অতঃপর আবিদ সাহেব

এক.

ছেলেটা এভাবে নষ্ট হয়ে যাবে কেউ ভাবতে পারেনি। আবিদ সাহেব ঠিক করেই নিয়েছিলেন ছেলেকে বিজ্ঞানে পড়াবেন। ডাক্তার বানাবেন। ডাক্তারিবিদ্যার প্রতি আবিদ সাহেবের ভিন্ন রকম টান। এই টান লাগার কারণ অবান্তর নয়। কৈশোরে আবিদ সাহেবেরও স্বপ্ন ছিল ডাক্তার হবেন। রাত দিন মিলে চৌদ্দ থেকে ষোলো ঘণ্টা পড়ে রেজাল্টের দিন দেখা গেল ওয়েটিং লিস্টের শেষ দিকে নাম। এক বুক কষ্ট নিয়ে ভর্তি হলেন বিশ্ববিদ্যালয়ে, রসায়ন শাস্ত্রে। এখনো মনে আছে, এ নিয়ে বাবা তার সঙ্গে কথা বলেননি এক বছর। তাই আবিদ সাহেব চেয়েছেন তার ছেলে সে অভাব পূরণ করুক; কিন্তু যত্নের ছেলের এই অবস্থা দাঁড়াবে তা কল্পনায়ও আসেনি।

আবিদ সাহেবের তিন ছেলে-মেয়ের মধ্যে রুহিন তৃতীয়। তার আগে দুই মেয়ে। সুস্মিতা বড়, সুরঞ্জনা মেজো। এই নাম দুটি আবিদ সাহেবের স্ত্রী সুলতার রাখা। আবিদ সাহেব নোযোগী ছিলেন না বলেই সুলতা বইয়ের দোকান খুঁজে খুঁজে নামের অভিধান কিনে এনে মেয়েদের নাম রাখলেন। এ নিয়ে কম ঝামেলা যায়নি। প্রথম সন্তান হওয়ার আগেই আবিদ সাহেব সুলতাকে বলে দিয়েছিলেন, ছেলে চাই, এটাই আমার পছন্দ। সুলতা ভেবেছিলেন, হয়তো মজা করে বলা; কিন্তু প্রথম সন্তান মেয়ে হওয়ার পর দেখা গেল, যা কথা তাই কাজ। মানিয়ে নিলেন। এর পর আসলো নাম রাখার ক্ষণ; সেখানে আরেক ঝড়। সুলতার শাশুড়ি নাম রাখতে চাইলেন, খোদেজা বেগম; শ্বশুর নাম রাখতে চাইলেন আম্বিয়া; সুলতা ঠিক করলেন, তার মেয়ের নাম হবে সুস্মিতা। সবাই এক পক্ষ হয়ে তাকে প্রায় এক ঘরে করে দিলেও সুলতা মচকালেন না। বছর তিন পর সুলতা আবার মা হলে পূর্বের সেই ঘটনার পুনরাবৃত্তি। সুলতা সামলে নিলেন সবকিছু। এর পর আবিদ সাহেবের সাথে সুলতার সম্পর্কটা আর আগের মতো রইল না। সুলতা ধরেই নিলেন, প্রেম আর বিয়ে, কল্পনা আর বাস্তবতা এক না। সংসার বিচিত্র জায়গা। নারীর পক্ষে মানিয়ে নেওয়াই শান্তি, সহ্য করাই সুখ। আবিদ সাহেবের সাথে সুলতার সংসারটা তাই সন্তানের মুখের দিকে তাকিয়ে টেনে নিয়ে যাওয়া মাত্র, এর বাইরে আর কোনো সৌন্দর্য অবশিষ্ট নেই। সুলতা মেয়ে দুটিকে মানুষ করতে চেয়েছেন- ছেলেও না, মেয়েও না, মানুষের মতো করে। এখন আবিদ সাহেবের ভাবাবেগ না থাকলেও এই দুই কন্যাকে নিয়ে বুক ফুলিয়েই কথা বলেন পরিবারের অন্যরা; যারা কন্যা প্রসবের দায়ে সুলতার দিক থেকে একদিন ফিরিয়ে নিয়েছিলেন ¯স্নেহের চোখ।

আবিদ সাহেব মনে করতেন, ছেলে বীরবীর্য। ছেলে হলো সাহস। সুলতা অন্য মানুষ। রুহিন জন্মের পর সুলতার শ্বশুরবাড়ির লোকদের মধ্যে ছেলে হয়েছে বলে যেমন পুষ্পরাজি ফুটেছিল তেমন পুষ্পরাজি ফোটেনি তার মনের মধ্যে। সন্তান প্রসবের সুখে সে শুধু হেসেছিল, যেমন হেসেছিল সুস্মিতা ও সুরঞ্জনার জন্মের পর। রুহিনের জন্মের পর থেকেই বদলে যেতে থাকেন আবিদ সাহেব। সব সময় ঘরে থাকেন, হাসেন। প্রতিদিন হাত ভরে খেলনা, খাবার আনেন; রুহিনের সামনে দেন। সুস্মিতা, সুরঞ্জনা যে ওনারই ঔরসজাত তা তিনি আমলেই নেন না। ছেলে বলতেই উন্মাদ ছিলেন। অনেক আগে চরাঞ্চলে লাঠিয়ালের ঘরে ছেলে হলেই যেমন আরও একটি লাঠি বৃদ্ধি পেল ভেবে ছেলেকে আলাদা মর্যাদায় বড় করা হতো, তেমনি মনোভাব আবিদ সাহেবের মধ্যে দেখা যেত যদিও আবিদ সাহেব এই উত্তরাধুনিক সভ্য সমাজের অগ্রগণ্য মানুষ; কিন্তু রুহিন এখন দাগি আসামি। বাইক ছিনতাই, রাহাজানি, ইয়াবা, শিসা, ধর্ষণের দায়ে ফেরারি। ঘরের বাইরে গেলেই লোকজন আড়চোখে তাকায়, আবিদ সাহেব মুখ নিচু করে স্থান ত্যাগ করেন। মাঝে মাঝে বাজ পাখির মতো রুহিন বাসায় এলে আবিদ সাহেব দরজা বন্ধ করে বসে থাকেন। রুহিন টাকার জন্য সুলতার কাছে, সুস্মিতার কাছে, সুরঞ্জনার কাছে হাত পাতে। মেজাজ দেখায়, না হলে এটা ওটা ভাঙে; সব শব্দ আবিদ সাহেবের কানে পৌঁছে, তিনি ছেলেকে দেখতে বের হন না। রুহিন এটা ওটা নিয়ে চলে যায়।

দুই.

আবিদ সাহেবের বয়স তেষট্টি কি চৌষট্টি। রোগাক্রান্ত, ভঙ্গুর। তিনি এখন প্রায় সময়ই জানালার কাছে বসে মানুষের চলাচল দেখেন, নিজের সাথে কী যেন বলেন অনুচ্চার শব্দে। সুলতা অনেক সময়ই পেছনে দাঁড়ান, পিঠে হাত দিয়ে জিজ্ঞেস করেন, ‘লাগবে কিছু?’ তিনি তাকিয়ে থাকেন বাইরের দিকে। চোখ গড়িয়ে পানি পড়ে। পানির ফোঁটাগুলো লুঙ্গিতে পড়ে লুঙ্গিটা পানির রেখা বরাবর ভিজে যায়। মৃদু করে বলেন, যাও। আজও বললেন, ‘যাও।’ 

‘যাও বললেই হলো না, আজ সিএনএন বাংলায় সুস্মিতার প্রথম প্রেজেন্টেশন। মেয়েটার আনন্দের দিন। দেখবে, চলো।’ বলে সুলতা কাঁধে হাত রাখলেন। আবিদ সাহেব মুখ ঘুরিয়ে তার চোখের দিকে চোখ রেখে তাকালেন। এই তাকানোর কী যেন ভাষা, সুলতা পড়তে পারেন, আবার পড়তে পারেন না। আবিদ সাহেব যেন ফিরে যান অনেক আগের দিনগুলোতে, তখন সুস্মিতার জন্ম হয়েছে। তিনি রাগ করে এক মাস বাড়িতে ফেরেননি। গায়ের রঙ কালো হয়েছে বলে দীর্ঘ দিন মেয়ের গা ছুঁয়ে দেখেননি। মনে পড়তে থাকে আরও কিছু কথা। যা তাকে ছাড়া এই বাড়ির কেউ জানে না। কেবল তিনি আর তার দুটি হাত জানে। শীতের রাত। সুস্মিতার বয়স আড়াই মাস। সুস্মিতার শ্বাসকষ্ট হচ্ছিল। সুলতা ডাক্তার ডেকে ওষুধ নিলেন। নেবুলাইজার দিলেন। সুস্মিতা ঘুমিয়ে পড়ল। সুলতা ক্লান্ত। আবিদ সাহেব ততক্ষণে সজাগ। সুলতা ঘুমিয়ে পড়লে আবিদ সাহেবের মাথায় চড়ে উঠল চিন্তাটা।

কন্যাসন্তানের প্রতি বিতৃষ্ণা, জমিয়ে রাখা খুনের নেশা। একটা পশু তার ভেতরে অতি দ্রুত বড় হতে লাগল। সুলতাকে ডিঙিয়ে আড়াই মাসের শিশুর গলা চেপে ধরলেন ছয় ফুট শরীরের আবিদ সাহেব! ধরে রাখলেন- যতক্ষণ না শ্বাস বন্ধ হয়ে গেল! যখন বুঝলেন শ্বাসপ্রশ্বাস হচ্ছে না তখন তিনি নিজের জায়গায় ফিরে শুয়ে রইলেন স্বাভাবিক মানুষের মতো। রাখে আল্লাহ মারে কে! ভোরের দিকে সুস্মিতার কান্নায় ঘুম ভাঙল সুলতার; আবিদ সাহেব চমকে উঠলেন। অস্থির চোখে তাকালেন সুস্মিতার দিকে। নিজের পাঞ্জার দিকে। এরপর আরও দু-তিন বার এরূপ পশু চেষ্টায় মত্ত হয়েছিলেন। তেমন সুযোগ না পেয়ে ক্ষান্ত হয়েছিলেন। আজকে সে মেয়েই যখন সুনাম কুড়াচ্ছে, প্রতিষ্ঠিত হওয়ার লড়াই করছে; অবসরপ্রাপ্ত, অসুস্থ বাবার চিকিৎসায় অর্থ রোজগার আর ব্যয় করছে দ্বিধাহীন; তখন তিনি বোধ করছেন, সে পাপের কোনো ক্ষমা নেই, কোনো উত্তর নেই। আবিদ সাহেব যখনই সুস্মিতা, সুরঞ্জনার দিকে তাকান তখনই কাঁটা চামচ দিয়ে চোখ দুটি উপড়ে ফেলতে ইচ্ছে করে তার, হাত দুটি স’মিলের করাতকলে বসিয়ে কেটে ফেলতে ইচ্ছে করে। এই নিষ্ঠুরতা আবিদ সাহেবের মনের ভেতর রুহিনের নষ্ট হয়ে যাওয়ার চেয়েও দশগুণ বেশি জোরে হেলিকপ্টারের পাখার মতো ঘুরতে থাকে। তিনি ভাবেন সে নিষ্ঠুরতার ফল পাবেন বলেই পরমকর্তা তাকে আজকের পরিস্থিতিতে হাজির করেছেন। তিনি একা একা কাঁদেন। পাপের হাত দিয়ে সে কান্না মুছতে যান না। 

তিন.

ভোরে সুলতা ঘুম থেকে উঠে দেখেন আবিদ সাহেব তার রুমে নেই। দরজা খোলা। ঘরে নেই, ছাদে নেই। সুলতার মনটা মোচড় দেয়। দ্রুত সুস্মিতা, সুরঞ্জনাকে ডেকে তোলেন। রাস্তায় নামেন । রাস্তা থেকে বাসার গলি পেরিয়ে মোড় পর্যন্ত যান, এত ভোরে রাস্তায় দু-চার জন উদ্বাস্তু আর রাস্তার দেয়াল ঘেঁষা কয়েকটি কুকুর ছাড়া তেমন কিছুই চোখে পড়ে না। সুলতার মন আরও মুচড়িয়ে ওঠে। যে কাজ কখনো তার চোখে পড়েনি এত দীর্ঘ সংসারকালে সে কাজ আজ তাকে বিচলিত করে তুলল। ‘কখনো বের হয়নি বলে কখনো বের হতে পারে না এমন তো নয় মা, হয়তো বের হতে ইচ্ছে করেছে...আর একটু পরই তো সকাল হয়ে যাবে।’ সুরঞ্জনা কথাগুলো বলে। সুলতা বুঝতে চান না। তিনি ঘামতে থাকেন। ‘রুহিনকে একটা ফোন দিয়ে জানাব মা?’ সুরঞ্জনা বলে। ‘অমানুষটার কথা বলবি না, সে কী করবে? কোথায় কোন ডেরায় আছে কে জানে, আপদ এসে বিপদ বাড়াবে, ফোন দিবি না।’ কোনো খোঁজ পাওয়া গেল না। কাকে জিজ্ঞেস করবেন, কার কাছে জানতে চাইবেন, পুরো পাড়াই তো ঘুমোচ্ছে। সুলতা আঁচল দিয়ে মুখ মোছেন। উৎকণ্ঠায় কাঁপে সুস্মিতা, সুরঞ্জনা। ফিরে আসে ঘরে। প্রধান দরজা পার হতেই মোটা একটা ভাঁজ করা কাগজ সুলতার পায়ের সাথে ঘ্যাঁচ করে বাঁধে। কাগজটা হাতে তুলতে তুলতে আরেকবার সুলতার কলিজা কামড় দিয়ে উঠল। সুস্মিতা সুলতার হাতে থেকে একটানে কাগজটা নেয়। আধ অংশ পড়তেই চাপা কান্নার সুর বজে ওঠে তিন জনের কণ্ঠে। পুরো অংশটা পড়া হয়। আবিদ সাহেব বুকের সব ভার রেখে নিরুদ্দেশ যাত্রা করেছেন। রেখে যাওয়া চিঠিটার শেষাংশে লিখেছেন, ‘পারলে আমাকে ক্ষমা কোরো; সুলতা, সুস্মিতা, সুরঞ্জনা। একটা ক্ষমাহীন পাপ, নিষ্ঠুরতার অনুতাপ নিয়ে চললাম। কোথায়, জানি না...। চাপা কান্নাটা আর চাপা থাকল না। ঘরে, ঘর থেকে দালানে ছড়িয়ে পড়ল অল্প সময়ের মধ্যেই।

সাম্প্রতিক দেশকাল ইউটিউব চ্যানেল সাবস্ক্রাইব করুন

মন্তব্য করুন

Epaper

সাপ্তাহিক সাম্প্রতিক দেশকাল ই-পেপার পড়তে ক্লিক করুন

Logo

ঠিকানা: ১০/২২ ইকবাল রোড, ব্লক এ, মোহাম্মদপুর, ঢাকা-১২০৭

© 2024 Shampratik Deshkal All Rights Reserved. Design & Developed By Root Soft Bangladesh

// //