একটি হারের গল্প

এক

হাসান দ্রুতপায়ে হাঁটছে । হাঁটা রেখে দৌড়-ই দিত সঙ্গে শিলা না থাকলে। শিলা আছে দশ কদম পেছনে। সে সাবধানে পা ফেলে হাঁটছে। সাবধানতার কিছু নেই অবশ্য। এটা বর্ষাকাল না। জলে কাদায় রাস্তা কোথাও পিচ্ছিল হয়ে নেই। দূর্বাঘাসের সবুজ মসৃণ এ পথ, সাচ্ছন্দেই হাঁটা যায়। শিলা তারপরও শহরের মেয়ে। মাটির রাস্তায় চলে অভ্যাস নেই। সে ভারি সতর্কপায়েই হাঁটছে। মানুষের চলাচলে কেমন পথ হয় আছে অবহেলায়।

শুরুটা ভারি রোমাঞ্চ বোধ হচ্ছিল। সে হাঁটছিল যেখানে পা ফেলছে ঠিক সেইদিকে চেয়ে, ঘাসের ওপর পা দেবে না এমন একটা নিয়ম মানতে মানতে। সেই ঘাস উঠে যাওয়া সাদা সরু পথটায় পা রেখে চলা একটা খেলা বৈকি। অনেকক্ষণ শিলা খেললও খেলাটা; কিন্তু এখন আর ভালো লাগছে না। মন মেজাজ বিগড়ে আছে খুব। হাসান একবারও পেছন ফিরে তাকায় নি। বাচ্চা ছেলের মতো কেমন হুড়াহুড়ি করে চলছে। এত আহ্লাদের কী আছে কে জানে? থাকলই বা। তাতেই কী? এমন আমুদে লোক হাসান তো না। বিয়েটা ঘিরেও যা সে করল বাড়াবাড়ি আশ্চর্যের চেয়ে তা কিছু কম না। হাসান এখানে যার বিয়েতে এসেছে সেই রেহানা তার নিকটজন কেউ না। লতায় পাতায় জড়ানো সম্পর্কের মতোই কেমন যেন চাচাতো বোন। এমন বোনের বিয়ের নামে লক্ষ টাকার কেনাকাটা করা হলে তাতে শিলার অবাক হওয়ারই কথা। আশ্চর্য হলেও শিলার আপত্তি নেই। কেনাকাটা করেছে করুক কিন্তু এই অকারণ ফালতু আবেগ দেখায় সে কোন বেকুব? এই যেমন এইমাত্র সে যেতে যেতে গাছের একটা কচি ডাল মট্ করে ভাঙল। এই গ-গ্রামের আবহাওয়ায় এ দৃশ্য ভারি সামঞ্জস্যপূর্ণ হলেও দেখতে তো ভালো লাগছে না। হাসান এখন শহরের মানুষ। কর্পোরেট চাকরি করে। হাজারো ক্লায়েন্ট সামলায়। তার জন্য এ কাজ ভারি বেমানান বটে। শিলা তাচ্ছিল্যের চোখে চায়। গ্রামের আলো বাতাসে বেড়ে ওঠেনি বলে সে মনে মনে খুশি। 

কী সর্বনাশ! শিলা চিৎকার করে ওঠে। পা ফসকে হাসান পড়ে গেছে মাটিতে। পড়ার ধরণ বলে দেয় ভালো ব্যথাই সে পেয়েছে। দৌড়ে শিলা কাছে ছুটে গেল। হাসানের আঘাত গুরুতর। হাটু কেটে রক্ত বেরোচ্ছে। বেশ খানিকটা রক্ত মাটিতেও পড়ে। শিলার মাথা ঝিমঝিম করা শুরু হয়েছে। হতভম্ব হয়ে হাসানের দিকে চেয়ে শিলা কী বলবে তাই ভাবছে। 

হাসছি না তো। হাসব কেন? শিলার ধমকে ভয় পেলেও হাসিটা সঙ্গে সঙ্গে মিলিয়ে গেল না। খুব লজ্জা পেলে যা হয়। লজ্জা ঢাকা কিছু হাসি মুখে রয়ে যায় অবশিষ্ট।

শিলা কড়া গলায় বলে, এখানেই বসে থাকবে? এমন একটা ইনজুরি, কিছুই কি তোমার গায়ে লাগে না? তুমি কী দেখেছ কতখানি কেটেছে? স্টিচ লাগবে। এক্স-রেও করতে হবে হাঁটুর। যেভাবে পড়েছ, ফ্র্যাকচার হতেই পারে। 

অপরিচিত স্থানে এসে পড়ে শিলা কী ভয় পেয়েছে? সামান্য বিষয় নিয়ে এত কথা বলে তো ভীত মানুষ। হাসান একরকম সহানুভূতির সঙ্গে বলল, বেড়াতে এসে এত চটে যাওয়া কী ঠিক? সামান্যই তো ব্যাপার। এর চেয়ে কত বড় বড় দুর্ঘটনা হয় মানুষের।

ঘটনা অসামান্য হবে কী হলে? দয়া করে বলবে?

হাসান কিছু বলে না। কী যেন কিছু লতাপাতা জড়ো করে হাতে পিষে ক্ষতটার উপর চেপে ধরে। চিকিৎসায় কাজও হয়। শিলা কিছু বলতে গিয়েও বলে না। এই চিকিৎসা পদ্ধতি তাকে অভিভূত করছে। হাসান অবাক হয় শিলাকে চুপ দেখে।

হাসান উঠে দাঁড়ায়। ব্যথাটা এখন আর টের পাওয়া যাচ্ছে না। মনটা তবু কেমন একটু  হলো। আনন্দের জোয়ারে একটা ভাটা পড়ল শুরুতেই। হাসান এরকম মানতে চায়না অবশ্য। জোর কদমে হাঁটা দিল। যেন বা আগের মতোই সে অক্ষত। 

হাসানের পাশেই হাঁটছে শিলা। হাসানকে এমন ব্যথা পেতে দেখার পর কী জানি একটা ভাবনা ভারি উদাস করে দিয়ে গেল। নিজেকে এমন জখম করল হাসান সেতো শিলার জন্য না। হাসানের এই উচ্ছ্বাস, এই উত্তেজিত আনন্দ কেন আজই প্রথম শিলাকে দেখতে হলো তা শিলা ভাবতে থাকে। এ জাতীয় চিন্তা আগে কোনোদিন সে করেনি। ফালতু ভাবনা, তবু মন কেমন করে দেয় যেন। 

হাসান আর শিলা বিয়েবাড়িতে এসে পৌঁছাল বিকাল থাকতে থাকতেই। হাসানের পায়ের চোট, মাঝখানে বিড়ি ধরানোর জন্য আগুন খোঁজার সংগ্রাম, এ সমস্ত কারণে মন মেজাজ কারোরই ভালো নেই। নতুন বাড়িতে লোকজন কেমন হবে শিলা তাই ভাবছে। হাসান ভাবে শিলা মনে মনে কতখানি সব সহ্য করছে। 

বাড়ির আঙ্গিনায় কিছু উঠতি বয়সের মেয়ে খিলখিল করছে। তাদের স্ফূর্তির সীমা নেই। এদেরই একজনের চোখ পড়ল শিলার দিকে। প্রথম দেখেছে বলে সে চট করে চোখ সরিয়ে নিল না। তাকিয়ে রইল খানিকক্ষণ। তারপর আবার খেলায় মন দিল। নতুন কিছু সে যেন দেখে নি। বিয়েবাড়িতে এমন কত লোক আসে। বিচলিত হওয়ার এতে কী আছে? কিংবা এমনো হতে পারে সামনে এসে কী সমাচার জানতে চাওয়ার মতো উপযুক্ত এখনও মেয়েটি হয়ে ওঠেনি। যা হোক, শিলা এখন দেখছে হাসানকে। আমি সখিনা। হাসান চেনার চেষ্টা করল না। মেয়েটি তাকে কীভাবে চেনে এমন প্রশ্নের উদয়ও হয়নি তার মনে। শিলাকে নিয়ে হনহন করে ছুটল বাসার মধ্যে। 

বাড়ির ভেতরে অন্ধকারই। শুধু সামনের ঘরে একটা ক্ষীণ আলোর বাতি জ্বলছে। বিকালের শেষের আলোটাকে অন্ধকারের চেয়েও মলিন লাগে। তেমন কিছু আলো আছে ঐ ভেতরের ঘরগুলোতে। তেমনই আলো আঁধারের মধ্যে থেকে মুখ দেখা যাচ্ছে না এমন কেউ একজন বের হয়ে আসছে। হাঁটার ভঙ্গি বলে দেয় সে প্রৌঢ় কেউ হবে। 

লোকটা বসার ঘরে হাসান আর শিলার সামনে এসে দাঁড়াল। শিলা যেমন ভেবেছিল তেমনই তিনি, বেশ বৃদ্ধ। শিলার আন্দাজ ইনিই রেহানার বাবা। ভদ্রলোকের চোখেমুখে একটা ভারি গাম্ভীর্য ফুটে উঠছে। কনের বাবাদের চেহারায় যেরকম থাকে।

স্লামালাইকুম চাচা। হাসান গদগদ গলায় বলে।

বৃদ্ধ লোকটি হাসানকে দেখে খুশি হতে পারল কিনা বোঝা যাচ্ছে না। তার মুখ অভিব্যাক্তিশূন্য। ভদ্রতার হাসিটুকু পর্যন্ত নেই সেখানে। এমনকি বয়সের অহংকারে মেয়ে মানুষের প্রতি সহজাত আকর্ষণটুকু তিনি হারিয়ে বসেছেন। শিলার দিকে একটিবারও না তাকিয়ে কেবল সে যে হাসানকেই চেনে এমনই একটা ভাব করে বলল, এত দেরি হইল যে বাবা?

দেরির অনেক কারণ আছে; কিন্তু সেসব তার মনে আসছে না। তড়িঘড়ি করে সে বলল, কই আর দেরি চাচা? দিন থাকতেই তো আসলাম।

রেহানা তোমাগো লাইগ্যা দুপুরে রান্নাবাড়ি করল। বলে লোকটা একটা দীর্ঘনিশ্বাস ফেললেন, যাও। বৌমারে নিয়া ভিতরে যাও। বিশ্রাম কর। অনেক পথ দৌড়াইয়া আইছ। এখন তোমাগো বিশ্রামের প্রয়োজন।

হাসান একটু মনঃক্ষুণ্ণ হয়। চাচার সাথে শিলার আলাপ করিয়ে দেওয়া গেল না। কিছু বলবার আগেই যে তিনি ছুটলেন ঘরের দিকে। বিব্রত ভঙ্গিতে হাসান শিলার দিকে তাকায়। অপমানটা শিলা সহজে মেনে নেবে এরকম মনে হচ্ছে না। 

শিলা ঘরে ঢুকেই বিছানায় শুয়ে পড়ল। নতুন ঘরে নতুন বিছানায় এভাবে এলিয়ে পড়তে অস্বস্তি হওয়ার কথা; কিন্তু শিলার শরীরজুড়ে ক্লান্তি এখন। দেহের ক্লান্তির চেয়েও বেশি ভাবনা-চিন্তার উৎপাত। বৃদ্ধ লোকটার এমন অভদ্রতায় অপমানের চেয়ে সে বরং আশ্চর্যই হয়েছে। শিলার ওপর তার একটা আক্রোশ আছে এমনই কথা শিলার মনে আসছে বারবার। এ বাড়িতে যে একটা অশান্তি চলছে তাও শিলা এখানে পা রেখেই বুঝে নিয়েছে। এসব কিছুর পর শুধু নিজের মান-অপমান নিয়ে ভাবাটা বোকামি। বিছানায় শুয়ে শিলার শরীর জুড়ালো ঠিকই কিন্তু মনের সেই খচ্খচ্টা রয়েই গেছে।

হাসান খাটে শিলার পাশে বসল। শিলার নম্র মুখটা দেখে ভারি শান্তি লাগছে। সে একটু সাহস পেয়ে বলে, কেমন লাগছে শিলা?

শিলা একইরকম আধশোয়া হয়ে হাসানের দিকে একটা সহানুভূতির দৃষ্টি দিয়ে বলে, খুব ভালো লাগছে।

আস্তে আস্তে আরও ভালো লাগবে। ভালো লাগা এক জিনিস শিলা, শুরু একবার হলে আর থামতে চায় না। 

কথা ঠিক। শিলা হাসতে হাসতে মাথা নাড়ে।

হাসান এবার কাচুমাচু হয়ে বলে, চাচার ব্যবহারে মনে কিছু নিও না। বিয়েশাদির ঝামেলা বুঝই তো। মাথা ঠিক থাকতে চায় না। বলে সে একটু থামে। একটা ছোট শ্বাস ফেলে বলে, চাচা খুব ভালো মানুষ। এলাকায় ওনার সুনাম আছে।

তোমার চাচা কেমন মানুষ জেনে আমি কী করব? এসব কথা আমাকে কেন বলছ? শিলা বিরক্ত হয়ে বলে।

হাসান লজ্জা পেয়ে যায়। বিব্রতকর প্রসঙ্গটা চাপা দিতে গিয়ে বলে, তোমাকে খুব ক্লান্ত লাগছে। চা খাবে?

চা কে খাওয়াবে? তুমি?

অবশ্যই আমি। এখন আমি এ বাড়ির ছেলে।

তুমি এ বাড়ির ছেলে মানে? বড় বড় চোখে চেয়ে শিলা বলে, আলতু ফালতু কথা বলবে না খবরদার।

হাসান কী আর দমে? ব্যস্ত হয়ে বলে, চায়ের কথা বলে আসি ভিতরে?

আমাকে একা রেখে তুমি এখন কোথাও যাবে না। হুকুমের গলায় শিলা বলে।

কেন? কী হয়েছে? হাসান যেন অবাক হয়।

আমার কিছুই হয়নি। আমি অবাক হচ্ছি তোমাকে দেখে। তোমার হয়েছে কী? এমন ছটফট করছ কেন?

একটু বিচলিত হয়ে হাসান বলে, ছটফট করছি না তো। কিন্তু বিয়েবাড়ি এসে মূর্তির মতো বসে থাকব তারই বা কী মানে?

মূর্তি হওয়ার দরকার নেই। যেখানে খুশি যাও।

যেতে আর দিলে কই? হাসানের উদাস জবাব।

দরজায় টোকা পড়ছে। রেহানা চা নিয়ে এসেছে। ভেতরে ঢোকার অনুমতি চাইছে। তাকে আসতে বলার জন্য উপযুক্ত লোক না হাসান। সে চেয়ে আছে শিলার দিকে। রেহানার প্রতি শিলার মনোভাবটা এখনও তার কাছে স্পষ্ট না।

শিলা বিছানায় নড়েচড়ে বসল। তৃতীয় কোনো ব্যাক্তির অনুপস্থিতিতে এতক্ষণ ঘরটা যেমন আপনার লাগছিল তাতে একটা ছেদ পড়ল হঠাৎ। রেহানার উপস্থিতি খুব কাম্য না আবার তাতে খুব আপত্তিও নেই শিলার। শিলার স্বভাব ঐ। দেখার আগে আগ্রহ জন্মে না কিছুতে। হাজার শুনেও না। বিয়ের কন্যা রেহানা বলে রেহানার প্রতি বাড়তি কৌতুহল কিছু সে বোধ করছে না। বরং একটা গ্রাম্য মেয়ের তাকে ঘিরে যে কৌতূহল দেখা যাবে তাতে শিলা বিব্রত বলা যায়। যা হোক, সে এখন ভদ্রতাবশেই যথেষ্ট কোমল গলায় ডাকল, ভেতরে আস রেহানা।

রেহানা ভেতরে আসল জড়ানো পায়ে হেঁটে। ভারি জড়সড় হয়ে চায়ের ট্রেটা বিছানায় রাখল। শিলার দিকে সে তাকাতে পারছে না লজ্জায়। এই লজ্জার ব্যাখ্যা শিলার কাছে না থাকলেও গ্রামাঞ্চলে নিশ্চয়ই আছে। গাঁয়ের লোক লজ্জাশরমের ইজ্জত করে। মেয়েছেলের দোষগুণের হিসাব করতে তাতে সুবিধা হয়। রেহানার লজ্জারাঙা মুখটা দেখে কিন্তু আন্দাজ করা যায় কতখানি বড় সে হয়েছে।

রেহানা কাছে আসতেই হাসান বসা থেকে উঠে ঘরের কোণার দিকের একটা জানালার পাশে এসে দাঁড়ায়। শিলা তার চায়ের কাপ হাতে নিতে নিতে বলল, কেমন আছ রেহানা? তুমি এত  লজ্জা পাচ্ছ কেন? বস এখানে আমার পাশে।

রেহানা কিছু বলে না। সে শুধু শিলার কথামতো বিছানায় তার পাশে বসল। শিলা মনে মনে বিরক্ত হয়। এ বাড়ির লোকজন সবাই কি কম কথা বলে? বলুক, তাতে দোষ কিছু নেই কিন্তু তা বলে একেবারে মুখে কুলুপ এঁটে থাকবে তারই বা কী মানে? আরও একটা ব্যাপার শিলা লক্ষ্য করছে। রেহানা ঘরে ঢোকার পর হাসান কেমন চুপ করে গেছে। রেহানাকে সে যেন চেনে না। জানালা দিয়ে বাইরের দিকে চেয়ে আছে। অন্যদিকে চেয়ে থাকার কথা তো না। কতদিন বাদে দেখা, সৌজন্য কথাটুকু অন্তত তাদের মাঝে হওয়া উচিত। শিলার মনে অনেক কিছুই আসছে; কিন্তু সেসব শিলা ভাবতে চায় না। ছোট চিন্তা করার মধ্যে কোন গৌরব নেই ।

শিলার চোখ পড়ে যায় হঠাৎ রেহানার গলার হারের দিকে। তার চেনা পরিচিত পৃথিবীটা ভাংচুর হয়ে যায় এক মুহূর্তে। মাথার মধ্যে ঘুরতে থাকা এতক্ষণের আজেবাজে ভাবনা-চিন্তা সব কোথায় হারিয়ে গেছে। স্তব্ধ চোখে সে শুধু চেয়ে আছে হারটার দিকে। রেহানার গলায় তার সেই হারিয়ে যাওয়া হারটা।

সে রেহানাকে কোনো চরম লজ্জাকর অবস্থায় পড়তে দিল না, তবে পশ্রয়ও দেয়নি। নিস্তব্ধ মুখে রেহানার চলে যাওয়ার জন্য অপেক্ষা করতে থাকে, সেটা বুঝতেও দেয়। রেহানা খুকী না, সে নির্বোধও না। উঠে দাঁড়াল। বলল, ভাবি আপনে বিশ্রাম নেন। কিছু লাগলে বলবেন।

বলব রেহানা, তুমি যাও।

হাসান একইরকম জানালা ধরে দাঁড়িয়ে নিশ্চুপ। হঠাৎ কী মনে হলো। রেহানা দরজা পর্যন্ত যেতেই আহ্লাদের গলায় বলল, তোর ভাবি দেখতে কেমন রে রেহানা?

ভাবি দেখতে আকাশের পরীর মতো।

আকাশের পরী মানে? পরীরা আকাশে থাকে নাকি?

রেহানা লজ্জা পেয়ে বেরিয়ে যায়। শিলা সেই লাজুক মুখটা দেখে অবাক হয়ে।

জানালা থেকে সরে এসে হাসান আবার শিলার পাশে বসল। ট্রের ওপর থেকে চা-এর একটা কাপ তুলে নিয়ে চুমুক দিতে দিতে বলে, চা খাচ্ছ না যে? ঠান্ডা হয়ে যাবে তো।

শিলা শান্ত ভঙ্গিতে তার আধ-খাওয়া চা-টা হাতে নেয়। হাসান কৌতুহলের সাথে বলে, রেহানাকে কেমন দেখলে?

কষ্টে হেসে শিলা বলে, খুব ভালো।

তুমি ফ্রেশ হয়ে নাও শিলা। শাড়িটা বদলে ফেল। আমি পাশের ঘরে যাচ্ছি।

কোথাও যেতে হবে না তোমাকে। শিলা আশ্চর্য গম্ভীর গলায় বলে।

কেন? তুমি চেইঞ্জ করবে না? এই শাড়িতেই থাকবে?

অর্থহীন কথায় শিলার আগ্রহ নেই। খানিক চুপ থেকে হঠাৎ বলে, বাসস্টেশন এখান থেকে কত দূর?

হাসান জানে কত দূর। তবু ভারি অজানা প্রশ্নটা। বিচলিত হয়ে সে বলে, বেশি দূর না। দেড় দুই মাইল। কিন্তু কেন?

যাওয়ার ব্যবস্থা কী?

রিকশা আছে। ভ্যান আছে। কিন্তু এসব কেন জানতে চাচ্ছ? হাসান একটু অধৈর্যের গলায় জিজ্ঞেস করে।

একইরকম গম্ভীর শিলা। বলে, ক’টা পর্যন্ত গাড়ি আছে?

একটু রেগেই হাসান বলে, সারারাতই গাড়ি আছে।

আমি এখন উঠব। আমাকে গাড়ি ধরতে হবে। বেশি রাত করা ঠিক হবে না।

তার মানে? এসব কী বলছ তুমি? হাসান ব্যাকুল গলায় বলে।

কী বলছি শুনলে তো। আমাকে যেতে হবে।

হতভম্ব হাসান ফ্যালফ্যাল করে চায়। শিলার দুচোখ ভরে জল আসছে।

এই পাগলামির মানে কী শিলা? হঠাৎ এমন কী হল তোমার?

এটা কোনো পাগলামি না। আই মিন ইট। শিলা স্পষ্ট গলায় বলে।

তুমি এভাবে যেতে পার না। আমার সাথে এসেছ আমার সাথেই যাবে।

তোমার সাথে যাওয়া বোধহয় আর হবে না। হাসান, আমি সম্ভবত তোমায় ছেড়ে যাচ্ছি।

আমার অপরাধ? হাসান কাঁদো কাঁদো গলায় বলে।

তোমার অপরাধ তুমি এতদিন আমার সাথে সংসার করেছ। যার প্রতি এত প্রেম, এত ভালোবাসা, নিজের বউ-এর গয়না চুরি করে যাকে দিতে তোমার লজ্জা হয় না তাকে বিয়ে করলে না কেন? সে গেঁয়ো মেয়ে বলে?

তুমি কার কথা বলছ? হাসান ভারি ক্ষিপ্ত হয়ে জানতে চায়।

যার গলায় আমার নেকলেসটা দেখলাম এইমাত্র। অবশ্য এই মেডেলতো রেহানারই পরার কথা। এই মনিহার আমায় নাহি সাজে। শিলা চোখ মুছতে মুছতে বলে।

এত বড় কথা তুমি আমাকে বলছ? ঠিক আছে রেহানাকে আমি ডাকছি। তুমি তাকে জিজ্ঞেস কর।

খবরদার। বিয়েবাড়িতে কোনো সিন ক্রিয়েট করবে না। তুমি কী ভেবেছ? রেহানা এসে সাক্ষী দিলেই সব ফয়সালা হয়ে যাবে? হাসান, এখানে এসে আমি অনেক কিছু দেখেছি। আমাকে কিছু দেখাতে এসো না প্লিজ।

শিলা বেরিয়ে গেছে। আটকাতে হাসান পারেনি। যাওয়ার মুহূর্তে উঠানে এসে শিলাকে সে বলেছিল, বাসস্ট্যান্ড পর্যন্ত এগিয়ে দেই শিলা?

শিলা বলল, না। আমার কষ্ট হবে।

দুই

দুই বছর পরের কথা। শিলা এখন অন্য একজনের ঘর করছে। শিলার এখনকার স্বামী সাজ্জাদ হোসেন বেশ ভদ্রলোক। শিলাকে খুব ভালোওবাসেন। একদিন এক সন্ধ্যায় তিনি বারান্দায় বসে পেপার পড়ছিলেন। শিলাকে চায়ের জন্য ডাকলেন, শিলা। এই শিলা। আমাকে চা দিয়ে যাও।

শিলা চায়ের পেয়ালা হাতে এসে দাঁড়াল।

এই যে তোমার চা। আর কিন্তু বিরক্ত করতে পারবে না। চায়ে চিনি হয়েছে কিনা দেখ।

চিনি ঠিক আছে।

শিলা নিজের ঘরে চলে আসে। বিছানার উপর রাখা খবরের কাগজটা হাতে নেয় এবং তাতে চোখ বুলানোর চেষ্টা করে। খাট লাগোয়া ছোট চেস্ট অব্ ড্রয়ারস্-টার ওপর তার একটা পুরনো হাতব্যাগ অনেকদিন ধরেই। বিছানায় আসলেই শিলার চোখ পড়ে। খোলার আগ্রহও হয়। আলস্যি করে খোলা হয় না। শিলা বিছানায় বসে ব্যাগটা হাতে নেয়। পুরনো ব্যাগ। সব খুলে দেখার কেমন একটা কৌতূহল থেকে যায়। ব্যাগের চেইন খুলে শিলা কিছু অপ্রয়োজনীয় কাগজপত্র পেল। ভারি হতাশাজনক। ব্যাগের ভেতরের দিকে আরও একটা পকেট, তাও চেইন-বন্ধ।  চেইনটা খোলে শিলা। ভেতরে তাকাতেই বুকটা ধড়াস করে ওঠে। কম্পিত হাতে সে নেকলেসটা বের করে আনল। স্তব্ধ চোখে কেবল চেয়ে থাকল সামনে দুহাতে ধরে রাখা হারটার দিকে, রেহানার গলায় সেদিন যে হারটা সে দেখেছিল। 

সাম্প্রতিক দেশকাল ইউটিউব চ্যানেল সাবস্ক্রাইব করুন

মন্তব্য করুন

Epaper

সাপ্তাহিক সাম্প্রতিক দেশকাল ই-পেপার পড়তে ক্লিক করুন

Logo

ঠিকানা: ১০/২২ ইকবাল রোড, ব্লক এ, মোহাম্মদপুর, ঢাকা-১২০৭

© 2024 Shampratik Deshkal All Rights Reserved. Design & Developed By Root Soft Bangladesh

// //