কুড়িতেই ঝরে গিয়েছিলেন দস্যু কবি তারাফা

ফরাসি কবি আর্ত্যুর র্যাঁবো সাহিত্যচর্চা করেছেন মাত্র কুড়ি বছর। ঠিক তেমনি প্রাচীনকালের আরবের এক কবি-তাঁরও যবনিকাপাত হয়েছে মাত্র কুড়িতে। র্যাঁবো কবিতা থেকে ছুটি নিয়েছিলেন ওই বয়সে। তবে কিছুকাল বেঁচে ছিলেন। কবিতা আর লেখেননি। আর প্রাচীন আরবের কবি তারাফা ইবন আবদের জীবন ও কবিতা একসঙ্গে থেমে গিয়েছিল। দু’জনই প্রবল প্রতিভাধর। কাজ করেছেন অল্পমাত্রায়; কিন্তু সাহিত্যের ইতিহাসে জ্বলজ্বল করছেন আপন প্রতিভা বলে। আজকের নিবন্ধে আমরা জানব তারাফাকে। আরবি কবিতার বরপুত্র তারাফা ইবন আবদ।

মদ-নারী আর উচ্ছৃঙ্খল জীবনের ঘেরাটোপে বন্দি ছিলেন তারাফা ইবন আবদ। আরবি সাহিত্যের তুমুল আলোচিত যে সপ্তঝুলন্ত কবিতা বা সাবায়ে মুয়াল্লাকা তার একটির কালজয়ী স্রষ্টা এই তারাফা। ছুলুক বা দস্যু কবিদের অন্যতমও তিনি। 

গড়পড়তা আরবি কবিতার পাঠক ইমরুল কায়েস-এর নাম বেশি উচ্চারণ করেন; কিন্তু সেকালের অন্য অনেক কবির নাম জানেন সীমিতসংখ্যক পাঠক। এই কায়েসের পর ঝুলন্ত কবিতায় সবচে আলোচিত কবি তারাফা। আরবি সাহিত্যের ইতিহাসে তাই সোনার হরফে লেখা রয়েছে তার নাম।

প্রাচীন আরবের খ্রিস্টীয় পঞ্চম শতাব্দীর শেষভাগে ‘বকর’ ও ‘তাগলিব’ নামে দুটি ইতিহাস প্রসিদ্ধ গোত্র ছিল। প্রাগৈসলামিক বহু ঘটনা এই দুই গোত্রের সঙ্গে নানাভাবে সংশ্লিষ্ট। তারাফা এ দুই গোত্রের অন্যতম বকর গোত্রের কবি ছিলেন। পারস্যোপসাগরের তীরে অবস্থিত ইয়ামান ও বাহরাইনের উত্তর-পূর্ব এলাকায় বকর গোত্র বসতি স্থাপন করে। এখানেই কবি জন্মগ্রহণ করেন। কবির প্রকৃত নাম ‘আমর’। মায়ের নাম ওয়ারদা বিনত কাতাদা। তার বংশ লতিকা হচ্ছে, তারাফা ইবন আল আবদ ইবন সুফয়ান ইবন সাদ ইবন মালিক ইবন দুবায়আ ইবন কায়স ইবন ছালাবা।

কবির চাচা আল-মুরাক্কিশ আল-আসগার, মামা আল-মুতালাম্মিস ও বোন আল-খিরনাক ছিলেন সে সময়ের বিখ্যাত কবি। ফলে পারিবারিক ঐতিহ্যগতভাবে শৈশবেই তারাফা ইবন আবদের মধ্যে কাব্য প্রতিভার স্ফূরণ ঘটে। ছোটবেলায় কবি বাবাকে হারান। চাচারা তার ও তার মা ওয়ারদা-এর সম্পত্তি আত্মসাৎ করে। বিধবা মায়ের প্রতি এ অবিচার ছেলে তারাফা সহ্য করতে পারেননি, ফলে প্রতিবাদ করে কবিতা লেখেন। কবিতার শেষে এর পরিণতি সম্পর্কে সতর্ক করেন।

চাচাদের প্রতি কবির প্রতিবাদের ভাষা ছিল অত্যন্ত মার্জিত ও সুনিপুণ। কবি তাদের অত্যাচারী ও দোর্দ- প্রতাপশালী কুলায়ব ওয়াইলের পরিণতির কথা স্মরণ করিয়ে দেন।

প্রসঙ্গত, জাহেলি যুগে বনু তাগলিব গোত্রের সর্দার কুলায়ব ওয়াইল-এর অত্যাচারে অতীষ্ঠ হয়ে বনু বকর গোত্রের জাস্সাস ইবন মুর্রা তাকে হত্যা করে। এ ঘটনায় ভ্রাতৃপ্রতিম গোত্রের মাঝে দীর্ঘমেয়াদি রক্তক্ষয়ী যুদ্ধের সূত্রপাত হয়। ইতিহাসের পাতায় এটি ‘বাসুস যুদ্ধ’ নামে পরিচিত। 

অভিভাবকহীন বালক এক সময় বেপরোয়া জীবনযাপনে অভ্যস্ত হয়ে পড়েন। মদ, নারী ও খেল তামাশায় সারাক্ষণ মত্ত থাকতেন। সামাজিক বন্ধনহীন কবি বিলাসিতার পেছনে অপব্যয় করতে গিয়ে নিঃস্ব জনবিচ্ছিন্ন হয়ে পড়েন। নিজের যে সামান্য স্থাবর ও অস্থাবর সম্পত্তি ছিল তা হারিয়ে কবি হতদরিদ্র হয়ে পড়েন। এক পর্যায়ে কবি গোত্রচ্যুত সুলুক বা ভবঘুরে দস্যুকবিদের একজন হিসেবে অন্তর্ভুক্ত হন।

কবিতায় কবি এই বিষয়টি সম্পর্কে আলোকপাত করেছেন। তিনি বলেছেন- ‘আমি সবসময় সুরাপান ও ভোগে মগ্ন ছিলাম। আর এ কারণে আমার স্বোপার্জিত ও পৈতৃক সম্পদ অকাতরে উড়িয়েছি। অবশেষে আমার এ বেপরোয়া জীবনের জন্য গোত্রের সবাই আমাকে পরিত্যাগ করে। আর এটা হচ্ছে এরকম-যেমন চর্মরোগাক্রান্ত আলকাতরা লেপে দেওয়া উটের সঙ্গে সবাই করে। তবে দস্যুকবিরা আমাকে ছেড়ে যায়নি। একইভাবে চামড়ার তাবুর ধনাঢ্যরাও ভোলেনি।’

তারাফা ছিলেন আরবিয় ব্যঙ্গরচয়িতা কবিদের মধ্যে অন্যতম। এ কারণে কবিতা রচনায় তিনি পরনিন্দা, ব্যঙ্গ ও কুৎসা রটনা ত্যাগ করতে পারেননি। তিনি রাজা ও সভাসদগণকে সন্তুষ্ট রাখার জন্য খুব তোষামোদি প্রকৃতির ছিলেন না। বরং তিনি অনেক সভাসদদের উদ্দেশ্যে ব্যঙ্গ কবিতা রচনা করেন। একদিন কবি রাজসভায় নেশাগ্রস্ত অবস্থায় রাজার সমুখে বেপরোয়াভাবে চলছিলেন। এটা দেখে রাজা আমর তার দিকে বাঁকা নজরে তাকান; কিন্তু নেশায় বুঁদ হয়ে থাকা কবি রাজার মনোভাব বুঝতে পারেননি। পরে মামা মুতালাম্মিস তাকে সাবধান করলেও কবি সে দিকে ভ্রুক্ষেপ করেননি। উল্টো কবি রাজার ওপর ক্ষেপে যান এবং রাজার উদ্দেশে একটি ব্যঙ্গ কবিতা রচনা করেন।

কবিতাটি শুনে রাজা কবির প্রতি মনে মনে ভীষণ ক্ষুব্ধ হন। আরেকটি বর্ণনায় আছে, এক দিন কবি তারাফা রাজার সঙ্গে সুরাপানের জলসায় একত্রে বসে পানে মত্ত ছিলেন। এমন সময় ওপর থেকে রাজার বোন তাদের দিকে উঁকি দেন। বোনের প্রতিচ্ছবি কবির পানপাত্রে উদ্ভাসিত হয়। তার রূপে মুগ্ধ হন কবি। লেখেন একটি রোমান্টিক কবিতা। ‘হে হরিণের পিতা! দেখ তার দুটি ঠোঁট-/সেখানে চমকাচ্ছে বিদ্যুৎ।/কত না ভালো হতো! যদি রাজা/বক বক না করতেন তখন।’

কবি তারাফা হিরাধিপতি আমর ইবন হিন্দের সান্নিধ্য লাভে ধন্য হয়েছিলেন; কিন্তু ব্যঙ্গ কবিতাই তার হয়েছিল কাল। শেষে এটিই তার মৃত্যুর কারণ হয়ে দাঁড়ায়। কবি তারাফার বাড়াবাড়িতে হিরার রাজা আমরের মনে গভীর ক্ষোভ তৈরি হয়। কবি মুতালাম্মিসও পূর্ববর্তী সময়ে বাদশাহকে ব্যঙ্গ করে কবিতা রচনা করেছিলেন। এ ঘটনা পুরনো দিনের হলেও রাজা আমর ভোলেননি। তিনি চতুর প্রকৃতির ছিলেন। সে কারণে নতুন কৌশলে তাদের দুজনকে শাস্তি দিতে ইচ্ছে করেন। কবি তারাফার মামা মুতালাম্মিসের কুৎসা রচনার ভয়ে ও কবি-গোত্রের প্রতিশোধ গ্রহণের আশঙ্কায় তিনি কবিকে প্রকাশ্যভাবে কিছু বললেননি। বরং তাকে ও তার মামাকে প্রকাশ্যে শাস্তি না দিয়ে কৌশলের আশ্রয় নিয়ে হত্যার পরিকল্পনা করেন।

এ উদ্দেশ্যে রাজা তাদের দু’জনকেই দুটি সিলমোহরকৃত চিঠি দিয়ে বাহরাইনের শাসনকর্তার কাছে পাঠালেন। তিনি তাদের ওখানে গিয়ে সশরীরে পুরস্কার গ্রহণের লোভ দেখান। মূলত আলাদা খামে ভরা ওই চিঠির বাহকদের মৃত্যুর নির্দেশ দেওয়া হয়েছিল। রাজার নির্দেশে তারা বাহরাইনের উদ্দেশে রওয়ানা হন। বাহরাইন ও ওমানের তখনকার শাসনকর্তা ছিলেন মুকাবির। 

মামা কবি মুতালাম্মিস ছিলেন খুবই বিচক্ষণ। পথে চিঠির বিষয়বস্তু সম্বন্ধে তার মনে সন্দেহ দেখা দেয়। যেহেতু তাদের কেউই অক্ষরজ্ঞান সম্পন্ন ছিলেন না, তাই তিনি হিরার একবালককে দিয়ে তার পত্রটি পড়িয়ে নিলেন। চিঠিতে কবিকে হাত-পা কেটে জীবন্ত কবর দেওয়ার নির্দেশ ছিল। মুতালাম্মিসের সন্দেহ সত্যে পরিণত হলো। তিনি চিঠি খানা নদীগর্ভে ছুড়ে ফেললেন এবং তারাফাকেও একইভাবে এটা করতে বললেন।

মামা মুতালাম্মিস সেখান থেকে সিরিয়া সীমান্তের গাসসানী সম্রাজ্যে পালিয়ে যান; কিন্তু তারাফা তার কথা শুনলেন না। মোহরকৃত রাজকীয় চিঠির অমর্যাদা না করে পুরস্কারের আশায় নিশ্চিত মনে বাহরাইনের শাসনকর্তার দরবারে হাজির হন। চিঠিখানা যথারীতি শাসকের কাছে দিলেন। ফলে রাজার নির্দেশ অনুযায়ী তিনি ৫৬৯ খ্রিস্টাব্দে কবিকে নির্মমভাবে হত্যা করেন।

মৃত্যুকালে তারাফার বয়স কেউ বলছেন ২০ বছর, কেউ বলেন ৩০। আবার কারোর মতো ৪০। বেশিরভাগের মতো হচ্ছে কুড়ি বছর। কুড়িতেই তারাফা চিরতরে হারিয়ে যান। তবে তারাফা শত শত বছর ধরে সাহিত্যরসিকদের কাছে বেঁচে আছেন তাঁর মুয়াল্লাকা বা ঝুলন্ত কবিতার জন্য। 

প্রাচীন আরবে ৫০১ খ্রিস্টাব্দ থেকে প্রতি বছর ২০ দিনের মেলা বসত। এটি ছিল আরবের আন্তর্জাতিক বাণিজ্য ও সংস্কৃতিমেলা, যা ‘ওকাজ সুক’ বা ওকাজের মেলা হিসেবে পরিচিত। মেলায় পঠিত হওয়ার পর আরব কবিদের যে কবিতা প্রথমস্থান দখল করত, তা কাবার দেয়ালে ঝুলিয়ে দেওয়া হতো। তারাফার একটি দীর্ঘ কবিতাও ঝুলন্ত সেই সাতটি শ্রেষ্ঠ দীর্ঘকবিতার একটি। 

সাম্প্রতিক দেশকাল ইউটিউব চ্যানেল সাবস্ক্রাইব করুন

মন্তব্য করুন

Epaper

সাপ্তাহিক সাম্প্রতিক দেশকাল ই-পেপার পড়তে ক্লিক করুন

Logo

ঠিকানা: ১০/২২ ইকবাল রোড, ব্লক এ, মোহাম্মদপুর, ঢাকা-১২০৭

© 2024 Shampratik Deshkal All Rights Reserved. Design & Developed By Root Soft Bangladesh

// //