যে যার বৃত্তে

জগদীশের দুই চোখে তীব্র আলো এসে লাগল। তিন ব্যাটারির টর্চ। চোখ ধাঁধিয়ে গেল।

এত রাতে কারও থাকবার কথা নয়। জগদীশের গণনায় কী তাহলে কিছু ভুল হলো! নিকষ অন্ধকার ভেদ করে একটা পরিচিত কর্কশ কণ্ঠস্বর, ‘জগদীশ দাঁড়া!’

জগদীশ স্থবির হয়ে গেল নিশ্চল পাথরের মূর্তির মতো। নড়বার শক্তি হারিয়ে ফেলল। জগলু কাছে এলো। ঠাস করে একটা চড় বসিয়ে দিল জগদীশের গালে। তারপর জগদীশের ভিরমি খাওয়া চোখের দিকে তাকিয়ে বলল, কবে যাবি?

‘মঙ্গলবার।’

‘আমার এখন কী করতি ইচ্ছা করচে জানিস!’ 

জগদীশ চুপ।

‘ইচ্ছা করচে তোরে শাবল দি মাটির নিচি পুঁতে দি। শালা কুত্তার বাইচ্চা। দুধ কলা দিয়ে এতদিন...’ রাগে জগলুর সারা শরীর কাঁপতে লাগল।

‘তোরে কালকেরতি যেন আর ত্রিসীমানায় না দেখি!’

এই ঘন অন্ধকারেও জগদীশ টের পেল প্রচণ্ড রাগে জগলুর চোখ দিয়ে আগুন বের হচ্ছে। 

জগদীশ এ যাত্রা বেঁচে গেল। সে ছাড়া পেয়ে রাতজাগা হ্যাংলা কুকুরের মতো ঘোঁৎঘোঁৎ করে জগলুর গা ঘেঁষে বেরিয়ে গেল।

সে যখন লম্বা পায়ে তেঁতুল গাছটার কাছে এসে পৌঁছল তখন গাছের মাথায় কিছু রাতজাগা পাখি খসখস আওয়াজ করে উঠল।

জগদীশ ভয় পেল না। এ শব্দ তার পরিচিত। অন্যরাতেও পরিশ্রান্ত হয়ে যখন সে গাছটার কাছে ফিরে আসে তখনো পাখিগুলো এভাবেই খসখস আওয়াজ করে ওঠে।

আজ কেমন যেন অবসাদে মনটা ভারী হয়ে উঠল তার। গাছের গায়ে হেলান দিয়ে বসে পড়ল সে। মিশমিশে নিঃশব্দ অন্ধকারে গা জুড়ানো ফিনফিনে একটা বাতাস বয়ে যাচ্ছিল তখন। কী যে ভালো লাগছিল! ইচ্ছে করছিল এখানেই রাতটা পার করে দেয়!

জগদীশের কাকারা সেই কবেই চলে গেছে। জগদীশদের ব্যবসা বড়। বড়দা রামাশিষ তিন মাস আগেই পার হয়েছে। ওখানে সে মুদি ব্যবসা শুরু করেছে। জগদীশের বাবা কৃষ্ণনাথ খুবই ভরসা করেন রামাশিষের উপর। হিসেবী ছেলে। আস্তে আস্তে রামাশিষ সেখানে গুছিয়ে নিচ্ছে।

আর এখানে জগদীশ। জগদীশের বউ-মেয়ে, জগদীশের বাবা কৃষ্ণনাথ আর মা শর্মিলী।

কৃষ্ণনাথের এখানে বড় মুদি ব্যবসা। সঙ্গে ভুসি-মালের আড়ত। আগে রামাশিষই সব সামলাত। এখন জগদীশ। চারদিকে টাকা ছড়ানো। গোছাতে সময় লেগে যাচ্ছে।

কৃষ্ণনাথের জমিজমা আগেই কিছু বিক্রি হয়ে গেছে। সে এখানে একটা একটা করে জমি বিক্রি করে আর রামাশিষের কাছে টাকা পাঠায়। রামাশিষ ওখানে জগদীশের একটা ব্যবস্থা করে দেবে। কৃষ্ণনাথ বুদ্ধিমান মানুষ। ওখানে গিয়ে আরও অনেকের মতো পথে বসতে চায় না।

জগলুর বাপ আজিজুল বারীও তীক্ষ্ণবুদ্ধির মানুষ। সে ঠিকই বুঝেছে কৃষ্ণনাথ খুব তাড়াতাড়িই চলে যাবে। তাই আগেভাগেই সে হাত করে নেয় কৃষ্ণনাথকে তার বাড়িটার জন্য। আগে জমিজমাও কিছু কিনেছে সে। কৃষ্ণনাথের বাড়িটা তার খুবই প্রয়োজন। ওটা ভেঙে মার্কেট বানাবে। টাকার তো কমতি নেই। সে ধাপে ধাপে কৃষ্ণনাথকে টাকা দেয় আর কৃষ্ণনাথ ধাপে ধাপে পাচার করে।

আজিজুল বারীর রড-সিমেন্টের বড় দোকান। সকাল সাতটার মধ্যেই দোকানে চলে আসে। তারপর জগলু ঘণ্টাখানেক বাদে সকালের খাবার নিয়ে আসে। আর দুপুরে দোকানের ছটকু বাড়ি থেকে খেয়ে দুজনেরই খাবার নিয়ে যায়। একা বাড়িতে জয়া, জয়ার মেয়ে আর জয়ার ভাবি। জগলুর বউ পারুল। জগলুর মা বছর দুয়েক গত হয়েছে।

ছোটবেলা থেকেই জগলুদের বাড়িতে জগদীশদের অবাধ যাতায়াত। পাশাপাশি বাড়ি। হিন্দু-মুসলমান; কিন্তু সেটা কখনো মনে হয়নি কারও। বরঞ্চ বিপদে-আপদে আজিজুল বারী ঢাল হয়ে দাঁড়িয়েছে কৃষ্ণনাথের জন্য।

জগলুর একমাত্র বোন জয়া। অসম্ভব রূপবতী। জগদীশ ভেবে পায় না কবে কবে এত রূপ ওর দেহে লেপ্টে গেল। সে এটাও ভেবে পায় না এ রকম লাবণ্যময়ী সুন্দরী বউকে ঐ শালা কেন ডিভোর্স দিল! ওর মতো বোকাপাঁঠা এ পৃথিবীতে আর কে আছে!

জয়ার মেয়ের বয়স তিন। ওকে নিয়েই জয়ার পৃথিবী; কিন্তু পঁচিশ বছরের ডিভোর্সি নারীর এক পৃথিবীতে চলে না। আরও একটা পৃথিবী লাগে। আর সেই পৃথিবী হচ্ছে ছোটবেলার খেলার সাথি বাড়ির পাশের জগদীশ।

এই জগদীশের সাথে কত স্মৃতি তার। জীবনের অনেকটা সময় সে ওর সাথে কাটিয়েছে। শৈশব-কৈশোর।

জয়া মাঝে মাঝে কাঠফাটা দুপুরে জগদীশকে তার পুরনো বাইক নিয়ে বাড়ি ফিরতে দেখে। জগদীশের এখন ঘাড় অবধি বড় বড় লম্বা চুল। ছোট ছোট খোঁচা দাড়ি। হাতে কাপড়ের রঙিন ব্রেসলেট। জয়ার মনে হয় ছেলেটা এখন দিনে দিনে কেমন যেন নিরাসক্ত, উদাসীন হয়ে যাচ্ছে। অথচ এই অপার্থিব উদাসীনতায় যেন সবুজ ফেনিল সমুদ্রের মতো জয়াকে আকর্ষণ করে।

জয়ার মেয়েটা জগদীশের গা ঘেঁষা। মামা মামা করে পাগল করে দেয়। আপন মামাও এত আপন হয় না। 

জগদীশ বাজার থেকে ইগলু আইসক্রিম, ক্যাটবেরি চকোলেট, জিরো চিপস বিনা পয়সায় নিয়ে আসে। আরও নিয়ে আসে জয়ার জন্য রঙিন কসমেটিকস। আর ঠিক এভাবেই জগদীশ একদিন বুদ্ধি করে কসমেটিকসের ব্যাগের মধ্যে নরম ফোমের দামি একটা ব্রা ঢুকিয়ে দেয়; কিন্তু কী আশ্চর্য! জয়া রাগ করে না। রাতে ফোন করে বলে, জগদীশ তুমি সঠিক মাপটা জানলে কী করে!

আহ! এভাবেই শুরু। জয়ার নতুন পৃথিবী।

জয়াদের পুরনো আমলের লম্বালম্বি চুন-সুরকির বাড়ি। পলেস্তারা খসা দেয়াল। আজিজুল বারী ভেঙেচুরে আর কিছুই করেননি।

বিয়ের পর থেকেই জয়া পিছনের দিকটার ঘরটায় থাকে। ঘরটার শেষ মাথায় কিছু ঝোপঝাড়। একটা সফেদা গাছ। দুটো জবা ফুলের গাছ। আর একটা কাঁঠালীচাপা। কাঁঠালীচাপার পাশ দিয়ে পিছনের মাটির পায়ে চলা পথ। 

মোবাইলে আগেই সংকেত চলে আসে। জয়া গ্রিন সিগন্যাল দিলে খুব সন্তর্পণে এগিয়ে আসে জগদীশ। তারপর পিছনের দরজাটা আস্তে করে খুলে দেয় জয়া। জগদীশের পরিচিত পথ। তাই গাঢ় অন্ধকারে কিংবা বাজপড়া তুমুল বৃষ্টির রাতেও এ পথ মাড়াতে তার কষ্ট হয় না।

এখন রাতে আজিজুল বারীর ঠিকমতো ঘুম হয় না। শরীরের নানারকম যন্ত্রণা। হয়তোবা মনেরও। বিছানায় অনেকক্ষণ যুদ্ধ করে সে ঘুমাবার জন্য; কিন্তু ঘুম ধরা দেয় না। অগত্যা বিছানা ছেড়ে উঠে পড়ে। বাইরে আসে। জয়ার ঘরের মধ্যে কেমন যেন অদ্ভুত ছায়া দেখতে পায়। অতি সাবধানে জয়ার ঘরের ঝুলে পড়া ভাঙা জানালার কাছাকাছি চলে আসে। তারপর আর কিছুই বুঝতে বাকি থাকে না। এমনকি কণ্ঠস্বরও চিনে ফেলে। গরম লোহায় ছ্যাঁকা খাবার মতো তীব্র যন্ত্রণায় হাত দুটো নিশপিশ করতে থাকে তার;

কিন্তু কিছুই করে না আজিজুল বারী। চোরের মতো আস্তে আস্তে ফিরে আসে নিজের ঘরের রোয়াকে। সামনে পাতা কাঠের বেঞ্চিটাতে থপ করে বসে পড়ে। মাথার মধ্যে যেন বন বন করে ইলেকট্রিক পাখা ঘুরতে থাকে। চিন্তা থমকে দাঁড়ায়।

আগামী সপ্তাহে কৃষ্ণনাথের বাড়িটা তার নামে রেজিস্ট্রি হওয়ার কথা আছে। এখন ঝামেলা বাঁধালে সব ওলট-পালট হয়ে যাবে। মহা লসে পড়ে যাবে সে। তাছাড়া মেয়েরও একটা সরস দুর্নাম রটে যেতে পারে!

এদিকে কাজ শেষে জগদীশ যখন বেরিয়ে যায় তখন দূরের রোয়াকে এক ভৌতিক ছায়ামূর্তিকে অনুভব করে। বুকের মধ্যে ধক করে এক পলক বাতাস বিঁধে যায়। বুড়ো কী প্রতিরাতেই এখানে বসে থাকে! কে জানে!

এই গভীর মধ্যরাতে প্রশান্তি এনে দেওয়া তেঁতুল গাছটার নিচে শুয়ে শুয়ে জগদীশ বুঝতে পারে কেন জগলু আজ তিন ব্যাটারির টর্চ ফেলে তার চোখ ধাঁধিয়ে দিল।

আজই ওদের বাড়িটা আজিজুল বারীর নামে রেজিস্ট্রি হয়েছে।

সাম্প্রতিক দেশকাল ইউটিউব চ্যানেল সাবস্ক্রাইব করুন

মন্তব্য করুন

Epaper

সাপ্তাহিক সাম্প্রতিক দেশকাল ই-পেপার পড়তে ক্লিক করুন

Logo

ঠিকানা: ১০/২২ ইকবাল রোড, ব্লক এ, মোহাম্মদপুর, ঢাকা-১২০৭

© 2024 Shampratik Deshkal All Rights Reserved. Design & Developed By Root Soft Bangladesh

// //