে টানি। মুখে কিছু না বললেও সে কি আমাকে স্পষ্ট দেখতে পেয়েছিল তখন? আমার চোখ দুটি খুব চকচকে উজ্জ্বল হয়ে উঠেছিল কি? আমি জানি না। তবে কোনো কথা বলতে পারিনি আমি। শুধু অনেকক্ষণ তাকে জড়িয়ে ধরে দাঁড়িয়েছিলাম দরজার কাছে। পারস্পরিক অনুভূতি বা নিজেদের ভবিষ্যৎ নিয়ে কখনো কথা বলি না আমরা। বর্তমানের বিশেষ মুহূর্তগুলো হারিয়ে যেতে পারে এই ভয়ে বোধহয়। আজো কিছু বললাম না। মনিকাও নয়।

গত কিছুকাল ধরে আমার স্ত্রীর সিঁড়ি ভাঙতে ও হাঁটতে বেশ কষ্ট হচ্ছিল। এমনকি এক-ই জায়গায় কয়েক মিনিটের বেশি দাঁড়িয়ে থাকাটাও রীতিমতো ক্লান্তিকর তার জন্য। ফলে রান্নাবান্নাও ঠিকমতো করতে পারে না। এ বয়সে, বিশেষ করে মেয়েদের মধ্যে, অস্টিও আর্থ্রাইটিসের আধিক্য খুব বেশি দেখা যায়। এই ভেবে ব্যথার ওষুধ ও অ্যান্টাইনফ্লেমেটরি বড়ি দিচ্ছিলাম ওকে। সেই সঙ্গে জয়েন্টের স্বাস্থ্য রক্ষার জন্য গ্লুকোসোমাইন, কন্ড্রাইটিস, ক্যালসিয়াম ও উচ্চমাত্রার ভিটামিন ডি। এতে তেমন উপশম না হওয়ায় অর্থোপেডিক ডাক্তারের কাছে গিয়েছিল কিছুদিন আগে। গত দু’ সপ্তাহ ধরে তার যে অগুন্তি পরীক্ষা-নিরীক্ষা করা হয়েছিল, একে একে সেসব পরীক্ষার ফল আসতে শুরু করেছে।

গতকাল রাতেই পাহাড়ি ক্লিনিক থেকে ঘরে ফিরেছি। অবশেষে, - জীবনের প্রায় দুই-তৃতীয়াংশ কাটিয়ে দেবার পর নিজের জীবন সম্পর্কে, কীভাবে শুধু নিজের জন্য নিজের মতো করে বাঁচা যায়, সে ব্যাপারে একটা সিদ্ধান্ত নিয়েছি। এক নির্মল প্রশান্তি ও অনাবিল আনন্দ নিয়ে ঘরে ফিরেছি গতকাল। তাই প্যাথোলজি রিপোর্টগুলো দেখেও খুলিনি সেগুলো গত রাতে। সকালে উঠে দেখবো স্থির করে শুতে চলে গেছি।

কিন্তু আজ দুপুরের মধ্যে স্ত্রীর ল্যাব টেস্টের কিছু ফলাফল দেখে, সেই সঙ্গে অর্থোপেডিক ডাক্তারের কল পেয়ে তার সঙ্গে বিস্তারিত কথা বলে স্তম্ভিত হয়ে যাই। যা ভাবা গেছিল তার চেয়ে অনেক বেশি খারাপ ও জটিল অবস্থা। এমন সম্ভাবনা ওর অর্থোপেডিক স্পেশালিস্ট-ও প্রথমে একেবারেই ভাবেননি। আগামীকাল শেষ এবং কনফার্মেটরি টেস্ট রেজাল্টটি আসার কথা ছিল; কিন্তু ডাক্তার ফোন করে আজই সেই ফলাফলটা জেনে নিয়েছেন রিপোর্ট ছাড়াই। ওটা ছাড়াও অন্য সব পরীক্ষা থেকে আমি ও ওর স্পেশালিস্ট প্রায় নিশ্চিত হয়েছিলাম, সেই সকালেই, যে যে এ বাড়ির গৃহকর্ত্রীর অসুখটা অতি কঠিন। মাল্টিপল সেক্লরোসিস। ধীরে ধীরে আর-ও খারাপ হবে তাঁর অবস্থা। প্রোগ্রেসিভলি ডিজেনারেটিভ অসুখ। ভবিষ্যতে ভালো হবার কোন-ই সম্ভাবনা নেই। প্রতিদিন আরো খারাপ হতে থাকবে। আর কিছুকাল পরেই হুইল চেয়ার ছাড়া চলাফেরা করা যাবে না এ প্রায় নিশ্চিত।

নতুন করে সিদ্ধান্ত নেবার পালা এখন আমার। ভাবার বেশি কিছু ছিল না। অতঃপর শহরের গ্রুপ প্র্যাক্টিস নয়, ঝর্ণাস্নাত পাহাড়ি শহরই ছাড়ার সিদ্ধান্ত নিই। স্ত্রীর পক্ষে একা বাস করা আর সম্ভব নয়। তার দেখাশোনার জন্য সার্বক্ষণিক একজন বিশ্বস্ত লোকের দরকার। পুত্র এ বছরই কলেজ শেষ করবে, তাই বলে কলেজ পাস করে ঘরে বসে মায়ের সেবা করবে না সে, বলাই বাহুল্য। কেউ-ই করে না। অন্তত এই সংস্কৃতিতে তো নয়-ই। আমার স্ত্রী অবশ্য বার বারই লং টার্ম কেয়ারের জন্য নার্সিং হোমে চলে যাবার ইচ্ছা ব্যক্ত করেছে। তার অসুস্থতার জন্য আমি সুস্থ মানুষ কেন এমন কঠিন জীবনযাপন করবো? এর সঠিক উত্তর আমিও জানি না। তবে ওই ঝর্ণাতলার ক্লিনিকে বা ওই পাহাড়তলির শহরে আর কখন-ই আমি ফিরে যাইনি। মনিকার সঙ্গেও যোগাযোগ করিনি। সে ফোন করলে হয় ধরিনি, অথবা ঠান্ডাগলায় জবাব দিয়ে ফোন রেখে দিয়েছি। সপ্তাহ ও সপ্তাহান্ত উভয়-ই কাটে এখন এই বাড়িতেই, মাঝে মধ্যে বাইরের দু-একটি রোগী দেখা ছাড়া। গ্রুপ প্র্যাক্টিসও একরকম ছেড়েই দিয়েছি, নামটা যদিও রয়েছে সেখানে। ফলে মাঝে মধ্যে দু’একটা কেইস নিই।

এভাবেই কেটে গেছে গত পাঁচ বছর।

যে স্ত্রীকে স্বেচ্ছায় ছেড়ে চলে যাবো বলে সিদ্ধান্ত নিয়ে নিয়েছিলাম, তার এই কঠিন অসুখের ডায়াগনসিস আমার সকল পরিকল্পনা আমূল বদলে দিয়েছে। আমার অসুস্থ স্ত্রী হুইল চেয়ারে বসে আজো উল বোনে, বই-ম্যাগাজিন পড়ে, বুক শেলফের বই থেকে ধুলা ঝাড়ে, ইচ্ছে হলে একপদ সহজ কোনো রান্নাও করে মাঝে মাঝে। গদি দেয়া মোড়ার ওপর বসে ফুল গাছের পরিচর্যা করে। রোজ সন্ধ্যায় ইজি চেয়ারে গা এলিয়ে দিয়ে চোখ বুজে প্রিয় গান শোনে। জীবন থেকে অতি কম প্রত্যাশা তার বরাবরই। এখন সে অপেক্ষাকৃত বেশি তৃপ্ত আজো বেঁচে আছে এই সুখানুভূতিতেই। পুত্রের গ্র্যাজুয়েট স্কুল শেষ। চাকরি নিয়েছে সিয়াটলে। এক ভেনেজুয়েলার নারীর সঙ্গে প্রেম করে লিভ টুগেদার করছে। মরোক্কোর বংশীবাদকের সঙ্গে কন্যার বিয়েটা ভেঙ্গে গেছে গত বছর। তবু সে ঘরে ফিরে আসেনি। রয়ে গেছে উত্তর আফ্রিকাতেই।

ওখানকার প্রত্নতাত্ত্বিক বিষয় আশয়ে এক দুর্নিবার আকর্ষণ জন্মে গেছে তার। কখনো সখনো বিভিন্ন জায়গা থেকে ভিউ কার্ড পাঠায়। কখনো বা নিজের তোলা বা আঁকা ছবি দিয়েই বানায় কার্ড।

আর আমি! ওদের যাপিত জীবনের, ওদের আনন্দ-বিষাদের অংশ হয়ে- এক রকম সাক্ষী হয়ে বেঁচে আছি আজও। শুধু মাঝে মাঝে জীবনের দৈর্ঘের প্রসারতার অসারতা ভেবে শঙ্কিত হই। অথচ, আমাদের সকল প্রচেষ্টা, মানুষের জীবনটাকে রাবারের ব্যান্ডের মতো করে দুই দিক থেকে টেনে টেনে তাকে আরো প্রলম্বিত করা; কিন্তু তা না করে যদি কেবল এই সীমিত জীবনটাকেই আরো একটু স্বস্তিময়, অর্থবহ, আরো আনন্দঘন করার চেষ্টা করতো, যদি নিজ অভিলাষ মতো জীবন কাটাবার স্বীকৃতি বা স্বাধীনতা মিলতো, অন্তর্গত বাসনার তৃপ্তির সন্ধান পাওয়া যেত, বাঞ্ছনীয় অভিজ্ঞতায় পূর্ণ করতে পারা যেতো যাপিত জীবনের অধিকাংশ মুহূর্তগুলো, তাহলে কতই না ভালো হতো। জীবনের মান ও সার্থকতা তো কেবল তার দৈর্ঘ্য দিয়ে মাপা যায় না! তবু সকলে সর্বাগ্রে দীর্ঘ জীবনের প্রত্যাশাই করে কেবল; কিন্ত্ কেন? কার লাভ হয় তাতে? কী লাভ হয়? কেমন করে? আমি বুঝতে পারি না।

সাম্প্রতিক দেশকাল ইউটিউব চ্যানেল সাবস্ক্রাইব করুন

মন্তব্য করুন

Epaper

সাপ্তাহিক সাম্প্রতিক দেশকাল ই-পেপার পড়তে ক্লিক করুন

Logo

ঠিকানা: ১০/২২ ইকবাল রোড, ব্লক এ, মোহাম্মদপুর, ঢাকা-১২০৭

© 2024 Shampratik Deshkal All Rights Reserved. Design & Developed By Root Soft Bangladesh

// //