শৃণু বা ছোট্ট একটি বোধের গল্প

-এটা আপনি কী করলেন?

-কী করলাম?

-পোস্টারগুলো সব ছিঁড়ে ফেললেন!

-ছিঁড়ব না তো কী করব? কত কষ্ট করে দেয়াল রঙ করে লিখেও দিয়েছি : এখানে কোনো পোস্টার মারবেন না, দেয়াল লিখন করবেন না- একটা দিন যেতে না যেতেই পোস্টার পড়ল, তাও যে লেখাটা লিখেছিলাম ঠিক তারই ওপরে!

-কাজটা আপনি ভালো করলেন না।

-কী করলে ভালো হতো? 

এসময় একটা বিশাল ছায়া ঘনিয়ে উঠতে থাকে। টনির হাতায় টান পড়ে। জড়ো হওয়া ছেলেগুলোও একটু সরে দাঁড়ায়।

বুড়ো লোকটার কাঁচাপাকা চুল। পেটানো শরীর। আর কী লম্বা। প্রায় সাড়ে ছয় ফুট না হলেও ছয় ফুট দুই তিন তো হবেই। পাঞ্জাবি আর লুঙ্গি পরা। কপাল ঘামছে দরদর করে। পাঞ্জাবি ঘামে ভিজে শরীরে লেপ্টে গেছে। সকাল থেকে প্রচণ্ড গালাগালি করে তিনি তার দেয়াল জুড়ে লাগানো পোস্টারগুলো ছিঁড়ছিলেন। লোকটা এমন কোনোদিন করতে পারে- কেউ কল্পনাও করেনি। বাইরে দেখতে শান্ত। কারো মতে, নরম স্বভাবেরই লোক। কেউ বলে, গম্ভীর। ‘দেখো 

না- সব সময় ভ্রুতে ভাঁজ পড়ে থাকে। বিরক্ত বিরক্ত।’

লোকটিকে কেউ কোনো দিন চেঁচামেচি চিৎকার করতে দেখেনি; কিন্তু গলার স্বর জলদগম্ভীর। এই ভারী কণ্ঠটা শুনলে বোঝা যায়, এ লোকটা কোথাও অন্য সবার চেয়ে আলাদা। 

দুটি বুড়োবুড়িতে একটা দোতলাবাড়িতে থাকা হয় তাদের। মেয়েরা দেশের অন্য জেলায়। একজন ঢাকা, অন্যজন খুলনায়। ছেলে আমেরিকায়। অনেকদিন পর আমেরিকা থেকে কদিন আগে বেড়ানোর জন্য এসেছে। মাসখানিক থেকে চলে যাওয়ার কথা। সেই ছেলেও দশাসই ছেলে। দাঁড়ালে যাকে বলে কিনা শালপ্রংশু অবয়ব গড়ে ওঠে।

একটা ইংরেজি টি অক্ষরের মতো রাস্তার ঠিক শেষ বিন্দুতে তার এই বাড়ির দেয়াল। ডানে কি বাঁয়ে যেদিক থেকেই রিকশা-গাড়ি ঢুকুক, একেবারে চোখে এসে বিঁধবে এই বিশাল দেয়ালটা। সারা বছর রাজ্যের পোস্টার পড়ে। তিনি বার বারই সেসব সময় পার হলে পরে ছিঁড়ে ফেলে দেন। পোস্টারের ওপরে পোস্টার, তার ওপরে পোস্টার। অনেকদিন ধরেই দু-দিন তিন দিন পার হলে এমনকি পোস্টারটা যে সময়ের জনসভা বা কোনো একটা কাজের ডেডলাইন দেওয়া- সে পর্যন্ত অপেক্ষা করে তারপর ছিঁড়তেন। কিন্তু এবার বড় ছেলে শৃণু বা শৃন্বন্তু দেশে ফিরে সারা বাড়ির ভেতরে-বাইরের দেয়ালে রঙ করিয়েছে। 

শৃণু ছিল এলাকার নাম করা মস্তান। লোকে বলত, আলেমের ঘরে জালেম। শৃণু নিজেকেও তাই বলত। খুব রাগ হতো বাপের ওপর কী নাম রেখেছে - ‘শৃন্বন্তু’- এই পানতুয়া মার্কা নাম! এই নাম খসাবে কীভাবে?- যখন থেকে বুঝতে শিখল, তত দিন স্কুলে ভালো নাম হিসেবে সেটা সেঁটে গেছে সব কাগজপত্রে: শৃন্বন্তু মোমেনিন।

বাপের ভাষায় ‘শোনো বিশ্বাসীগণ।’ বাপের নামও রেখেছিলেন দাদা, আমীরুল মোমেনিন। বাবা ছিলেন স্কুলের শিক্ষক। আমীরুল মোমেনিন সাংবাদিকতা করে জীবনটা পার করেছেন। 

এই সাংবাদিক প্লটে জমিটা তিনি নিতেন না, তার জিগির দোস্ত ময়েজুদ্দিন ওয়েসেকপুরী না বললে। ময়েজুদ্দিনকে তিনি বহুবার বলেছিলেন, এই সব কর না। কলমের কালি দিয়ে মানুষ জীবন সাজায়, তুমি ধ্বংস করে দিলে? নিজের সুবিধার জন্য কলম নয়। অন্যের সুবিধার জন্য কলম।

-কথা তো ওই একই হলো! অন্যরা কলম ধরছে, তুমি সুবিধা পেলে। তুমি কলম ধরলে তো অন্যরা সুবিধা পেল।

-দেখো ভাই, দেবে সাধ্যমতো, নেবে প্রয়োজনমতো- আমি এই নিয়ে সারাজীবন চলেছি।

-এখন আর চলবে না। সোভিয়েত ইউনিয়ন ফুট্টুস।

-তাতে কী?

-তাতে অনেক কিছু। আরে মিয়া, আমরা হলাম গুটি। সাম্র্রাজ্যবাদীরা যেমন চালাবে, আমরা তেমন চলব। গুটির গুটি আমরা। কিছুই আমাদের হাতে নেই। তুমি ধ্বংস করার কথা বলো! বরং উল্টা চলতে গেলে ধ্বংস। ফিনিসড।- বলে ময়েজুদ্দিন দু’হাতে খেলা শেষ হওয়ার মতো করে আড়াআড়ি কাটাকুটি একটা ভঙ্গি করে।

-কীসের ধ্বংস? 

-তোমার মতো নরম লোক দিয়ে জগতে কিছু হবে না মোমেন।

শৃণু হয়েছে ঠিক উল্টা। বাপের কাছ থেকে পেয়েছিল লম্বা চওড়া শরীর। এক মাথা কোঁকড়ানো চুল। মিহি দাড়িতে তাকে একদম ফিলিমের হিরো লাগত। প্রাইভেট পড়ায় ফাঁকি দিয়ে বন্ধু রিয়াসতের সঙ্গে জীবনে প্রথম সিনেমা দেখতে গিয়েছিল : জনি। দেওয়ান নজরুলের জনি। ‘দুনিয়াটা মস্ত বড়/ খাও দাও ফুর্তি কর/আগামীকাল বাঁচবে কিনা বলতে পারো?’- সোহেল রানার ঠোঁটের সেই গানটা হয়ে গেল কিনা তার জীবনদর্শন!: ‘কারো নই আমি, নও কারো তুমি/ যে যার তালে/ ঘোরে ফেরে চলে/ বলতে পারো কে কার মাল খায় কে? ঝোপ বুঝে কোপ মারো/ সেই তো ভালো।’ বা এগানের ওই কথাটা সে অক্ষরে অক্ষরে তার কলিজার ভেতরে ঢুকিয়ে নিয়েছিল: ‘সেই তো ভাই রাজা/ যার পকেট তাজা/ চারদিকে উড়ছে টাকা/ ধরো ধরো।’ 

আর এ সিনেমায় ‘জনি আমার নাম’ গানটায় বিদেশি বিকিনিওয়ালিদের এক ঝলক দেখানোটাও ছিল ধাক্কামারা। এরপর চট্টগ্রামের সব সিনেমা হলে একের পর এক ছবি এলে আর কোনো কথা নেই। সে আর রিয়াসত চলে যেত। তারপর বনানী কমপ্লেক্স হলো। নতুন সিনেমা হল। কী উত্তেজনা সবার। রেডিওতে হরদম বাংলা সিনেমা নিয়ে আর বিজ্ঞাপন তরঙ্গে মাত হয়ে থাকা দিন। ইত্তেফাকের কখনো এক পৃষ্ঠা কখনো দুই পৃষ্ঠাজুড়ে সিনেমার বিজ্ঞাপন! চিত্রালী, পূর্বাণী আরো কী সব পত্রিকা!

শৃণু- এ নামটাও সে বদলে ‘সনি’ করতে চেয়েছিল। শুনে একটা ঠেসে চড় মেরেছিলেন মোমেনিন।

বিদেশে গিয়ে অবশ্য নিজের নামটা সনিই বানিয়েছে সে। বাপ তার নামের আগে পরে কোনো মোহাম্মদ আহাম্মদ জুড়ে দেয়নি। এই একটা জিনিসের জন্য তার বাপের প্রতি বড় কৃতজ্ঞতা। 

শৃন্বন্তু মোমেনিন শৃণু ওরফে সনি অনেক দেরিতে হলেও বাপের একটা ভরসা হয়েছে- এলাকার লোকে বুঝতে পারে। শৃণু মায়ের কাছে পেয়েছিল তেজ। বাপকে মায়ের সামনে ভেজা বেড়াল না হলেও কোনো দিন উচ্চবাচ্য করতে দেখেনি। গালাগালি, গায়ে হাত তোলার তো প্রশ্নই ওঠে না। মা ছিল তার সব কাজের আসল ভরসা ও প্রশ্রয় দেওয়ার মানুষ। 

মায়ের জন্যই নিজের একটা খেয়াল খুশির জগৎ তৈরি করতে পেরেছিল। হলে নতুন বাংলা সিনেমা দেখা আর রহস্য রোমাঞ্চের বইপত্র পড়া- স্কুলের পড়াটা কোনোমতে চালিয়ে চালিয়ে অদ্ভুতভাবে সবাইকে অবাক করে ফার্স্ট ডিভিশন পেল, ইন্টারেও তো আরো ভালো হলো ফল।- এটা একটা রহস্যময় বিষয় হয়ে আছে তার নিজের কাছে, তার বাপের কাছেও। তিনি ছেলেকে ডেকে বলেছিলেন, তুই নকলটকল করেছিস? না কী করে এটা করছিস?

-আমি তোমার ছেলে। কিছু বুদ্ধিশুদ্ধি তো আছে আমার নাকি?

আমীরুল মোমেনিনের কাছে আরো অবাক করা বিষয় ছিল এই ‘গোল্লায় যাওয়া ছেলে’ মানে যে-ছেলের এমন সিনেমার নেশা, সস্তা বইপত্রের নেশার ভেতরে সেই ছেলে দিব্যি চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে দর্শনে ভর্তি হয়ে যায়। এরপর শুরু হয় তার রাজনীতি। মোমিনিন অবাক হন- কোন ফাঁকে এই ছেলের রক্তে ঢুকে পড়েছিল কমিউনিজমের ভূত নাকি না বুঝে না শুনে শুরু করেছিল সেসব? বার বার শিবিরেরা খেদিয়েছে তাকে। একসময় লেখাপড়াই বন্ধ হয় হয়। এর ভেতরে এলাকার কয়েকটা গণ্ডগোলে জড়িয়ে পড়ে। সেই সময়ের পাড়া মহল্লার মারামারি আর কী! 

লিটু সওদাগরের মহাসুন্দরী মেয়ে আসমাতুল হুসনাকে নিয়ে এলাকায় বিশ্রী একটা ব্যাপার শুরু হয়েছিল। দেয়ালগুলো ভরিয়ে দেওয়া হয়েছিল রানা আর হুসনার নাম যোগচিহ্ন দিয়ে লিখে। রটে যায় যে, এসব কাজ রানাই করিয়েছিল। ঠিক তখনই হুসনার প্রেমে আরেক দিওয়ানা আরিফও একই কাজ করে: দেয়ালে দেয়ালে আরিফ যোগ হুসনা লিখে ভরিয়ে দেয়। এর ভেতরে ঢুকে পড়ে শৃণু। লম্বা চাওড়া বেপরোয়া মেজাজের শৃণু রানা আর আরিফ দুটোকে প্রকাশ্যে পিটিয়ে এলাকায় মস্তান খ্যাতি লাভ করে। চ্যালা জুটে যায় এক ডজন। যে রাজনীতি সে বিশ্ববিদ্যালয়ে করে উঠতে পারেনি, সেটা একটা ভিন্ন খাতে নিয়ে যায় শৃণু। লিটু সওদাগরের মন জয় করতে না; কিংবা হুসনার মন জয় করতে না-নিজে থেকেই সে ছাত্রদলে যোগ দেয়। কাগজে কলমে না হলেও সেই সময়ে চট্টগ্রাম শহরে ছাত্রদলের নানান ছোট বড় অনুষ্ঠানে শৃণু কমবেশি খাটাখাটনি করতে থাকে। 

বাপের আওতার পুরো বাইরে চলে গিয়ে বার বার ফিরে এসেছিল শৃণু। বিশ্ববিদ্যালয়ে অনার্স শেষ করতে পারলেও এম.এ পাস করাটা হয়নি। এলাকা শৃণু আর কায়ানাথের দুটো গ্রুপ তৈরি হয়ে গিয়েছিল। সেও এক বাজে পরিস্থিতি। এর ভেতরে আসমাতুল হুসনা আর সে পালিয়ে গিয়ে বিয়ে করে। বেশ অনেক দিন পালিয়ে পালিয়ে থাকার পর আরেক অলৌকিক উপায়ে আমেরিকা যাওয়ার ব্যবস্থা করে ফেলে। কেউ কেউ বলে- আগামী দিনে শৃণুর ক্ষমতা প্রতিপত্তি বাড়ার সম্ভাবনা দেখেই পার্টির ওপরের পর্যায়ের লোকেরাই তাকে কায়দা করে বিদেশ পাঠিয়ে দিয়েছে। আগেই বলেছি: শৃণুর ভালোমন্দ সমস্ত কাজের পেছনে ছিল তার মা হুরেজাহান বেগম। সেই মা পুরনো কাজপত্র ঘাঁটতে গিয়ে আমীরুল মোমেনিনের একটা ডায়েরি পান। তাতে শৃণুর জন্মদিনের তারিখ দিয়ে অনেক কিছু লেখা আছে, নিজের এই পুত্রসন্তান জন্মানোর মাধ্যমে প্রথম তিনি টের পেলেন যে তিনি কে, কতটা অর্থনৈতিক সামর্থ্য তার আছে বা নেই, আরো অনেক কিছু। শেষে লেখা আছে-

‘শৃন্বন্তু বিশ্বে অমৃতস্য পুত্রা

আ যে ধামানি দিব্যানি তস্থূ’

-শ্বেতাশ্বতর উপনিষৎ, ২ . ৫

বেদাহমেতং পুরুষং মহান্তম্

আদিত্যবর্ণং তমসঃ পরস্তাৎ।

তমেব বিদিত্বাতিমৃত্যুমেতি

নান্যঃ পনথা বিদ্যতে অয়নায়

- শ্বেতাশ্বতর উপনিষৎ, ৩ . ৮

শোনো বিশ্বজন,

শোনো অমৃতের পুত্র যত দেবগণ

দিব্যধামবাসী, আমি জেনেছি তাঁহারে

মহান্ত পুরুষ যিনি আঁধারের পারে

জ্যোতির্ময়। তাঁরে জেনে তাঁর পানে চাহি

মৃত্যুরে লঙ্ঘিতে পারো, অন্য পথ নাহি।

আমি আমার এই পুত্রের ডাক নাম শৃণু ও ভালো নাম শৃন্বন্তু মোমেনিন রাখব।

পড়ে তিনি মাথামুণ্ডু কিছু না বুঝলেও অদ্ভুত একটা অনুভূতি হয়। তিনি সেদিন শৃণুকে সেটা তুলে দেন। শৃণু সেই ডায়েরির পাতাটা সেদিন কতবার পড়েছিল জানে না। প্রতিবারই তার চোখে ভিজে উঠেছিল। আর বুঝেছিল, সে আসলে কিছুই করতে পারেনি। আমেরিকা যাওয়া তার ঠিক হয়েছে কিনা- এটাও বার বার তাকে খোঁচাতে থাকে।

সাম্প্রতিক দেশকাল ইউটিউব চ্যানেল সাবস্ক্রাইব করুন

মন্তব্য করুন

Epaper

সাপ্তাহিক সাম্প্রতিক দেশকাল ই-পেপার পড়তে ক্লিক করুন

Logo

ঠিকানা: ১০/২২ ইকবাল রোড, ব্লক এ, মোহাম্মদপুর, ঢাকা-১২০৭

© 2024 Shampratik Deshkal All Rights Reserved. Design & Developed By Root Soft Bangladesh

// //