বিনুর সঙ্গে রিকশায় ঘোরা

এক

বিছানায় শুয়ে শুয়ে সিলিং দেখছিল বকুল, কিছুই করার নেই যখন, এই সময়। রোজ ঘুম ভেঙে গেলে অনেকক্ষণ সিলিংটা দেখে সে, তার ভাড়া করা এক রুমের সিলিং যেখান থেকে একটা পুরনো ফ্যান ঝুলছে। দু’বছর হলো এই ঘরে আছে, অথচ এর আগে কখনো সিলিংটার দিকে এমন মনোযোগ দিয়ে দেখেনি, যেমন দেখছে আজকাল, রোজ, রোজ।

মানুষ কি গর্তে পড়ে গেলে এভাবে আকাশ দেখে, উঠবার চেষ্টা করার আগে অথবা উঠতে না পেরে? মনে মনে ভাবে সে, যে ভাবনায় সময় কাটাবার ইচ্ছা যতটুকু তার চেয়ে বেশি অন্য কোনো উদ্দেশ্যে নেই; কিন্তু তার এই চিন্তায় একটা ফাঁক আছে, একটা গড়-মিল। গর্তে পড়লে মানুষ আকাশ দেখুক না দেখুক, তাড়াতাড়ি ওঠার চেষ্টা করে, হ্যাচর-প্যাচর করে একা, কিম্বা কারো হাতের সাহায্য নিয়ে। বকুল ওঠার চেষ্টা করে না, ইচ্ছা করলেই পাওে; কিন্তু সেই ইচ্ছা তার হয় না। সে তো আর হঠাৎ জেগে উঠে দেখছে না যে গল্পের সেই পোকা হয়ে গিয়েছে, তার শরীর বদলে ছোট্ট কিম্ভুতকিমাকার এবং কদাকার দেখাচ্ছে। তার হাত-পা অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ সব ঠিকই আছে, যেমন ছিল আগে; কিন্তু সে উঠতে পারছে না, ওঠার চেষ্টাও নেই, যেন চেষ্টার জন্য যে ইচ্ছা বা গরজ, তা উধাও হয়ে গিয়েছে। এখন কি সকাল, কি দুপুর, কি বিকেল-সব সময় শুয়ে শুয়েই কাটে তার, এখন যেভাবে আছে। তবে মাঝে-মাঝে তার শরীরের দিক পরিবর্তন হয়, চোখ সব সময় সিলিং দেখে না। প্রায়ই সন্ধ্যার পরও শুয়ে থাকে সে অন্ধকারে, বাতি জ্বালায় না, বিল পরিশোধের কথা ভেবে। একই কারণে পানিও খরচ করে কম। খাওয়া, সে তো কবেই কমতে কমতে প্রায় শূন্যের কোঠায় এসে থেমেছে। আহা? যেন ইচ্ছে করলেই সে খাবার কেনার জন্য খরচ করতে পারে। খাবার কেনার খরচের কথাটা অন্য খরচের লেজে লেজে চলে এল। খাওয়ার খরচ এখন তার প্রায় নেই বললেই চলে। ফ্রি খাচ্ছে সে। ফ্রি। বাতাস খেতে কি খরচ করতে হয়? এই একটাই খাদ্য যা ফ্রি করে দিয়েছে ওয়েলফেয়ার স্টেট। যত খুশি বাতাস খাও, কেউ কিছু বলবে না। যদি খেতে না পার, খাওয়ার মুরোদ না থাকে, টাফ লাক। অন্যের কিছুই করার নেই, রাষ্ট্রেরও না। ছাত্র হিসেবে সাহায্য পাওয়ার মতো তুমি কোনো শ্রেণিতে নেই। কেউ তোমার নাম-ঠিকানা নিতে আসবে না। তুমি প্রণোদনার নামে যে আর্থিক সাহায্য তা পাওয়ার যোগ্য নও, হতদরিদ্র হলে পেতে, অবশ্য যদি তালিকায় নাম উঠাতে পারতে। মোদ্দা কথা হলো, শনাক্তযোগ্য কোনো শ্রেণি নেই তোমার। অগত্যা যতক্ষণ মাথার ওপর সিলিং আছে, তাই দেখ, যেমন দেখছো সারা বিকেল। আগেরকালে মানুষ ঘরের ওপরে তাকিয়ে কড়ি-বর্গা গুনতে পারত। মরচেপড়া হলেও তাতে চমৎকার চলে যেত সময়। শুয়ে শুয়ে গণনার ওই একটা সময় ছিল, ব্রিটিশ আমলে এমনকি তারপরও কিছু কাল; কিন্তু তার বাড়ি তৈরিতে কড়ি-বর্গা ব্যবহার করা হয় না। সব কংক্রিটের ঢালাই। বেশ মসৃণ দেখায়। অবশ্য বাড়ি পুরনো হলে কংক্রিটের সিলিংয়ে আঁকিবুঁকি দেখা যেতে পারে। আরো পুরনো হলে কংক্রিটের আবরণ ভেদ করে বেরিয়ে আসে মরচে পড়া আয়রন রড। তোমার এই এক কামরার ঘর নতুনও না, খুব পুরনোও হয়নি। তাই সিলিংয়ের দিকে তাকালে শুধু হলদেটে রঙ দেখা যায় কোথাও কোথাও, যেন বাচ্চা ছেলে পেশাব করে গেছে যেতে যেতে। সেই হলুদ রঙ দেখতে দেখতে বকুলের জন্ডিস রোগের সময় তার হলুদ রঙ চোখের কথা মনে পড়ে। খুব হিংসুটে ওই হলুদ রঙ। জন্ডিসড আই!

পেটের ভেতর খুব মোচড় দিয়ে উঠল বকুলের। সে ময়লা চাদরে ঢাকা বিছানা এপাশ-ওপাশ করল কিছুক্ষণ। ব্যথাটা তবুও যায় না, ভেতরটা জাপটে ধরেছে অক্টোপাসের মতো। নতুন কিছু না, কদিন থেকেই হচ্ছে এমন। বকুল জানে কেন হচ্ছে, এর জন্য ডাক্তারের কাছে যেতে হয় না, হাসপাতালেও না। হাসপাতালে? ভাবতেই হাসি পায় তার। যেন ইচ্ছে করলেই সেখানে গিয়ে সাদা ধবধবে বিছানায় শুতে পারবে সে, নার্স এসে তার নাড়ি টিপে দেখবে, ব্লাড প্রেসার নেবে। গলা থেকে ঝোলানো স্টেথোস্কোপে। তারপর ট্রলিতে করে স্টিলের বাটিতে গরম খাবার নিয়ে আসবে হাসপাতালের বয়। হাসপাতালে চিকিৎসা যেমনই হোক, খাবারটা ঠিক সময় আসে বলে শুনেছে সে। চমৎকার করে সাজিয়ে নিয়ে আসে, পরিষ্কার ধবধবে সাদা কাপড়ে ঢেকে। আহা! কি চমৎকার সেই দৃশ্য! ভাবতে ভাবতে বকুলের চোখ মুদে আসে।

দরজায় করাঘাত একবার মৃদু শব্দে। একটু পর আবার, এবার শব্দটা জোরালো। বকুলকে উঠতে হলো। দরজা খুলে যাকে দেখলো তিনি খুব পরিচিত, বিরস বদনে কোনো ভনিতা না করে বাড়ির মালিক শরীফ মিয়া বললেন, ভাড়াটা? 

বকুল লুঙ্গির গিট্টু বাঁধতে-বাঁধতে বললো আর ক’টা দিন সময় দেন না ভাই সাহেব।

বাড়িওয়ালা বললেন, এই করে অনেক দিন হয়ে গেল।

বকুল বলল, বুঝতেই পাচ্ছেন অবস্থাটা। চারদিকে এই রকম। নিশ্চয়ই বুঝতে পারছেন। চাকা ঘুরছে না কোথাও। সব থেমে গিয়েছে। তবে চাকা চলবে, নিশ্চয়ই আবার চাকা চলবে। এতো চিরকাল থাকবে না। তাই হয় নাকি? কখনো হয়েছে। এক মাস। দু মাস। বড় জোর তিন মাস। দেখেন না অপেক্ষা করে।

বাড়িওয়ালা বলেন, আমার যে আর চলছে না। বাড়িভাড়া দিয়েই সব খরচ মেটাই। দু-দু’জন বাড়ি ভাড়া বকেয়া রেখে গ্রামে চলে গেল। এখন রয়েছেন শুধু আপনি; কিন্তু থেকেও নেই। বলছেন ছেলে পড়ানোর বেতন পাচ্ছেন না; কিন্তু আপনি বেতন না পেলেও আমাকে তো সংসার চালাতে হবে? ঘরে মানুষ আছে। তাদের খাওয়ার খরচ আছে। ইলেকট্রিক গ্যাস, পানি এই সব বিল দিতে হয়। 

বকুল পেটের ব্যথায় কুঁকড়ে গিয়ে বলে, জানি। জানি। বলতে হবে না আপনাকে; কিন্তু আমার যে এখন ভাড়া দেওয়ার উপায় নেই। তারপর ঘরের ভেতর তাকিয়ে সে বলে, যদি ইচ্ছে করেন ঘরের টেবিল, চৌকি, বইপত্র, থালা আর গ্লাস নিতে পারেন, জুতোটাও। স্যান্ডেলই যথেষ্ট আমার জন্য।

বাড়ির মালিক চোখ টিপে বলেন, ঠাট্টা করছেন নাকি?

বকুল মাথা ঝাকিয়ে বলে, না, না ঠাট্টা করব কেন? আমার কি এখন সেই ফুরফুরে মেজাজ আছে যে ঠাট্টা মশকরা করি?

বাড়ির মালিক বলেন, আপনার অবস্থা আমি বুঝি; কিন্তু আপনাকেও আমার অবস্থা বুঝতে হবে। কী করব বলুন? আপনার কাছে আসা ছাড়া আমার আর কী করার আছে? দেখুন কী করতে পারেন। একটা কিছু করুন। নিশ্চয়ই একটা উপায় খুঁজে বের করতে পারবেন। অনেকেই করছে বলে শুনছি, নতুন নতুন কাজ বের করছে তারা, যা আগে কখনো দেখেনি, সেসব কাজ করার কথা ভাবেনি কেউ। সে সব কাজ করে দিনাতিপাত করছে তারা। বাঁচতে তো হবে। বাঁচার জন্য মানুষ কী না করে? শুনেছি মানুষের মাংস খায়। ওয়াক থু। কি বলে ফেললাম। দেখেন তো, আমার মাথাটা ঠিকভাবে কাজ করছে না। কেমন যেন এলোমেলো হয়ে যাচ্ছে। ভাববেন না বাড়িওয়ালা বলে আমি আপনার চেয়ে ভালো আছি। 

না, বকুল সাহেব, আমরা এখন এক নৌকার যাত্রী। আর আমাদের নৌকাটার ফুটা দিয়ে পানি উঠতে উঠতে টালমাটাল হয়ে পড়েছে। কখন ডোবে, কখন ডোবে-এই ভাব। বলতে বলতে তিনি প্রায় দৌড়ে চলে যান ঘরের সামনে থেকে। বকুল পেট চেপে ধরে ঘরের ভেতর সেলফে টিনের বাক্সগুলো খুলে এক একে। না কোথাও টাকা থাকার দূরের কথা, একটা পয়সাও নেই। একটা টিনে কিছু চিড়ে পাওয়া গেল, কালো হয়ে গিয়েছে। সে কাঁপা হাতে ক’টা চিড়ে তুলে এনে মুখে পুড়ে চিবুতে লাগল। পুরনো হয়ে গিয়েছে চিড়া। মুখের লালা দিয়ে ভেজাতে সময় লাগল। সে চিবুতে লাগল মরিয়া হয়ে।

দুই

মোবাইলে ফোন বেঁজে উঠল। বিনু বলল, কি রে তোর কোনো খোঁজ-খবর নেই। মোবাইল বন্ধই থাকে দেখি। কি হয়েছে তোর?

বকুল চিড়া চিবুতে চিবুতে বলে, কিছু হয়নি। কি হবে আবার?

তাহলে বের হোস না কেন? দেখা হচ্ছে না কত দিন হলো। অন্যরা দেখা না করলেও ফোন করে কিংবা ধরে আমি করলে। তুই ফোন করিস না আমি কল করলে ধরিসও না। তোর কেইসটা কি? 

বকুল বলে, কেস আবার কি? দেখছিস না এখন সময়টা কেমন? এখন কি আগের মতোন বের হওয়া যায়?। সবাই ঘরে বসে বসেই সময় কাটাচ্ছে। বাইরে বের হয়ে কানমলা কে খেতে চায়।

বিনু বলল, বাইরে বের হলে সবাইকে ধরছে না। যারা খাবার কিনতে দোকানে যাচ্ছে কিংবা ওষুধ কিনতে তাদেরকে কেউ কিছু বলছে না। না পুলিশ, না মোবাইল কোর্টের মহিলা ম্যাজিস্ট্রেট। সে রকম একটা অজুহাত দেখালেই হলো। তাহলে কোনো সমস্যা হবে। একটু থেমে বিনু বলল, শোন, তোর টাকা-পয়সার অসুবিধে নেই তো? সংকোচ করিস না। দরকার হলে বলবি। আর ফোন করে জানাস কেমন আছিস। আমি ফোন করলে ধরিস। তারপর হেসে বলে, তুই মনে হয় খুব ভয় পেয়েছিস। বাইরে বের হতে চাস না। ভিতুর ডিম!

বিনু বকুলের বন্ধু। বিনুর আরো বয়ফ্রেন্ড আছে। সবার সঙ্গে সে একইরকম ব্যবহার করে। কারো সঙ্গে প্রেম-ট্রেম নেই। মনে হয় প্রেম ব্যাপারটা সে হাসির বলে মনে করে। কুইয়ার ক্যারেক্টার। একটা সুন্দরী মেয়ে, বাপের টাকার অভাব নেই। গাড়ি চড়ে ক্লাসে আসে, গাড়িতে করে বাড়িতে ফেরে। খুব মিশুক, সবার সঙ্গেই বন্ধুত্ব; কিন্তু শুধুই ফ্রেন্ডশিপ। প্রেম-ট্রেম কিচ্ছু না। স্ট্রেঞ্জ, তাই না? তার বন্ধুরা তাকে সেই জন্য ‘সাইকো’ নাম দিয়েছে। না, বকুল যত কষ্টেই থাকুক বিনুর কাছে টাকা চাইতে পারবে না। নিজে থেকেই অফর করল সে। তবুও বকুল তার কাছে হাত পাততে পারবে না। গোয়ার বলে তার একটা দুর্নাম আছে। সেটা সে এই দুর্দিনে বিসর্জন দিতে পারবে না। খারাপ হোক একটা খেতাব তো বটে। প্রত্যেকেরই একটা খেতাব থাকা উচিত, ভাবলও বকুল। তা না হলে সে যে একজন মানুষ যার পরিচয় আাছে, তা জানা যাবে কী করে? একমাত্র জীবজন্তুর জগতেই কারো নাম বা খেতাব নেই। ভাবতে-ভাবতে তার চোখে মৃদু হাসির রেখা ফুটে উঠল। মুখের চিড়ে ক’টা চিবুতে চিবুতে এখন নরম হয়ে এসেছে। গেলা যায়। তারপর এক গ্লাস পানি খাবে সে। চিড়ে ক’টা পেটে গিয়ে ফুলে উঠবে। ব্যথাটা এখনই কমতে শুরু করেছে। বদমাশ!

তিন

মোবাইলের দোকান খোলাই ছিল। ইউনিফর্ম পরা ছেলেটা বকুলের কাছে এসে বলল, কি দরকার বলুন। 

বকুল পকেট থেকে মোবাইল সেট বের করে তার সামনে রেখে বলল, এটা...। তার কথা শেষ হলো না। 

ছেলেটা বলল, এটার কি সমস্যা হয়েছে বলুন? 

এবার বকুল ইতস্তত ভাব ছাড়াই স্পষ্ট করে বলল, এটা বিক্রি করতে চাই। এক বছর হলো কিনেছি আপনাদেরই দোকান থেকে। 

ছেলেটা হেসে বলল, সরি। আমরা পুরনো সেট কিনি না। নতুন সেট বিক্রি করি। সরি। 

বকুল বলল, আপনাদের দোকান থেকেই কিনেছিলাম। গ্যারান্টি দিয়েছিলেন। এই দেখেন রিসিট।

ছেলেটা আগের মতো হেসে বলল, কিনতে পারেন; কিন্তু আমাদের গ্যারান্টি বলে না যে, পুরনো সেট কেনা হবে। আমাদের সাপ্লাইয়ার আছে। তারা নতুন সেট পাঠায়। আমাদের পুরাতন সেট কেনার নিয়ম নেই। হ্যাঁ, পুরাতনের সঙ্গে এক্সচেঞ্জ করা যায়। 

বকুল হতাশ হয়ে চলে আসছিল। ছেলেটা পেছন থেকে ডাক দিল তাকে। বকুল তার কাছে যেতে সে বলল, মাঝে-মাঝে পুরনো সেট কেনার জন্য কাস্টমার আসে। তাদের আমরা ফিরিয়ে দিই। এই মাত্র একজন এসেছিল। আমাদের কথা শুনে চলে গিয়েছে। এখুনি গিয়েছে। হয়তো রাস্তার ফুটপাতে দেখা পেতে পারেন। জিন্সের প্যান্ট আর লাল টি-শার্ট। দেখুন ধরতে পারেন কিনা তাকে। বকুল দরজার দিকে যেতে বলল, কত দাম চাইব বলুন তো?

ছেলেটি কাউন্টারের পেছনে থেকে বলল, সে আমি কী করে বলব? আপনিই দর-দাম করবেন যদি তার দেখা পান। তবে যে দামে কিনেছিলেন তার চেয়ে কম চাইবেন। তারপর দেখেন কী বলেন তিনি? 

বকুল রাস্তায় এসে ফুটপাতে জিন্সের প্যান্ট আর লাল টি-শার্ট লোক খুঁজতে থাকল। তারপরে সে দেখল ঐ কম্বিনেশনের পোশাকে বেশ কয়েকজন হাঁটছে ফুটপাতে, কেউ রিকশায় উঠছে, নামছে। রাস্তায় অবশ্য বেশি লোক নেই। ‘হলিডে’ ঘোষণার পর মানুষের চলাচল কমে গিয়েছে। পুলিশ, র‌্যাব আর বিজিবির গাড়ি ঘুরছে হলিডে বানচাল করছে কিনা কেউ, দেখার জন্য। সন্তোষজনক উত্তর দিতে না পারলে কান ধরে ওঠ-বস করানো হচ্ছে। দেখে বিশ্বাস হতে চায় না। সবকিছু যেন এক জাদুর কাঠিতে বদলে গিয়েছে রাতারাতি। পরিচিত সবকিছু দৃশ্য বদলে গিয়েছে হঠাৎ করে। চেনা শহরটা অন্যরকম দেখাছে। যেন বাস্তবে না, সিনেমার পর্দায় দেখছে এই সব নতুন দৃশ্য।

চার

দরজায় করাঘাত। খুব চেনা এই শব্দ। এক একজনের করাঘাত একেক রকম। অভ্যস্ত প্রাণ শুনেই বুঝতে পারে। ইন্দ্রিয়গুলোর বুদ্ধিমত্তা আছে, জন্ম সূত্রেই, রোবটের মতো না। এসব জানা আছে বকুলের। দরজা খুলে সে দেখতো পেল বাড়িওয়ালার পরিচিতি মুখ। তার দাড়ি বেশ হয়েছে, বকুলও দাড়ি কামায় না এখন। কেন কামাবে? ক্লাস নেই, ছাত্র দু’জনকে পড়াতে যেতে হয় না। আড্ডা হয় না আগের মতো। ঘরে শুয়ে-বসে থাকার দিন-রাত গুলোতে দাড়ি কাটলেই কি, না কাটলেই বা কি? কিন্তু বকুল আর বাড়িওয়ালা শরীফ মিয়া তো এক নয়। তার ফ্যামিলি আছে, ছেলে-মেয়ে-বউ আছে। তারা দেখে কিছু বলে না? হঠাৎ ফেরারি আসামির মতো আত্মগোপন করার জন্য দাড়ির আশ্রয় নেওয়া কেন? রসিক হলে তারা এমন ভাবতেই পারে। ভেবে একটু হাসতেও পারে মুখ টিপে; কিন্তু বকুল জানে এখন সে রসিকতার সময় না। হাসবার কারণ খুব কম এই সময়, একথা অল্প বয়সের ছেলে-মেয়েরাও জেনে গিয়েছে। তারা হাসে না। অনেকেই হাসতে ভুলে গিয়েছে। হাসি ব্যাপারটা অধিকাংশ মানুষের দৈনন্দিন জীবন থেকে যেন উধাও হয়ে গিয়েছে। সব ধরনের হাসির কথা হচ্ছে না। হচ্ছে প্রাণ খুলে, উচ্ছ্বসিত হয়ে হাসার কথা। হবে হ্যাঁ, যাদের এই দুঃসময় কাবু করতে পারেনি, যারা সৌভাগ্যবান তাদের জন্য হাসি নিশ্চয়ই আগের মতোই আছে। বাইরে না হলেও তারা নিজেদের মধ্যে নিশ্চয়ই আগের মতোই হাসে। তাদের জন্য হাসাহাসি বদলায়নি। বাইরে আগের মতো বের হতে পারছে না, তার জন্য হাসা বন্ধ করা হবে তাদের? হাসি সাম্যবাদে বিশ্বাস করে না। সে খোলাবাজারে পণ্য। যে কিনতে পারে অঢেল কিনে নিয়ে স্টক করে রাখতে পারে। মাসের পর মাস, বছরের পর বছর, তাদের জন্য কিছু না হাসি কিনে রাখা। যেমন কিনে স্টক করেছে তারা অন্য সব কিছু। বাড়িওয়ালা শরীফ মিয়া বললেন, বাড়ি ভাড়া নিতে এলাম। 

সে তো জানি। এ ছাড়া আপনার সঙ্গে আমার এমন কি আত্মীয়তা যে খোঁজ নিতে আসবেন। মনে মনে এই কথা বলল বকুল। মুখে হাসি এনে সে বলল, এই তো দিলাম গত সপ্তাহে। 

শরীফ মিয়া বললেন, সেটাতো বকেয়া ভাড়া। এখন আবার বকেয়া পড়ে গিয়েছে না? কবি মানুষ তো তাই খবর রাখেন না।

(হ্যাঁ, একদিন শরীফ মিয়াকে তার লেখা একটা কবিতা শুনিয়েছিল বকুল। তিনি শুনে না বুঝেই বলেছিলেন, চমৎকার। খুব উঁচু দরের কবিতা। শুনে বকুলের মনে হয়েছে যেন ফেসবুকে কারো কমেন্ট শুনছে। তারা এইভাবেই এপ্রিশিয়েট করে থাকে। বুঝুক, না বুঝুক অন্তত একটা লাইক দেয়। তাই বা কম কি? কেউ তো পড়ে প্রতিক্রিয়া জানাচ্ছে। শরীফ মিয়ার সেই প্রশংসা শুনে কৃতার্থ বোধ করেছে বকুল।)

বকুল বলল, কটা দিন সময় দিতে পারেন না? বুঝতেই পারছেন আমার অবস্থা।

শরীফ মিয়া বলেন, বুঝতে পারছি। পারব না কেন? কিন্তু আপনিও আমার অবস্থা বুঝতে পারছেন তো। ছা-পোষা সংসারের হাল ধরে আছি। আমি যাকে বলে নাচায়।

বকুল বলে, আচ্ছা আমিও যদি আপনার অন্য ভাড়াটিয়াদের মতো গ্রামে চলে যাই, তাহলে কার কাছে বাড়ি ভাড়া চাইবেন? ঘরটাতো খালিই পড়ে থাকবে। কার কাছে ভাড়া চাবেন আপনি? আর এই সময়ে নতুন ভাড়াটিয়াও কেউ আসবে না। 

শুনে প্রায় শিউরে ওঠেন শরীফ মিয়া ত্রস্তে বলেন, না, না। গ্রামে যাবেন না। নিয়মিত ভাড়া দিতে না পারলেও একজন ভাড়াটিয়া আছেন, এই ভাবনাটা বুকে বেশ সাহস জোগায়। একেবারে খালি বাড়ি নিয়ে থাকলে মনে হবে কেউ লুট করে নিয়ে গিয়েছে। বাড়ি-ঘর, আসবাব-পত্র, আশা-ভরসা। সব। বলতে বলতে তিনি হাঁপিয়ে ওঠেন। তাকে শঙ্কিত দেখায়। সব ঘর খালি হয়ে যাবে, তিনি এক গভীর খাদের মধ্যে পড়বেন। সেই ভয়ে তাকে জাপটে ধরেছে, ভাবল বকুল। শরীফ মিয়া সেই সম্ভাবনা দেখে ভয়ে ভীত হয়ে পড়েছেন। বকুল বুঝতে পারে এই মুহূর্তে সে শরীফ মিয়ার কাছে কেবল ভাড়া দেওয়া একজন ভাড়াটিয়া নয়, একটা অবলম্বনও বটে। এখন সামর্থ্য নেই; কিন্তু ভবিষ্যতে সম্ভাবনা আছে। যে কোনো দিনই এই সম্ভাবনা সত্যি হয়ে যেতে পারে। যেমন হয়েছে গত সপ্তাহে তার মোবাইল বিক্রির দুই-তৃতীয়াংশ টাকা হাতে পেয়ে। অবশ্য তিনি জানেন না মোবাইল বিক্রি করে টাকাটা জোগাড় করেছে বকুল। তার জানার দরকার কি? টাকা পেলেই হলো। কোত্থেকে এলো সে টাকা, তার খোঁজ নিয়ে কাজ কি তার? খুন-খারাবি করে টাকাটা আনলে চিন্তিত হতে পারতেন। পুলিশের ঝামেলা হতো; কিন্তু যত বড় সংকটেই পড়ুক, বকুল টাকার জন্য কাউকে খুন করবে না, এ বিষয়ে তিনি নিশ্চিত। কবিরা খুন করে বলে শোনেননি শরীফ মিয়া। বড় জোর মদ টদ খেয়ে মাঝে-মাঝে মাতাল হয়। আগে এমপি, মানে মেথর পট্টিতে তারা যেত ওই কাজে। এখন যত্রতত্র মদ পাওয়া যায় বলে সেখানে যেতে হয় না বলে শুনেছেন তিনি। তার এই এক কামরাতেই কি বসেনি বকুলের বন্ধুদের নিয়ে মদের আসর? বসেছে, মাঝে-মাঝে। তাদের জোর গলায় কথা-বার্তা আর কবিতা পড়া শুনেই বুঝেছেন তিনি; কিন্তু কিছুই বলেননি পরদিন সকালে। কেন বলবেন? দরজা-জানালায় ঘা দিয়ে শব্দ করেনি তারা, বাথরুমের আয়না ভাঙেনি। বমি করার শব্দও শোনেননি তিনি। শুধুই একটা জোর গলায় কথা-বার্তা। কম বয়সে এটা মানায়। অন্তত. তিনি তাই মনে করেন। তাছাড়া কবিদের কিছুটা প্রশ্রয় দেওয়া যায়। শরীফ মিয়া গম্ভীর হয়ে বলেন, গ্রামে যাওয়ার কথা ভাববেন না। এখানে অসুখটা যদি ধরেই ফেলে তাহলে হাসপাতালে নিয়ে যাবে। অ্যাম্বুলেন্সকে খবর দিলেই তাদের সাদা পোশাক পরা লোকগুলো আসবে, একেবারে মিলিটারি স্টাইলে। স্ট্রেচারে তুলে নিয়ে যাবে। আমাকে ডাকবে না। ধারে কাছে কাউকে যেতে দেবে না। আত্মীয়-স্বজনকেও খবর দিতে বলবে না। যাওয়ার আগে আমার বাড়ির ছাদে উড়িয়ে দেবে লাল পতাকা। লোকে ভাববে, আমি কমিউনিস্ট হয়ে গিয়েছি। না, তা ভাববে না। এখন কেউ কমিউনিস্ট হয় বলে শুনিনি। এখন ফ্যাশন হলো কোভিডে আক্রান্ত হওয়া। বলতে পারেন এটা স্ট্যাটাস সিম্বল। হ্যাঁ, মরণঘাতি বড় এই অসুখ। জীবনে কোনো কোনো স্ট্যাটাস চড়া দাম দিয়েই পেতে হয়। যাই হোক আপনি গ্রামে যাওয়ার চিন্তা মাথা থেকে ছাড়ুন। এখন আসি। আবার কদিন পর আসব। এর মধ্যে আশা করি আপনি টাকা যোগাড় করতে পারবেন। আপনাকে দেখেই বুঝেছি টাকা আপনার হাতের ময়লা। 

শরীফ মিয়া দীর্ঘ বক্তৃতা দিয়ে নিজেকে শান্ত করে গেলেন। এই একটা গুণ লোকটার। কালো মেঘের আঁচলেও রুপালি পাড় দেখতে পান। ক’জন পারেন এমন? ভাবতে ভাবতে বকুল নিজের হাতের তালু দেখে। কয়েকটা রেখা ওপরে, নিচে, সমান্তরালে দেখা যাচ্ছে। এসব কি তার ‘হাতের ময়লা’ টাকা দেখতে পায়? টাকা দেখে আনে যখন দরকার, আলাদীনের প্রদীপের মতো? শরীফ মিয়া তাকে বেশ একটা সার্টিফিকেট দিয়ে গেলেন। তার মুখে একটা সূক্ষ্ম হাসির রেখা ফুটে উঠে।

বকুল টেবিল থেকে পাঠ্যপুস্তকগুলো গুছিয়ে নিয়ে একটা ব্যাগে ভরে। তারপর ঘরের দরজা টেনে শিকল দিয়ে বের হয়। দরজা তালা দেয় না আজকাল সে। কি আছে ঘরে চুরি যাওয়ার মতো?

পাঁচ

নীলক্ষেতে প্রায় সব বইয়ের দোকান বন্ধ। মজনু শেখের দোকানের পাট আধ খোলা দেখা যায়। বকুল উঁকি দিয়ে দেখে সে ভেতরে বসে একজনের সঙ্গে কথা বলছে নিচু স্বরে, সামনে টাকার বান্ডিল। একশো টাকা, পাঁচশো টাকা, হাজার টাকার এতগুলো নোট সে আগে দেখেনি। মজনু শেখ তাহলে এই দুর্দিনেও ভালো ব্যবসা করছে। গুড, ভেরি গুড। সে ভালো জায়গাতেই এসেছে। হোক না সব দোকানপাট বন্ধ নীলক্ষেতে। এই একটা তো খোলা আছে। শুধু খোলা না, দারুণ ট্রানজেকশনও হচ্ছে। হাজার-হাজার টাকার বেঁচা-কেনা চলছে। জয় হোক মজনু শেখের। নীলক্ষেতের ইজ্জত সে একাই ধরে রেখেছে। বড় বড় ব্যবসা বাণিজ্য রসাতলে যাক। বই কেনা বেচা চলছে। মজনু শেখের বইয়ের দোকান টেনিসনের সেই ছোট্ট নদীটির মতো। চারদিকে যাই ঘটুক না কেন- সে চলবে পাগলপারা। চিরকাল। 

ভেতরে উঁকি দিলেই মজনু শেখ সতর্ক হয়ে টাকা বান্ডেল হাত দিয়ে ঢেকে রাখার চেষ্টা করে। দেখে হাসি পায় বকুলের। সে মাথা গলিয়ে বলল, মজনু শেখ কেমন আছেন?

মজনু শেখ মিনমিনে গলায় বলল, এই আছি কুনো রকম । 

বকুল মনে মনে বলল, কুনো রকমই থাকেন ভাই। আপনার এই কুনো রকমই এখন ভরসা। সে তার মাথা দোকানের ভেতরে আরো কিছুটা গলিয়ে বলল, কয়েকটা বই আনছিলাম। বিক্রির জন্য। সব টেক্সট বই। বিজনেস অ্যাডমিনেষ্ট্রেশন। পড়তে হলে এসব কিনতেই হবে। 

মজনু শেখ হতাশ গলায় বলে, বই আনছেন? ভাই এখন তো বই কেনা বন্ধ।

সন্দিগ্ধ হয়ে বকুল বলে, কেনা বন্ধ কেন? দেখতে পাচ্ছি বেশ কেনা-বেচা চলছে। আপনার সামনে টাকার বান্ডিল। আপনি তো সোনা চোরাচালানি করেন না। মাদকদ্রব্যও বিক্রি করেন না। এই টাকা বই বিক্রি আর কেনার, তা না বললেও বোঝা যায়। 

মজনু শেখ ভারী গলায় বলে, দোকানটা বেইচা দিলাম এই ভাইয়ের কাছে। দোকানে বিক্রি বাটা নাই এক মাস হইল। কেমনে চলুম? তাও আশায় আশায় ছিলাম; কিন্তু অবস্থার উন্নতি নাই। দ্যাহেন না আশে-পাশে সব দোকান বন্ধ। হয় গ্রামে গ্যাছে গিয়া, না হয় বিক্রি কইরা দিছে। বইয়ের বিজনেস আর চলব না ভাইজান। স্কুল-কলেজ সব বন্ধ। বই কিনব কেডা। তারপর সামনের লোকটার দিকে তাকিয়ে বলে, চলব; কিন্তু দেরী হইব। আমি আর আমাদের লাহান গরিব মানুষ অত দিন অপেক্ষা করুম কেমনে? তাই এই ভাইজানের কাছে বেইচা দিলাম। ভাইজানের আলুর আড়ত আছে মোকামে। পেঁয়াজের আড়ত আছে। চালু ব্যবসা। এই সব কখনো বন্ধ হইব না। মিয়া ভাইয়ের পুঁজি আছে আল্লাহর মেহেরবানিতে। হেই পুঁজি দিয়া দোকানটা কিনে নিলেন। বলতে বলতে মজনু শেখ চোখের পানি মুছে বলল, খুব কষ্ট হইছে বেইচা দিতে। কত দিনের পুরনো দোকান। কত লোক আইছে বই কিনতে, বই বিক্রি করতে। আপনার মতো কত লোকের সাথে জানাশুনা হইছে। আর এই যে নীলক্ষেত, বাজার বইল্যা মনে করি নাই। আমাদের বাড়ি ঘর। সংসার। এইডা ছাইড়া যাইতে কলিজা ফাইট্যা যায় ভাইজান। বলে সে চোখ মোছে লুঙ্গির কোনা দিয়ে। তার গলা ফ্যাসফেসে হয়ে এসেছে কান্নায়। সামনের লোকটা তার কাঁধে হাত রেখে সান্তনা দেয়। বলে, যদি টাকা ফেরত দিতে পারেন, দোকান ফেরত পাইবেন ভাইজান। মন খারাপ কইরেন না।

বকুল মরিয়া হয়ে বলে, এই যে ভাই, নতুন মালিক। আমার বইগুলা কিনবেন? খুব দামি আর প্রয়োজনীয় বই। ছাত্রদের কিনতেই হবে। 

নতুন মালিক আড়তদার বলে, ভাইজান আমি নতুন এই ব্যবসায়। এহনো জানা নেই কোন বই কিনুম। তাছাড়া এহোন কিইনা লাভ। জানেন তো স্কুল-কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয় সব বন্ধ। বই কিনবো কেডা? কিনলে আমার এই ভাই কি তার দোকান বেইচা দেন? 

বকুল জানতো এই কথাই বলবে আড়তদার, মজনু শেখের দোকানের নতুন মালিক। তার সঙ্গে আলোচনা না বাড়িয়ে বেরিয়ে এলো সে নীলক্ষেতের অলি-গলির ভেতর থেকে। ঝাঁপ দিয়ে বন্ধ ঘরগুলোর ভেতর থেকে বইয়ের সোঁদা গন্ধ বের হচ্ছে। বাতাস না পেয়ে তাদের শ্বাসরোধ হওয়ার অবস্থা হয়েছে মনে হয়। বই হলে হবে কি? তাদেরও প্রাণ আছে, ভাবলো বকুল। রাস্তায় এসে দেখলো এক বুড়া রিকশাওয়ালা দাঁড়িয়ে আছে। তাকে দেখে সাগ্রহে বলল, যাইবেন নাহি? 

বকুল ফুটপাতে দাঁড়িয়ে ভাবছে। বইয়ের ব্যাগ নামিয়ে রেখেছে নিচে। এতক্ষণ টেনে টেনে তার হাত ব্যথা করছে। হঠাৎ কি খেয়াল হল, সে রিকশাওয়ালাকে বলল, আমাকে তোমার রিকশা চালাতে দিবা? 

রিকশাওয়ালা অবাক হয়ে বলল, ক্যান? আপনে রিকশা চালাইবেন ক্যান? উইঠা বহেন আমি আপনারে চালাইয়া নিয়া যামু। ব্যাগটা উঠান। 

বকুল হেসে বলে, রিকশা চালাবার শখ হয়েছে ভাই। কোনোদিন তো রিকশা চালাইনি। হ্যাঁ, ছেলেবেলায় সাইকেল চালিয়েছি।

রিকশাওয়ালায় হেসে বলে, সাইকেল চালানি আর রিকশা চালানি এক না। পারবেন না ভাইজান। 

বকুল হেসে বলে, দেখি না চেষ্টা করে হঠাৎ শখ হয়েছে। তোমার তো এখন ভাড়াটিয়া নাই। এমনিতেই চুপ করে দাঁড়িয়ে আছ। এই সময় আমি না হয় একটু চালিয়ে দেখি। আমারও কিছু করার নাই। শখটা হঠাৎ মাথায় এলো কিনা, তাই বলছি। দাও না ভাই, একটু চালাই।

তার আগ্রহ দেখে বুড়ো রিকশাওয়ালা বলে, আহেন। দ্যাহেন পারেন কিনা। আমার তো লোকসান নাই। ঠিকই কইছেন আপনে। কোনো কেরায়া নাই ধারে-কাছে।

বকুল রিকশায় উঠে বুড়োকে বলে, তুমি সিটে এসে বসো।

বুড়ো অবাক হয়ে বলে, আমি? আমারে ক্যান? আমারে নিয়ে রিকশা টানতে অসুবিধা হইব আপনার। খালি রিকশা চালাইয়া দ্যাহেন। বকুল বলে, তুমি এসে বসো তো ভাই। ব্যাগটাও তুলে নাও রিকশায়। 

বুড়ো রিকশাওয়ালা বেশ সন্ত্রস্ত হয়ে বলে, এক্সিডেন্ট কইরা ফালাইবেন। আমার কথা হুনেন। শখ হইছে যখন, একলাই চালাইয়া দ্যাহেন। 

বকুল বলে, রাস্তা ফাঁকা। কোনো গাড়ি টারি নাই। রিকশাও চলছে কম। এক্সিডেন্ট হবে কার সঙ্গে? উঠে বস ভাই। ব্যাগটা তুলে আন। 

বকুল রিকশা চালিয়ে যাচ্ছে। যেতে যেতে বলে, কেমন চালাচ্ছি ভাই সাহেব? 

ভাই সাহেব ডাক শুনে বুড়ো রিকশাওয়ালা খুব খুশি হয়। উচ্ছ্বসিত হয়ে বলে, খুব ভালোা চালাইতেছেন। অক্করে ওস্তাদের লাহান।

বকুল তাকে বলে, আজকাল কেমন রোজগার-পাতি হয়? লোকজন তো বেশি বাইরে বের হয় না। কেরায়া পাওয়া যায়? 

বুড়ো মন খারাপ করে বলে, খুব কম। দুই-তিনশো টাকা হয়। 

তাতে চলে সংসার? বকুল জিজ্ঞেস করে?

বুড়ো বলে, বাড়ি ভাড়া বাকি পড়ছে। রিকশার মালিককে একশো টাকা দিই এক বেলার লাগি। বাকি একশো টাকায় চাল-ডাল সবজি কিনি। এভাবে চলতাছে দিন। 

বাড়িওয়ালা ভাড়ার জন্য তাগাদা দেয় না? 

তা আর দেয় না? কিন্তু হে আমাদের অবস্থা বোঝে। তার চায়ের দোকান আছে বস্তিতে। দোকানে বিক্রি-বাট্টা হয়। তাইতে চালায় সংসার। হের লাগি বেশি চাপ দেয় না ভাড়া দিতে। তাছাড়া রিকশা তো পইরাই থাহে।

কোথায় থাক তুমি ভাই?

বুড়ো বলে, রায়ের বাজার।

তোমার রিকশার মালিকও সেখানে থাকে?

জ্বি।

বকুল বলল, খুব দূরে না রায়ের বাজার। চল তোমারে চালাইয়া নিয়া যাই।

শুনে বুড়ো শঙ্কিত হয়ে বলে, যাইবেন? কী দরকার? আপনার শখ তো পুরা হইছে। তারপর বলে মালিক দেখলে রাগ করতে পারে।

বকুল বলে, সে চিন্তা করো না তুমি। আমি তাকে সামলাব। তুমি ব্যাগটা ভালো করে ধইরা রাখ যেন পইরা না যায়।

বুড়োর কাছ থেকে রাস্তার হদিস জেনে নিয়ে বকুল রিকশা চালিয়ে যায়। তার এখন একটু কষ্ট হতে থাকে। অভ্যেস নেই, তার ওপর ব্যাগ আর বুড়ো রিকশাওয়ালাকে টেনে নিতে হচ্ছে। সে প্রায় হাঁপিয়ে ওঠে। এক সময় তারা রায়ের বাজারে এসে পৌঁছায়। বড় রাস্তা থেকে একটু নিচে চলে গিয়েছে ইট বিছানো কাঁচা রাস্তা। রাস্তার সামনে কিছু লোক বসে বসে গল্প করছে। তারা তার দিকে তাকিয়ে অবাক হয়ে তাকাল। বকুল বুড়োকে বলল, তোমার মালিক কোথায় এখন?

বুড়ো বলে, মনে হয় চায়ের দোকানে। হেইখানেই বইয়া থাহে সারাদিন। 

বকুল বলে, চল তার সঙ্গে কথা বলি।

কি কথা? বুড়োর স্বরে শঙ্কা।

বকুল বলে, তার সম্বন্ধে জানতে চাই। এই ব্যবসা কেমন করে চলে? লাভ-ক্ষতি কেমন হয়? কী কী অসুবিধা আছে এই বিজনেসে, এই সব জানতে চাই। 

জাইনা কি করবেন? বুড়ো অবাক হয়ে শুনে।

বকুল বলে, আমি যে বিষয়ে লেখাপড়া করি সেখানে এইসব কথা লেখা নাই। আমি এই ছোটখাটো বিজনেস নিয়ে লিখলে একটা নতুন কিছু হবে বুঝলা বুড়া মিয়া। গবেষণা। শুনেছ গবেষণার কথা? তারপর উত্তরের অপেক্ষা না করে সে বলে, এই যে তোমাকে রিকশা চালিয়ে নিয়ে এলাম এর জন্য ভাড়া পাবা তুমি। 

শুনে বুড়ো খুব আপত্তি করে। বকুল বলে, তুমি এই সময়ে একজন কেরায়া পেতে পারতে। সে ক্ষতিপূরণ বলে মনে করতে পারো। তুমি গরিব মানুষ। তোমাকে ঠকাবো কেন? তারপর বলে, তোমার মালিকের আরও রিকশা আছে? 

বুড়ো বলে, আছে। কইলাম না এহন খালিই পইরা থাহে। কেরায়া নাই তাই রিকশা চালাইতে চায় না কেউ। অনেকে গ্রামে গ্যাছে গিয়া। রিকশা খালিই পইড়া থাকে। 

মালিকের দেখা পাওয়া গেল। বুড়ো ঠিকই বলেছে সে চায়ের দোকানে বসে কয়েকজনের সঙ্গে কথা বলছে আর হাতে ধরে রাখা কাপ থেকে পিরিচে চা ঢেলে খাচ্ছে মাঝে-মাঝে। 

বকুল তার পাশে বসে বলে, আপনার রিকশা চালিয়ে এলাম। বুড়ো রিকশাওয়ালা দিতে চায়নি একসিডেন্টের ভয়ে। আমি তার ভয় দূর করার জন্য এখানে চালিয়ে নিয়ে এলাম। দেখালাম যে আমিও পারি। 

শুনে মালিক অবাক। দোকানে অন্য যারা ছিল তারাও খুব অবাক হয়ে তাকে দেখতে থাকল। তাকে নিয়ে বলাবলি করা শুরু করল কেউ কেউ। দু’একজন মাথায় হাত রেখে কিছু বলে হাসাহাসি করল। দেখে বকুল বুঝল তারা তার মাথা খারাপ মনে করে মজা পাচ্ছে।

প্রথমে মালিক রাজী হতে চায় না। পরে বকুলের জেদ দেখে রাজী হল। বলল, এক কাপ চা খাইয়া যান। লগে লাঠি বিস্কিট। অনেক দূর রিকশা চালাইয়া আইছেন। 

বকুল হেসে বলল, হ্যা আমার এখন চা খাওয়ার দরকার। 

আসবার আগে সে বুড়োকে তার ভাড়ার টাকা বুঝিয়ে দেয়। সে কিছুতেই নেবে না; কিন্তু বকুলের চাপে তাকে নিতে হয়। সে বইয়ের ব্যাগটা হাতে নিয়ে বলে, এইডা?

বকুল বলে, এইটা এখন এখানে থাক এই দোকানে। আমি তো আবার আসব। তখন নিয়ে যাব। 

মালিক শুনে বলে, বুড়ো মিয়া আপনারে নিয়া যাইব। তারপর বুড়োর উদ্দেশ্যে বলে, মিয়া ভাইরে নিয়া যাও। কেরায়ার ভাড়া নিবা না, আমি দিমু। 

ছয়

বকুলকে দেখে বাড়ির মালিক শরীফ মিয়া খুশি হয়ে বলেন, আইছেন? আমি তো আপনারে ব্যাগ নিয়া বাইর হইতে দেইখ্যা ভাবলাম গ্রামে রওয়ানা হইলেন বুঝি।

বকুল বলে, গ্রামে গেলে আপনাকে না বলে যাব মনে করেছেন? কি যে বলেন!

শরীফ মিয়া বলেন, না। আপনি তেমন মানুষ না। তাও মনে আসল কথাটা। তারপর বলেন, রিকশা চাইপা আইলেন দেখি? হাতে একটা ব্যাগ। রোজগার-পাতি কিছু হইল মনে হয়।

বকুল সিঁড়ি দিয়া ওপরে উঠতে উঠতে বলে, মনে হয়। তাকে খুব প্রফুল্ল দেখায়। সে একটা কবিতা আবৃত্তি করতে করতে দরজা খোলে। 

সাত

বিনু তার গাড়ি নিয়ে বকুলের মেসের সামনে এসে ডাক দিল নিচ থেকে। এটা তার পুরনো অভ্যাস। সে কখনো ওপরে ওঠে না। গাড়ি নিয়ে এলে মোবাইলেও কল করে না। চিৎকার করে ডাক দেয়। অথবা জানালায় ঢিল ছোড়ে। বাড়ির মালিক প্রথম দিকে আপত্তি করলেও এখন আর কিছু বলেন না। তিনি বুঝে গিয়েছেন মেয়েটা অন্য রকমের। একটু জংলী; কিন্তু খারাপ স্বভাবের না। বড়লোকের মেয়ে, একটু ফূর্তিবাজ তো হবেই। তার একজন ভাড়াটিয়া এরকম বড় লোকের মেয়ে বন্ধু আছে জেনে তিনি খুশিই হন। 

বকুল নিচে নেমে এলে বিনু বলল, তোর কি হয়েছো বলতো? ফোন ধরিস না কেন? ক’দিন থেকে ফোন করছি। শুনতে পাস না?

বকুল বলল, ফোনটা হারিয়ে ফেলেছি।

শুনে বিনু অবাক হয়ে বলে, হারিয়ে ফেলেছিস? তা আরেকটা কিনে ফেল। মোবাইল ছাড়া এক মুহূর্তও থাকা যায়? কত দরকারী এটা। চল, তোকে দোকানে নিয়ে যাই। আজই একটা কিনে ফেলবি। তারপর কি মনে করে বলে, তোকে একটা মোবাইল প্রেজেন্ট করব। তোকে কিছু দেওয়া হয়নি আমার। অন্য বন্ধুদের প্রেজেন্ট দিয়েছি। তুই বাদ পরে গিয়েছিস। ভালোই হল তোর ফোন হারিয়ে গিয়েছে।

বকুল বলল, দেখি না কদিন মোবাইল ছাড়া থাকা যায় কি না। এত ব্যস্ত হওয়ার কি আছে?

আছে, আছে। এই যে আমি ফোন করে করে তোকে পাই না এটা আমাকে অস্থির করে ফেলে। আমার কোনো বন্ধু লাপাত্তা হয়ে গিয়েছে এটা আমি ভাবতেই পারি না। আমাকে ভীষণ আপসেট করে দেয়। এসব চলবে না আমার সঙ্গে।

বকুল বলল, মোবাইল কিনব না তাতো বলিনি। বলেছি, এখুনি কী দরকার? তারপর বলে, চল তোকে একটা নতুন অভিজ্ঞতা দিই।

বিনু অবাক হয়ে বলে, কী নতুন অভিজ্ঞতা? এই দুঃসময়ে পুরনো অভিজ্ঞতাই ধরে রাখা যাচ্ছে না। কোন নতুন অভিজ্ঞতার কথা বলছিস?

বকুল বলল, তোকে পুরানো ঢাকায় নিয়ে যাই। কখনো তো যাস নি। সেখানকার অলি-গলি দেখবি। নবাবদের ধসে পড়া দালান দেখতে পাবি। চকবাজারের দোকানপাট খোলা না থাকলেও চোখে পড়বে তোর। তারপর ওয়াইজঘাট হয়ে সদরঘাট যাব আমরা। কত জাহাজ, লঞ্চ, নৌকা! সব এখন জাদুমন্ত্রে চুপচাপ নোঙ্গর ফেলে আছে। 

শুনে বিনু বলল, মনে হচ্ছে ইন্টারেস্টিং; কিন্তু আমার ড্রাইভার কি সেখানকার রাস্তাঘাট চিনবে? শুনেছি সেখানকার গলি খুব ন্যারো। গাড়ি যেতে পারবে?

বকুল বলল, গাড়ি কেন? আমরা দু’জন রিকশায় যাব।

রিকশায় পুরনো ঢাকা! ওয়াও! দ্যাট উইল বি সামথিং। হ্যা নতুন অভিজ্ঞতা বটে। শুনেই এক্সাইটেড ফিল করছি। ডাক রিকশা। আমি ড্রাইভারকে বলছি এখানে অপেক্ষা করতে।

বকুল রিকশা চালিয়ে নিয়ে বিনুর সামনে এস বলল, ওঠ পেছনে।

বিনু অবাক হয়ে বলে, ঠাট্টা করছিস নাকি? 

বকুল বলে, না। আমি যে রিকশা চালাতে পারি দেখাব তোকে। ওঠ দেখি। সেখান থেকে ঘুরে আসতে সময় নেবে।

বিনু তবুও ইতস্তত করে। বলে, ত্ইু সেখানে যেতে পারবি রিকশা চালিয়ে? অতদূর? তোরতো অভিজ্ঞতা নেই। খাম-খেয়ালি করে নিজেও বিপদে পড়বি, আমাকেও...। সে কথা শেষ করে না। 

বকুল রিকশার প্যাডেলে চাপ দিয়ে সামনে যেতে যেতে বলে, তোর গায়ে সামান্য আঁচড়ও পড়বে না। আই গ্যারান্টি। তারপর হেসে বলল, তোর কি একারই প্রাণের দাম? আমার নেই। 

বিনু রিকশায় উঠে বসল। বকুলে প্যাডেলে চাপ দিয়ে চালাতে শুরু করল রিকশা। দেখে হাত তালি দিল বিনু। 

আট

রাস্তায় বাদাম কিনল বিনু। সে খোসা ভেঙ্গে খাচ্ছে। মাঝে-মাঝে সামনে হাত বাড়িয়ে বকুলকে দিয়ে বলছে নে। আমি খোসা ছাড়িয়ে দিয়েছি। তারপর উচ্ছ্বসিত হয়ে বলল, দারুণ লাগছে রে। দিস ইজ আউট অব দ্য ওয়ার্ল্ড। দারুন থ্রিলিং। মনে হচ্ছে স্বপ্ন দেখছি। তারপর বকুলের পিঠ চাপড়ে বলল, তুই খুব রোমান্টিক রে। দারুণ রোমান্টিক। অড্রে হেপবার্নও ‘রোমান হলিডেতে’ গ্রেগরি পেকের সঙ্গে মোটরসাইকেলের পেছনে যেতে যেতে এত আনন্দ পায়নি। কথা শেষ করে বিনু বাদামের খোসা বাতাসে উড়িয়ে দিয়ে বলল, টু হেল উইথ কোভিড! 

সাম্প্রতিক দেশকাল ইউটিউব চ্যানেল সাবস্ক্রাইব করুন

মন্তব্য করুন

Epaper

সাপ্তাহিক সাম্প্রতিক দেশকাল ই-পেপার পড়তে ক্লিক করুন

Logo

ঠিকানা: ১০/২২ ইকবাল রোড, ব্লক এ, মোহাম্মদপুর, ঢাকা-১২০৭

© 2024 Shampratik Deshkal All Rights Reserved. Design & Developed By Root Soft Bangladesh

// //